‘আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ’ এককথায় একটি অসাধারণ বই। বাংলাভাষায় এই ধরনের প্রকাশনা আমার চোখে পড়েনি। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত অনুষ্টুপ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা পরের বছর বর্ধিত আকারে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। ২০১৯ সালে তার পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। দুই মলাটের মধ্যে বাইশটি প্রবন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশকে ধরতে চেয়েছে বইটি। কাজটি অত্যন্ত কঠিন হলেও সম্পাদকরা যে অনেকটাই সফল হয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। এই লেখার পরিসরে সম্পূর্ণ বইটির যথাযথ আলোচনা সম্ভব নয়, কিন্তু প্রায় সবগুলি প্রবন্ধই এত গুরুত্বপূর্ণ যে আলোচনাতে অন্তত উল্লেখের দাবি রাখে।
ছয় পর্বে বিভক্ত বইয়ের প্রথম পর্ব ‘নতুন যুগের সূচনা’। ঠিক কখন বিজ্ঞানে আধুনিক যুগ শুরু হল স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে মতান্তর আছে, তবে অনেক ঐতিহাসিকই গালিলিওর সময়ের দিকে নির্দেশ করেন। আধুনিক ঐতিহাসিক মতে মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলা সমীচীন নয়; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন অগ্রগতি ঘটেছে এই সময়, তার থেকেও বেশি ঘটেছে টেকনোলজি বা প্রকৌশলের উন্নতি, যা ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম সম্ভবই হত না।
গালিলিও গালিলি। শিল্পী যুস্তুস সুস্তেরমান। ১৬৩৬। সৌজন্য রয়াল মিউজিয়াম্স, গ্রিনউইচ
তা সত্ত্বেও এখন আমরা Science বলতে যা বুঝি, যার মূলে আছে পর্যবেক্ষণ পরীক্ষানিরীক্ষা এবং পরিমাণগত মূল্যায়ন, শব্দটার সেই অর্থে ব্যবহারই শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। গালিলিও সপ্তদশ শতকেই আপ্তবাক্য বা প্রাচীন গ্রন্থের উপর নির্ভর না করে নিজে দেখার উপর জোর দিয়েছিলেন। এই পর্বের প্রথম লেখাটিতে সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তী আরবদের হাত ধরে কেমন করে প্রাচীন গ্রিক ধ্যানধারণা ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চাকে সঞ্জীবিত করে তুলল এবং শেষপর্যন্ত তা গালিলিও ও কেপলারে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করল, তার বিবরণ দিয়েছেন। মধ্যযুগে বাণিজ্যবিস্তার, শিল্পের জন্য নতুন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্ষেপে তুলে ধরা প্রবন্ধটি বিষয়ের গুরুত্বের কারণেই আরও একটু দৈর্ঘ্য দাবি করে। শুধু নতুন কোনো আবিষ্কার বা উদ্ভাবন নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নতুন দর্শন। সেই দর্শন সৃষ্টির পিছনে গালিলিও ও নিউটনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের হাতে তৈরি বিজ্ঞানকে আমরা আজ সনাতনি বা ক্লাসিক্যাল আখ্যায় অভিহিত করে থাকি, তার মূলে ছিল নিশ্চয়বাদ বা Determinism। চার শতাব্দী কাল নিশ্চয়বাদ বিজ্ঞানের দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। সে প্রভাব এতটাই গভীর যে বিংশ শতাব্দীতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা যখন তার মূলে কুঠারাঘাত করল, তখন কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রথম দুই স্রষ্টা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ও আইনস্টাইন নিজেদের সৃষ্টিকেই সন্দেহ করলেন।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (বাঁদিকে) ও অ্যালবার্ট আনস্টাইন
