“বেগম সাহিবা, আপনার সব কথা শুনব বলেই আমি আজ প্রাসাদে এসেছি।
বলুন আপনি। আমি শুনছি”।
লাল রেশমের ভারি পর্দার পেছনে বালাপোষ জড়িয়ে হুঁকোয় দুটো বড় টান দেন বেগম সাহিবা। বেশ শীত পড়েছে আজ। সঙ্গে ভাগীরথীর জোলো হাওয়া।
ধীরে ধীরে কথা কইতে শুরু করেন বেগম। তিনি খুব সুস্থিরভাবে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেন না। গলার স্বরের পর্দা ওঠা নামা করে। তিনি অস্থির হয়ে পড়েন সহজেই।
মীরজাফর কুষ্ঠ রোগে মারা গেলেন। ১৭৬৫ সন। তারপর বাজ পড়ে মরল তার বড়ছেলে মিরন। এদিকে মীরকাশিম তো পাগল হয়ে দিল্লির পথে পথে ঘুরে মরছে। মসনদে এখন বসবে কে?
“নজমুদৌল্লা, আমার ছেলে। সিংহাসনের হকদার তো সেইই”।
“কিন্তু, বেগমসাহিবা, ও যে নাবালক, এত বড় দায়িত্ব সামলানোর মত বড় হয়ে ওঠেনি। মাত্র পনেরো বছর বয়েস”...
বেগম এবারে অস্থির হয়ে উঠছেন। ঘনঘন হুঁকোয় টান। ভুস ভুস ধোঁয়া।
“কেন হবে না সাহেব? আমি আপনাকে দেখব, আর আপনি আমাকে। সোজা হিসেব। আমার দান খয়রাতের পরিচয় কি আগে পান নি? সোজা কথা হল বব্বু বেগমের ছেলেদের হাতে আমি মসনদ তুলে দেব না”
রবার্ট ক্লাইভ বেগমের মনের কথা পড়ে ফেলেছেন ততক্ষণে।
“আমি তো নবাব মীরজাফরকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারবো না। তবে আমি আর আমার সঙ্গে সমস্ত ইংরেজরা, আমরা একেবারে আমাদের মন থেকে আপনাকে বলছি, আমরা সবাই আপনার সন্তান। আর আপনি আমাদের মা, বেগম সাহিবা। আপনাদের সাহায্যেই তো এতো দূর আমরা এলাম।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ক্লাইভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সে তো সত্যিই! ইতিহাস সাক্ষী!
নইলে পলাশির আমবাগানে যত লোক দাঁত কেলিয়ে যুদ্ধ দেখছিল তারা যদি একখানা করে থান ইট ছুড়ে মারত তাহলেই দফা রফা হয়ে যেত।
বেগম কোম্পানি সাহেবের রাতের খানায় রাখবেন রোগনি রোটি, শামি কাবাব, বড় ডেগচিতে সারা রাত জারানো মাংস আর শালগম দিয়ে বানানো শাবডেগ। সঙ্গে মাহি পোলাও। ভাগীরথীর টাটকা মাছের পোলাও, কাঁটা ছাড়া, সুগন্ধি মশল্লায় জাফরানে আর গোলাপজলে আদুরে মখমলি মাছ ফিরিঙ্গি জিভে জমবে ভালো। বেগমের ইচ্ছে ছিল বারো ঘন্টা ধরে তরিবৎ করে বানানো সাত খানা পরত দেওয়া মিঠি পরোটাও রাখা হোক। হ্যাঁ, তাও হচ্ছে বৈকি শেষ পর্যন্ত!
