আমষ্টারডাম শহরে আমি থাকতাম ব্রাউজারগ্রাগট ক্যানালের ধারে – আর আমার বাড়ি থেকে মিনিট পনেরো হেঁটে গেলে হেরেনগ্রাগট ক্যানালের ধারে ছিল এক বন্ধুর বাড়ি। সেও তখন একাই থাকত তার অ্যাপার্টমেন্টে আর তার থেকেও বড় কথা একদম নীচের ফ্লোরেই ছিল তার আস্তানা। তাই আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা দুজনে চেয়ার নিয়ে ক্যানালের ধারে বসে সময় কাটাতাম মাঝে মাঝে – গল্প করে, সাথে খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি। সেই বন্ধু আবার আমার থেকে অনেক বেশী স্যোশাল ছিল – ফলে মাঝে মাঝে আমরা দুজন ছাড়াও সঙ্গী জুটে যেত। সে ছেলে কি একটা আর্ট অফ লিভিং টাইপের ডিসকাশন গ্রুপ চালাতো বুধবার রাতে তার অ্যাপার্টমেন্টে – এই জিনিসে আমার খুব একটা ইন্টারেষ্ট ছিল না। কিন্তু ভাট মারতে এবং তাদের সাথে খাওয়া দাওয়া করতে ভালোই লাগত – ফলতঃ তাদের ক্লাসে ঠিক সময়ে হাজির হতে না পারলেও, তার পরে হাজির হয়ে যেতাম প্রায়ই।
তো এইভাবেই সেই ক্লাসের নিমন্ত্রণের ফলেই আলাপ হয়ে যায় রোমানিয়ান মেয়ে দুটির সাথে। বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টের একদম লাগোয়া একটা গলি আর সেই গলিতে ছিল দুটি লাল-জানালা। অনেকেই হয়ত এটা জানেন যে আমষ্টারডামে বিশেষ ভাবে চিহ্নত রেড-লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ছাড়াও, গোটা শহর জুড়ে বেশ কিছু জায়গায় আরো ছড়িয়ে আছে এমন লাল-জানালা। আসল রেড-লাইট ডিষ্ট্রিক্টের মোট জানালার তুলনায় এরা গুণতিতে তত না হলেও – মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে যেত এদের উপস্থিতি। ঠিক তেমন ভাবেই বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টের পাশের গলির সেই লাল-জানালা দুটো চোখ পরে যায় একদিন।
তখনো এই লাল-জানালার ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবার ইচ্ছে জন্মায় নি, বা আলাদা কোন ইন্টেরেষ্ট এদের জীবন কাহিনী জানার। এটাও জানা ছিল না যে এই জানালা গুলি শিফট হিসাবে ভাড়া পাওয়া যায়! জানালা অ্যাভেলেবল হলে লাল জ্বলবে আর পর্দা খোলা, লাল আলো জ্বলছে কিন্তু পর্দা টানা মানে ভিতরে কেউ ‘কাষ্টমার’ আছে, আর পর্দা টানা এবং আলো জ্বলছে না মানে সেই জানালায় তখন কেউ ডিউটিতে নেই।
একদিন শনিবারের সকাল – বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরছে, এমনটা অবশ্য প্রায় হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে কফি খেয়ে ভাবছি এখন বাজার করতে সুপার মার্কেট যাব কিনা – একদম ড্যাম্প ওয়েদার আর সেন্ট্রাল আমষ্টারডামে উইকএন্ডে ব্যস্ততা বাড়তে বেশ বেলা হয়ে যায় কারণ এখানে রাত শেষ হয় অনেক দেরীতে। তো সেই হিসাবে রাস্তায় খুব একটা কেউ নেই – কফি খেয়ে ফ্রিজ খুলে দেখি রান্না