এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বাজাড়ু

    gargi bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০২ জুলাই ২০২১ | ৩৪৪২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৮ (৪ জন)
  • বাজার করাটা নিঃসন্দেহে একটা শিল্প। তাতে বিশেষ কারিগরি দক্ষতা লাগে, ইচ্ছা লাগে, ধৈর্য লাগে, বুদ্ধি, দুষ্টবুদ্ধি লাগে, অতি দ্রুত অঙ্ক-কষার ক্ষমতা লাগে। বাপরে, এত কিছু যদি আমার এই এক দেহতেই থাকে, তাহলে বাজার কেন করব বাপু, অ্যাষ্ট্রনট হব, চাঁদে যাব, মঙ্গলে যাব। কিন্তু তা বললে চলবে কেন? বাজার অতি বিষম বস্তু, না করলে পেটে কিছু পড়বে না, তবে কিনা যাঁরা গৃহিণী নিয়ে ঘর করেন তাঁদের অবশ্য পেটে না পড়লেও পিঠে ঠিক পড়বে। 


    আমি নিজেই নিজের গৃহিণী বলে পেটে ও পিঠে কোথাওই কিছু পড়ে না। তবে ঘরে মাত্তর একখানা আলু আর অর্ধেক অলাবু পড়ে থাকলে বাজারে না গিয়ে উপায় আছে? মাঝে মাঝে আবার পঞ্জিকাতে ‘অলাবু ভক্ষণ নিষিদ্ধ’ লেখা থাকে। কিন্তু সেখানে বাজারে ‘যাত্রা নাই’ বলে কিছু লেখা থাকে না। অনেক ভেবে দেখেছি, পৃথিবীতে দুই প্রকার বাঙালী বর্তমান, যথা - বাজাড়ু ও অ-বাজাড়ু। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গপ্পে দেখবেন, প্রায়ই একজন বাজাড়ুর উল্লেখ থাকে, বাজারই যার মক্কা-মদিনা, কাশী-কেদার। এই গোত্রের মানুষরা টমেটোর পেট টিপে-টুপে পরীক্ষা করেন, পুটুস করে ঢ্যাড়স ভেঙে তার কচিত্ব দেখে নেন, পটলের খোসা দেখে দেশী না পরদেশী জেনে যান, তারপর এমন একটা দাম হাঁকেন যে, সবজিওয়ালা ঘাঁটা-চচ্চড়ি হয়ে তার থেকেও কম দাম নিয়ে বসে থাকে। এঁরা হলেন প্রকৃত বাজাড়ু, নমস্য ব্যক্তি, বাজারে এঁরা ঢুকছেন দেখলে বিক্রেতারা চোখে চোখে কথা কয় – “এই, অমুকবাবু এসেছে, সাবধান”। সকলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিল সেকথা ভাবতে থাকে, ভালো জিনিষ আপনা-আপনি চটের নীচে লুকিয়ে পড়ে। 


    তা আমি বাজারে ঢুকলেও বিক্রেতাদের চোখে চোখে কথা হয়ে যায়, আশ্চর্যের ব্যাপার দোকানিদের নিঃশব্দ শব্দাবলী আমি স্পষ্ট শুনতে পাই – “এই, মুরগী এসেছে, মুরগী এসেছে”। 


    স্বীকার করছি, আমি প্রকৃতই অ-বাজাড়ু টাইপের। বাজারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বিখ্যাত কবিতাংশ মনে আসে – “আগ কা দরিয়া হ্যায়, ঔর ডুব কে জানা হ্যায়।” 


    এই যেমন ধরুন, শীতের শেষ, মাস-তিনেকের অদর্শনের পর কচি পটল নববধূর মতো প্রেমপূর্ণ চোখে তাকাচ্ছিল। ভারিক্কি চালে দর জিজ্ঞেস করলাম - পটল কত করে গো? 


