যারা আগুন লাগায়
যুগে যুগে যারা আগুন লাগায় তাদের মুখোশগুলি আলাদা, মুখগুলি একই। সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, বিভ্রান্ত করে আগুনের ফুলকিকে দাবানলে পরিণত করতে তারা সিদ্ধহস্ত। স্থান-কাল-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভেদে তারা অস্ত্র বদলে নেয়। তবে হিংসায় যে অস্ত্রগুলি চিরকালীন, তা হল গুজব, বিভ্রান্তিকর স্লোগান। ভুয়ো তথ্যের বোতলবন্দি দৈত্যকে রাজনীতির ব্যাপারীরা, ধর্মের ব্যবসায়ীরা সময়ে সময়ে বের করে আনেন আর বারবার কবরে দাফন হয় ‘অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’।
১৯৪৬ সালে মুসলিম লিগের ডাকা ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে ইন্ধন জোগানের জন্যে যথেষ্ট ছিল ‘হাম লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান। দেখা যায়, উত্তর ভারতে এর সঙ্গেই অনেকে জুড়ে নিচ্ছে, ‘জ্যায়সে লিয়া হ্যায় হিন্দুস্তান’। এভাবেই দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারকরা উসকানি আর গুজবকে হাতিয়ার করে সেদিন আগুন লাগিয়েছিল, ঘৃণা ছড়িয়েছে মুখ থেকে মুখে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভালোই অস্ত্র মজুত ছিল কলকাতা সংলগ্ন এলাকাগুলিতে। জোর করে কিছু দোকান বন্ধ করার প্রয়াসকে কেন্দ্র করে শুরু হল ভ্রাতৃহত্যা। কলকাতা শহরে চার দিন ধরে যে নরমেধ যজ্ঞ চলেছিল, তা থামাতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রের ধ্বজাধারীরা, অবাধ ধর্ষণ-লুণ্ঠনের দিনগুলি মানবতার দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। স্বজনহারা, ধর্ষিত, নিপীড়িত মানুষ সেদিন যে যার মতো করে বুঝে নেয়, ব্রিটিশ যা বলেছে তাই ঠিক, হিন্দু-মুসলিম দুই জাতি, এদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। একদিকে শুরু হল দেশ বদল, আর অন্য দিকে শিকড় ছড়াতে শুরু করল গুন্ডারাজ, দাঙ্গাই জন্ম দিয়ে গেল এক নব্য লাঠিয়াল ভ্রাতৃসংঘের। হিন্দু মহল্লাগুলিতে সেই সময় চালু গুজব ছিল, মুসলিম লিগের মুম্বই হেড কোয়ার্টার থেকে মুসলিম এলাকাগুলিতে ডাকযোগে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হচ্ছে। পোস্টঅফিস ব্যবহার করা যাচ্ছে মানে সরকার মদত দিচ্ছে দাঙ্গাবাজদের, ফলে পাড়া বাঁচাতে, মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাই নতুন বাহুবলী। এভাবেই ‘দাদা’দের জন্ম।
দুই পক্ষ থেকেই এই দাদারা অবাধে লুঠ করেছে, ধর্ষণ করেছে, নৈরাজ্য আর স্বৈরাচারের সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে। সব থেকে বেশি লাঞ্ছিত হয়েছে মেয়েরা। এই প্রসঙ্গে ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ গ্রন্থে শৈলেনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্টেটসম্যান পত্রিকা থেকে একটি দীর্ঘ নিবন্ধের অংশবিশেষ তুলে এনেছিলেন। তার একটা অংশে এখানে আলোকপাত করতে চাই। কলকাতা দাঙ্গায় গুন্ডা উত্থান প্রসঙ্গে ওই নিবন্ধে লেখা হয়, “লুঠপাট, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করায় এরা ছিল সিদ্ধহস্ত। এ ছাড়া পাড়ার গুন্ডাদের আগ্রহের অন্যান্য ক্ষেত্রও আছে। নিজে সে দলীয় রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আগ্রহবিহীন তবে নির্বাচন অভিযানের সময়ে যে দল সবচেয়ে বেশি টাকা দিতে রাজি তার সমর্থনে তার চ্যালাচামুণ্ডাদের সেবা হাজির।” অনেক স্রোত ভেঙে, অনেক নদী পেরিয়ে বঙ্গ রাজনীতি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেও এই কথার প্রাসঙ্গিকতা এক চুলও বদলায়নি।
