জর্জ ফ্লয়েড (George Floyd), ছেচল্লিশ বছর বয়সী প্রায় সাড়ে ছ ফুট লম্বা দশাসই চেহারার এক কৃষ্ণকায় মানুষ। বাঙালি মায়েরা হামেশাই এমন মানুষদের দেখিয়ে শিশুদের ভয় দেখান --- “বদমাইশি করনা, চুপ করে ভাত খেয়ে নাও না হলে জর্জ ধরে নিয়ে যাবে!” তবে জর্জ বাংলা দেশে থাকেন না, থাকতেন আমেরিকার মিনিয়াপলিস নামের একটা পেল্লাই শহরে। আমেরিকার মায়েরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের জর্জকে দেখিয়ে ভয় হয়ত দেখান না, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মানুষ হিসাবে না দেখে দানব হিসাবে দেখার ইতিহাস ভারতেরই মত আমেরিকারও প্রাচীন ইতিহাস। কালো মানুষকে অসুর বা দানব বা দক্ষ হিসাবে দেখার বর্ণবাদ আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছে, নাকি ভারত থেকে আমেরিকায় গিয়েছে সে নিয়ে জবরদস্ত তর্ক করা যেতে পারে। ঐতিহাসিক ওয়েন্ডি ডনিজার (Wendy Doniger) তাঁর The Hindus: An Alternative History বইটিতে বলেছিলেন যে রেসিজম বা বর্ণবাদ ভারতবর্ষেই প্রথম শুরু হয়, যা পরে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ওপরই প্রয়োগ করে ২০০ বছর ধরে রাজত্ব চালায়। “ডিম আগে না মুরগি”- তার চক্করে না পড়েও এটুকু সহজেই বলা যায় যে সাড়ে ছ ফুটের দশাসই কৃষ্ণকায় জর্জকে ভয় পাওয়ার বর্ণবিদ্বেষ যেমন বাঙালি বর্ণহিন্দু ভদ্রসমাজে সর্বজনস্বীকৃত, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সমাজে কালো মানুষদের মানুষ হিসাবে না দেখার ইতিহাসও বর্ণবাদী হিন্দুধর্মের মতই প্রাচীন এবং বুনিয়াদি। এ কথায় পরে ফিরব। এখন বলি জর্জ ফ্লয়েডের কথা। ২০২০-র মে মাসের ২৫ তারিখ। জর্জ মিনিয়াপলিসের একটা ছোট্ট দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে সবে বেরিয়েছেন। হঠাৎ চারিদিকে সাইরেন, পুলিশের গাড়ি, জনা পাঁচেক পুলিশ ঘিরে ধরেছে জর্জকে। কারণ জর্জ দোকান থেকে বেরোনোর সাথে সাথে দোকানদার পুলিশে ফোন করে জানান জর্জ যে কুড়ি ডলারের নোট দিয়েছিলেন সিগারেট কিনতে তা জাল। আমেরিকার পুলিশ এসব ব্যাপারে ভয়ানক তৎপর, বিশেষ করে নালিশ যদি কালো মানুষের বিরুদ্ধে হয় তাহলে শুধু তৎপরতাই নয়, সঙ্গে জোটে ক্ষিপ্রতাও। নিমেষের মধ্যে চারজন পুলিশ ঘিরে ফেলে জর্জকে। জর্জ যতই লম্বা চওড়া হন না কেন, ছিলেন অত্যন্ত নরম প্রকৃতির। চারজন পুলিশ জর্জকে ধরে সহজেই রাস্তায় আছড়ে ফেলল। হাত দুটো পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে দিল। এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার, নাম ডেরেক শোভান (Derek Chauvin), এক হাতে জর্জের মাথাটা ঠুসে ধরেছে রাস্তায় আর হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছে জর্জের গলাটা। বাকি পুলিশের দল ঘিরে দাঁড়িয়ে, আর কিছু দর্শক ভিড় করেছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার করে বলছেন, “লোকটা মরে যাবে যে!” এদেরই মধ্যে একজন তাঁর মোবাইল ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে দিয়েছেন। ডেরেক শোভানের হাঁটুর নিচে জর্জের গলা। জর্জ কাতর স্বরে মিনতি করছেন, হাঁটু তুলে নিতে। বার বার বলছেন “I can’t breathe” ---- আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। ডেরেক শোভানের মুখে অনাসক্তি। হাঁটুটা ধীরে ধীরে ছেপে ধরছে জর্জের গলা। এক মিনিট, দু মিনিট, তিন মিনিট ......... জর্জের শ্বাস ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে আসছে...... চার মিনিট, পাঁচ মিনিট...... জর্জের দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ফোঁটা। অসহায় জর্জ কাতর স্বরে ডাকছে তাঁর মা’কে “mama where are you (মা তুমি কোথায়)”…… ডেরেক শোভানের হাঁটু তখন চেপে আছে জর্জের গলা, ডেরেক শোভানের মুখে নেই কোন অভিব্যক্তি। ছ মিনিট, সাত মিনিট, আট মিনিট...