বিজ্ঞানের বিকাশের দুটি ধারা আছে। একদিকে যেমন সে নতুন নতুন শাখার জন্ম দিচ্ছে, তেমনি আবার আপাতভাবে সম্পর্কহীন বিষয়কে এক জায়গায় নিয়ে আসছে। সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ইতিহাস এসেছে ‘সংশ্লেষ ও নির্মাণ’ পর্বের ছ-টি প্রবন্ধে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনুমান ছিল পৃথিবীর বয়স মাত্র কয়েক হাজার বছর। ভূবিদ্যার অগ্রগতি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ কেমনভাবে আমাদের পৃথিবীর প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের পথ দেখাল, সে কথা এসেছে দীপঙ্কর লাহিড়ী ও সুশান্ত মজুমদারের প্রবন্ধ দুটিতে।
দীপঙ্কর লাহিড়ী পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে যে প্রশ্নগুলি তুলেছেন, বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তার কয়েকটির সম্ভাব্য উত্তর আমরা গত সিকি শতাব্দীতে পেয়েছি। আমাদের চিন্তার জগতে বিবর্তনবাদ সম্ভূত বিপ্লব এবং সমাজবিদ্যাতে সেই তত্ত্বের অপপ্রয়োগের কথা এসেছে দ্বিতীয় লেখাটিতে। এক অতিমারির যুগে দাঁড়িয়ে ভাইরাস ও তার টিকা নিয়ে আগ্রহ অনেকের মনেই জেগেছে। দুটি প্রবন্ধে সেই বিষয়ে আলোচনা পাওয়া যাবে। এই পর্বে নিশীথ পাল লিখেছেন জীবাণুবিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস, পরের পর্বে জীবাণু বা ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসাতে বিজ্ঞানের ব্যবহার নিয়ে লিখেছেন পীযূষকান্তি সরকার। দুজনেই দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীর কৌতূহল ও সমাজের চাহিদা কেমনভাবে এক জায়গায় এসে মিশেছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চারিদিকের সমস্ত পদার্থের পিছনে কয়েকটি মৌলিক পদার্থের সন্ধান করেছে। একসময় ভাববাদী ও বস্তুবাদী দর্শনের সংঘর্ষের কেন্দ্রে ছিল প্রাচীন পরমাণুবাদ। যা ছিল প্রাচীন যুগের দার্শনিক আলোচনার বিষয়বস্তু, মধ্যযুগের অ্যালকেমিস্টদের হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত তা আধুনিক রসায়নে মৌলিক পদার্থ ও অণু পরমাণু আবিষ্কারে পৌঁছেছে; ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের কলমে এসেছে সেই ইতিহাস।
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাতে সংশ্লেষের এক বিরাট ভূমিকা আছে, গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড তত্ত্ব বা স্ট্রিং তত্ত্ব সেই প্রচেষ্টার সর্বশেষ রূপ। তড়িৎ ও চুম্বক, এই দুই আপাতভাবে সম্পর্কহীন শাখাকে কাছাকাছি এনেছিলেন ফ্যারাডে, তাঁর পরে ম্যাক্সওয়েলের হাতে তা এক সূত্রে বাঁধা পড়ে। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সেই প্রথম মহাসংশ্লেষের ইতিহাস লিখেছেন ভূপতি চক্রবর্তী। দীপন ভট্টাচার্য আলোচনা করেছেন কেমনভাবে বলবিদ্যা ও তাপগতিবিদ্যা—পদার্থবিজ্ঞানের এই দুই শাখার শক্তি বিষয়ক চিন্তা এক জায়গায় এসে মিলল। পদার্থবিজ্ঞানের এই অগ্রগতি শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
তৃতীয় পর্ব ‘প্রাণের পরিচয়’, আছে তিনটি লেখা, তার একটির কথা আগেই বলেছি। পদার্থের গঠন সন্ধানে ক্ষেত্রে যেমন আমরা অণু-পরমাণু হয়ে শেষ পর্যন্ত মৌলিক কণাতে পৌঁছেছি, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোশ থেকে ডিএনএ গঠন আবিষ্কার অনুরূপ ইতিহাসের সাক্ষী। জেনেটিক্স বিজ্ঞানের স্রষ্টা মেন্ডেল, তাঁর গবেষণা ও তা পুনরাবিষ্কারের চিত্তাকর্ষক ইতিহাস লিখেছেন পুলক লাহিড়ী। বিজ্ঞানের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখাটির ইতিহাস নিয়ে একটি তথ্যবহুল কিন্তু অত্যন্ত সুখপাঠ্য প্রবন্ধ লিখেছেন শিবদাস ঘোষ, স্বাভাবিকভাবেই আগের লেখাটির অনেক কিছুই তাঁর আলোচনাতেও এসেছে। প্রবন্ধটিতে স্বল্প পরিসরের মধ্যে আধুনিক জেনেটিক্সের একটা স্বচ্ছ পরিচয় পাঠক পাবেন।