    – এজ্ঞে, খুব সস্তা, মাত্তর কুড়ি ট্যাকা। 


    সেকি? নতুন ওঠা পটলের এত কম? আহা, তা দাও দেখি, শ-পাঁচেক। ব্যাগ-পূর্ণ করে পটল এল, একশো টাকার একটা নোট দোকানিকে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, দোকানিও হাত গুটিয়ে আমার দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আমি কিরকম ঘাবড়ে গেলাম। শেষে, যা থাকে কপালে, বললাম – পাঁচশো পটল তো দশ টাকা হল, নব্বই ফেরত দাও? দোকানির হাসি কান ছুঁল – এজ্ঞে দিদি, একশো পটল কুড়ি ট্যাকা, সবে উঠেছে তো। 


    - সেকি, আগে বলোনি তো? 


    – এজ্ঞে, কিলোর হিসেব - সেও তো বলি নাই। তা আপনার পাঁচশো পটল হল গিয়ে গোটাগুটি একশো ট্যাকা। আচ্চা, ধনেপাতা বরং খানিক দিয়ে দিই। - বলে খানিক ঘাস-পাতা পুরে দিল ব্যাগে। আমার খাদ্য হিসেবেই বোধহয়। 


    আমার তখন কী দশা? কী আর বলব, পয়সা যায় যাক, মান না যায়। খুব স্মার্টলি “ওঃ আচ্ছা, তাই তো” বলে শুকনো হাসি হেসে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চিকেন কেনার কথা ছিল, ইচ্ছে হল না। সলিডারিটি বলেও তো একটা কথা আছে?


    নিজের বুদ্ধির ওপর আমার বরাবরই খুব গর্ব। মানে ছিল আর কী, ওই যতদিন বাজার করা শুরু করি নি নিজ হাতে, ততদিনই। অধ্যাপনার চাকরি করতে শহর থেকে মফস্‌সলে এলাম, তার আগে কুটোটি ভেঙ্গে দুটোটি করিনি কখনো। গৃহপালিত জীবের মতো খেয়েছ দেয়েছি, কলম চিবিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি নাম্বার জোগাড় করেছি। ভেবেছিলুম অধ্যাপনা মানে আকাশপথে চলার সামিল। তা ধপাস করে পপাত ধরণীতলে হলাম, যখন সবজিওয়ালা জিজ্ঞেস করল - ঝিঙে কত দেব? পাঁচশো? 


    আমি তেড়ে উঠে বলেছিলাম - অত কে খাবে? একশো দাও। 


    দোকানি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে একখানা সরু মতো ঝিঙে দাঁড়িপাল্লায় তুলল। আমি আঁতকে উঠে বললাম - এটুকুতে কী হবে? 


    সে বললে - একশো তো এইই হবে।


    - আচ্ছা, তবে, আড়াইশো দাও। না, না পাঁচশো দাও। আচ্ছা সাড়ে সাতশো দাও। আর তার সঙ্গে উচ্ছেও দাও। ওই সাড়ে সাতশোই দাও।


    দোকানি ততক্ষণে বুঝে গেছে আমার ফাণ্ডা। পুরোপুরি ‘পুস্তকস্থা তু যা বিদ্যা’ অর্থাৎ কিনা পুস্তকে যা বিদ্যা আছে, তার অবস্থাও যা তা। খুব তাচ্ছিল্য সহকারে বলল - ঝিঙে পাঁচশ নে যান, আর উচ্ছে আড়াইশো দিচ্ছি। এতেই হবে’খন। 


    আমি আমার মনের খাতায় নোট করলাম, ঝিঙে যতটা নিতে হয়, উচ্ছে তার অর্ধেক। 


    এরকম শিক্ষানবিশি চলল অনেকদিন। মুদি জিজ্ঞাসিল - কালো জিরে কত দেব? আর গোটা জিরে?