সে যাই হোক, দাঙ্গার আগুন কতদূর যেতে পারে, সেদিনই প্রথম বুঝেছিল কলকাতা শহর। কলকাতার দাঙ্গার আগুনের আঁচে হাত সেঁকে নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, মৈমনসিংহ, কুমিল্লা, পাবনায় গুজব ছড়াতে নেমেছিল একদল ধর্মান্ধ। অঞ্জনকুমার ঘোষ তাঁর গবেষণাপত্রে (Partial truths: Rumour and Communal Violence in South East Asia) এমন অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ তুলে এনে দেখিয়েছিল কীভাবে রংচঙে হিংসার গল্প ছড়িয়ে ঘৃণার বিষ বাতাসে সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি দেখান, বালিগঞ্জ এলাকায় হঠাৎ গুজব ছড়িয়েছিল, হিন্দুদের কলের জলে বিষ মেশানো হচ্ছে। আতঙ্কে ভুগতে থাকা হিন্দু সমাজ অচিরেই বুঝতে পারল মুসলিম সমাজও একই কলের জল খায়। নোয়াখালি অঞ্চলে কলকাতার দাঙ্গা-কাহিনি কয়েকশো গুণ পল্লবিত হয়। সেইসব কাহিনি প্রচার করে চলতে থাকে ধর্মান্তরীকরণ। লিগের স্থানীয় নেতা মৌলানা গোলাম সারওয়ার সেদিন হিন্দু-মুসলিম ঘৃণায় ইন্ধন জোগানোয় বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন। কলকাতায় দাঙ্গায় আত্মীয়কে হারানোর শোক থেকে নিজেকে তিনি জাতিদাঙ্গা ছড়ানোর উন্মাদ কার্যক্রমে লিপ্ত করেন। ‘মুসলিমের প্রস্রাবে হিন্দু ভেসে যাবে’ জাতীয় বীভৎস আপ্তবাক্য তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ইদের আগে মসজিদে মসজিদে বোঝানো হতে থাকে বেহেস্তে যেতে গেলে একজোট হতে হবে। গুজবের ব্যবসায়ীরা কোথাও কোথাও বলতে থাকে, নানা জায়গায় শিখদের একজোট করা হয়েছে মুসলিম নিধনে।
এই পরম্পরা বহতা নদীর মতোই, উপলখণ্ড ভেঙে বেড়িয়ে গিয়েছে স্রোত, কিছুতেই রোধ দেওয়া যায়নি, দেশ ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছে। এই সব ফেলে আসা দিনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন অনেকেই। কিন্তু আমরা তার থেকে সম্ভবত কিছুই শিখতে পারিনি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, নাগরিক সভ্যতা নতুন স্বপ্ন দেখেছে। এক পা এগিয়েছে, আর তারপরেই গুজব আর জাতিদাঙ্গার মতো অভিশাপে দু-পা পিছিয়ে এসেছে। সবচেয়ে প্রবল হয়ে বেঁচে থেকেছে পরস্পরকে বোঝাপড়ার অভাব, ফোবিয়া। আর তারই সুযোগ নিয়ে গিয়েছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা।
প্রবীণের স্মৃতির কোনো রক্তাক্ত কক্ষে, নবীনের পাঠস্মৃতিতে আজও তাই উজ্জ্বল বাবরি ধ্বংসের পরবর্তী ঘটনা। ১৯৯২ সালের ১১ ডিসেম্বর দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার নাম—নাথিং বাট রিউমরস। দেখা যায় কলকাতা শহর বারুদের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর অদূরে মুচকি হেসে সলতে পাকাচ্ছেন দাঙ্গার ব্যাপারীরা। কোনো মহল্লায় মুখে মুখে ছড়ায় লালবাজারের দখল নিয়েছে মুসলিমরা, কেউ আবার বলতে শুরু করেন কলকাতার কয়েকটি মসজিদও ভাঙা হয়েছে। দিব্যচক্ষুতে রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল কেউ কেউ। ভিন ধর্মের মহিলাদের স্তন উপড়ে ফুটবল খেলার দৃশ্যকল্প নির্মাণেও পিছপা হয়নি দাঙ্গাবাজরা। মুসলিম সমাজের একটা অংশকে বিশ্বাস