বারো হাজারি গদিনশীন মুন্নি বেগম পর্দানসীন এবং হুঁকোনসীন হয়ে বাজিমাত করলেন। তখন মীরজাফরের অন্যবেগম বব্বু মাসোহারা বা দেউড়ি পেত ছয় হাজার।
সিংহাসনে বসলেন নজমুদৌল্লা। শর্ত অনুযায়ী ইংরেজদের হাতে এলো প্রচুর প্রচুর টাকা। বেগমের কাছ থেকে। ক্লাইভ এই টাকা দিয়ে একটা ট্রাস্ট ফান্ড বানিয়েছিলেন। অসুস্থ কর্মচারী, মৃত সেনাদের বিধবা স্ত্রী বা কোনো ত্রাণ কাজে এই টাকা খরচ করা হত।
মীরজাফরের প্রথম বেগম আলিবর্দি খানের সৎ বোন শাহ খানুম বেগম সাহিবা। অন্য দুজন মুন্নি ও বব্বু।
মুন্নি বেগমের জীবনের গল্প যেন চক মিলানো দালান। অজস্র নকশা আর রঙের টুকরো।
“হাজারো খোয়াহিশে অ্যায়সি কে হর খোয়াহিশে পে দম নিকলে”
মুর্শিদাবাদ তখন ঠাঁটবাটের শহর। নবাবদের শহর। তারপর বাণিজ্য। নানান দেশের সওদাগরের ভিড়। সেই শহরে এসে পড়ল এক নাচিয়ে মেয়ে। যাকে বলে নচ গার্ল। কোত্থেকে? সিকান্দ্রা, আগ্রার কাছে। যেখানে সম্রাট আকবরের সমাধি। পেটের খিদেয় নাচতে নেমেছিল সে। ভালো তালিম পেয়েছিল। মেয়ের প্রতিভাও ছিল। তাই সেকালে নচ গার্লদের মধ্যে সেও বেশ নাম করল।
নাচগানের কদর ছিল মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদে নাচিয়ে দলের সঙ্গে নাচতে এলো মুন্নি। সবাই বলল ক'টা দিন থেকেই যাও।আরও বেশি জায়গা থেকে ডাক আসতে পারে। এইরকমই এক মেহফিলি নেশার মধ্যেই আশনাই হল সেনাপতির সঙ্গে নাচনির। তার চাঁদ মুখের শোভায় নাচে গানে মুগ্ধ হলেন সেনাপতি। তাকে বেগম করলেন মীরজাফর। মুন্নির আর সিকান্দ্রা ফিরে যাওয়া হল না।
লেখা হয়নি মেয়েদের কথা তেমন ভাবে। তাই জানা যায় না ইতিহাসের গ্রিনরুমেই আটকে পড়ে থাকা আকর্ষণীয় এইসব চরিত্রগুলোকে। বেগম এসেছিলেন সমাজের অনেক অনেক নীচের তলা থেকে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেন নি তিনি। মুন্নি বেগমের জীবনের মানচিত্রে অনেক রঙের মিশেল।
লড়াই করে উঠে আসা এক ভিনদেশি মেয়ে। ধুরন্ধর। উদ্ধত। ক্ষমতার আকর্ষণ।
“অ্যাই, কে আছিস, এতিমখানায় খাবার কাপড় সব দিয়ে এলি কি? ওখানে কে এসে দাঁড়িয়ে আছে? সদ্য বিধবা? আহা, থাকার জায়গা আছে? নেই? আস্তানা করে দাও, নায়েব। জলদি”।
হ্যাঁ, একদিকে প্রচণ্ড ক্ষমতার মোহ, সেই ক্ষমতা পাবার জন্য ফিরিঙ্গিদের হাতে ঢালাও উৎকোচ, আবার অন্যদিকে মুন্নি খুব পরোপকারী দয়ালু। তাঁর দরজা থেকে খালি হাতে কাউকে ফিরিয়ে দেন না তিনি। নিজে এককালে অসহায় গরিব ছিলেন তো!
তাঁর দুটি অল্প বয়সী ছেলে পরপর মসনদে বসলো আর অল্পদিনের মধ্যেই মারা গেল। কিন্তু যতদিন তারা মসনদে ছিল মুন্নি বেগমের দাপটের চোটে প্রাসাদের ছাদে কাক পায়রা পর্যন্ত বসতে পারত না।
এই সময় মুন্নি বেগম বানালেন চক মসজিদ। মুর্শিদাবাদের নবাবি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এইটি বেঁচে বর্তে আছে। এর কাছেই ছিল সেই নিশ্চিহ্ন চেহেল সুতুন। এখন সবাই চক মসজিদে দাঁড়িয়ে চেহেল সুতুনের খোয়াবনামা লেখে। দেখতে না পাক, ইতিহাসখেকোদের তাতেই সুখ!