    আমি খুব উদাস ভঙ্গীতে (যেন এটা আর এমন কী ব্যাপার, তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কালিদাস কী লিখেছেন) বললাম, ওই দিন না, যেমন দেন। 


    মুদিও ততদিনে বিলক্ষণ চিনতে শুরু করেছে আমায়। দোকানের ভেতর চেঁচিয়ে বলল – এই, দিদিকে পঞ্চাশ কালো জিরে আর পঞ্চাশ গোটা জিরে দে তো। 


    আমার মনের নোট খাতায় আবার নতুন অঙ্ক বসল। কালো জিরে হলে পঞ্চাশ। গোটা জিরে হলেও তাই। 


    এমন করতে করতে পোক্ত হলাম। মানে, আমি মনে করলাম আমি পোক্ত হয়েছি। অন্তত আমার সেই বন্ধুর থেকে তো বটেই। কলকাতার রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের পাশে একটা লোক একঝুড়ি আলু নিয়ে বসেছিল। আমার বন্ধু চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলল - আলু দাও এক কেজি। 


    লোকটি অন্য দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গীতে বসেই রইল। বন্ধু রগচটা, তার ওপরে সারাদিনের কাজের শেষে হা-ক্লান্ত, বাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে, বয়ফ্রেণ্ডের সাথে কথা নেই সাত দিন, ইত্যাদি-প্রভৃতি। লোকটির উদাসীনতা দেখে সে চেঁচাল – বলছি, আলু দাও এক কিলো। কথা কানে যাচ্ছে না? বেচবে না তো বসেছ কেন? 


    বন্ধুর বোঝা উচিত ছিল এই রকম যাদবপুরের মোড়ে একা একটা লোক আলু বিক্রি করবে কেন? 


    চেঁচানি শুনে লোকটি আরো নিস্পৃহ গলায় বলল - ওগুলো আলু নয়। 


    - আলু নয় মানে? পষ্ট দেখছি আলু, তুমি বলছ আলু নয়? 


    দু-একজন লোক জমে গেল। - ও দিদি, কী হয়েছে? 


    হঠাৎ করে নিস্পৃহতায় আগুন লাগিয়ে আলু বা নয়-আলু বিক্রেতা তেড়ে ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল - তখন থেকে বলছি, আলু নয়, আলু নয়, তবু বলে আলু। এগুলো কিউই। ফল চেনে না, বলতে এসেছে আবার। আলুই চেনে শুধু। 


    তখন সকলের খেয়াল হল, পাশের ঝুড়িতে কয়েকটা কলা আর পেয়ারাও আছে। বন্ধুর কী হয়েছিল আমায় জিজ্ঞেস করবেন না। তবে আলু সেদিন তার বাড়িতে ঢোকে নি। কিউই ঢুকেছিল কিনা জানি না।



    শুধু মাঠে ক্ষেতে খামারে ঘুরলেই চলবে? জলের ফসল – তার বাজারও বিষম বস্তু। তার আবার আঁশ আছে, কানকো ছাড়ানো-না-ছাড়ানো আছে, চালানি আছে, লোকাল আছে, জ্যান্ত আছে, মরা আছে, ট্যাঙ্কির জলের জিয়ন কাঠি আছে, ইঞ্জেকশান আছে। সর্বোপরি মাছ কেটে তার রক্ত বিক্রি-না-হতে-পারা মাছে লাগানো আছে। এত রক্তারক্তির মাঝে আমার এক সহকর্মী একজন মৎস্যবিক্রেতার নাম্বার দিয়ে বলল - যা খাবি অর্ডার দিয়ে দিলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে। 


    তা সেরকমই চলছিল। ঘোর বর্ষা তখন, বাঙালীর ঘরে ঘরে ইলিশের বান ডেকেছে। আমার ফোনের মাছ-বিক্রেতাকে বলেছিলাম - ইলিশ এলে বলো। সে একদিন সুসংবাদ দিল, ইলিশ এল বাড়িতে। কিন্তু তারপর থেকে সে বলতেই থাকল। প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটায়। অনলাইন ক্লাশ চলছে, ভার্চুয়ালি আমি বোঝাবার চেষ্টা করছি, জগত অনিত্য। অমনি ফোন – দিদি, ভালো ইলিশ আছে, নেবেন? - কালই তো নিলুম। আজ না। 


    পরদিন আবার সাড়ে আটটা, ব্রহ্ম জগতের কর্তা – যেই বলেছি, অমনি ফোন – আজও ইলিশ ছিল দিদি, নেবেন না?