করানো হয় নাখোদা মসজিদ ধ্বংসের মুখে, হিন্দু সমাজকে বোঝানো হতে থাকে জোড়ামন্দির, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি ভাঙা হয়েছে। গঙ্গা ধরে এসে মুসলিমরা বাগবাজারের ভগবৎসভা পোড়াবে, এমন কথাও ত্রাস সৃষ্টি করে। রাজাবাজার, সল্টলেকের দখল নিয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে মুসলিমরা, এমন গুজবও সক্রিয় থেকেছে। চোরাস্রোত হিসেবে যোগ হয়েছে মুসলিম মহিলা অপহরণ ও এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে মসজিদ ভাঙার ভুয়ো খবর। সেদিন আমার-আপনার প্রাণের শহরটাকে বাঁচাতে আসলে ঘাম ছুটে গিয়েছিল পুলিশ প্রশাসনের। আর ওদিকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রাণে বাঁচতে সেই ‘দাদা’দের উত্তরসূরিদের মসিহা ঠাওরানো ছাড়া আর কোনো উপায় অবশিষ্ট ছিল না। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু জনতাকে বারবার অনুরোধ করেন, গুজবে কান না দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! গুজবের শক্তি আজও একচুলও কমেনি। দমেনি গুজবকে হাতিয়ার করা দুর্বৃত্তরা।
এইসব পুরোনো বীভৎসতার ছবিকে সামনে রেখে বর্তমানের পরিস্থিতিকে যখন পড়ি, তখন বুঝতে পারি কিচ্ছু বদলায়নি। আমাদের মন বদলায়নি, সংহতি-মৈত্রীর শুভ উদ্যোগগুলিকে আজও ব্যর্থ করতে সমান ভাবে সক্ষম রাজনীতির লোকেরা, আর আমজনতা নেহাত ক্রীড়নক। গোদের উপর বিষফোঁড়ার নাম সোশ্যাল মিডিয়া। মুখে মুখে কথা ছড়াত আগে, তাকে পুলিশ আটকে রাখতে পারত অঞ্চল ঘিরে, কিন্তু আজকের নতুন দানবকে বধ করার কোনো একমুখী কৌশল নেই। দাঙ্গাবাজদের হাতে এই অস্ত্র কালাশনিকভের থেকেও বেশি ভয়ংকর। আজ যারা আগুন লাগায় তারা ঠান্ডা ঘরে বসে গোটাটাই অপারেট করে। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে ওঠে সেই অপারেশনের বেসক্যাম্প। খবরের আগে ‘ভাইরাল’ হয় ভুয়ো খবর। প্রত্যক্ষ দাঙ্গাবাজেরা আজ প্রথমে রাস্তায় নামেন না, তাঁদের খোঁজ পেতে পেতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঘরবাড়ি। পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা গত পাঁচ-ছয় বছরে বারবার ঘটেছে, যখন সবটা বোঝা গিয়েছে তখন লাশ গোনা ছাড়া আর কোনো কাজই বাকি ছিল না। ৩৬ বছর বয়সি মার্ক জুকারবার্গের ব্রেন চাইল্ড ফেসবুককে মানুষখেকো দৈত্যের ভূমিকা নিতে দেখে ভূতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে নাগরিক সমাজ। কার্যসিদ্ধিতে হাসি চওড়া হয়েছে দাঙ্গা-সওদাগরদের। হুগলি, উত্তর চব্বিশ পরগনা, মালদহ, হাওড়ায় বারবার রক্ত ঝরেছে। আমরা চিনব তাদের, যারা এই জায়গাগুলিতে আগুন লাগাল, জানব কীভাবে ছলে-বলে-কৌশলে ফেসবুককেই অস্ত্র বানাল তারা।
ধূলাগড়-নৈরাজ্যের দিনগুলি
শহর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত ধূলাগড়ের ছবিটা বাইরে থেকে নিটোলই ছিল। কেউ টের পায়নি বারুদস্তূপের উপর বসে আছে এই পুরানো জনপদ। কিন্তু ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহ জুড়ে এই এলাকায় যে অশান্তি হয়েছিল তা অনেক সমীকরণ, অনেক বোঝাপড়া বদলে দিয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে নেমে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, গোটা ঘটনায় সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে পরিকল্পিত রটনা। দাঙ্গার খবর সংগত কারণেই খবরের কাগজে সেভাবে প্রকাশিত হয় না। কাজেই তিলকে তাল করা রটনার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেসবুক।