করার মত কিছু নেই। ফলে বেরোতেই হবে – অনেক কিছু কেনার আছে, তাই যাব আলবার্ট হাইন সুপারমার্কেটের বড় ভার্সেনটায় যেটায় যেতে হলে শর্টকাট করা যায় ওই বন্ধুটার বাড়ির পাশ দিয়ে হেরেনগ্রাগট ক্যানেলের ধার দিয়ে। বন্ধুকে ফোন করলাম সে যাবে নাকি সুপারমার্কেটে জানতে চেয়ে – বলল, “তুই আমার বাড়ি হয়ে আয়, এখানে আরেক কাপ কফি খেয়ে বেরুনো যাবে একসাথে, যা ওয়েদার”।
বাজার করতে বেরিয়েছি – ছাতা নিয়ে খুব একটা বেশি বৃষ্টি না হলে বেরুতে ভালো লাগত না। তাই মাথার হুডটা টেনে চলেছি বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে – রাস্তা প্রায় খালি। ওর বাড়ির কাছাকাছি এসে সেই লাল-জানালার গলির ভিতর দিয়ে চলেছি। অবাক হয়ে দেখলাম এত সকালেও একটা জানালায় লাল-আলো জ্বলছে এবং তার থেকেও বড় কথা এক বেশ বয়ষ্ক লোক ছাতা ভাঁজ করতে করতে দরজা খুলে বেরিয়ে আসা মেয়েটির সাথে কথা বলছে। দরদাম করছে মনে হচ্ছে – এ পাবলিকও মনে হচ্ছে বাড়িতে বলে বাজার করতে বেড়িয়েছে! তবে বাজার করতে যাবার আগে এখানে একটা মিনিট তিরিশের ব্রেক নিচ্ছেন! লাল জানালার দরজায় দাঁড়িয়ে এমন কথা বলা বা দরাদরি বিশাল কিছু দুর্লভ দৃশ্য নয় আমষ্টারডামে – কেউ হাঁ করে তাকিয়েও দেখে না! কিন্তু আমি সেদিন এত সকালে কাষ্টমার দেখে এত বেশী অবাক হয়েছি যে কি বলব – এ লোক কি রাতে ঘুমায় নি নাকি! কতখানি কাম মাথাচাড়া দিলে তবেই এত ড্যাম্প ওয়েদারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে লাল-জানালার দারস্থ হওয়া যায় – তাই মনে মনে ভাবছিলাম। নিজের অজান্তেই লোকটিকে মেপে নিচ্ছিলাম মনে হয় – এদিকে টুরিষ্টের আগমণ একটু কম। ফলে এই লোক মনে হচ্ছে স্থানীয় কাষ্টমার। বুঝতে পারি নি আমার হাঁটার গতিবেগ কমে গিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি! মেয়েটির চোখাচোখি হয়ে গেল – একটু মৃদু হাসল মনে হচ্ছে। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম আমি।
বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই পাশের লাল জানালার মেয়েটিকে চিনিস নাকি?” সে বলল “জানালা তো দুটো, তবে মনে হয় ওই জানালা দুয়ের বেশী মেয়ে ব্যবহার করে। আর তাছাড়া যে ড্রেস আর মেকাপ লাগিয়ে থাকে, এবং সাথে লাল আলো – ওদের ভিতরে যারা থাকে তাদের বাইরে দেখলে চিনতে পারা চাপের”। আমি দেখলাম কথায় যুক্তি আছে – এবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে আমাকে দেখে হাসার কারণটা কি? উত্তর পেলাম – “কারণ হতে পারে দুটো, এক তো তোকে পোটেনশিয়াল কাষ্টমার ভেবেছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তোকে হাসি দিয়ে রাখল, আর দুই হয়ত তোকে আর আমাকে দেখেছে এই বাড়ির বাসিন্দা হিসাবে বেশ কিছু দিন ধরে – আমাদের তো আর মেকাপ নেই, তাই তোকে দেখে চিনতে পেরেছে সকাল বেলা হলেও”। লাল-জানালার পাশ দিয়ে যাবার সময় মেয়েদের চোখাচোখি হয়ে গেলে হালকা হাসি বিনিময় খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু কাষ্টমারের সাথে কথা বলতে বলতে রাস্তায় অন্য কাউকে দেখে তার প্রতি হাসি ছুঁড়ে দেওয়া খুব একটা কমন নয়। এটা তখনি মূলত হয় যদি চেনাশুনা কেউ হয় – এমনটাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা।
এই ঘটনার পরে বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে – আমরা সেই গলি দিয়ে প্রায়ই যাতাযাত করি, কিন্তু চোখ তুলে আর আলাদা করে খুঁজে নেওয়া হয় না। একদিন বিকেলের দিকে অফিস থেকে ফেরার সময় আলবার্ট হাইনের ছোট ভার্সেন সুপারমার্কেটে কিছু কিনতে ঢুকেছি আমরা দুজনে। কাউন্টারে পে করতে গিয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে ওয়েট করছি, দেখি আমাদের পিছনে একটা মেয়ে – দেখতে বেশ সুন্দরী আমাদের দেখে হাসল। এবার নিজে থেকেই বলল – “তোমরা ওই গলির পাশের বাড়িতে থাক না? আমি তোমাদের সাথে চোখাচোখি হলে হাসি ওই লাল জানালা থেকে, কিন্তু তোমরা মনে হচ্ছে আমাকে চিনতে পারো নি”।
এই ভাবেই তার সাথে আলাপ হয়ে যায় – উচ্চারণ শুনেই মনে হয়েছিল যে ইষ্টার্ণ ইউরোপের কোথাও একটা হবে। পরে জেনেছিলাম যে তার বাড়ি রোমানিয়া। এখন আর ঠিক মনে পড়ছে না, কিন্তু মনে হয় আমার বন্ধুর ওই আর্ট-অব-লিভিং ক্লাসেও একবার খুব সম্ভবত এসেছিল। কিন্তু রাতের বেলা এদের বাইরে বেরুনো খুব একটা সম্ভব হয় না। বিশাল দিনের পরিচয় বা সেই মেয়েটির সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করার সময় হয়েছে এমন নয় – কিন্তু মুখচেনা হয়ে গেছে। এর সাথে কথা বলতে বলতেই আমার আমষ্টারডামের রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্টের ইতিহাস এবং বিশেষ করে এখানে যারা থাকে তাদের মানবিক দিকটা খুঁজে পাবার ইন্টারেষ্টের শুরু। অনেক ইচ্ছে থাকলেও কিন্তুবশতঃ এই মেয়েটিকে ইন্টারভিউ টাইপের কিছু নেবার সুযোগ হয় নি বা ওকে বলতে পারি নি।
রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়ানোর অনেক সমস্যা আছে – শুধু রিসার্চ পারপাশ যেতে হলে অনেক নিয়মাবলি আছে, পারমিশন নেবার ব্যাপার আছে। আর একটা হয় কাষ্টমার সেজে গিয়ে মেয়েদের সাথে কথা বলা – কিন্তু তাতে অনেক টাকা দরকার। এতসব কিছু করার সময় সময় এবং টাকা কোনটাই ছিল না – তাই তুলনামূলক সহজ পদ্ধতিটাই অবলম্বন করা গেল – পড়াশুনা – নানাবিধ বই, থিসিস, রিসার্চ রিপোর্ট, আমষ্টারডাম মিউনিসিপ্যালিটির ডুকুমেন্ট, নানাবিধ সাক্ষাতকার ইত্যাদি। পুরো বিষয়টাই খুব ইন্টারেষ্টিং – অনেক কিছু অজানা জিনিস জানতে পারলাম – সব কিছু নিয়েই হালকা করে লেখা যেতে পারে, তবে যেটা আমি আগে কোনদিন ভাবি নি, কিন্তু এই নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে শিখলাম তা হচ্ছে – এই রেড লাইট এরিয়া গুলির স্থাপত্য/আর্কিটেকচার এই ভাবে মানুষের ইরোটিক সেন্সের সাথে বিবর্তিত হয়েছে – পৃথিবীর নানা জায়গার রেড-লাইট জায়গাগুলির মধ্যে আর্কিটেকচারে কি মিল আছে – দারুন ফ্যাসিনেটিং জিনিস।
আমি যে সব দেশে থেকেছি বা ঘুরে বেড়িয়েছি তাদের মধ্যে ‘স্বাধীন’ ভাবে বেঁচে থাকার কনসেপ্টের কাছাকাছি যতটা নেদারল্যান্ডসে বসবাস করে পৌঁছানো যায় তা অন্য কোন দেশে যায় না। এ দেশের আইন কানুন বেশ লিবারেল – মানে ধরুণ পতিতাবৃত্তি এখানে আইনত সিদ্ধ, আপনি চাইলে ২৫ গ্রাম পর্যন্ত নিজের মনোরঞ্জনের জন্য ড্রাগস কাছে রাখতে পারবেন – চাকুরী থেকে ছাঁটাই করা এমন চাপের যে আপনি যদি বিজনেস ওনার হন তাহলে কাউকে ছাঁটাই করার থেকে বিজনেস গুটিয়ে দেওয়া সহজ টের পাবেন। এবং এত লিবারেল আইনের মাঝে থেকে খুব বেশী আইন ভাঙার দরকার হয় না – তাই এমন বিন্দাস বাঁচতে খুব কম দেশে লোককে দেখেছি। আইন না ভেঙে যা খুশী করে যান কারো সামাজিক চক্ষু রাঙানী নেই – আর কেউ কেয়ারও করে না। ডাচেদের জীবন এতই নিরুত্তাপ যে এদের খুঁজে খুঁজে এবং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সমস্যা বের করতে হয় টাইম পাশের জন্য। চেনাশোনা ডাচ থাকলে দেখবেন কমপ্লেন করেই যাচ্ছে – এই আমাদের পাড়ার রাস্তায় কাজ হচ্ছে আগে থেকে নোটিশ দেয় নি। কেউ হয়ত মনে করিয়ে দিল কেন ১৫ দিন আগে তো মিউনিশিপ্যালিটি বুলেটিন ছেড়েছিল – তখন বলবে, তবুও বাড়িতে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল!
ডাচেদের নিয়ে এত কথা লিখছি কেন রেড লাইট নিয়ে লিখতে বসে? রেড লাইট এলাকায় শুধুই যে লাল-জানালা এবং যৌন ব্যাপার স্যাপার নিয়ে নানাবিধ ব্যবসা আছে এমন নয় – এটা একটা রেসিডেন্সিয়াল এলাকাও। বরং বলা যেতে পারে এই জায়গাটার লোকেশনের জন্য (স্টেশনের কাছে, ক্যানালের ধারে ইত্যাদি) এখানে হাউসিং প্রপার্টির দাম প্রচুর – প্রায় পশ এলাকাও বলতে পারেন এই আশপাশটা। তাই আমার এটাও জানার ইচ্ছে ছিল যে এমন সব রেড লাইট সংক্রান্ত হইচই নিয়ে এখানে যারা বাস করে তারা কি ভাবে? খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এই নিয়েও রিসার্চ হয়ে গেছে – আমষ্টারডাম ইউনিভার্সিটি থেকে একটি মেয়ে মাষ্টার্স প্রোজেক্ট করেছিল এখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে। সেই নিয়েও পরে এক পর্বে লিখব। ইদানিং শুনলাম আমষ্টারডামের মেয়র খুব সরগোল ফেলেছেন এই রেড লাইটের ব্যবসা নিয়ে। তাঁর মতে এই এলাকাটা আমষ্টারডামের সুনামের ক্ষতি করছে! তাই শহর থেকে রেড লাইট এলাকা সরিয়ে দেবার প্ল্যান করছেন তিনি ধীরে ধীরে – দেখা যাক তাঁর প্ল্যান কতটা সফল হয়!
আমি যেটুকু ডাচেদের সাথে মিশেছি তাতে করে আমার মনে হয় না এই রেড লাইট আছে কিনা তা নিয়ে তেমন কেউ মাথা ঘামায়! কারণ এদের মধ্যে দেহ ব্যবসা নিয়ে কোন ট্যাবু নেই – কে দেহ বিক্রী করছে আর কে বাদাম, সেই নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। তবে হ্যাঁ এরা অনেকেই সচেতন যে এই দেশ ব্যবসার পিছনে অনেক বঞ্চনা এবং অনেক বেআইনী ব্যাপার স্যাপার লুকিয়ে আছে। তাদের বক্তব্য সরকার সেগুলোর দিকে নজর দিক – আর তাদের মূল প্রবলেম ছিল টুরিষ্টের ঢল নামা এবং রাত ভর চিৎকার করে কিছু কিছু মাতালের ডিসটার্ব করাতে। আমাকা অফিস যাবার ফেরী ধরতে হত আমষ্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশনটা পেরিয়ে – শুক্রবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে স্টেশনে ঢোকা যেত না এত ভীড়! প্রচুর প্রচুর টুরিষ্ট তো আসেই তাদের সাথে আসে কিছু বিশেষ প্রকৃতির কম বয়ষ্ক ছেলে-মেয়ে টুরিষ্ট। কারো হয়ত ব্যাচেলার পার্টি, কারো জন্মদিন ইত্যাদি ইত্যাদি – ব্যাচেলর পার্টিতে রেড-লাইট ডিষ্ট্রিক্ট গিয়ে ফুর্তি করা তো খুবই কমন। উদ্ভট ড্রেস পরা লোকজনের সাথে চলতে ফিরতে ধাক্কা খাবেন। বেলুনের ফোলানো নুনু নিয়ে মাতামাতি মনে হয় সবচেয়ে কমন।
এই রেড লাইট এলাকার ইতিহাস অনেক দিনের – সেই গল্পে ধীরে ধীরে ঢুকব। তবে এই এলাকায় লাল-জানালা ও নানা পর্ণ-শো ছাড়াও অনেক মণিমুক্তো ছড়ানো আছে – কত ছোট ছোট দোকান, কেউ পুরানো ঘরি বিক্রী করছে তো কেউ পুরানো বই। আর আছে অনেক ভালো ভালো রেষ্টুরান্ট এবং পাব। এই ধরণের রেষ্টুরান্ট নেই এখানে! তবে সব রেষ্টুরান্ট তো আর ভালো নয় কারণ অনেকেই জানে তারা ফ্লাইং মাতাল কাষ্টমার হ্যান্ডেল করছে, খাবারের দিকে ভালো নজর দিলেও চলে। কিন্তু অনেক রেষ্টুরান্ট তাদের স্ট্যান্ডার্ড মেনটেন করে – এই এলাকাতেই খেয়েছি দুর্দান্ত স্প্যানিশ, আর্জেন্তিনিয়ান, ইতালিয়ান, থাই, চাইনীজ, ইন্দোনেশীয়ান, সিরিয়ান আরো কত কি।
কিছু কিছু পাব তো এখানে লেজেন্ডারি – এই এলাকার আশে পাশেই আছে আমষ্টারডাম শহরের সবচেয়ে পুরানো পাব। এটা অনেক টুরিষ্ট খুঁজে পায় না – সেই পাবে ছিল আমাদের অফিস ফেরত ভাঁটের জায়গা সাথে ডাচ কলিগ থাকলে। এদের একটা স্পেশাল কনিয়্যাক টাইপের ছিল যা নাকি আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই রেড লাইট এলাকার ক্যানালের পাশ দিয়ে বহু বহুদিন দৌড়াতে বেরুতাম। অবশ্য ওয়েদার একটু খারাপ থাকলে তবেই – কারণ ওয়েদার ভালো থাকলে এই এলাকাতে এত ভীড় হয়ে যায় যে তার মধ্যে দিয়ে ছোটা প্রায় অসম্ভব। এক শনিবারে দুপুরের খানিক পরে কি মনে হল ছুটতে বেরুলাম – সেদিন ওয়েদার ভালো। রেড লাইট এলাকার ক্যানালের ধারে একটা ব্রীজ পেরিয়ে