বিংশ শতাব্দীর সূচনাতে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, আজও তা শেষ হয়নি। এই বিপ্লবের মূলে আছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতাবাদ; আমাদের বিশ্ববীক্ষাকেই পালটে দিয়েছে এই দুই তত্ত্ব। চতুর্থ পর্ব ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এ কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ইতিহাস লিখেছেন মিতা চৌধুরী। সুন্দর প্রবন্ধটিতে একটু অপ্রাপ্তি রয়ে গেল। প্রথম পর্বে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে বিজ্ঞান দর্শনে নিশ্চয়বাদের যে সমাপ্তির কথা বলেছেন তা এসেছে কোয়ান্টাম তত্ত্বের হাত ধরেই; সেই বিষয়ে আরও একটু আলোচনা থাকলে ভালো হত। বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ে শ্রীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি এককথায় অসাধারণ। গালিলিও-নিউটনের সময় থেকে আইনস্টাইন পর্যন্ত দেশ ও কাল সম্পর্কে আমাদের ধারণার বিবর্তনের ইতিহাস লিখেছেন প্রবন্ধে; সহজ কথায় আপেক্ষিকতাবাদের মতো জটিল তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন; এসেছে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কথা। কী দিয়ে সমস্ত কিছু গড়া, মানুষের এই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর সন্ধান আমাদের নিয়ে গেছে পদার্থের অভ্যন্তরে, মৌলিক কণা আবিষ্কারের এক শতাব্দীব্যাপী সেই ঘটনাক্রমের চিত্তাকর্ষক ইতিহাস লিখেছেন প্রসাদরঞ্জন রায়। বিশ্ব সৃষ্টির বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণ তত্ত্ব বনাম স্থিতাবস্থার তত্ত্বের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন নারায়ণচন্দ্র রানা।
অঙ্কশাস্ত্রের নানা শাখা বিশুদ্ধ গণিত হিসেবেই সৃষ্টি হয়েছিল, পরে তাদের বিজ্ঞানে ব্যবহার হয়েছে। মিতা চৌধুরীর লেখাতে যেমন এসেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে ম্যাট্রিক্স ব্যবহারের কথা, তেমনি শ্রীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির প্রয়োগ। পুলক লাহিড়ীর লেখাতে পেয়েছি মেন্ডেল যখন জীববিদ্যাতে গণিতের ব্যবহার করেছিলেন, অনেকের কাছেই তা অভিনব লেগেছিল। আধুনিক যুগে জ্যোতির্বিদ্যার বাইরের পদার্থবিজ্ঞানে গণিতের ব্যবহারে পথিকৃৎ গালিলিও; তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘গণিতের বর্ণমালাতে মহাবিশ্ব লিখেছেন ঈশ্বর।’ পঞ্চম পর্ব ‘বিজ্ঞানের ভাষা ও বর্ণমালা’-র চারটি লেখাতে এসেছে গণিতের অগ্রগতির ইতিহাস।
ক্যালকুলাস বা কলনবিদ্যার স্রষ্টা হিসেবে সাধারণভাবে নিউটন ও লাইবনিৎসের কথা মনে এলেও তার ইতিহাস আসলে আরও প্রাচীন, সেই কথা এসেছে নলিনীকান্ত চক্রবর্তীর প্রবন্ধে। আধুনিক বীজগণিতের ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত, গণিত শাস্ত্রের নানা শাখার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত গণিতের বিভিন্ন শাখাতে বীজগণিত কেমনভাবে প্রবেশ করেছে সেই কাহিনি লিখেছেন প্রদীপকুমার মজুমদার। অতীন্দ্রমোহন গুণের রাশিবিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধটি সুলিখিত হলেও অতৃপ্তি রেখে যায়, এ বিষয়ে আরও আলোচনা থাকলে ভালো হত। মিহির চক্রবর্তী লিখেছেন গণিতের জগতে তিন ‘প্রলয়’-এর বৃত্তান্ত: অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি, অসীমতা, এবং স্ববিরোধমুক্তির অপ্রামাণ্যতা। বিষয়গুলি জটিল সন্দেহ নেই; তিনটি ধারণাই আমাদের সাধারণ বুদ্ধির বিরুদ্ধে যায়, তিনটিই গণিতের প্রচলিত কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
শেষ পর্ব ‘মানুষ ও বিজ্ঞান’-এ আছে তিনটি প্রবন্ধ। অমর ভাদুড়ি লিখেছেন আণবিক জীববিদ্যা ও জৈব প্রযুক্তির অগ্রগতির ইতিহাস। বিজ্ঞানের অপরিমেয় সম্ভাবনা একই সঙ্গে অনেক নৈতিক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে, শেষে সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক। অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের কথা, তিনি জোর দিয়েছেন বিজ্ঞানমনস্কতার উপর। তাঁর শেষ কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিজ্ঞান কোনো জাদুদণ্ড নয় যা মানুষের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেবে। বিজ্ঞানবাদ বা scientism শেষ কথা নয়, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শাসন এবং মতাদর্শের। কৌশিক দাস লিখেছেন কম্পিউটারের অগ্রগতির ইতিহাস। সুলিখিত প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ অব্দের অ্যাবাকাস থেকে, চার্লস ব্যাবেজের যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর হয়ে শেষ পর্যন্ত আধুনিক কম্পিউটারের কথাতে পৌঁছেছে।
শুধু যান্ত্রিক প্রযুক্তির উন্নতি নয়, একই সঙ্গে অ্যালগরিদম, প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, অপারেটিং সিস্টেমের বিকাশের কথাও সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা হয়েছে। তবে এত দ্রুত এই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে যে এ বিষয়ে যে কোনো লেখাই খুব দ্রুত পুরোনো হয়ে যেতে বাধ্য। বইয়ের শেষে ১৫৪২ সালে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক জগৎ ও ভেসালিয়াসের শারীরবিদ্যা বিষয়ক বই প্রকাশের পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানের মূল অগ্রগতির কালপঞ্জি এবং গ্রন্থপঞ্জিটিও পরিশ্রমের ফসল। বিশেষ করে দ্বিতীয়টি আগ্রহী পাঠকের সহায়ক হবে।
একটা কথা আলাদা করে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাতে বিজ্ঞান লেখার একটা সমস্যা পরিভাষার অভাব। অনেকেই বহু ক্ষেত্রে মূল শব্দটি বর্ণীকরণের পক্ষপাতী, অনেকে আবার অনুবাদ করতে চান। আলোচ্য বইটিতে দু-রকম প্রয়োগই দেখেছি; দু-দলের পক্ষে ও বিপক্ষেই যুক্তি আছে। সে বিতর্ক মাথায় রেখেও বলি, কণাপদার্থবিদ্যাতে ব্যবহৃত Flavour, Colour, Strangeness শব্দগুলি যেহেতু ইংরাজির সাধারণ অর্থ বহন করে না, তাই তাদের পরিবর্তে যথাক্রমে স্বাদ, রঙ বা বিচিত্রতা শব্দের ব্যবহার প্রশ্ন রেখে যায়।
আরও কিছু বিষয়ে লেখাকে কি জায়গা দেওয়া যেত? জৈব রসায়নের বাইরের বাকি রসায়নশাস্ত্রের কথা বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে থেমে গেছে, বা জীবনবিজ্ঞানে ডারউইনের পরে জেনেটিক্স ও জৈবপ্রযুক্তি ছাড়া আলোচনা নেই—এই সমস্ত ব্যক্তিগত অনুযোগ সম্ভবত অসার, কারণ একটি বইয়ের মধ্যে বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার ইতিহাসকে স্থান দেওয়া সম্ভব নয়। তবু একটা কথা বইটি পড়তে বসে মনে হচ্ছিল। গত পঁচিশ বছরে বিজ্ঞানের অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে, কয়েকটি লেখাতে সেই কথা সংযোজন করলে ভালো হত। ২০১৯ সালে প্রকাশিত কোনো বিজ্ঞানের অগ্রগতি সংক্রান্ত বইতে হিগস বোসন, অভিকর্ষ তরঙ্গ বা ক্লোনিঙের উল্লেখ থাকা উচিত বলেই মনে হয়। কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে একটিই প্রবন্ধই স্থান পেয়েছে, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানার সেই লেখাটির প্রথম প্রকাশের সময়েই এই বিষয়ে স্বীকৃত জ্ঞানের বিপরীত পথে হেঁটেছে। কম্পিউটার বিষয়ে নতুন প্রবন্ধটি যুক্ত করা খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু যে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বা বিশ্বতত্ত্ব গত পঁচিশ বছরে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধ্যানধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে, অথবা যে ন্যানোপ্রযুক্তি বা যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে আমূল পালটে দিচ্ছে, নতুন সংস্করণের সময় সে সমস্ত বিষয়ে দু-একটি নতুন লেখা কি যোগ করা যেত না?
