আমার একটা এগারোজনের টিম আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কদের। তাদের প্রাইম-টাইমের গাওয়া গানের ওপর ভিত্তি করে। আমার টিম শুধু টেস্ট ম্যাচ খেলে।
একনম্বরে আসেন ঋতু গুহ। ইংল্যন্ডের কনকনে হাওয়ায় গ্রিন টপ পিচে খেলা হচ্ছে। বল পাগলের মতন সুইং করছে। ঋতু ধরলেন "ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ"। বল লেট সুইং করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে মাথা নাবিয়ে গায়িকার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। গাব্বায় খেলা। বল বুকের নিচে নাবেই না। ঋতু ধরলেন, "ও হে সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি।" যেই বলেছেন, "তব পদতললীনা / আমি বাজাব স্বর্ণবীনা", বলগুলো হাল্কা ড্রপ খেতে খেতে উইকেটের পাশ দিয়ে চলে যেতে লাগল। সেই যেবার ইডেনে ফিফথ ডে-র শেষ দুঘন্টায় ১১৩ করলে ইন্ডিয়া জিতবে অবস্থায় ঋতু নেবে "শ্রাবণের ধারার মতন পড়ুক ঝরে" গেয়ে ম্যাচ বের করে আনলেন, সে গান ভোলেননি নিশ্চয়ই। ইনিই আমাদের হবস, ইনি আমাদের গাভাসকার।
ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ
ও হে সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি
শ্রাবণের ধারার মতন পড়ুক ঝরে
দু' নম্বরে আসবেন কণিকা বন্দোপাধ্যায়। ইনিও সবরকম পিচের প্লেয়ার। হয়ত উচ্ছল গানে ঋতুর মতন অত এফেক্টিভ নন, কিন্তু জর্জ হেডলি যেরকম রান-মেশিন ছিলেন, কণিকা সেরকম গান-মেশিন। টপ্পাঙ্গের গানে গলা একটু বেশি আন্দোলিত করে ফেললেও তাঁর "বাজে করুণ সুরে", "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে" বা "আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে" - লর্ডসের লং রুমে দীর্ঘদিন বাজবে।
বাজে করুণ সুরে
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে
তিন নম্বরে সুবিনয় রায় ছাড়া কেউ আসতেই পারেন না। নইলে ইনিংস কে গড়বেন? একটা একটা করে ইঁট সন্তর্পণে গেঁথে ইমারত তৈরি হবে। অন্য প্রান্তে যদি ধ্বসও নাবে, সুবিনয় এমসিসি ম্যানুয়ালের কপিবুক খেলে যাবেন। এমন কপিবুক যে বয়কটও লজ্জা পান। কখনও তিনি ব্র্যাডম্যান, কখনও পুজারা। কখনও দুর্দান্ত, কখনও শুধু গ্রামার। তাঁর তিনটে ইনিংস বেছে নেওয়া শক্ত। তাও বাছব "খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি", "তিমির অবগুণ্ঠনে" আর "এ কী সুধারস আনে"।
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
তিমির অবগুণ্ঠনে
এ কী সুধারস আনে
টু ডাউন আসছেন কনক বিশ্বাস নী দাস। একটু পুরনো প্লেয়ার। মার্চেন্ট, হাজারেদের সঙ্গে খেলেছেন। সি কে, মুশতাকদের শেষ বয়েসের খেলা দেখেছেন। এনার গানের মাহোলই আলাদা। "আমার দিন ফুরালো" গাইতে গাইতে যখন বলছেন "মনে হয় তার চরণের ধ্বনী জানি / হার মানি তার অজানা জনের সাজে" - তখন গায়ে যদি কাঁটা না দিয়ে ওঠে তাহলে আপনি ভীম নাগের আবার-খাব সহযোগে টেস্ট ক্রিকেট নয়, মৌচাকের চমচম খেতে খেতে টি-টোয়েন্টি দেখুন। আর আপনি যদি টেস্ট ক্রিকেটই চান, তাহলে এর সঙ্গে শুনে নিন "সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়" আর "তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে", বুঝতে পারবেন প্রকৃতি ইচ্ছে করলে একজনের গলায় সুরের প্রতিটা শেড কেমন দিতে পারে। ওই দেখুন তেন্ডুলকার আর ভিভ রিচার্ডস লর্ডসের বারন্দায় বসে এনার গান শুনে 'আফরীন, আফরীন' করছেন।