ছুটছি হঠাৎ পিছনে থেকে ডাক এল ‘হাই সুকান্ত’ – ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজে দেখি একটা পাবের সামনে ছোট্ট টেবিলে রোদের দিকে মুখ করে আমার এক কলিগ বিয়ার পান করছে। জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার এখানে? বলল, এটা নাকি ওর প্রিয় পাব! সময় পেলেই এখানে রাস্তার ধারে বসে বসে লোক দেখতে দেখতে বিয়ার পান করে একা বা সাথে কেউ থাকলে। সেদিন দৌড়াচ্ছিলাম বলে আর বেশী কথা হল না – কিন্তু পরে একদিন অফিসে তার কাছে সেই পাবের অনেক গল্প শুনেছি। হয়ত সামনের কোন এক পর্বে লিখব সেই সব নিয়ে।
আমাষ্টারডামে আমাকে যেটা আশ্চর্য্য করেছিল তা হল - এই এত গাঁজার দোকান, এত রেড-লাইট এরিয়ার ভীড় – কিন্তু ক্রাইম রেট খুব খুব কম! মানে ইউরোপের বা পৃথিবীরে অন্য জনপ্রিয় টুরিষ্ট শহরগুলির তুলনায় আমষ্টারডামে অপরাধ বেশ কম। অনেকে বলে প্রাগ শহরেও নাকি ক্রাইম রেট খুব কম – কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে তো আমষ্টারডাম রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতেই বেশী সেফ লাগে।
আমষ্টারডামে পতিতাবৃত্তি আইনত সিদ্ধ লিখলাম – পতিতাদের লাইসেন্স নিতে হয়। এরা যা ইনকাম করে তার থেকে সরকার ট্যাক্স পায় – সরকার থেকেই নিয়মিত যৌন-কর্মীদের শারীরিক পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কেউ বিনোদনের জন্য লাল-জানালার ঘরে ঢুকে সেই যৌন-কর্মীটির কাছ থেকে তার হেলথ সার্টিফিকেট-টি দেখে নিতেই পারেন।
এটা হয়ত অনেকেই জানেন যে এই রেড লাইট এলাকার জানলায় দাঁড়ানো মেয়েদের ছবি তোলা নিষিদ্ধ। পুলিশ নজর রাখে – ছবি তুলতে গিয়ে তাদের হাতে ধরা খেলে ফাইন হবে। আর তাছাড়া সে মেয়েদের ছবি তুলতে চাইবেন তাদের গালিগালাজ শুনতে হবে (যদিও কাঁচের ওপাশ থেকে কি বলছে শুনতে পাবেন না হয়ত)। তবে বেশীর ভাগ জানালার মালিকের আন্ডারে ওদের সুরক্ষার জন্য কিছু রক্ষী থাকে (অনেকে বলে ভাড়া করা গুন্ডা টাইপের) – পুলিশের চোখে না পড়লেও এদের হাতে পড়তেই পারেন। ক্যামেরার ছবি তো ডিলিট করাবেই – বেশী বাড়াবাড়ি করলে ক্যামেরারও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। নিজে কোনদিন তাই লাল-জানালার ছবি তোলার চেষ্টা করি নি। কেবল ক্যানালের উপরে ব্রীজে দাঁড়িয়ে গোটা এলাকার ছবি তুলেছি যেটা লিগ্যাল। তাই এই লেখায় উইন্ডো-র যে ছবি গুলো পাবেন সেগুলো ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