এক, দুই, তিন, চার...ছেচল্লিশ সেকেন্ড। জর্জের সাড়ে ছ ফুটের নিথর দেহ পড়ে আছে মিনিয়াপলিসের রাজপথে। ম্যালকম এক্সের থেকে মাইকেল এরিক ডাইসন, প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ লেখক আর বুদ্ধিজীবী বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে শ্বেতাঙ্গ বুটের তলায় কালো মানুষদের পিষে মারা (White men’s heels on black men’s neck) ঔপনিবেশিক সাহেব থেকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের একমাত্র স্বপ্ন। প্রায় দুশ বছর ধরে ব্রিটিশরাজের বুটের তলায় কালো ভারতীয়দের পিষে মরার ইতিহাস আমরা সবাই জানি। ডেরেক শোভান শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সেই স্বপ্নই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, হাঁটুর তলায় জর্জের গলা টিপে তাঁকে ধীরে ধীরে হত্যা করে।
আট মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ডের মর্মান্তিক ভিডিও নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল দেশ বিদেশে। ২০২০ সালের ভয়াবহ অতিমারী অগ্রাহ্য করে দেশে দেশে নগরে নগরে লক্ষ লক্ষ মানুষ ---- সাদা, কালো, বাদামি, ছেলে, মেয়ে, সিস, ট্রান্স, গে, স্ট্রেট, ইয়াং, ওল্ড ---- সবাই বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। প্রতিবাদে মুখর গোটা পৃথিবী। আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জর্জ ফ্লয়েডের শেষ আর্তনাদ “I can’t breathe.” সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে এক অপরূপ ধ্বনি, বাঁচার অধিকারের ধ্বনি: “Black Lives Matter (কালো জীবনের মূল্য আছে)।” জর্জ ফ্লয়েডের নামের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে আরও নাম, যারা সবাই জর্জের মতই পুলিশি বর্বরতার শিকার ----- টামির রাইস, এরিক গারনার, ট্রেভন মার্টিন। ব্রিয়ানা টেইলারের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে রব উঠেছে “Say Her Name (মেয়েদের নাম উচ্চারণ করুন)!” আমেরিকার রেসিজম আর পুলিশি বর্বরতা নিয়ে লিখতে গিয়ে পুলিৎজার প্রাইজ (Pulitzer Prize) পাওয়া খ্যাতনামা কৃষ্ণাঙ্গ লেখক টা-নেহিসি কোটস (Ta-Nehisi Coates) আমেরিকার নাগরিক ও মানবিক অধিকার অর্জনের আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা ডক্টর মার্টিন লুথার কিং (Dr. Martin Luther King, Jr.) এঁর বিখ্যাত উক্তি “the arc of the moral universe bends towards justice (মহাবিশ্বের নৈতিকতা ন্যায়বিচারের দিকেই বাঁকে)” কে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন “the arc of the moral universe bends, not towards justice, but towards chaos (মহাবিশ্বের নৈতিকতা বাঁকে বটে, তবে ন্যায়বিচারের দিকে নয়, বিশৃঙ্খলার দিকে).” কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঢেউয়ে কোটসও টলেছেন। আমেরিকার ২০২০র নির্বাচনের এক মাস আগে ভ্যানিটি ফেয়ারে (Vanity Fair) “The Pyromancer’s Dream” নামে লেখা প্রবন্ধে কোটসকে আশাবাদীই মনে হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, “আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম যে সত্যিকারের