এদিকে মুন্নিবেগমের খরচাপাতি দিন দিন বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। অতিথি সেবা, অনাথ বিধবা অসহায়দের ভরণপোষণ, জেনানা মহলের খরচা তার ওপর ঘটা করে চক মসজিদে একের পর এক পার্বণ লেগেই থাকত। ঈদ উল ফিতর, ঈদ উদ জোহা, নওরোজ, শব এ বরাত, মুহররম। সব সময় চক মসজিদ সরগরম।
নায়েব রেজা খান মুন্নি বেগমের হাতে নাকাল হতে আর চাইছিল না। সে এবারে বেঁকে বসল। তারপর বুব্বু বেগমের দিকে তো কেউ ফিরেই দেখেনি এতদিন! আংরেজ ফিরঙ্গিরা বকলমে দেশ শাসন করে। তাদের এবারে মনে হল এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। মুন্নির দুই ছেলে মারা যাবার পর বুব্বু বেগমের ছেলে মসনদে বসেছে। অতএব এখনো প্রাসাদে, হারেমে মুন্নি কেন ছড়ি ঘোরাবেন? নবাবের প্রতিনিধিত্ব করবেন? এখন বুব্বুর হাতে সেই ক্ষমতা দেওয়া দরকার। বেশ চলল কিছুদিন মুন্নি-বুব্বু পাঞ্জা লড়াই। অথচ মুন্নি বেগম নাকি এমন ভাব দেখাতেন যে কিছুই হয়নি!
এর মধ্যে শতরঞ্জের চালের খেলায় ওয়ারেন হেস্টিংস ঢুকে পড়লেন গভর্নর হয়ে। তাঁর সঙ্গে মুন্নির খুব বন্ধুত্ব হল। নবাবের অভিভাবক হিসেবে মুন্নি নিজের অধিকার জবরদস্ত কায়েম করলেন মোটা টাকার বিনিময়ে। ওয়ারেন হেস্টিংসের মত ইংরেজ যুবকেরা তখন ভারতে গিয়ে লাখ টাকা কামানোর স্বপ্ন দেখত। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল যে তিনি ঘুষ খেয়েছেন বেগমের কাছ থেকে। মুন্নি বেগম জবাব দিলেন ঘুষ? সে কাকে বলে? মান্যিগণ্যি মানুষ প্রাসাদে এলে নজরানা দিতে হয়, উপহার দিতে হয়, খাতিরদারি করতে হয়। তাও বলে দিতে হবে নাকি?
কিন্তু মুন্নি বেগমকে শেষপর্যন্ত কোম্পানি সরিয়ে দেয়। তাতে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন হেস্টিংস। মুন্নি বেগমকে সমর্থন করে যুক্তি সাজিয়েছিলেন মন্দ নয়। এদিকে দাপট থেকে একবিন্দু সরে আসবার পাত্রী তিনি মোটেও ছিলেন না।
তিনি সেই সময়কার দুর্বল নবাবকে হুমকি দিতেন যে যদি তাঁর কথা না শোনা হয় তবে নবাবির যত ধনভাণ্ডার তিনি গরিব আর ফিরিঙ্গিদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। ফিরিঙ্গিরা তো দুহাত পেতেই থাকত।
কোম্পানির সিন্দুক বেগম ভরে দিয়েছিলেন দরাজ হাতে। ক্লাইভ এবং হেস্টিংস এবং কোম্পানির অফিসারদের সঙ্গে মধুর সখ্যের জন্য তাঁকে তখন “কোম্পানির মা” বলে ডাকা হত। আহা, মায়ের আদর বলে কথা!