একটা বইয়ের লেখিকা এখানে কাজ করে এমন অনেক মেয়েদের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন – সেই ইন্টারভিউ থেকে আইডিয়া পাই প্রায় সব মেয়েই তাদের উপার্জনের কিছু অংশ ব্যয় করে অপ্রীতিকর অবস্থার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই রক্ষীদের পিছনে। যারা শুধু মাত্র লাল-জানালার পিছনে কাজ করে তাদের হয়ত খুব বেশী ঝামেলায় পরতে হয় না, কিন্তু যে যৌন কর্মীরা এসকর্ট হিসাবে কাজ করে ক্লায়েন্টদের সাথে হোটেলে যায় তাদের রিস্কটা অনেক বেশী থাকে। অনেক পাভার্ট ক্লায়েন্ট শারীরিক অত্যাচার করতে শুরু করে – আগে থেকে তাদের দেখে বোঝা যায় না যে এমন করতে পারে – তাই তেমন অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে এই রক্ষী-রাই সহায় হয়। তেমন ঘটনাও পড়েছি বইতে –
আজকের দিনে আপনি আমষ্টারডাম শহরে গেলে ‘রেড-লাইট ওয়াকিং ট্যুর’ পেয়ে যাবেন। অনেক অনেক ছোট ছোট কোম্পানী আছে এগুলো চালায় – ছোট্ট ছোট্ট গ্রুপ করে একজন ছেলে/মেয়ে ঘুরিয়ে দেখায় রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট। আগে ওই জানালার পিছনে থাকত নিজে, কিন্তু এখন এমন ট্যুর করিয়ে বা পাব-এ কাজ করে জীবন চালায় এমন মেয়ের সাথেও আলাপ হয়ে যেতে পারে আপনার।
এই রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট এ কাজ করে ডাচ প্রসটিটিউট এর সংখ্যা খুম কম – প্রায় নেই বললেই চলে। এখানকার লাল-জানালার ওধারে মেয়েরা বেশীর ভাগ আসে সার্বিয়া, রোমানিয়া, রাশিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, স্পেন – এবং কিছু কিছু গুয়েতমালা ও আফ্রিকা থেকে। পরের পর্বে এই নিয়ে বিস্তারে ঢুকব – এখন অল্প করে বলে নিই। এই লাল-জানালা (যার পিছনে আছে খুব ছোট্ট একটি ঘরে যাতে একটি বিছানা) বা লাল-কামরা যাই বলুন তা ভাড়া পাওয়া যায় ৮ ঘন্টা শিফটে। দিনের বেলায় ৮ ঘন্টার শিফটের ভাড়া ৮৫ ইউরো মত, রাতের বেলা সেই ভাড়া বেড়ে হয় ১১৫ ইউরো মত। আর যদি প্রাইম লোকেশনের ধারে সেই লাল-জানালা হয় তাহলে তার ভাড়া শিফট প্রতি হয়ে যেতে পারে ১৫০ ইউরো মতন।
কত চার্জ করে এই মেয়েরা একবার সেক্সের জন্য? সঠিক হিসেব পাওয়া তো সেই ভাবে সম্ভব নয় – তবু মোটামুটি বেসিক সেক্সে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য লাগে ৫০ ইউরো মতন। কাষ্টমার মাতাল হলে বা বিশেষ কিছু অনুরোধ রাখতে হলে চার্জ আরো বেশী দিতে হয়। ও হ্যাঁ, প্রায় সব ইন্টারভিউতেই এক কনক্লুশন – খুব কম প্রসটিটিউট-ই তাদের কাষ্টমারদের চুমু খায়। সেই সব সমীক্ষাতে এটাও দেখা গেছে যে এখানে আসা কাষ্টমারদের মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০% বিবাহিত। যদি দিন ভালো যায় তাহলে একজন প্রসটিটিউট আট ঘন্টার শিফটে গড়ে ৬ থেকে ১০ জন কাষ্টমার পেতে পারে।
