'বিশে ডাকাত' কি সত্যিই ডাকাত ছিল!
বিশে ডাকাত ধরা পড়লে তাঁর ফাঁসি হয়, গাছের ডালে ঝোলানো হয় তাঁর মৃতদেহ। ডাকাতের এত বড় শাস্তি ?
বাংলায় চোর ডাকাতের উত্পাত তো বরাবর। প্রাচীন কাল থেকেই এদের আবার নানা রকম ভাগ, সেই অনুযায়ী সমাজে ও পুলিশের কাছে মান ও শাস্তির হের ফেরও। ছিঁচকে চোর, সিঁধেল চোর, ডাকাত, দস্যু আরও কত কি নাম। ছিঁচকে চোর, সকলের চোখের আড়ালে জিনিস তুলে নিত, এদের কদুচোর বলে সবাই হেও করত। সিঁধেল চোর, ঘরের পিছন থেকে দেয়াল কেটে আলকাতরা বা তৈলাক্ত কিছু গায়ে মেখে ঘরে প্রবেশ করত। কাজ সেরে ঐ কাটা জায়গা দিয়ে বেড়িয়ে আসত। ডাকাতরা জঙ্গলে থাকত। কালীপুজো করে উল্লাস করতে করতে গ্রামে গিয়ে ডাকাতি করত। জলদস্যু জলের নৌকা ভর্তি যাত্রী বা সম্পদ লুট করত। আর কিছুদস্যু নির্জন জায়গায় রাস্তার পাশে ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে থাকত। দূর দূরান্ত থেকে আসা পথিকদের মেরে সর্বস্ব লুট করে নিত। এরা ছিল ঠ্যাঙারে দল। বেশির ভাগ সময় নিরীহ মানুষগুলোকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে হত্যা করে তার অর্থ কড়ি নিয়ে নিত। এরা ধরা পড়লে কারো তিন মাস কারো তিন বছর, বড় জোর ছয়-সাত বছরের জেল হত। তাই বলে ফাঁসি! আসলে এই সব ডাকাতদের মত ছিল না বিশে ডাকাত। বিশেডাকাত নীলকরসাহেব ও ব্রিটিশদের ঘোষিত ডাকাত। হ্যাঁ, তিনি ডাকাতি করতেন মূলত লোভ, অত্যাচার আর অন্যায়ের যতুগৃহ নীলকরসাহেবদের কুঠিতে আর প্রজানির্যাতনে নীলকরদের প্রতিযোগী হয়ে ওঠা নির্দয় জমিদারদের বাড়ি বা প্রাসাদে। প্রকৃ্তপক্ষে তিনি ছিলেন নদিয়ার তথা বাংলার নীলবিদ্রোহের পথপ্রদর্শক ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ, ঊনিবিংশ শতাব্দীর শুরু, ইউরোপে তখন শিল্প বিপ্লবের তোড়ে বস্ত্রশিল্পএর প্রসারও ঘটেছে। বস্ত্র রঙ করার জন্য নীল খুব প্রয়োজনীয় বস্তু তখন তাদের কাছে। পৃথিবীতে মোট যে ৩০০ প্রজাতির নীলগাছ পাওয়া যায় তার ৫০ টা প্রজা্তির নীল (ইন্ডিগো ফেরা) ভারতে চাষকরা সম্ভব ছিল। আর বিশেষ করে বিহার ও বাংলাদেশে উৎকৃষ্ট প্রজাতির ৪০ রকমের নীল চাষ করার উপযোগী পরিবেশ ছিল। নীলের এই বিশেষ প্রজাতির নাম ‘ইন্ডিগোফেরা টিঙ্টোরিয়া’। এর থেকে শুধু নীল রঙ নয়, এর তেল থেকে ভালো ওষুধও প্রস্তুত করাও সম্ভব। এই উৎকৃষ্ট মানের নীলচাষের জন্য সবচেয়ে ঊর্বর মাটি ছিল নদীয়া ও যশোর জেলার মাটি। তাই ইংরেজরা নীলের ব্যবসার জন্য এই দুই জেলাতে এসে ভিড় করল। ১৭৭৭ এ প্রথম নীল প্রস্তুত করে চন্দননগরের ফরাসির দেখানো ভিতের ওপর অট্টালিকা তৈরি করল ইংরেজরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় ব্যবসা শুরু করল নীল স্বপ্ন নিয়ে । সাহেবরা দুই ভাবে নীলচাষ করত। নিজেরা জমি কিনে তাতে চাষিদের দিয়ে নীলের চাষ করত। আর চাষির জমিতে নীল চাষ করা হত সাহেবের ইচ্ছায় এবং পরে নীলকুঠির সাহেব তা কিনে নিত। এর জন্য কিছু