ভাগলপুর থেকে চিঠি লিখছেন হেস্টিংস তাঁর স্ত্রীকে, “মানি বেগম তোমার কথা খুব বলছিলেন। বলছিলেন তুমি চলে গেছ এখান থেকে। তোমার কথা মনে পড়ছে বেগমের”।
মুন্নি বেগমের মৃত্যুর খবরে ইউনিয়ন জ্যাক অর্ধনমিত রাখা হয়। দেওয়া হয় গান স্যালুট।
কোম্পানির মা কি তিনি একজনই ছিলেন? উঁহু। সেই সময় জেনানামহলে ফিরিঙ্গিপ্রীতির আরও নমুনা আছে! কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ছিলেন ওয়াটস। ক্লাইভের মতই তাঁর হম্বিতম্বি। কাশিম বাজার তখন খুব ব্যস্তবাগীশ জায়গা! সিরাজ উদ দৌলা কলকাতা অভিযানে বেরিয়ে কাশিমবাজার দখল করে কুঠিয়াল ওয়াটসকে শুধু গ্রেপ্তার করলেন না, তাঁর মিসেস ও কচি কচি বাচ্চাদেরও ধরে ফেললেন। আলিবর্দি খানের বেগম মানে সিরাজের দিদিমা মানে আমিনা বেগমের মা, নাম কী তাঁর! সরফুন্নিসা! তিনি যে আবার তলে তলে কোম্পানি ভক্ত ছিলেন সে তো আর সিরাজ জানতেন না। দিদিমা বললেন ওই মেমসাহিবকে জেনানামহলে থাকতে দেওয়া হোক। বলে রাখা ভালো মিসেস ওয়াটস ছিলেন এ দেশিয় খ্রিস্টান। দিদিমার সঙ্গে মিসেস ওয়াটস সই পাতালেন। ভালোবেসে দিদিমা তাঁকে বেগম বলে ডাকলেন। আর কী করলেন? এখানেই আরেক বাজিমাত! গোপনে একখানি চিঠি লিখে রাতের আঁধারে মিসেস ওয়াটস আর তাঁর বাচ্চাদের ভাসিয়ে দিলেন নৌকোয়। গেলেন তাঁরা কোথায়? চন্দননগরে ফরাসিদের আস্তানায়। এইভাবেই ছাড়া পেলেন মিসেস ওয়াটস। সিরাজের দিদিমার রাজনীতির চাল একেবারে বেমিসাল! অন্দরের জেনানারা মোটেই আয়েস করে শুয়ে বসে পান হুঁকো খেয়ে আর কিসসা শুনে কাটাতেন না। প্যাঁচ পয়জারে খুব পিছিয়ে ছিলেন না। ঘসেটি বেগমকেই ধরুন না কেন!
সিরাজের দিদিমার ফিরিঙ্গিপ্রীতির জন্য কুঠিয়াল ওয়াটস গিন্নি সিরাজের হারেমে সাঁইত্রিশটি দিবস কাটানোর নবাবি সুখ ভোগ করে যতদিন বেঁচে ছিলেন সেই পোলাওয়ের ঢেঁকুর তুলেছেন। পরে ওয়াটস হেভেনে গেলে পাদ্রী জনসনকে বিয়ে করে বেগম জনসন হয়ে কলকাতার ফেয়ারলি প্লেসে রীতিমত জাঁকিয়ে বসলেন। কলকাতার সান্ধ্য মজলিসে বেগম জনসন তাঁর সেই সাঁইত্রিশটি দিনের খানদানি সুখভোগের গপ্প খেলিয়ে খেলিয়ে শোনাতে ছাড়তেন না। এবং বলা বাহুল্য স্তাবকের সংখ্যা তাঁর ভালোই ছিল।
ইতিহাসের অলিগলির গল্প, মূল স্রোতে মিশতে পারেনি কোনোদিন। কিন্তু সময়ের নাড়ি ধরতে হলে তাদের রসের জুড়ি নেই!