প্রথমে বলি, সেদিন কী হয়েছিল সেদিন ধুলাগড়ে। ২০১৬, ১২ ডিসেম্বর, ধূলাগড় মুসলিমদের নবি দিবসের একটি মিছিল ছিল। এই মিছিল যখন যাচ্ছে তখনই হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের উগ্রবাদীরা পরস্পরকে উসকানি দেয়। ইট পাথর ছোড়া, বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে। জানা যায়, কয়েক জন মুসলিম যুবককে একটি স্থানীয় ক্লাবে আটকে রাখা হয়েছিল। ১৩ ডিসেম্বর মিলাদ-উল-নবি উপলক্ষ্যে অন্য একটি মিছিল বেরোলে আবার নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়। হিন্দু এলাকার বাসিন্দাদের মতে মিছিলে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এলাকার সব দোকান ভাঙচুর করে, বাড়িঘর ভাঙচুর হয়। ঠিক একই অভিযোগ ওঠে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ ঘটনায় কমবেশি শামিল ছিল দু-পক্ষই।
ধূলাগড়ে দাঙ্গা আটকাতে রাফ নেমেছিল। কিন্তু ২৫ কিলোমিটার দূরের কলকাতা শহর বা ধুলাগড় সংলগ্ন অন্যান্য জনপদে ফেসবুক হয়ে ‘খবর’, ছবি ছড়িয়ে বলা হচ্ছিল মুসলমানরা এলাকার দখল নিয়েছে। হিন্দু দোকানপাট ভাঙচুর করা হচ্ছে। হিন্দু মন্দির জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে এই পোস্টগুলির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ফেসবুক। সত্যাসত্য যাচাই করার কোনো পথ খোলা ছিল না, সুপরিকল্পিত ভাবেই উদাসীনতাকে হাতিয়ার করেছিল মৌলবাদীরা। ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের মনে ভয় ঢুকে যায়। তারা যাচাই করে দেখেইনি (অবকাশও ছিল না), যে দোকানগুলি মুসলিমদেরই, তারা সেই দোকান ভাঙবে কেন! আদৌ হিন্দু মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না। ফলাও করে প্রচার হতে থাকে ওই এলাকার একটি মসজিদ নাকি সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে হস্তক্ষেপ করতে হয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে আঙুল তোলেন। বিবৃতিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, শেষ ১৫ দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত তথ্য বিকৃত করে হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে জি নিউজের সাংবাদিক পূজা শর্মা, এডিটর সুধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি ১৫৩ এ তে মামলা দায়ের করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
ধূলাগড়ে ঘটনা ঘটার পরে পরেই বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও রাহুল সিনহার নেতৃত্বে বিজেপি কর্মীদের একটি দল ঘটনাস্থলে যান। ফেসবুক মারফত তাদের উষ্মা তাঁরা তুলে ধরতে থাকেন। প্রেস কাউন্সিলের বিধিনিষেধকে সম্মান করে যে বিষয়ে সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ ভাবে মৌনতার পথ নেয়, সোশ্যাল মিডিয়া বা তাঁকে হাতিয়ার বানানো ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের সেই দায় নেই। ফলে বিজেপি নেতারা সেদিন ফলাও করে প্রচার করতে পেরেছিলেন ধূলাগড়ে হিন্দুরা কোণঠাসা। আমরা বলতে চাইছি, এই ঘটনায় কোনো এক পক্ষের দায় ছিল না। কিন্তু ঘটনার থেকে ফেসবুকের সৌজন্যে রাজনৈতিক ফয়দা লুটেছিল একটি পক্ষই।