বর্ণবাদ-বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠতার উত্থান হচ্ছে তা আসন্ন নির্বাচনে কেবল আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই পরাস্ত করতে পারে তাই নয়, ট্রাম্পের সমগ্র বর্ণবাদী দর্শনকে মানব অস্তিত্ব থেকে মুছে ফেলা যেতে পারে (It is possible, then, that for the first time in American history, a legitimate anti-racist majority is emerging…., where we can seek not merely to defeat the incumbent president Trump, but to erase his entire philosophy out of human existence)”। ২০২০র নির্বাচনে বর্ণবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পতনে কোটসের আশা হয়ত খানিকটা পূরণ হয়েছে। যদিও কোটসের মতে এ লড়াই প্রজন্মগত লড়াই। ট্রাম্পের পতনের সঙ্গেই এ লড়াই শেষ হয় না। এ লড়াই কেবল আমেরিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধেই নয়। এ লড়াই আরও বৃহত্তর লড়াই, এ লড়াই বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।
পৃথিবী যখন জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে, যখন আকাশে বাতাসে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” ধ্বনিত হচ্ছে, ঠিক এমনি সময় আমার মনে পড়ে আনন্দ তেলতুম্বদের (Anand Teltumbde) “The Persistence of Caste (কাস্টের অচলায়তন)” বইটিতে লেখা একটি বর্বর হত্যাকাণ্ডের কথা। এ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট আমেরিকা নয়। মিনিয়াপলিসের মতো পেল্লায় শহরের ঘটনা নয়। এই বর্বরতা ঘটে দশ হাজার মাইল দূরে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। এই ঘটনার ক্ষেত্র ভারতের এক ছোট্ট নগর। এই ঘটনাটা সাব অল্টারন সমাজের সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতি প্রশান্ত বদনে গ্রাস করার বর্ণহিন্দু পরম্পরা বজায় রেখেই আনন্দ তেলতুম্বদের বই থেকে আত্মসাৎ করলাম। হাথরাসের মতই এই ঘটনাটিও ঘটে সেপ্টেম্বর মাসে, তবে সালটা ২০২০ নয়, ২০০৬। ঘটনাস্থল মহারাষ্ট্রের একটি গ্রাম। নাম খৈরলাঞ্জি (Khairlanji)। জেলা ভান্ডারা (Bhandara)। আনন্দ তেলতুম্বদের ভাষায় ভান্ডারা জেলা উন্নতিশীল এবং সমৃদ্ধ। গড় শিক্ষার হার প্রায় ৮০% যা ভারতের শিক্ষার হার (৫৯.৫%) থেকে প্রায় ২০% বেশি। এমনকি গোটা মহারাষ্ট্রের শিক্ষার হারের (৭৭.২৭%) থেকেও বেশি। ভান্ডারায় দলিত সম্প্রদায়ের বাসের হার ২৫.২৬%, যা জাতীয় অংকের (১৬.৪৮%) তুলনায় বেশি। ভান্ডারা জিলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকার নিজেই এই জিলাকে ১৯৫৪ সালে তাঁর নির্বাচনক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। ভান্ডারা আম্বেদকরপন্থী আন্দোলনের একটি দুর্গ হিসাবে গণ্য করা হয়। আমেরিকার ওকলাহোমা রাজ্যের টালসা (Tulsa) ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের এক সমৃদ্ধ শহর। ১৯২১-এর ৩১ মে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় টালসা, ওকলাহোমা। ২০০৬-এর ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যালীলায় মত্ত বর্ণহিন্দু আধিপত্যবাদীদের তাণ্ডবে বিনষ্ট হয় মহারাষ্ট্রের ভাণ্ডারা জেলার খৈরলাঞ্জি গ্রামের এক দলিত পরিবার, ভূতমাঙ্গে পরিবার। এঁদের ওপর আছড়ে পড়া বর্ণহিন্দু তাণ্ডবের কথাই আজ আবার মনে করিয়ে দেবার সময় এসেছে। আনন্দ তেলতুম্বদের বই থেকে তুলে আনলাম এই মর্মভেদী অধ্যায় যা বর্ণহিন্দু সমাজে জন্মানো প্রতিটি মানুষকে শুধু নতুন করে ভাবাবেই না, হয়ত জাতপাতবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের ইন্ধনও যোগাবে। হয়ত মানুষ জেগে উঠবে। জাত, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে এক কণ্ঠে গর্জন করে উঠবে “দলিত জীবনের মূল্য আছে” ---- “দলিত লাইভস ম্যাটার”।