    আমি আতঙ্কিত হয়ে ক্লাশের সময় বদলালাম। এবং অবশেষে আরেকটি ইলিশ কিনলাম। দামটা শুনে ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু মাছতুতো ভাই আশ্বস্ত করল - আমায় বিশ্বাস করছেন না দিদি? এমন মাছ যে আপনি জনমেও ভুলবেন না। 


    কথাটার আক্ষরিক শক্তি আছে বুঝতে সময় লেগেছিল। এদিকে আমার আর এক সহকর্মী দুঃখ করছিল, এবছর নাকি তার পাতে ইলিশ ওঠে নি। পরোপকারী হয়ে তাকেও খবর দিলাম যে বাজারে ভালো ইলিশ উঠেছে। সে সবটা শুনে চুপ করে রইল। তারপর নিঃশব্দে ফোন কেটে দিল।


    দুপুরে ইলিশের তেল, ভাজা, বেগুন দিয়ে ঝোল, সরষে দিয়ে ঝাল সাজিয়ে খেতে বসছি, মোবাইল বাজল, সকালের সেই সহকর্মী। 


    - খেতে বসছ?


    - হ্যাঁ।


    - বাড়িতে ধূপ আছে? আর প্রদীপ, শাঁখ?


    - আছে তো? কিন্তু এখন কেন?


    - শোনো মন দিয়ে। প্রথমে ধূপ জ্বালাবে, তারপর প্রদীপ। শাঁখ বাজিয়ে প্রণাম করবে, তারপর –


    - আরে কাকে সেটা বলবে তো?


    - কাকে আবার, তোমার ইলিশকে। খোঁজ নিয়ে দেখলুম, বাজারে বিক্কিরি হচ্ছে হাজার টাকা কিলো, তুমি কিনেছ দুহাজার দিয়ে। ওটার যা দাম, তাতে ধূপ-ধূনো না দেখালে অকল্যাণ হবে গৃহস্থের। হা-হা-হা-


    ফোন কেটে গেল। 


    কী আশ্চর্য ও নিষ্ঠুর! সারাদিন অপেক্ষা করে বসেছিল, দুপুরে আমি কখন খেতে বসব? কারো উপকার করতে নেই। 


    ইলিশে আর রুচি হল না। রাগে গরগর করতে করতে বোনকে ফোন লাগালাম। সে সবটা শুনে সান্ত্বনা দিল - তোর অবস্থা তো আমার থেকে অনেক ভালো রে দি। তুই তো তবু মাছ চিনিস। আমি তো রুই ছাড়া কিছু খাই না। বাজার পারতপক্ষে যাই না। অনলাইন অর্ডার করি – রুহু এক কিলো। ওরা কেটে-কুটে দিয়ে যায়, শোভাদি রেঁধে দেয়। আরে, একদিন বাজারে গিয়েই চিত্তির। মাছওয়ালাকে বললাম, কোনটা রুই? সে দেখিয়ে বলল, এটা রুই, এটা কাতলা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কাটাপোনা কোনটা? মাছওয়ালা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল পাক্কা এক মিনিট। তার মাঝেই আমি সেখান থেকে সটকে পড়লুম। আরে, কী করে জানবো কাটাপোনা আলাদা কোন মাছ নয়? পুরো ইজ্জত কা ফালুদা হো গয়া।   