ওই এলাকায় প্রকৃত পরিস্থিতিটা খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর। রঞ্জিতবাবু আমাদের বলেন, “ধুলাগড়ে ঘটনার কয়েকদিন পরে আমরা সেখানে যেতে পেরেছি। কারণ প্রথম প্রথম বহিরাগতদের ঢুকতে দিচ্ছিল না পুলিশ। অচেনা লোক ঢুকলে ধরপাকড়ের ভয় ছিল। বিষয়টা নিয়ে ঠিক-ভুল যাই জানছিলাম সবটাই ফেসবুক থেকে। ফেসবুকে বেশ কয়েকটি পেজে বলা হচ্ছিল মুসলিমরা ধূলাগড় জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মন্দিরে ভাঙচুর হচ্ছে, কিন্তু পুলিশ নির্বিকার। সারি সারি দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার ছবি সামনে আসছিল।”
রঞ্জিত শূর সেদিন গোটা এলাকা ঘুরে বুঝে ফেলেছিলেন কারা, কীভাবে এই আগুন লাগিয়েছে। তিনি বলেন, “অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতি বলে একটা ক্লাব আছে ধুলাগড়ে। আরএসএস পরিচালিত এই ক্লাবই ছিল দাঙ্গার গর্ভগৃহ। এই ক্লাব লাগোয়া অন্নপূর্ণা একটা মন্দির ছিল। ফেসবুকে বলা হচ্ছিল এই মন্দির তছনছ করা হয়েছে। অথচ আমরা গিয়ে দেখলাম সেই মন্দিরে এতটুকুও স্পর্শ করা হয়নি। এলাকাবাসীরা আমাদের বলে এই মন্দিরে কোনো আঘাত লাগেনি।”
স্মৃতি খুঁড়ে উনি অনর্গল বলে চলেন, “ওই এলাকায় একটা অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম রয়েছে। সেখানে ভাঙচুর হয়েছে। এ ছাড়া একটা ছোটো শিবমন্দিরে তালা ভাঙা হয়েছে। ওখানে বোমা পড়েছিল। কিন্তু এই কাজটা কারা করেছে আমরা জানি না। মুসলিমরা বলছে, এই অনুকূল আশ্রমটি আর-একটি আরএসএস ঘাঁটি। এই দুটি ঘাঁটি থেকেই আক্রমণ করা হয়েছিল মুসলিম মহল্লায়। অন্য দিকে, সাধারণ হিন্দু পরিবারগুলিও জানিয়েছে হিন্দু এলাকায় আইনুল বলে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ভাঙচুর হয়েছে, কল উপড়ে নেওয়া হয়েছে।”
আমরা রঞ্জিত শূরকে প্রশ্ন করি, ঠিক কী কারণে দাঙ্গা লাগল, রটনার ভূমিকা কতটা ছিল? উনি বলেন, “নবিদিবসের মিছিল নিয়ে ওই এলাকায় সমস্যাটা শুরু হয়। অন্নপূর্ণা ক্লাবের বক্তব্য এই মিছিল চালু হয়েছে ২০১৫ থেকে। মিছিলের আয়োজকরা চাইছিল ক্লাবের সামনে দিয়ে যেতে। ক্লাবের সামনে দিয়ে যেতেই মিছিলটাকে আটকানো হয়। দু-চারজনকে আটকে রাখা হয়। কিন্তু রটনা এখানে অনেক বড়ো আকার নেয়। ফেসবুক ব্যবহার করে বলা হচ্ছিল, ওই এলাকার একটি মসজিদের আন্ডারগ্রাউন্ডে অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে। একটি জলসায় বাইরে থেকে বহু লোক আসছে। ফলে হিন্দুরা বিপন্ন। প্রতিরোধের জন্য তৈরি হতে হবে। এখান থেকেই অশান্তি।”
দীর্ঘদিন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা রঞ্জিত শূর মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বজ্ঞানশূন্যতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমাদের মনের। ইসলামোফোবিয়া ঢুকে গিয়েছে মনের অন্দরে। উনি বলছিলেন, “আমরা দেখলাম অনেক বামমনস্ক মানুষের মধ্যে রাতারাতি ইসলামোফোবিয়া তৈরি হয়ে গেল। এই কারণেই আমরা ঠিক করি ধুলাগড় যাব। আর ধুলাগড়ে গিয়ে দেখলাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ছবিটা ছিঁড়ে দিয়েছে কেউ।”