"সরকতি যায়ে হ্যাঁয় রুখ সে নকাব আহিস্তা আহিস্তা
নিকলতা আ রহা হ্যাঁয় আফতাব আহিস্তা আহিস্তা”
মুর্শিদাবাদ সেই সময়ে লিখছিল আরেক তেজস্বিনীর আখ্যান।
সন ১৭৭০। বাংলা ১১৭৬ সনে দেখা দিল ভয়াবহ মন্বন্তর। বাংলার রায়ত ও জমিদারদের নাভিশ্বাস। কোম্পানির খাজনা ভরতে হবে জমিদারদের অথচ রায়তদের বুক পিঠ এক হয়ে গেছে অনাহারে। খাজনা না দিতে পারায় বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারিয়েছিলেন। যারা ভালো দর হেঁকেছিল তারা সে সব জমিদারি কিনে নিত। রাজশাহী নাটোরের রানি ভবানী প্রজাদের স্বার্থে খাজনা আদায় সাময়িক বন্ধ রেখে ছিলেন মানবিক কারণে। এর অর্থ, কোম্পানির খাজনা খিদে মেটাতে রানির বিলম্ব। ওয়ারেন হেস্টিংস খপ করে গিলতে চাইলেন রানির জমিদারি। রানি কলকাতার কাউন্সিলের কাছে আবেদন রাখলেন। বললেন প্রজা রক্ষা আমার কর্তব্য। আমি সাহেবদের অনুরোধ করেছিলাম, একটু সময় চেয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু সাহেবরা আমার কাছারি আমার আয় আমার সম্পত্তি সব দখল করতে চায়।
ওয়ারেন হেস্টিংসের মুখে ঝামা ঘসে রানি তাঁর জমিদারি ফিরে পেলেন কাউন্সিলের বিচারে। নাটোরের জমিদার গিন্নি থেকে রানি হয়ে উঠে এখানে মুরশিদাবাদি কিসসায় তিনি কেন এসেছেন?
স্বামী মারা যাবার পর খোদ নবাব আলিবর্দি খান জমিদার পত্নীর হাতে প্রজাদের দায়িত্ব তুলে দেন। সেই জমিদারি বিশাল আকার নিয়েছিল রানি ভবানীর দক্ষতায়। বিরাট অঙ্কের রাজস্ব দিতেন কোম্পানিকে। কোম্পানি আর বাংলার নবাব দুজনায় তাঁকে সমীহ করে চলত। এই বিশাল জমিদারির মধ্যে মুর্শিদাবাদও পড়ে ছিল। জমিদারির আয়তন এতোটাই বড় ছিল যে রানিকে অর্ধ বঙ্গেশ্বরী বলা হত। রানি অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত। দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আর কূটনীতির রাজযোটক। লক্ষ করার মত তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা।
ভাগীরথীতে হাওয়া খেতে গিয়ে রানির বাল বিধবা মেয়ে রূপসী তারাসুন্দরীকে দেখে সিরাজের লোলুপতা সত্ত্বেও রানি কিন্তু পলাশির যুদ্ধে সিরাজকেই সমর্থন করেন। সিরাজ তখন তাঁর কাছে ব্যক্তিমাত্র নন। তিনি বাংলার নবাব। রানি বাংলার নবাবকেই সমর্থন করেছিলেন। কারণ সেই সময়কার রাজনৈতিক রসায়নকে তিনি ভাল চোখে দেখেননি।
এদিকে শোনা যায় যে তিনি মেয়ের রোগ ও মৃত্যুর ভুয়ো খবর রটিয়ে দিয়ে নদীর ধারে তার শ্রাদ্ধশান্তিও করেছিলেন।
মানুষের জন্য অনেক করেছেন রানি।দাতা কর্ণের মতই তাঁর মহিমা! আজ মুর্শিদাবাদে টেরাকোটার চার বাংলা মন্দির তাঁর অসামান্য অবদান। কাছেই রয়েছে ভবানীশ্বরী মন্দির। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব পঙ্খের কাজ বাংলার সম্পদ। তাঁর মন নিবিষ্ট থাকত পুজো আর দেবসেবায়।