শর্ত দিত চাষিকে আর দিত দাদনে টাকা যা শোধ করার জন্যও বিশেষ শর্ত ছিল। নদিয়ার সহজ সরল চাষিদের বোকা বানিয়ে মুনাফার বাক্স ভরেছিল তারা। নীলকরের জমিতে নীলচাষ করলে তাতে খরচ বেশি হত কিন্তু চাষিকে দিয়ে তার জমিতে নীলচাষ করালে চাষের সব খরচ চাষিদের দিতে হত। চাষের শেষে দামে ও ওজনে ঠকাতে পারত। এতে সাহেবদের লাভ বেশি হত বলে তারা চাষিদের দিয়ে জোর করে চাষির জমিতেই নীলের চাষ করাত। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদে দাদনে নেওয়া টাকা চাষিরা শোধ করতে পারত না কোনোদিন, প্রতারণা করা হত তাদের সঙ্গে। নীলচাষের আগেই চুক্তি পত্রে সই করিয়ে সহজ, সরল, নিরক্ষর চাষির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত। অবিভক্ত বিরাট নদীয়া জেলার অর্ধেকের বেশি জমিতে শুধু নীল চাষ হত এই ভাবেই। আউশ, আমন, বোরো, কেরশাল, ফকিরমনি, নুনঝুরি, পাথরকুচি ধানের পরিবর্তে শুধু নীল চাষ হলে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। নীল চাষ না করে তারা ধান, গম চাষ করতে চাইলে, তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত সাহেবরা, এদের ইন্ধন যোগাত স্থানীয় তোষামোদকারী ও নীলকুঠি র দেশীয় কর্মচারীরা। নীলকর সাহেবদেরও লাঠিয়াল বাহিনী ছিল, মহিলা ও শিশুদের ওপরেও নির্মম অত্যাচার শুরু করলে নীলচাষিদের বিদ্রোহ ভয়ংকর আকার নেয়। নীলকর সাহেবদের লাঠিয়াল ও সরকারি পুলিশের সঙ্গে বিদ্রোহী চাষিদের সরাসরি সশস্ত্র লড়াই হয়। মোট তিন দফায় নীল বিদ্রোহ হয় এই নদীয়াতে। প্রথম দফাতে গণ- দরখাস্ত করে, আবেদন -নিবেদন, সভা –সমিতি করে সংগঠিত হয়। দ্বিতীয় দফায় নীলচাষের বিরুদ্ধে চাষিরা ধর্মঘট করে। কিন্তু পরের দিকে নীলকর সাহেবদের লোভ বাড়তে থাকে সীমাহীন মাত্রায়। নীলকর সাহেবদের লাঠিয়ালদের সঙ্গে চাষিদের খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে বারবার। এই বিদ্রোহকেই নীলকর সাহেবরা ‘ডাকাতি’ আর বিদ্রোহী চাষিদের ‘দস্যু’ বা ‘ডাকাত’ বলে প্রচার করত। বিশ্বনাথ সর্দার এমনি একজন ‘ডাকাত’।
বিদ্রোহী চাষি 'বিশে ডাকাত' ওরফে বিশ্বনাথ সর্দারকে রীতিমত ভয় পেতে শুরু করে নীল সাহেবরা। তিনি নিজে একটি দল তৈরি করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই । শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ার জঙ্গলে তাঁর আস্তানা ছিল। সেখানে গোপনে চাষিদের তীর ধনুক ও লাঠি চালানো শেখাতেন। তীর ধনুক, ইট পাথর ও মাটির ঢেলা, বেল, কাঁসা-পিতলের থালা, মাটির ও পাথরের পাত্র হাতিয়ার ছিল তাদের । বিশ্বনাথ রনপা তৈ্রি করেছিলেন দ্রুত এগোনোর জন্য। কখনো রনপা কখনো রাতে নৌকা বেয়ে তাঁর নেতৃত্বে তাঁতি ও চাষিদের নিয়ে গড়া দল একে একে নিশ্চিদিপুর, শান্তিপুরের, চিত্রশালীর নীলকুঠী লুঠ করে। লুঠ করে বেশ কয়েকটি জমিদার বাড়ি । নিশ্চিদিপুর কুঠি আক্রমণ করলে নীলকর সাহেব ভয়ে সপরিবার নদী পার হয়ে ওপারে রুদ্রনগর গিয়ে সারারাত বড় গাছের ডালে লুকিয়ে ছিল। বিশ্বনাথ কুঠি লুঠ করে টাকা পয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী গ্রামের গরিবদের দান করে দিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যেই ছিল ' দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন'।