    আমি পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগলাম এবং বোনকে কথা দিলাম খুব শিগ্‌গিরি ওদের বাড়ি গিয়ে শুক্তো রেঁধে খাওয়াব। ভগ্নীপতি বাঙালী খাবার খুব পছন্দ করে। 


    আচ্ছা পাঠকগণ, আপনারা কোনদিন শুক্তো খেতে গিয়ে ডিক্সনারি দেখেছেন? সেদিন আমরা দেখেছি। 


    কলকাতা এসে দেখি আকাশের দিকে ক্রম-ধাবমান শহরে বাংলা ভাষার কদর রয়াল এস্টেটের প্রোজেক্টের নামেই শুধু জ্বলজ্বল করছে। আহা কী সব সুন্দর সুন্দর নাম – সবই আবার স্ত্রীলিঙ্গে – কুজ্ঝটিকা, আন্তরিকা, মেঘনয়না। কিন্তু অনলাইনে বাজার অর্ডার করতে হলে উচ্ছে সেখানে বিটারগোর্ড। শুক্তো রাঁধতে অগত্যা বিটারগোর্ডই অর্ডার করা হল। সে নাকি কেটে কুটে পরিস্কৃত হয়ে প্যাকেট বন্দী হয়ে সাতসকালে দরজার বাইরে অপেক্ষা করবে। কিন্তু সকালে উঠে দেখি, ভগ্নীপতি মাথায় হাত দিয়ে সোফার কোণে বসে আছে। আফসোসের সঙ্গে বলল - উচ্ছের বদলে অন্য কী একটা এসে গেছে। 


    প্যাকেটের মধ্যে পাতলা গোল গোল করে যা বন্দী রয়েছে, তা আর যাই হোক উচ্ছে নয়। চিচিঙ্গে নাকি? শোভাদি হুড়মুড় করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল - তকন থেকে বলচি, ওটা ঝিঙে। বিশ্বাস করচ নি। 


    সত্যি, শেষ পর্যন্ত ঝিঙেই বেরলো। কিন্তু উচ্ছে অর্ডার দিলে ঝিঙে এল কেন? তাহলে কি বিটারগোর্ড মানে ঝিঙে? মানে ঝিঙেও তো মাঝে মধ্যে তেতো হয়। আমার দৌড় ছোটবেলার ‘লার্নিং ইংলিশ’-এই সীমাবদ্ধ। কনভেণ্ট পড়া বোন রাগত স্বরে বলল - এই দেখো ডিক্সনারি, বিটারগোর্ড হল উচ্ছে। আর ঝিঙে হল রিচগোর্ড। চিচিঙ্গে স্নেকগোর্ড। 


    উঁকি মেরে দেখলুম প্যাকেটের ওপর লেখা রিচগোর্ড। বোঝো, শুধু গোর্ডটুকু অক্ষত আছে, বাকিটুকু বদল। বেঁচে থাক আমাদের আ মরি বাংলা ভাষা। কিন্তু যার বাড়িতে বিটারগোর্ড গেল, তাদের কী হল কে জানে? শুক্তো তো করতে পারবে না? কারণ, কাঁচকলা, থুড়ি, ‘র-ব্যানানা’ তো আমাদের বাড়িতে। 


    যাই হোক, আমরা দুপুরে শুক্তোর বদলে জমিয়ে ঝিঙে-আলু-পোস্তো খেলুম। বোন বলল, অমন করে শুধুমুদু ‘ঝিঙে-পোস্ত’ বললে চলবে কেন? বলতে হবে, ফাইনলি ডাইসড রিচগোর্ড উইথ ফ্রেশ পটাটো সিমারড ইন দ্য পেস্ট অফ পপিসিডস কুকড ইন গোল্ডেন মাস্টার্ড অয়েল।


    এরপর শুধু টেনিদার চেলাদের মতো “ইয়াক ইয়াক” বলাটা বাকি থাকে! 