এই অর্ধ বঙ্গেশ্বরী রানির সঙ্গে আবার মুন্নি বেগমের স্নেহের প্রীতিময় সম্পর্ক! মুন্নি বেগম, ষড়যন্ত্রী মীরজাফরের বেগম, সিরাজ হত্যার অন্যতম অনুঘটক। রানিমাতা, বেগমসাহিবাকে একটি অতিকায় পালকি উপহার দেন। তিরিশ কাহার সেই পাল্কি বইত। তিরিশ কাহারের খরচাপাতি চালানোর জন্য একটি গ্রামও রানি বরাদ্দ করেন। কেন? এমনিই ভালোবেসে? তাই আবার হয় নাকি? এও এক দূরদর্শিতা। এও এক রাজনীতির পাশার চাল।
রাজত্ব বা বৃহত্তর জায়গির বজায় রাখার জন্য রানির নবাবকে খুশি রাখতে হবে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নবাব খুশি রাখবে কোম্পানিকে। আর কোম্পানি? সে তো লুটতে এসেছে।
দাবার ছকে ঘুঁটি। এপাশ ওপাশ, এধার ওধার। বদলা বদলি। তখন কিস্তিমাতের খেলার দান কোম্পানির হাতে!
এইসব ব্যক্তিত্বময়ীরা ইতিহাসের রাজপথে হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে যাবার জন্যই এসেছিলেন যে !
দেখলাম নির্লিপ্ত গ্রামবাসী, অনিচ্ছুক ব্যাজার পাহারাদার অথবা শুনশান চত্বর। বাতাবিলেবুর ফুল পাঠিয়ে দেন রানি কোনো এক পাগলের হাত দিয়ে।
শেষ শীতের অলস দুপুরে প্রায় জনহীন প্রত্নস্মারকে তাঁদের না বলা কথা ফিরে ফিরে আসে। কেউ কেউ শুনতে পায়। অনেকেই পায় না।
“বড় ধুম লেগেছে হৃদি কমলে
মজা দেখিছে আমার মন পাগলে”
ইতিহাস লিখিয়েরা যত্ন করে মুছেছে রানীদের নাম কর্ম।
ভারতীয়রাই ভারতের সাথে সবচেয়ে বেইমানি করেছে।
Rani Bhabani ki shotti Siraj ke support korechhilen palash r মধ্যে?
"...জীবনের গল্প যেন চক মিলানো দালান। অজস্র নকশা আর রঙের টুকরো।"
সুপর্ণার লেখা পড়তে আসি সেই সব আশ্চর্য নকশা আর রঙের বাহারের খোঁজে-
একটি লেখাও হতাশ করে নি আজ অবধি।
মুর্শিদাবাদের অলিগলিতে ইতিহাস। সেই ইতিহাসের স্রষ্টাদের অজানা,স্বল্প জানা কাহিনি খুঁজে আনছেন আপনি। পড়তে ভাল লাগছে। রোমাঞ্চ এবং রাগ একই সঙ্গে হচ্ছে।
রোমাঞ্চের বিষয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলি। লালবাগে যে আধুনিক সরাইখানায় আশ্রয় নিয়েছিলাম সেটি ছিল ওমরাহ গঞ্জে। পাড়াটার নাম পড়েই রোমাঞ্চ হচ্ছিল। এই পাড়াতেই একসময়ে যাঁরা থাকতেন তাঁরাই বাংলা শাসন করতে নবাবকে সাহায্য করতেন। অথবা দরবারি কুচক্রের জাল বিছোতেন। মুর্শিদাবাদের অলিগলিতে ইতিহাস। সত্যি রোমাঞ্চকর।
উফফ!!!! কী পড়লাম! বর্তমানকে হারিয়ে ফেলে ছিলাম! ফিরতে বেশ বেগ পেতে হল
ইতিহাসের সে সময়ের পরে পথে ঘুরছি এখনও। অপূর্ব।পরের কিস্তির অপেক্ষায়