মায়েরা ডাকে (পর্ব তিন)
জেনে কি বা প্রয়োজন
অনেক দূরে বন
রাঙা হ'ল কুসুমে, না,
বহ্নিতাপে ?
ক্লাস টেনে আমি সংস্কৃত ঐচ্ছিক নিলাম। আসলে এমনিতেই আমাদের ইস্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে সংস্কৃত পড়ানো হত। শ্লোকের ছন্দ খুব ভালো লেগে গেল। মা ইস্কুলে বাংলা পড়াত। সংস্কৃতেও দখল ছিল। মায়ের কাছে সংস্কৃত পড়তাম। আন্তঃশ্রেণী প্রতিযোগিতা এসে গেল। দীপ্তিদি আমাদের একটা সংস্কৃত রামায়ণের অধ্যায়ের অংশ আবৃত্তির জন্য দিলেন। রাবণকে হারিয়ে দিয়েছেন রামচন্দ্র। সীতাকে অশোকবন থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু রাম সীতার সতীত্বের পরীক্ষা নেবেন। অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। কুন্ডে আগুনের লেলিহান শিখার সামনে সীতা একের পর এক প্রশ্নে ফালাফালা করে দিচ্ছেন পিতৃতন্ত্রকে। মা আমাকে স্বরের ওঠানামা করে বলতে শিখিয়ে দিয়েছিল। ঐ অংশটা আবৃত্তি অভ্যাস করতে করতে শিরায় আগুন ধরে যেত আমার। মাধ্যমিকের আগে একদিন পড়তে ভালো লাগছিল না। গল্পের বইগুলো আলমারি থেকে নামিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। মায়ের নবম শ্রেণীর প্রাইজের বইটা বেরিয়ে পড়ে। সালের দিকে নজর পড়ল, ১৯৬৩ সাল।
- মা - আ! তুমি ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছিলে?
- না। আমাদের মাধ্যমিক নয় হায়ার সেকেন্ডারি। একেবারে ইস্কুলেই ইলেভেন অবধি পড়ে, তারপর কলেজ।
- ও তার মানে ১৯৬৫ সাল।
- না রে আমি পাশ করেছি ১৯৬৭ সালে। তুই ৮৭ তে পরীক্ষা দিবি। আমি ঠিক কুড়ি বছর আগে পরীক্ষা দিয়েছি।
- মাথাটা গেছে তোমার মা। নবম শ্রেণীতে এই তো লেবেলে লেখা আছে ১৯৬৩।
মায়ের হাসিটা খুব করুণ দেখায়।
- দুবছর পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার।
- এ্যাঁ, ওহ্ তোমরা যখন গরীব হয়ে গিয়েছিলে, তখন? পরে বলব করে করে তো ক্লাস টেনে উঠে গেলাম। কি হয়েছিল খুলে বলবে এবার? একটু শুনি।
- শুনবো বললেই তো শোনা যায়না মা। তার জন্য মন প্রস্তুত করতে হয়।
- আমি বড় হয়ে গেছি মা। কি বুকে চেপে রেখেছ, নিঃসঙ্কোচে বলো। আমি শুনতে প্রস্তুত।
- তোর দিদা হল দাদুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী ভারতী তোর বড়মামার জন্মের একবছরের মাথায় মারা যায়। ছোট বাচ্ছা দেখবে কে? দাঁতিদা তখন আমার মায়ের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বাবার আবার বিয়ে দেয়। তার পরে মা বাবার একে একে এগারোটি সন্তান হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সন্তান শিশু বয়সে মারা যায়। ছোড়দা, আমি আর তোর দুই মাসি - এই চারজনই বেঁচে রইলাম। আর বড়দা ছিল, আমাদের সৎ দাদা। মা শোকে তাপে পাথর হয়ে গিয়েছিল। গান, হাতের কাজ, পড়াশোনা এগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিল। সংসারে থেকেও অন্যরকম মানুষ ছিল। আমরা বড় হচ্ছিলাম। বড়দার বিয়ে হল। তারপর বাবার যে কি হল। কান পাতলা লোক ছিল। কেউ কানে ফুসমন্তর দিয়েছিল হয়তো। বাবার হঠাৎ ধারণা হল, সৎ ছেলে বলে মা বড়দার দেখাশোনা করছেনা। কিন্তু মা অমন মানুষ ছিলনা। চিরকাল মুখ বুজে বাবার সব তান্ডব সয়ে এসেছে। এবারে মা প্রতিবাদ করল। কিন্তু ফল হল সাংঘাতিক। বাবা মায়ের হাত থেকে ভাঁড়ারের চাবি কেড়ে নিল। চাল, ডাল সব একটা ভাঁড়ারের আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা চাবি দিল। আমরা না খেয়ে রইলাম।
- সে কী! এমন ও হয়?
- হয়। আমাদের জীবনে হয়েছিল। তোর মাসিরা তখন ছোট। খিদেতে কান্নাকাটি করত। ছোড়দা পাশ দিয়েছে। আর আমি নাইনে পড়ি। রোজ অফিস যাবার আগে, আমরা চার ভাইবোন আর মা বাদে, যতজন ছিল, তাদের মতো চাল বার করে দিয়ে, চাবি নিয়ে বাবা অফিস চলে যেত। কয়েকদিন পরিচারিকারা বাড়ি থেকে কিছু খাবার এনে খাইয়েছিল।
- দাদুভাই কী চাইছিল? অপবাদ স্বীকার করে নিয়ে আত্মসমর্পণ?
- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাই। ভুল স্বীকার করলে নিজে হেরে যাবে। বাবা হার স্বীকার করতে জানতোনা।
- তারপর? পাশে তো সেনবাড়ি ছিল, তাঁরা কিছু বলেননি?
- সেনবাড়ি জানতে পারেনি। মায়ের মনে অভিমানের পাহাড় জমেছিল। তাই মনে হয়, কিছু বলেনি। তবে আমার এখন মনে হয় বললে ভালো হত। ওবাড়িতে গুরুজনেরা ছিলেন।বাবাকে শাসন করতে পারতেন। তবে ঐ সময়ে সেনবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা একটু টাল খেয়ে গিয়েছিল।
- কেন?
- আমরা তো দাঁতিদার বাড়ি ভাড়া থাকতাম, বাবা অত টাকা ওড়াতো, কিন্তু বাড়ি ভাড়া দিতনা। শেষে যখন অনেক টাকা বাকি পড়ল, তখন মায়ের হাতের ভারি ভারি চুড়ি গুলো বেচে বাড়িভাড়া দিয়ে দিল। মা তাতে খুবই দুঃখ পেয়েছিল। গয়না যে শুধু সম্পদ তা তো নয়। অনেক স্মৃতি থাকে। হয়তো মায়ের মায়ের, বা দিদার, ঠাকুমার বা অন্য কারোর স্মৃতি ছিল। আর কি একটা ছুতোয় বাবা দাঁতিদার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে দিল। ও বাড়ি ডাকসাইটে জজ, ব্যারিস্টার, অ্যাটর্নিদের বাড়ি। সবসময়ে আমাদের উপকার করেছে।আত্মীয়দের মধ্যে ছুটকো কারণে এই মামলা করাতে সেনবাড়ির লোকেরা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল। আর অন্দরে মেয়েতে মেয়েতে তো সম্পর্ক থাকে। বাবার এই মামলা করার জন্য মা সেনবাড়িতে মরমে মরে গিয়েছিল।
- দাদুভাই কি পাগল ছিল? এমন কেউ করে? ছি ছি।
- হ্যাঁ তা ছিটগ্রস্ত তো ছিল, একথা হলপ করে বলা যায়।
- তারপর?
- তারপর মা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আসলে মা তখন সহ্যের শেষ সীমায় চলে গিয়েছিল।
- কি সে সিদ্ধান্ত?
- আমাদের বাড়ির এক রাঁধুনির কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে, মা আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে, বাগবাজার থেকে অনেক দূরে অশোক নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে চলে যায়।
- কিন্তু সংসার চলল কিকরে? আর দাদুভাই খোঁজ করেনি?
- যেদিন আমরা বাড়ি থেকে চলে যাই, সেদিন অফিস থেকে ফিরে, নাকি কাউকে দেখতে না পেয়ে আমাদের নাম ধরে অনেক ডাকাডাকি করেছিল। পরে শুনেছি।
- আচ্ছা, সংসার খরচটা?
- আমার মেজপিসির বাড়ির ছেলে হলেন চিত্র পরিচালক সলিল দত্ত। তাঁকে ধরে ছোড়দা টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় সহকারী পরিচালকের কাজ জুটিয়ে নেয়। কোনো মাস মাইনে ছিলনা। যেদিন কাজ, সেদিন পয়সা। কতদিন হয়েছে, সারাদিন হাঁড়ি চড়েনি। ছোড়দা রাতে চাল কিনে এনেছে, তখন সবাই খেয়েছি। এইসময়েই আমাদের তিন বোনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
- আবার শুরু হল কি করে?