    খাবার টেবিলে সেদিন প্রভূত জ্ঞান বর্ষণ করলাম এবং ব্যাখ্যা করলাম, কেন বাজার করাটা একধরণের শিল্প। অনলাইনে অর্ডার না করে নিজ চক্ষু-কর্ণ-ঘ্রাণ-জিহ্বা-ত্বক, সর্বোপরি আত্মবোধের ওপর ভরসা করাটাই একমাত্র উপায়। কেন জানি না আমার নিজের ওপর প্রবল আস্থা জন্মেছিল যে, আমিও ধীরে ধীরে একজন দক্ষ বাজাড়ু হয়ে উঠছি। খুব শিগ্‌গিরিই আমি শীর্ষেন্দুর না হোক অন্য কারো গল্পে বাজাড়ু হিসেবে ঠাঁই পাব। বিধাতা অলক্ষ্যে মুচকি হাসলেন। 


    গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বিকেলে নিকটস্থ ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর্স-এ গিয়ে হাজির হলাম। স্টোর্স মাঝারি মাপের, ব্র্যাণ্ডেড জিনিষ রাখে না, নিজেদের প্রোডাক্টই বেচে। থরে থরে সাজানো প্যাকেটের রকমফের আছে। আমি আমার নিজস্ব থিওরি আউড়ে সতর্ক ইন্দ্রিয়-বলে ব্যাগ ভর্তি করলাম। আমার মতে রঙ যাচাই করে নেওয়াটাও প্রভূত প্রয়োজনীয়। রাতের মেনুতে লুচি-ঘুগনি। তাই নিষ্কলঙ্ক শুভ্রত্ব দেখে নিশ্চিত হয়ে ময়দা কিনলাম, সঙ্গে সোনালি রঙের মটরদানা। আমার নৈপুণ্য দেখে বোন তারিফ করল। আমি প্রায় মাটিতে পা না ফেলে নির্ভার খুশিতে ফিরে এসে প্যাকেট কেটে ময়দা মাখতে বসলাম। ওমা, জল দিয়ে যত মাখি সে তত সরে সরে যায়, কিছুতেই ঠাস করে মাখতে পারি না। শেষমেষ এমন দশা হল যে, ল্যাল্ল্যালে ময়দা একদিকে, জল আরেকদিকে। কী মুশকিল, ময়দা এমন পিচ্ছিল হল কবে থেকে?


    ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সে ফোন করলুম। সমস্যা শুনে তারা কম্পিউটার খুলে দেখে বলল - ম্যাডাম, আপনি তো ময়দা নেন নি। বরং এক প্যাকেট অ্যারারুট নিয়েছেন। আপনি কি অ্যারারুটকে অ্যারারুট ভেবে নেন নি? 


    আমি লাইন কেটে দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। অবস্থা দেখে বোনের করুণা হল, বলল – চিন্তা করিস না দি। রাতের খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি। চিকেনের কিছু আনাই? 


    আমার দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উঠে এল – না রে, তোরা খা। আমার জন্য ভেজ কিছু আন বরং।


    এরপরও কি আর চিকেন খাওয়া যায়, বলুন? সলিডারিটি বলেও তো একটা কিছু আছে? 

     [সমাপ্ত]  


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০২ জুলাই ২০২১ | ৩৪৪২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    দরজা - gargi bhattacharya
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sm | 42.***.*** | ০৫ জুলাই ২০২১ ১৬:৪৩495626
  • অসাধারণ লেখা ।অনাবিল আনন্দ পেলাম।অসংখ্য ধন্যবাদ।শীর্ষেন্দু আর সঞ্জীব বাবুর স্মার্টনেস পেলাম। আরও এরকম লিখুন।

  • Nirmalya Nag | ০৬ জুলাই ২০২১ ১৪:২৭495636
  • দারুণ দারুণ।

  • gargi bhattacharya | ০৬ জুলাই ২০২১ ২১:৩৭495640
  • অনেক ধন্যবাদ। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন