পদার্থবিজ্ঞানে ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে, এবারে নোবেল কমিটি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ। অপর অর্ধেক ভাগ করে নিয়েছেন দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্দ্রেয়া ঘেজ ও জার্মানির রেইনহার্ড গেনজেল। তিনজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ পেনরোজ, তাঁর বয়স উননব্বই বছর। কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে তাত্ত্বিক গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে। পেনরোজ অত্যন্ত সুপরিচিত বিজ্ঞানী; দীর্ঘদিন তিনি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কাজ করে চলেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রচার করার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। অপর দুই প্রাপক তাঁদের নিজেদের জগতে বিখ্যাত হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে অতটা পরিচিত নন। ছায়াপথের কেন্দ্রের অতি-ভারী (supermassive) এবং অতি-ঘন বা অতি-সংহত (compact) বস্তুটি আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের সম্মানিত করা হয়েছে। নোবেল কমিটি সরাসরি না বললেও সাধারণভাবে মনে করা হয় যে সেই বস্তুটি একটি কৃষ্ণগহ্বর। এই সংক্রান্ত সমস্ত গবেষণাই বেশ জটিল, এই সংক্ষিপ্ত লেখাতে আমরা অঙ্কের মধ্যে না ঢুকে এই বছরের পুরস্কৃতদের কাজের সামান্য পরিচয় পাওয়ার চেষ্টা করব।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ পায় ১৯১৫ সালে। সেই তত্ত্বের সমীকরণগুলো বেশ জটিল, একশো বছরে মাত্র কয়েকটা বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম সমাধানটি নির্ণয় করেন কার্ল শোয়ার্জসচাইল্ড। সেই সমাধান ব্যবহার করে ১৯৩৯ সালে রবার্ট ওপেনহাইমার এবং হার্টল্যান্ড স্নাইডার প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ধারণা দেন। শোয়ার্জসচাইল্ড সমাধান অনুযায়ী কোনো বস্তুর ভর যদি একটি বিন্দুতে চলে যায়, তাহলে সেই বিন্দুতে দেশকালের বক্রতা অসীমে পৌঁছে যায়। একে বলছি সিঙ্গুলারিটি বা ব্যতিক্রমী বিন্দু। সিঙ্গুলারিটি শুনেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা স্কুলেও সিঙ্গুলারিটির মুখোমুখি হয়েছি। একটা সমীকরণ নিলাম, y=1/x2, তার x=0 বিন্দুতে y-এর মান অসীম হয়ে যাচ্ছে। এও এক ধরনের সিঙ্গুলারিটি। অর্থাৎ যদি কোনো বিন্দুতে কোনো রাশির মান অসীম হয়ে যায়, আমরা তাকে সিঙ্গুলারিটি বলতে পারি। অবশ্যই আইনস্টাইনের সমীকরণের সিঙ্গুলারিটি উপরের উদাহরণের থেকে অনেক জটিল, কিন্তু সেই আলোচনাতে আমরা যাচ্ছি না।
শোয়ার্জসচাইল্ড সমাধান থেকে দেখা যায় নক্ষত্র যখন খুব ছোটো হয়ে যাবে, তখন তার কেন্দ্র থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থাকলে কোনো বস্তু, এমনকি আলোর পক্ষেও আর তার মাধ্যাকর্ষণকে অস্বীকার করে ওই দূরত্বের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কেন্দ্র থেকে ওই দূরত্বটাকে বলে শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধ। কেন্দ্রের চারপাশে এই যে গোলক, যার ভিতর থেকে কোনো কিছুই আর বেরিয়ে যেতে পারবে না, তার নাম ঘটনা সীমান্ত (Event Horizon)। বস্তু বা আলো প্রবেশ করতে পারে তাই তা গহ্বর। আলোও বেরোতে পারে না, তাই তা কৃষ্ণ।
(তথ্যচিত্র সৌজন্য মার্কিন ন্যাশনাল এয়ারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন—নাসা)
অনেক দিন পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বর ছিল শুধুই বিজ্ঞানীদের কল্পনার জগতে। সাধারণ ভরের জন্য শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধের মান খুব ছোটো, যেমন সূর্যের জন্য তা মাত্র তিন কিলোমিটার। তার মানে সূর্যের ভর একই রেখে তাকে যদি তিন কিলোমিটারের থেকে ছোটো করা যায়, তাহলে একটা কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হবে। সূর্যের ব্যাসার্ধ হল সাত লক্ষ কিলোমিটার। তাই প্রথমে মনে করা হত যে অঙ্ক যাই বলুক, আসলে সে রকম কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না; কৃষ্ণগহ্বরের অঙ্কে যে সমস্ত অনুমান করা হয়, হয়তো বাস্তবে তারা কাজ করে না।
এখানেই আসেন পেনরোজ। ১৯৬৫ সালে তিনি তাঁর যে বিখ্যাত উপপাদ্যটি প্রকাশ করেন তাকে আইনস্টাইনের পরে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করা হয়। উপপাদ্যটিকে খুব সহজ করে বলা যায় যে বস্তুর নিজের উপর মাধ্যাকর্ষণ যদি যথেষ্ট বেশি হয়, তাহলে তার অন্তিম পরিণতি অবশ্যই কৃষ্ণগহ্বর। অঙ্কের অনুমানের উপর তা নির্ভর করে না, তাকে এড়ানোর কোনো উপায় নেই। পেনরোজের এই উপপাদ্য থেকেই ব্ল্যাক হোল বিষয়ক তাত্ত্বিক গবেষণাতে জোয়ার আসে। নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করার সময় এটির কথা নিঃসন্দেহে কমিটির সদস্যদের মনে এসেছে।
পেনরোজের এই উপপাদ্যটি প্রমাণ করতে কাজে লেগেছিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক অমলকুমার রায়চৌধুরির সমীকরণ। বস্তুত আধুনিক সমস্ত সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যই রায়চৌধুরি সমীকরণ থেকে শুরু হয়। হকিং পেনরোজের এই উপপাদ্যটিকে প্রয়োগ করে দেখান যে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল একটা সিঙ্গুলারিটি থেকে। তার পরে পেনরোজ ও স্টিফেন হকিং একসঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। তাঁদের যৌথ গবেষণার ফল হিসেবে আমরা আরও কয়েকটি উপপাদ্য পেয়েছি যাদের একসঙ্গে বলা হয় হকিং পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যসমূহ। তিন বছর আগে মৃত্যু না হলে হয়তো পেনরোজের সঙ্গে পুরস্কৃতের তালিকায় হকিঙের নামও থাকত। পেনরোজ আজও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে কাজ করে চলেছেন, যদিও তাঁর সাম্প্রতিকতম গবেষণা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে মতভেদ আছে।
বাস্তবে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হতে পারে কেমন ভাবে? তারকাকে বাইরে থেকে চেপে ছোটো করার কোনো সুযোগ নিশ্চয় নেই, কিন্তু কোনো তারকা যখন তার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে, তখন সে নিজের মাধ্যাকর্ষণের জন্যই সংকুচিত হয়। ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর আগেই দেখিয়েছিলেন যে ভর যদি খুব বেশি হয়, তাহলে তারকার সংকোচনকে বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। তার থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে একটা নির্দিষ্ট মানের থেকে বেশি ভরের তারকার অন্তিম পরিণতি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মহাকাশে আমরা এমন কিছু কিছু বস্তুর খোঁজ পেতে শুরু করি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া যাদের অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৬৪ সালে হংসমণ্ডল নক্ষত্রমণ্ডলীতে (Cygnus) একটা খুব শক্তিশালী এক্স রশ্মির উৎসের সন্ধান পাওয়া দিয়েছিল। তার ভর মেপে দেখা গেল সূর্যের ভরের পনেরো গুণ, এই ভর মাপার কথায় আমরা পরে আসব। সেখানে দূরবিন দিয়ে কোনো তারকার চিহ্ন পাওয়া গেল না। যে বস্তু থেকে এক্স রশ্মি বেরোচ্ছে, তার আয়তনও খুবই ছোটো। এত ছোটো এত ভারী কোনো বস্তু, যার থেকে কোনো আলো বেরোচ্ছে না, তা একটা জিনিসই হওয়া সম্ভব—কৃষ্ণগহ্বর। ওই এক্স রশ্মি উৎসের খুব কাছে একটা বিরাট তারকা দূরবিনে দেখা যাচ্ছে। ওই তারকা থেকে গ্যাস মাধ্যাকর্ষণের টানে কৃষ্ণগহ্বরে গিয়ে পড়ছে এবং পড়ার সময় উত্তপ্ত হয়ে এক্স রশ্মি বিকিরণ করছে—এটাই বিজ্ঞানীদের ধারণা।