বিশ্বনাথ সর্দার নদীয়ার ইন্ডিগো কনসার্নের নীলকর স্যামুয়েল ফেডি নামে এক অত্যাচারী সাহেবের কুঠি লুঠকরে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়টএর বাংলোর পাশথেকে ফেডিকে তুলে নিয়ে আসেন। জঙ্গলে এসে ফেডি প্রাণভিক্ষা চাইলে তাঁর দল রাজি না হলেও বিশ্বনাথ সর্দার তাকে প্রাণ ভিক্ষাদেন। শর্ত ছিল কাউকে সেদিনের ঘটনা প্রকাশ না করার। ফেডি ছাড়া পেয়ে শর্ত ভেঙ্গে প্রথমেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সব জানিয়ে দিলে ব্রিটিশ সরকার থেকে ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ নামে সেনাপতির নতৃত্বে একটি বিশাল সৈন্য বাহিনী ও এলিয়টের সৈন্যবাহিনী কে পাঠায় বিশ্বনাথকে জব্দ করার জন্য । বিশ্বনাথের দল তাদের পাল্টা আক্রমণ করলে ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ বাহিনীও লুকিয়ে পড়ে বাঁশবেড়িয়া কুঠিতে। বাঁশ বেড়িয়া ছিল নদীয়ার বারোটি কুঠির প্রধান কার্যালয়। বিশ্বনাথ বাঁশবেড়িয়া ও খালবোয়ালিয়া কুঠি আক্রমণ করে মূলত ‘ব্ল্যাক ওয়ারকে উদ্দেশ্য করে। 'ব্ল্যাক ওয়ার' এর মত হিংস্র বাহিনীও বিশ্বনাথের ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায় । বিশ্বনাথের ভয়ে ফেডি সহ আরও বারো জন নীল-সাহেব তাদের মেমদের নিয়ে বাঁশবেড়িয়া কুঠির পিছনে কলিঙ্গ-বিলের জলে ভেসেছিল মাটির হাঁড়িতে মাথা লুকিয়ে। তাঁর প্রতাপ থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটিশরা তাঁর দলের মধ্যে লোক পাঠায়। এমন বিদ্রোহীকেও ধরা পড়তে হয় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। যদিও তিনি বার বার আস্তানা পাল্টেছেন তবুও নদীয়ার কুনিয়ার কাছে জঙ্গলে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল তাঁর দল তখন ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ সেনা বাহিনী দলকে ঘিরে ফেলে। সেই মুহূর্তে দলের পরাজয় অনিবার্য বুঝে বাকিদের বাঁচিয়ে তিনি নিজে এসে ধরা দেন। বিশ্বনাথ ধরা পড়লে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয় তাঁকে। ১৮০৮এর ২৭ শে সেপ্টেম্বর রাত্রে (১২১৫বঙ্গাব্দে) গঙ্গার পাশে তাঁর ফাঁসি হয়। চাষীরা হত্যার প্রতিবাদ করে। ব্রিটিশ সরকার আর নীলকরসাহেবরা মিলে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা করে। মৃতদেহ লোহার খাঁচায় করে এনে আসাননগরের অশ্বত্থ গাছের ডালে ঝুলিয়ে পশু পাখি দিয়ে খাদ্য করে রাখে । উদেশ্য ছিল আর কেউ যেন এমন বিদ্রোহ করার সাহস না পায়। তাঁর মায়ের আকুতিভরা নিবেদনেও কঙ্কালটা সৎকার করতে দেয়না তারা।