খৈরলাঞ্জি গ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৭৮৭। এর মধ্যে ১৮১ টি ওবিসি (OBC, Other Backward Class) পরিবার, যার ৭২০ জন সদস্য। দশটি আদিবাসী পরিবার, আর মোটে চারটি দলিত পরিবার; দুটি মাতঙ্গ পরিবার আর দুটি মাহার পরিবার, যার একটি ভূতমাঙ্গে পরিবার। দলিত সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ বাবাসাহেব আম্বেদকারকে অনুসরণ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। ভূতমাঙ্গে পরিবারও বৌদ্ধ। ভূতমাঙ্গে পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচ। পঞ্চান্ন বছরের ভাইয়ালাল ভূতমাঙ্গে, তাঁর চল্লিশ বছরের স্ত্রী সুরেখা ভূতমাঙ্গে, তাঁদের দুই ছেলে সুধীর (২১) আর রোশন (১৯), আর সতের বছরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা। সুধীর জন্ম থেকে অন্ধ তাই বাবা-মা কে চাষবাসে সাহায্য করা ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারতেন না। রোশন অবশ্য কলেজপড়ুয়া ছিলেন। প্রিয়াঙ্কা মেধাবী। সেই বছর দশম শ্রেণির পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী। গ্রামের সেচ খালের খুব কাছেই ভূতমাঙ্গেদের প্রায় বারো বিঘা চাষের জমি যা থেকে রোজগার মন্দ নয়। যদিও দলিত পরিবার হওয়ায় সেচের খাল থেকে দিনের বেলায় জল তোলার অধিকার তাঁদের ছিলনা। রাতের অন্ধকারে বা কাক-ভোরে উঠে জল ভরে চাষ করতেন ভাইয়ালাল আর সুরেখা। যা আয় করতেন তাতে সংসার ভালই চলছিল। নিজেদের একটা বাড়ি বানানোর টাকাও জমিয়েছিলেন ভাইয়ালাল আর সুরেখা। কিন্তু দলিতদের পাকা বাড়ি বানাতে দেওয়া মানে তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্বের মর্যাদা দেওয়া, যা বর্ণহিন্দু ছাড়া আর কারও প্রাপ্য নয়। ভূতমাঙ্গেদেরও পাকা বাড়ি বানানোর অধিকার দেয়নি খৈরলাঞ্জির পঞ্চায়েত যা বর্ণহিন্দুদের কব্জায়। বাস্তুভিটে বা হোম-ওনারশিপের সঙ্গে নাগরিকত্বের অধিকার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে শ্বেতাঙ্গ শাসক তৈরি করেছিল “রেড-লাইনিং,” যে অলিখিত আইনের বলে তৈরি হয়েছিল “হোয়াইট সুবারবিয়া” বা শেতাঙ্গ উপপুরী আর “ব্ল্যাক ঘেটো” অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ বস্তি। তাই তো হিন্দু ভারত আজ সিএএ আর এনআরসি তৈরি করে ভারতীয় মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার লিখিত আইন পাস করার পরিকল্পনা করে চলেছে। দলিত বা আদিবাসীদের ক্ষেত্রে অবশ্য নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কিছু নেই, ভারতীয় নাগরিকত্বের মর্যাদাই কোনদিন তাঁদের দেওয়া হয়নি। ভাইয়ালাল আর সুরেখার পাকা বাড়ি বানানোর স্বপ্ন পূরণ হয় নি। তবে পঞ্চায়েতের নিষেধ খানিকটা অগ্রাহ্য করে কাছের একটি নির্মাণক্ষেত্র থেকে ইট এনে একটা অপোক্ত বাড়ি তৈরি করে ফেলেন ভূতমাঙ্গেরা। পঞ্চায়েতের কথা অগ্রাহ্য করার অপরাধে ভূতমাঙ্গের বাড়ি শুধু ইট দিয়েই তৈরি হয়, সিমেন্ট লাগে না তার গায়ে, বিদ্যুৎ সংযোগও আসে না। আদর্শগত ভাবে সুরেখা একজন আম্বেদকার-অনুগামী। সুরেখা ছিলেন সমাজ সচেতন, অন্যায়ের প্রতি অসহিষ্ণু, নির্ভীক, আর স্পষ্টভাষী। তবু পরিবারের সুখ শান্তির কথা ভেবে তিনি চুপ থাকেন। তিনি চুপ করে থাকলেও, গ্রামের বর্ণহিন্দু পরিবারগুলো মোটেই চুপ করে থাকে না। শুরু হয় অকারণ বর্ণবাদী গালিগালাজ, মস্করা আর চলে ভয় দেখান। গ্রামের কুয়ো থেকে জল নিতে বাধা আসে। গ্রামের হিন্দু মহিলারাই নেতৃত্ব নেন এইসব অত্যাচারে। ভূতমাঙ্গেরা এইসব দৈনন্দিন অত্যাচারও বরদাস্ত করে চলেন। কিন্তু দিন দিন বাড়তে থাকে অত্যাচার। হিন্দু ছেলেরা ভূতমাঙ্গেদের ক্ষেতের ওপর দিয়ে যাতায়াত করা, ট্র্যাক্টর চালানো, গরু চরানো শুরু করে। অতিষ্ঠ হয়ে ভূতমাঙ্গেরা পুলিশে যান। কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
এরপর একদিন মাহাগু বিঞ্জেওয়ার নামের এক বর্ণ হিন্দুর উসকানিতে দশ থেকে পনেরজন ওবিসি গোষ্ঠীভুক্ত লোক চড়াও হয় সুরেখার ভাই সিদ্ধার্থ গাজভাইয়ার ওপর। সুরেখা আর প্রিয়াঙ্কার চোখের সামনে চলে বর্বর গণপিটুনি। প্রায় আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সিদ্ধার্থ গাজভাইয়াকে। এরপর শুরু হয় পুলিশ-আদালত। প্রায় এক মাসের দৌড় ঝাঁপ পুলিশি হয়রানি সহ্য করার পর ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০০৬ পনেরো জন অপরাধীর মধ্যে বারো জনের নামে আদালতে অভিযোগ দায়ের হয়। কিন্তু পরিহাসর বিষয় এই যে, যেসব অভিযোগে এই বারো জন অপরাধীকে অভিযুক্ত করা হয়, তার একটাও প্রিভেন্সান অফ আট্রসিটি (PoA) অ্যাক্টের আওতায় না হওয়ায় সবই জামিনযোগ্য। তিন ঘন্টার মধ্যে বারো জনই জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। এর পরের ঘটনা শুনলে আমাদের রক্ত হিম হয়ে যাবে। বর্ণহিন্দু বর্বরতার বিবরণ আনন্দ তেলতুম্বদের বই থেকেই পড়ে নিতে অনুরোধ করব। জামিনে মুক্ত বারোটি বর্ণহিন্দু পরিবারের পুরুষ, মহিলা, এমনকী নাবালকরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরেখা, সুধীর, রোশন, আর সতের বছরের প্রিয়াঙ্কার ওপর। ভাইয়ালাল সেই সময় বাড়ির বাইরে ছিলেন, বাঁচাতে পারেননি তাঁর পরিবারের কাউকে। বাড়ি থাকলেও বাঁচাতে পারতেন বলে মনে হয় না। হয়ত নিজেই বাঁচতেন না। বর্ণহিন্দু মহিলারা টেনে বের করে আনে সুরেখা, সুধীর, রোশন, প্রিয়াঙ্কার দলিত দেহগুলি, আর ছুঁড়ে দেয় তাদের পুরুষদের উন্মত্ত বাহুতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে।
জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যার ভিডিও কোন এক পথিকের আইফোনে রেকর্ড করা আছে, কিন্তু ১৯৫৫ সালের এমেট টিলের (Emmett Till) অমানবিক গণপিটুনি আর হত্যাকাণ্ডের না আছে কোন ছবি, না আছে কোন ভিডিও, ছিল শুধু সাক্ষ্যপ্রমাণ। আর ছিল এমেট টিলের ক্ষতবিক্ষত দেহ, যা তাঁর শোকাচ্ছন্ন মা গোটা পৃথিবীকে দেখাবার সাহস জোগাড় করেছিলেন। স্তম্ভিত বিশ্ব দেখেছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের নগ্ন রূপ। এমেট টিলের হত্যাকাণ্ড সদ্যোজাত নাগরিক অধিকার আন্দলনে একটা স্ফুলিঙ্গের মত কাজ করে। গোটা দেশ জেগে ওঠে, রুখে দাঁড়ায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। ১৯৬৩ সালে লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ মিলিত হন রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি তে। ডক্টর মার্টিন লুথার কিং দেন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা, “আই হ্যাভ এ ড্রিম”। পরের দু বছরের মধ্যে পাস হয় সিভিল রাইটস বিল যা এতকাল কেবল শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য বরাদ্দ ছিল সেই সমস্ত নাগরিক অধিকার আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়েরও প্রাপ্য বলে ঘোষণা করে। সিভিল রাইটস বিল আমেরিকায় প্রবেশের দ্বার, যা এতকাল কেবল ইউরোপর শ্বেতাঙ্গ শ্রেণির জন্য অবারিত ছিল, তা খুলে দেওয়া হল পৃথিবীর সকল মানুষদের জন্য। সেই সিভিল রাইটস বিলের জোরে আজ লক্ষ লক্ষ এশিয়ান, আফ্রিকান, ল্যাটিন আমেরিকান অ-শ্বেতাঙ্গ অভিবাসী আমেরিকার নাগরিকত্বের অধিকার অর্জন করেছে। এমেট টিল, ডক্টর মার্টিন লুথার কিং আর অগণিত কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান যারা তাঁদের জীবন দিয়েছেন নাগরিক অধিকারের জন্য, তাঁদের কাছে প্রত্যেক আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে।
এমেট টিলের মতই, সুরেখা, সুধীর, রোশন, আর প্রিয়াঙ্কার দেহের ওপর বর্ণহিন্দু অত্যাচারের ভিডিও নেই। আছে চাক্ষুষ সাক্ষী। আনন্দ তেলতুম্বদের বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে সেই অমানবিক সন্ত্রাসের বিবরণ। শুধু ধর্ষণ, গণপিটুনি আর খুন করেই খৈরলাঞ্জির বর্ণহিন্দুরা পরিতৃপ্ত হয়নি। গণধর্ষণের পর তারা সুধীর আর রোশণের ওপর শুরু করে অকল্পনীয় অত্যাচার; দুজনকে হুকুম দেওয়া হয় তাদের মা ও বোনকে ধর্ষণের। সুধীর আর রোশন জীবন দেবে তবু এমন হুকুম পালন করবে না। আদেশ পালন না করায় তাদের যৌনাঙ্গ থেঁতলে দেওয়া হয়। এই মর্মান্তিক হত্যালীলা চলে গ্রামের সকলের চোখের সামনে। নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে গোটা খৈরলাঞ্জি গ্রামের অধিবাসী। গোটা গ্রামবাসীর চোখের সামনে এমন তাণ্ডব তো প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা হতে পারেনা। গণধর্ষণ, গণহত্যা, অঙ্গছেদ তো কাম বা স্যাডিজম হতে পারেনা। এই মনোবৃত্তির পেছনে আছে যুগ যুগ ধরে বর্ণহিন্দুদের মজ্জায় মজ্জায় ভরে দেওয়া মনুসংহিতার বিষ যা অবর্ণ দেহকে অচ্ছুত, ম্লেচ্ছ আর অস্পৃশ্য ভাবতে শেখায়। অবর্ণের মানবাধিকার অর্জনের চাহিদাকে স্পর্ধা বলে মনে করায়। প্রকাশ্যে ধর্ষণ, হত্যা, এবং অঙ্গছেদই এমন অবর্ণ দেহের একমাত্র প্রাপ্য। সংক্ষেপে, বর্ণহিন্দুর চোখে অবর্ণ দেহের কোন দাম নেই, দলিত দেহের কোন দাম নেই, দলিত জীবনের কোন মূল্য নেই।
সন্ত্রাসের পরের দিন প্রিয়াঙ্কার ক্ষত বিক্ষত নগ্ন দেহের হদিস মেলে পাশের গ্রামের খালার ধারে। প্রিয়াঙ্কার মৃতদেহের হাতে ট্যাটু করা তারই নাম; প্রিয়াঙ্কা। বাবা ভাইয়ালাল মেয়ের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। পরদিন আরও তিনটি মৃতদেহ পাওয়া যায় সেই একই খালে, সুরেখা, সুধীর আর রোশনের বিবস্ত্র মৃতদেহ। খৈরলাঞ্জি সন্ত্রাস আর হত্যাকাণ্ডের পরের ঘটনাও কম বেদনাদায়ক নয়। পুলিশ, আইন, আদালত, বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী, দলিত-দলিতবিরোধী ইত্যাদির খপ্পর পেরোতে পেরোতে বছরের পর বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আজও ভাইয়ালাল ভূতমাঙ্গে পাননি ন্যায়বিচার। আনন্দ তেলতুম্বদে নথিবদ্ধ করেছেন সেই ইতিহাসও।
খুবই ভালো লেখা, আর মানুষের দুর্ভাগ্য, সময়োচিতও। এইসব বৈষম্যের বিভৎসতা আরো কতদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে কে জানে।
একট ছোট জিনিস মনে হলো। 'জর্জ যতই লম্বা চওড়া হন না কেন, ছিলেন অত্যন্ত নরম প্রকৃতির। চারজন পুলিশ জর্জকে ধরে সহজেই রাস্তায় আছড়ে ফেলল।' - এইটা বোধয় ঠিক না, জর্জ রেজিস্ট করেছিলেন, খুব সহজে আছড়ে ফেলা ওরকম ঠিক না।
সামান্য ব্যাপার, তবে তথ্যনিষ্ঠ লেখা তো, তাই চোখে লাগলো, এই বাক্যটা বাস্তব জর্জের ওপর একটু কল্পনা চাপানো মনে হলেও হতে পারে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
রাজা ভট্টাচার্য্য কি ভারতবর্ষ বইয়ের রাজাদা?