এই ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম হয়েছে কোনো ভারী তারকার মৃত্যুর ফলে, এদের ভর একটা নির্দিষ্ট মানের বেশি হয় না। তার কারণ তারকাদের ভরের একটা সর্বোচ্চ সীমা আছে, কাজেই তার থেকে যে কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম তার ভরও যত খুশি বেশি হতে পারে না। অন্য দিকে উনিশশো পঞ্চাশের দশক থেকেই রেডিয়ো জ্যোতির্বিদ্যার সাহায্যে বোঝা গিয়েছিল যে প্রায় সমস্ত গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই আছে এক অতি-ভারী বস্তু। তার ভর সূর্যের ভরের কয়েক লক্ষ গুণের বেশি হলেও গ্যালাক্সির তুলনায় তার ব্যাস খুবই কম, কখনো-কখনো হয়তো এক আলোকবর্ষেরও অনেক কম। গ্যালাক্সির ব্যাস লক্ষ আলোকবর্ষ বা তার কয়েক গুণ হওয়াও বিচিত্র নয়। (আলো এক সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার যায়, এক বছরে আলো যত দূর যেতে পারে সেই দূরত্বকে বলে এক আলোকবর্ষ।) আমাদের নিকটতম তারা প্রক্সিমা সেন্টাউরির দূরত্ব ৪.২৪ আলোকবর্ষ। গ্যালাক্সিগুলির কেন্দ্রের অতি-সংহত বস্তুগুলি সম্ভবত কৃষ্ণগহ্বর; এত কম আয়তনের মধ্যে এত বেশি ভরের অস্তিত্ব অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। অন্য যুক্তিও আছে—কিছু কিছু গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি বেরোচ্ছে, কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে পদার্থের পতন ছাড়া ওই পরিমাণ শক্তি উৎপাদনের কোনো উপায় আমরা কল্পনা করতে পারি না। হয়তো মনে আছে, দু-বছর আগে M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছিল।
একটা কথা বলে রাখা ভালো, সম্প্রতি এই দুই ভরের মাঝামাঝি ভরের কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অনুমান করা হয় কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে অন্য কোনো কৃষ্ণগহ্বর বা সাধারণ নক্ষত্রের সংঘর্ষে এদের জন্ম। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি-ভারী কৃষ্ণগহ্বরগুলি কেমনভাবে তৈরি হল, তা নিয়ে এখনও একমত হওয়া যায়নি, হয়তো একই পদ্ধতিতে অপেক্ষাকৃত ছোটো কৃষ্ণ গহ্বর থেকেই তাদের সৃষ্টি। সেই আলোচনাতে না গিয়ে আমরা বরং এ বছরের নোবেল পুরস্কারের কথায় ফিরে যাই। দূরের গ্যালাক্সিগুলির কেন্দ্রে অতি-ভারী কৃষ্ণগহ্বর দেখা যাচ্ছে, আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথের কেন্দ্রেও তা থাকা উচিত। ১৯৭৪ সালে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে খুব ছোটো এক রেডিয়ো উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়; খুব ছোটো মানে তার আয়তন আমাদের সৌরজগতের মতো। অনুমান করা হয়েছিল সেটিই আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বর। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র মোটামুটি ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে Sagittarius বা ধনুরাশির দিকে অবস্থান করে। কিন্তু তা আমরা সাধারণ আলোতে দেখতে পাই না, কারণ মহাজাগতিক ধূলিকণার মেঘ তাকে ঢেকে রেখেছে। এই রেডিয়ো উৎসের নাম দেওয়া হয়েছে Sagittarius A* বা সংক্ষেপে Sgr A*।
ছায়াপথের কেন্দ্রের একটি কৃষ্ণগহ্বর স্যাজিটেরিয়াস এ (ছবি সৌজন্য নাসা)
ধূলিরাশির মেঘ ভেদ করে Sgr A*-কে পর্যবেক্ষণের জন্য বিজ্ঞানীরা ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে চেষ্টা শুরু করেন। রেইনহার্ড গেনজেল এবং আন্দ্রেয়া ঘেজ এ বিষয়ে গবেষণারত দুটি আলাদা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঘেজের দলটি হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত কেক (Keck) টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন। গেনজেলের নেতৃত্বাধীন দলটি ব্যবহার করেন চিলিতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজার্ভেটরির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ।