বইটি ছাপা ও বাঁধাই খুবই ভালো। কিন্তু বিজ্ঞানের বইতে সমীকরণ সঙ্কেত ইত্যাদি থাকবে, ছাপার সময় সেগুলির প্রতি আলাদা দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। অতীন্দ্রমোহন গুণ বা নলিনীকান্ত চক্রবর্তীর প্রবন্ধ দুটিতে বেশ কিছু ভুল চোখে লাগলেও মূল রচনার ক্ষতি করেনি। কিন্তু প্রসাদরঞ্জন রায়ের প্রবন্ধটিতে এত ছাপার ভুল আছে যে তা কোথাও কোথাও লেখার অর্থ পালটে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ছাপাখানার ভূতের কল্যাণে প্রোটন আর অ্যান্টিপ্রোটনের পার্থক্যই খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। মিতা চৌধুরীর লেখাটিতেও সেই রকম ভুল চোখে পড়ল। আশা করি পরের সংস্করণে এগুলি সংশোধিত হবে।
এছাড়াও কিছু কিছু অনবধনতাজনিত ভুল চোখে পড়ে। বিশেষ করে ‘মৌলকণিকার সন্ধানে’ প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করি। এত সুন্দর প্রবন্ধটিতে ‘দু-তিনটি স্থায়ী পরমাণু ছাড়া বাকিগুলি তেজস্ক্রিয়’ বা ‘হাইড্রোজেন বাদ দিলে সব মৌলের জন্যই N>Z’—এধরনের সাধারণ ভুলগুলি না থাকলেই ভালো হত। প্রবন্ধে আছে, মহাবিশ্বের আদিতে যখন কণিকা ও প্রতিকণিকার সংখ্যা প্রায় সমান, তখন একশো কোটি ফোটন বা ইলেকট্রন (!) বা নিউট্রিনো পিছু একটি প্রোটন বা নিউট্রন ছিল। কণিকা ও প্রতিকণিকার সংখ্যা যখন সমান ছিল, সেই তাপমাত্রায় প্রোটন-নিউট্রনের অস্তিত্বের কথাই উঠতে পারে না। তা ছাড়া কণিকা প্রতিকণিকার ধ্বংসের মাধ্যমেই ফোটন বা নিউট্রিনোর জন্ম, আর ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি হলে মহাবিশ্বের মোট আধান ঋণাত্মক হত। এই রকম ভুল না থাকাই বাঞ্ছনীয়। ‘কলনবিদ্যার উদ্ভব’ প্রবন্ধে পেলাম, ‘π যে অমূলদ সংখ্যা এ ধারণা আর্যভট্টের ছিল, এ ধারণা করার সংগত কারণ আছে; যদিও এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।’ এই ধরনের বিভ্রান্তিকর বাক্য সম্পাদনার সময় বাদ দেওয়া যেত। কয়েকটি প্রবন্ধের ভাষা একটু গুরুভার মনে হয়েছে—তবে তার জন্য দায়ী হয়তো আমার সেই বিষয়ে জ্ঞানের অভাব।
তবে এই সবই অতি সামান্য ত্রুটি। বইটিতে গত কয়েক শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির মূল ধারাটি ধরা পড়েছে সন্দেহ নেই। আলাদা করে উল্লেখ করি, পত্রিকাতে ও পরে বইয়ের প্রথম সংস্করণে সম্পাদকদের বক্তব্যের কথা। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগাযোগ বড়ো ক্ষীণ, চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধালাভ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার—এর বাইরে আমরা বিজ্ঞানকে দূরে রাখতেই অভ্যস্ত। তাই আমাদের দেশে বিজ্ঞানের ইতিহাস সংক্রান্ত বই অনেক সময়েই হয়ে দাঁড়ায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জীবনী বা আবিষ্কারের কাহিনি। এই সংকলনে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাসকে ধরতে চেয়েছেন এবং তা মানুষের ইতিহাসের অঙ্গ হলেও কোন্ বৈশিষ্ট্যের জন্য তা স্বতন্ত্র আলোচনা দাবি করে, তার পরিচয় সম্পাদকদের কথাতে পাওয়া যায়। একই সঙ্গে বাংলাতে বিজ্ঞান লেখার প্রধান সমস্যাগুলিরও উল্লেখও তাঁরা করেছেন। বিজ্ঞানের ইতিহাস জানতে আগ্রহী পাঠকের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।
এই লেখাগুলো পড়লে কষ্ট হচ্ছে। কারণ রিভিউ পড়লে মূল বইটা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কত বই আর কিনে পড়া যায়? সম্পাদক / লেখককে বলব বই এর রিভিউ এর সঙ্গে সঙ্গে একটা লাইব্রেরিরও সন্ধান দিন,যেখান থেকে রিভিউ করা বই নিয়ে পড়া যাবে।
এ বিষয়ে তো অনেক বই-ই হয়েছে। ফলে ব্যাপারটা কণ্ডূয়ন-পুনঃকণ্ডূয়নের মতন দাঁড়িয়েছে।