আমার দিন ফুরালো
সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়
তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
থ্রি-ডাউন আসছেন সুচিত্রা মিত্র। স্ট্রং, স্টেডি ব্যাট। একটু আধটু হাতও ঘোরাতে পারেন। গানে ফ্ল্যামবয়েন্স নেই, কিন্তু মিস ডিপেন্ডেবল। নিজের দিনে একাই ম্যাচ বের করে দেবেন। ডেবিউতে সেঞ্চুরি করেছিলেন "হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়" দিয়ে। "পরাণে পড়িয়াছে টান / ভরা নদীতে আসে বান" শুনে বিপক্ষের গেম প্ল্যান সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে গেছিল। সেরকম নিজের দিনেই গেয়েছিলেন "কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি"। আরেক সেরকম দিনে গেয়েছিলেন, "আমার মুক্তি আলোয় আলোয়"ও। তিনি আমাদের মহিন্দর অমরনাথ, তিনি আমাদের টোনি গ্রেগ।
হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
এরপর তিনজন অলরাউন্ডার। ব্যাটে-বলে এমনকি স্রেফ ফিল্ডিঙেও এনারা যেকোনদিন ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারেন। এনারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। এনারা স্বয়ম্ভূ। এনাদের সঙ্গীতভবন নেই, গীতবিতান-দক্ষিণী নেই। এনারা এমসিসি ম্যানুয়াল, যাকে অনেকে স্বরবিতান বলে ডাকেন, হেলায় অবজ্ঞা করেন। অথচ এনারা নিজেদের প্রাইমে যা গেয়েছেন, তাইই ক্রিকেট।
ছ' নম্বরে নাববেন শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস। যাঁর খেলা লাইন-দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে আসতেন স্যার গারফিল্ড সোবার্স। ব্যাট করতে নেবে যেদিন "জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে" গাইলেন, সেদিন বিপক্ষ শুধু বাউন্ডারি থেকে বল কুড়িয়েই গেল। বল করতে নেবে গাইলেন "পুরানো জানিয়া চেও না আমায় আধেক আঁখির কোণে" সেদিন উল্টোদিকের ব্যাটসম্যানদের প্যাভিলিয়নে শুধু-যাওয়া-আসা-শুধু-স্রোতে-ভাসা। কবে যে "আজি যত তারা তব আকাশে" বা "এস গো জ্বেলে দিয়ে যাও" গেয়ে ফেলবেন তা দেখার জন্যে ক্রেনিয়াস গ্রহ থেকে মালসা-ভর্তি অ্যাং-সাহেবরা রেগুলার আসতেন একসময়ে। এখন সে জর্জও নেই, সে অ্যাংও নেই।
জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে
পুরানো জানিয়া চেও না আমায় আধেক আঁখির কোণে
আজি যত তারা তব আকাশে
এস গো জ্বেলে দিয়ে যাও
সাতে আসছেন আরেক অলরাউন্ডার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যিনি সোবার্সকে কাকা বললেও, নিজে ভাইপোর অধিক। দিল্লির কালীবাড়িতে তাঁর গান শুনে কপিল দেব ক্রিকেটে আকৃষ্ট হন। সে সন্ধ্যায় "আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল" শুনে দিল্লিতে আঁধি নয়, কালবৈশাখী এসেছিল। আবার যেদিন গেয়েছিলেন "মরি হায় চলে যায় বসন্তের দিন" সেদিন সারা শহর দাবদাহে পুড়ে গেছিল। যখন গাইলেন "মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে", বিপক্ষের ব্যাটসম্যান চোখের জল চেপে প্যাভিলিয়নে হাঁটা দেয় তেকাঠি হারিয়ে।
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল
মরি হায় চলে যায় বসন্তের দিন
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে
আটে আছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, যাঁকে ইয়ান বোথাম গুরু মানতেন। জুবিলি টেস্ট যাতে বোথাম ১৩ উইকেট আর ১১৪ রান করে একা হাতে ভারতকে হারিয়েছিলেন, শোনা যায় সারাটা সময় তিনি পঙ্কজ মল্লিকের "আমারে তুমি অশেষ করেছ" আর "খরবায়ু বয় বেগে" শুনে গেছিলেন। একবার পঙ্কজ মল্লিকের "এমন দিনে তারে বলা যায়" শুনে বিপক্ষের ব্যাটসম্যান ইনিংসের মাঝে মাঠে ব্যাট নাবিয়ে প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করতে চলে গেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিকই টিমের ক্যাপ্টেন।
আমারে তুমি অশেষ করেছ
খরবায়ু বয় বেগে
এমন দিনে তারে বলা যায়
তিনজন স্পেশালাইজড বোলার নিয়ে নাবছে আমার দল।
নিলীমা সেন "খেলার সাথী বিদায় দ্বার খোল" গেয়ে যে কত ব্যাটসম্যানের সর্বনাশ করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। "আজি গোধূলীলগনে এই বাদললগনে" কিম্বা "প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে" দিয়ে যে কোনদিন যে কোন লেভেলের ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করার ক্ষমতা ধরেন নিলীমা। গায়নে অন্তর্মুখীতা - যেন পুজোয় বসেছেন। কিন্তু এক্সিকিউশনে রুথলেস, ঠিক যেন মাইকেল হোল্ডিং।
খেলার সাথী বিদায় দ্বার খোল
আজি গোধূলীলগনে এই বাদললগনে
প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে
আরেক স্পেশালাইজড বোলার রাজেশ্বরী দত্ত। পিচ যেদিন সহায়তা করবে রাজেশ্বরীকে রুখতে পারে এরকম ব্যাটসম্যান নেই। রাজেশ্বরীর "কখন যে বসন্ত গেল"-র বেদনা যাকে ছোঁবেনা, তিনি রবীন্দ্রনাথের গান শোনার লায়েক নন। তাঁর "কিছুই তো হল না" শুনলে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ যেন ওনার গাওয়ার জন্যেই এই গান লিখেছিলেন। আর "চিরসখা ছেড় না"-র যে আকুতি, বিশেষতঃ দক্ষিণীর গায়কদের তানকর্তবের বিপ্রতীপে রাজেশ্বরীর এই গান একাই পুরো বিপক্ষ দলের মহড়া নিতে পারে। বাঙালি অধ্যুষিত দলে ইনিই একমাত্র জন্মসূত্রে পাঞ্জাবী।
কখন যে বসন্ত গেল
কিছুই তো হল না
চিরসখা ছেড় না
শেষে আসছেন স্পেশালাইজড স্পিনার অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়। অত বুদ্ধি করে আর বোধহয় কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাননি। তাঁর "আমার যদিই বেলা"-র ফ্লাইটের লুপে পড়ে ঘোল খায়নি এমন ব্যাটসম্যান ভূভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেরকমই তাঁর "আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে"র পরিবর্ত সুর আর "নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে"র মোহমায়ায় পড়ে সর্বস্ব খোয়ানো ব্যাটসম্যানের মিছিল যদি কোনদিন বেরোয়, বাংলা রাজনীতির হাল বদলে যাবে। মুশকিল হল, খুব মুডি প্লেয়ার।
আমার যদিই বেলা
আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে
নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে
তাহলে এই আমার টিম দাঁড়াল। কে ম্যাচ খেলতে আসবি?
১। ঋতু গুহ
২। কণিকা বন্দোপাধ্যায়
৩। সুবিনয় রায়
৪। কনক দাস
৫। সুচিত্রা মিত্র
৬। দেবব্রত বিশ্বাস
৭। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
৮। পঙ্কজ কুমার মল্লিক
৯। নিলীমা সেন
১০। রাজেশ্বরী দত্ত
১১। অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়
এখানে রইল চৌতিরিশটা ইনিংস।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।