সাধারণ বা দৃশ্য আলোতে ছায়াপথের কেন্দ্রকে দেখা যায় না, তাই বিজ্ঞানীরা অন্য ধরনের আলোর কথা ভাবলেন। আলো হল তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি চারশো থেকে সাতশো ন্যানোমিটারের মধ্যে হয়, তাহলে তা আমাদের চোখে ধরা পড়ে। (এক ন্যানোমিটার হল এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ।) আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাতশো ন্যানোমিটার থেকে এক মিলিমিটারের মধ্যে হলে তাকে আমরা বলি অবলোহিত আলো, তাকে ব্যবহার করা হল। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে বেরোনো অবলোহিত আলোর মাত্র দশ শতাংশ ওই ধূলির মেঘ ভেদ করে আসতে পারে, তাই তা দেখার জন্য দুই দল বিজ্ঞানীকেই প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি করতে হয়েছে। দেখা গেছে যে দুই মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত আলো পর্যবেক্ষণের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী।
কৃষ্ণগহ্বরকে দেখা যায় না, পরোক্ষ সাক্ষ্য থেকে তার অস্তিত্বের কথা বোঝা যায়। সেজন্য প্রথমেই তার ভর নির্ণয় প্রয়োজন। মহাজাগতিক বস্তুর ভর নির্ণয় করা হয় কেমন করে, তাকে তো দাঁড়িপাল্লাতে চাপানো যাবে না। কেন্দ্রের ভারী বস্তুটির মাধ্যাকর্ষণের টানে অনেক নক্ষত্র তাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। যদি কেন্দ্র থেকে তাদের কারও দূরত্ব এবং একবার পাক খেতে তার কত সময় লাগে তা নির্ণয় করা যায়, তাহলে উচ্চমাধ্যমিকের বইতে পড়া কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে আমরা কেন্দ্রের বস্তুর ভর বার করতে পারি। এভাবেই আবর্তন কাল থেকে গ্রহনক্ষত্রদের ভর জানা যায়, হংসমণ্ডলে অবস্থিত কৃষ্ণগহ্বরটির কত ভারী এই পদ্ধতিতেই তা নির্ণয় করেছিলাম। অবলোহিত আলোতে দেখা গেছে যে ছায়াপথের কেন্দ্রে আছে বহু সংখ্যক নক্ষত্র, তারা এক খুব ভারী অদৃশ্য বস্তুর মাধ্যাকর্ষণের টানে ছায়াপথের কেন্দ্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি নক্ষত্রের গতিপথ দুই দশকের বেশি সময় ধরে ওই দুই দল বিজ্ঞানী মাপছেন। এই সমস্ত পর্যবেক্ষণ থেকে তাঁরা আলাদা আলাদা ভাবে দেখিয়েছেন যে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রের ভর সূর্যের ভরের চল্লিশ লক্ষ গুণের কাছাকাছি। কেন্দ্রের না দেখা বস্তুটি নিশ্চয় আমাদের সৌরজগতের থেকে ছোটো, কারণ কয়েকটি নক্ষত্র কেন্দ্র থেকে মাত্র একশো পঞ্চাশ কোটি কিলোমিটার দূর দিয়ে যায়, এটা সূর্য থেকে ইউরেনাসের দূরত্বের থেকেও কম। এই জন্যই কেন্দ্রের বস্তুটিকে অতি-ভারী ও অতি-সংহত বলা হয়। আবর্তনরত নক্ষত্ররা যখন খুব কাছে আসে, তখন তাদের কারও কারও বেগ সেকেন্ডে কুড়ি হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। দেখা গেছে এই ধরনের উচ্চ বেগে ও তীব্র মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রেও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ পুরোপুরি কাজ করে; একশো বছর আগে আবিষ্কৃত এই তত্ত্ব এখনও পর্যন্ত সমস্ত পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে।
যা দেখাই যায় না কিন্তু যার অস্তিত্ব প্রমাণিত সেই কৃষ্ণগহ্বর ব্যাপারটি কী? প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝাচ্ছেন অ্যান্ড্রিয়া ঘেজ
পেনরোজ অঙ্ক কষে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন এবং তার নানা ধর্ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ঘেজ ও গেনজেল পর্যবেক্ষণ করে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতি-ভারী কৃষ্ণগহ্বর কেমন করে তৈরি হল, গ্যালাক্সি গঠনে তার ভূমিকা কী—এই সমস্ত নির্ণয় এখন বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ। আন্দ্রেয়া হলেন চতুর্থ মহিলা যিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন। আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে এই তিন বিজ্ঞানী অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন সন্দেহ নেই।
পেনরোজকে আগেই নোবেল দেওয়া উচিত ছিল। তার সঙ্গে স্টিফেন হকিংকেও।