- ইস্কুলে শ্রদ্ধাপ্রাণাজী খোঁজ করছিলেন, আমরা তিনবোন গেলাম কোথায়। বছর দুয়েক বাদে খোঁজ পেয়ে তিনি বাড়িতে লোক পাঠান। ট্রেনে করে অনেক দূরের পথ। কিন্তু তিনি বাধ্য করেন আবার পড়াশোনা শুরু করতে। ভোরে বেরোতে হত। ইস্কুলে হোস্টেলে ভাত খেতাম। লক্ষ্মীদি মানে শ্রদ্ধাপ্রাণাজী সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রোজ রোজ খেতে লজ্জা করত। মাঝে মাঝে বলে দিতাম খেয়ে এসেছি।সেদিন সারাটা দিন উপোস।
- বুঝলাম, এইজন্য তোমাদের সব বোনেদের, মামার গ্যাস্ট্রিক আলসার ধরেছে। তারপর?
- তারপর আর কি, ইস্কুলের দিদিদের একটা আশা ছিল যে, আমি স্কুলের শেষ পরীক্ষাতেও ফার্স্ট হব। কিন্তু হতে পারলাম না। যা হোক একটা ফল হল।
জানিস পাশ করার পর বাবার অফিসে ফোন করেছিলাম স্টেশন থেকে। বাবা একটা কথা বলল, ফার্স্ট হয়েছ? আমি যেই বললাম না, অমনি ফোন কেটে দিল। হ্যাঁ রে, ফার্স্ট হতে গেলে বাড়িতেও একটা পরিবেশ দিতে হয়, বাবা কি জানতোনা?
মায়ের গলা বুজে আসে, মায়ের মাথায় হাত বোলাই। বলি,
- যা গেছে তা গেছে মা, ক্ষমা করে দাও।
মা চোখ মোছে। বলে
- ক্ষমা করে দিয়েছি রে মা। বাবা স্যাক্সবি থেকে অবসর নেবার পর, কপর্দক শূন্য হয়ে তো আমাদের কাছেই চলে এসেছিল। সঞ্চয় তো করেনি কোনদিন। বলতো, টাকা যে কোনদিন না থাকতে পারে, এমন কথা কখনো মাথায় আসেনি। বড়দা তখন ফায়ার ব্রিগেডের চাকরি নিয়ে উত্তর বঙ্গে। দেখার ও কেউ ছিলনা। শেষ বয়সে রাতে গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, ছোড়দা কখন ফিরবে। কিন্তু ছেলের মন তখন বাবার থেকে একসমুদ্র দূরে।
আমার মাধ্যমিকের প্রস্তুতি চলে জোর কদমে। পড়তে পড়তে একটু তন্দ্রা মতো চলে এসেছিল একদিন। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। অগ্নি কুন্ডে ধু ধু আগুন জ্বলছে। শিখা উঠেছে লকলকিয়ে। একপাশে রামচন্দ্র নয়, আমার দাদু বিকাশচন্দ্র, আর অন্যপাশে মুখোমুখি সীতা নয় লাবণ্য। বিকাশচন্দ্রের গমগমে গলা শুনি,
- এই শেষ সুযোগ। দোষ স্বীকার করো, সৎ ছেলেকে দেখোনি। স্বীকার করে করুণা ভিক্ষা করো, তবেই প্রাণভিক্ষা দিতে পারি আমি।
লাবণ্যর মনের কথা শুনতে পাই আমি। দুধের শিশুকে দেখাশোনার জন্য ঘরে এনেছিলে, বুকে করে মানুষ করেছি। কিন্তু আশ্চর্য, মুখে লাবণ্য একথা বলেনা। নতমুখ তুলে বিকাশের চোখে চোখ রাখে। এতকাল গোপনে ইংরেজি চর্চা করা লাবণ্য আজ প্রকাশ্যে শুধু বলে
- আই কুইট। গুড বাই।
তারপর দুজোড়া লবকুশকে নিয়ে সীতা নয় লাবণ্য এগিয়ে যায় অশোক বন নয় তপোবন মানে অশোক নগরের দিকে।
পায়ে পায়ে চলতে চলতে মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল আমার - ১৯৮৭ সাল। ফলও বেরোল। মাধ্যমিকে যে ইস্কুল থেকে ফার্স্ট হয়, সে একটা চ্যালেঞ্জ কাপ পায়। কুড়ি বছর আগে ওটা মঞ্চে উঠে মায়ের নেওয়ার কথা ছিল। বিধির বিধানে হয়নি। কুড়ি বছর পরে কাপটা আমি পেলাম।নিবেদিতা ইস্কুলের যেসব দিদিরা মাকে আর আমাকে, দুজনকেই পড়িয়েছেন, তাঁরা আমাকে উপলক্ষ করে ওটা মাকেই দিলেন। অন্তত তাঁদের শরীরী ভাষায় সে কথাটা প্রকাশ পাচ্ছিল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।