যদিও এই এলাকা-কে বলা হয় রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট এবং লেখাতেও বার বার লাল রঙের জানালা লিখেছি – তাহলে কি এখানে রঙের ব্যবহার কোন গূঢ় অর্থ বহন করে? লাল ছাড়া কি অন্য কোন রঙ ব্যবহার করা হয় না এখানের জানালায়? ঠিক গূঢ় বা চমকপ্রদ না হলেও, কি রঙের আলো তার একটা অর্থ আছে বৈকী! লাল রঙ দেখলে বুঝতে হবে সেই জানালায় আছে মেয়ে – যদি নীল রঙের আলো জ্বলে জানালায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই প্রসটিটিউট আসলে পুরুষ ট্রান্সভেস্টাইট / ট্রান্সজেন্ডার। যদিও অনেক সময় দেখা গেছে ট্রান্সভেস্টাইট লাল আলো জ্বালিয়ে মেয়ে পরিচয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানালায়। আর যদি জানালায় লাল এবং নীল রঙের আলোর মিশ্রণ দেখেন তাহলে বুঝতে হবে সেই জানালায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রান্সভেস্টাইট /ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু তার কাছে ছেলে বা মেয়ে দুই ধরণের খরিদ্দারই ওয়েলকাম।
২০০২ তে একবার আমস্টার্ডামের এই এলাকাটায় প্রায় আধবেলা ঘুরে বেরিয়েছি। তারপরে খানিক ঘাঁটাঘাটি আমিও করেছিলাম বটে।
লেখো লেখো মন দিয়ে পড়ব।
বাহবা
খুব সুন্দর হয়েছে
Excellent
ভালো লাগছে পড়তে। চলুক।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম
ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রথম প্রধান উইম দুইসেনবেরগের একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
স্কিফোলে চেক ইন হচ্ছে ফ্লাইটের জন্য কাউনটারের মহিলা প্রশ্ন করলেন , " উইন্ডো সীট নেবেন ?" ডাচ মহিলা যাত্রী বললেন , " না, আমি ছুটিতে যাচ্ছি "।
সকলকে ধন্যবাদ।
দমুদি লেখার তো ইচ্ছে রয়েছে দেখা যাক কি হয়
হীরেনবাবু একদম যুতসই ,ফ্রী জিনিস দেখলে ডাচেদের মাথার ঠিক থাকে না!
ঠিক। কিন্তু এখানে উইন্ডো সিট না নেওয়ার অর্থ কাজ থেকে ছুটি !!
তাই নাকি? ধারণা ছিল যে ডাচ রসিকতা অন্তত বুঝতে পারি! কিন্তু এখন দেখছি তাও না! এই রসিকতাটি মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।
Clue আছে উইনডো সিটে!
আচ্ছা তাহলে ঠিক আছে :) আসলে আমি ভেবেছিলাম আরো গূঢ় কিছু অর্থ আছে যেটা আমি বুঝতে পারি নি! এই উইন্ডো সরাসরি আমার লেখার উইন্ডোকেই ইঙ্গিত করছে কিনা সেই নিয়ে দোটানায় ছিলাম। এবার ক্লিয়ার হল - ধন্যবাদ।
যথার্থ ! মেয়েটি ছুটিতে যাচ্ছে । কাজেই উইনডো থেকে দুরে !
চমকপ্রদ ধারাবাহিক। সূচনা পর্ব একটু এলোমেলো মনে হলো।
মাঝে মাঝে অহেতুক ইটালিক হরফের ব্যবহার কেন?
আরও লিখুন
সম্ভবত কোন কোদ চাপানো আছে, যা ছবির নীচের অনুচ্ছেদ গুলোকে ক্যাপশন হিসেবে চিহ্নিত করে। যে সব অনুচ্ছেদ এ পাতায় ছবির নীচে, তারা সে কারণে ইটালিক হয়ে আছে। ছবির পর দু'বার এন্টার / একটা স্পেস, একটা এন্টার দিলেই বোধহয় ঠিক হয়ে যাবে।