বিশ্বনাথ সম্পর্কে আনন্দ বাজার পত্রিকা শ্রী মোহিত রায় লিখেছিলেন,
“বিশ্বনাথের দানের খ্যাতি লোক বিশ্রুত ছিল। কৃপণ ধনীর যম ছিল বিশ্বনাথ। দরিদ্র পোষণই ছিল বিশ্বনাথের জীবনের ব্রত। বিশ্বনাথের প্রদত্ত অর্থে বহু দরিদ্র পরিবার প্রতিপালিত হয়েছে, বহু কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতা উদ্ধার পেয়েছে।“ (১৩/১০/ '৬১)
ঐতিহাসিক শ্রী সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, “যে দুই একজন মানুষ এই ভয়ংকর দুর্যোগের সময় সাধারন মানুষকে রক্ষা করিবার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তাহারাও সরকারি নথিপত্রে এবং বিদেশীদেরই রচিত ইতিহাসে ‘দস্যু-ডাকাত’ নামে অভিহিত হইয়াছেন। এসকল তথাকথিত ডাকাতদের মধ্যে বিশ্বনাথ বা বিশে ডাকাত খ্যাতি- অখ্যাতির সর্বাগ্রগণ্য।“
ক্ষিতীশ-বংশাবলিচরিত(২৮পাতা) অনুসারে তিনি- “বিশ্বনাথ যেমন ধনীদের ধন অপহরণ করিয়া লইত তেমনই দুঃখী দরিদ্র দিগকে যথেষ্ট অর্থ দানও করিত। এই কারণে সে বিশ্বনাথবাবু নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিল।“
নীলবিদ্রোহে যাদের রক্তে লাল হয়েছে বাংলার মাটি তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসে বিশ্বনাথ সর্দারের নাম। তিনিই ছিলেন নীল বিদ্রোহের প্রথম শহিদ। দু শো বছর আগে এ জেলার মানুষ প্রার্থনা করেছিল এমন ডাকাত যেন তাদের ঘরে ঘরে জন্মায়। আজও আসান নগরের সেই অভিশপ্ত মাঠকে (যেখানে তাঁর মৃতদেহ গাছে ঝোলানো হয়েছিল) 'ফাঁসি তলার মাঠ' বলা হয়। এত করেও ব্রিটিশরা নদিয়ার চাষিদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিশ্বনাথ সর্দারের যোগ্য উত্তরসূরীর মত তারা প্রাণবাজি রেখে বিদ্রোহ চালিয়ে গেছে। ক্রমে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে যশোর, পাবনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, খুলনা, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম সহ সারা বাংলার চাষিদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৯ এ সারা বাংলা জুড়ে নীল বিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে তার ক্রমপরিনতিতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নীলকুঠিয়ালদের নীলস্বপ্ন। বিদেশিদের ইতিহাসে তিনি ‘বিশে ডাকাত’ হলেও আমাদের শ্রদ্ধায় মুছে যাক সে ইতিহাস, অক্ষয় হোক শহিদ বিশ্বনাথ সর্দারের নাম স্বাধীনদেশের ইতিহাসের পাতায়।
তথ্যসূত্র
1) স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া- নদীয়া নাগরিক পরিষদ।
2) ক্ষিতীশ- বংশাবলি -চরিত।
3) বিশ্বনাথ সর্দার- ইউকিপিডিয়া।
ভাল লাগল
শাবাশ বিশ্বনাথ!
এপারে আরেক ঐতিহাসিক বৃটিশ বিরোধী কৃষক বিদ্রোহের নেতা, রংপুর অঞ্চলের নুরুল দীন। সৈয়দ শামসুল হক তার "নুরুল দীনের সারাজীবন" নাটকে এই মহানায়ককে পরিচিত করিয়েছেন, অমর করেছেন।
আরো লিখুন
ভালো লাগলো