রঞ্জিতবাবু আমাদের জানিয়েছিলেন তিনি পুলিশের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নন। স্বয়ং ডিএসপি-কেও ‘আমরা-ওরা’ করতে দেখেন তিনি। তবে ধুলাগড়ের দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ ভাবে কেউ মারা যাননি। দিন কয়েক বাদে এক বৃ্দ্ধের মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাক জনিত কারণে। ক্ষতি হয়েছিল সম্পদের, অর্থনীতির। ওই এলাকায় বহু কারখানায় জরির কাজ হত। কারখানাগুলি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এলাকার মুসলিমদের দাবি, তাদের মোটর সাইকেলগুলিতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কুয়োয় ফেলে দেওয়া হয়।
মোটর সাইকেলের গায়ে লেখা থাকে না ব্যবহারকারী হিন্দু না মুসলিম। কিন্তু ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে জ্বলন্ত মোটর সাইকেলের ছবির চেয়ে ভালো অস্ত্র আর কী হতে পারে। ক্রমে এলাকার দোকানগুলি বেদখল হয়েছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটা বড়ো অংশ পিছনের দিকে সরে গিয়েছে, যেখানে জমির দাম কম, বড়ো বাজার নেই। এমনকি শহুরে ইনটেলেকচুয়ালদের মনেও মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করতে এই দাঙ্গাটির ভূমিকা লিখে রাখার মতোই। আমরা মনে রাখব, গোটা বিষয়টাই হয়েছিল ফেসবুককে সামনে রেখে। একদল ‘আক্রান্ত হিন্দু’-র আজ আত্মরক্ষার প্রয়োজন, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সেই একই এই আবেগকে রাজনৈতিক ফয়দায় পরিণত করার খেলা শুরু হয়েছে তার পরে পরেই। এর ফল ভুগতে হবে কয়েক প্রজন্মকে। এর ফলেই পরস্পরকে না চেনার পরিসর, ভীতি আরও বাড়বে। ফেসবুক হাত ধুয়ে ফেলবে।
যতদিন এই ধরনের তথাকথিত গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সরকার দেশ শাসন করবে ।..এই ধরনের মৌলবাদী চিন্তাধারা এবং তৎপর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ইত্যাদি ঘটবে !!আমরা যারা সম্প্রীতি ।...ঐক্য ।..সদ্ভাব ।..ইত্যাদি নিয়ে চিৎকার করি।... দাদারা কিস্সুই হবেনা !!পাল্টানো দরকার, দরকার ওই বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দেয়া লোকটাকে আবার সচল করার ।।..যাকে ভয় পেয়েছিল এই রকম অত্যাচারী শাসকরা ....যিনি একমাত্র বলে ছিলেন , বিপ্লব আসন্ন ।...ঝাঁপিয়ে পড়ি চলো !! কেউ শোনেন নি !!সংসদীয় গণতন্ত্রের চোরা বালিতে মুখ গুঁজে দিন ।..মাস ।.বছর কাটিয়ে দিলো এনারা ।..যখনি জনগণ নামক বাসুকী ফনা তুলেছিল।..পালিয়েছিলো সবাই !! সুতরাং , মুখোশ ছেড়ে এবার ভিত টাকে নাড়া দিই চলুন !!অনেক দেরি হয়েগেছে !!!!
সন্তোষবাবু,
বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনার পোস্টগুলির ভাষাও ওই ফেসবুক মার্কা, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা । কতগুলো অর্ধসমাপ্ত বাক্য আর 'বিস্ময়সূচক' চিহ্ন দিয়েছেন?
এক গ্লাস জল খান। গোলগোল কথা না বলে ঠান্ডা হয়ে কংক্রিট কথা বলুন। ঠিক কী করতে হবে বলুন। শুনতে চাই।গদগদ আবেগে কিস্যু হবে না।
আমার তো নানান টইতে সন্তোষবাবুর পোস্টগুলো পড়তে ভালোই লাগে। পড়তে পড়তে মনে হয় এই পাঁঠার ঝোল দিয়ে লাস্ট রুটিটা খেয়ে নিয়েই বিপ্লব করতে ঝাঁপিয়ে পড়বো।
সন্তোষ বাবুর কমেন্ট গুলো আমি তিন মাইল দূর থেকে চিনতে পারি। মাঝে ... দেওয়া আর শেষে !!! ট্রেডমার্ক
ঝাঁপিয়ে পড়ো, ঝাঁপিয়ে পড়ো। ঝাঁ আ আ আ আ :-)
একটা ছোট্টো মুদ্রণ প্রমাদ। শৈলেন নয়, শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
বইটার জন্যে অপেক্ষায় রইলাম।
লেখাটা বেশ লাগলো। বইটার জন্য অপেক্ষা করছি।