ঠাকুরের অত্যাচারের ঘটনাও লিপিবদ্ধ করুন। পরের পর্বের প্রতীক্ষায় থাকবো।
একটা ছোট পরীক্ষা করে দেখা যায়। খইরলাঞ্জি নামটা শুনলে কতজন মনে করতে পারেন ( অবশ্যই এই লেখা পড়ার আগে ) সেখানে কি হয়েছিল? মনে হয়না শতাংশের হিসেবে খুব বেশি হবে। ...পরের পর্বের অপেক্ষায়।
এবং ...আমাদের রাষ্ট্রপতি একজন দলিত সম্প্রদায়ের লোক !! এবং আমাদের রোহিত ভেমুলা একজন দলিত ।..এবং এখনো আমাদের দেশের অনেক গ্রামে গঞ্জে নিচু জাত বা অচ্ছুৎ বলে যাদের সম্বোধন করা হয় ।..তারা এই ধরনের হিংসার শিকার হচ্ছেন দিন রাত !!স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত .....কেউ না ।..কোনো ডান -বাম -মধ্য পন্থী পার্টি না ।..কোনো বুদ্ধিজীবী না ।..কোনো গায়ক - নায়ক না।.. কেউ এগিয়ে এসে এই চরম জাতি বিদ্বেষ কে আঘাত হানতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন নি !!আক্ষেপের বিষয় !!বর্তমান সরকার এই বর্ণ বিদ্বেষ কে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছে ।..সঙ্গে মুসলিম বিদ্বেষ !! আমরা বুলেট ট্রেন চালাব ।।.চন্দ্রায়ন করছি ((লোম ছিড়ছি দাদা )) ... বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্তি বানিয়ে দেশ উদ্ধার করছি ।..কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে ওই খুনি দাড়িওয়ালা 'র জন্য বিমান কিনতে সচেষ্ট হচ্ছি ।.সাংসদ গন স্থুল পাছা নিয়ে এস ।ইউ ।ভি চড়ে রাজনৈতিক বেলেল্লা পানা করছেন ।..নির্লজ্যের মতো দেশ টাকে ধর্ষণ করে চলেছেন ।..এবং আমরা দেখে যাচ্ছি !!তেলটুম্বদে স্যার , এই জন্য আপনাকে ওরা জেল বন্দি করে ।..এই জন্য ওরা ভারভাড়া স্যার কে কথাবলতে দেয় না !!কারণ , সত্যি কথা গুলো বলে ফেলেন ।..ওদের বিপদ হয় !! বিচার ব্যবস্থা মনেকরে আপনাদের তুলনায় অর্ণব গোস্বামীর মতো একটা বদমাশ জেনিয়াস 'র মূল্য অনেক বেশি !!থু : থু :।..থুতু ফেলি এই সমাজ ব্যবস্থায় !! ঘৃণা করি এই সব জন প্রতিনিধি দের !! কামনা করি এদের আসন্ন মৃত্যুর !!!!
খুব ভালো লেখা আর বাস্তবিকই আমরা মানুষত্ব হারাচ্ছি।
সন্তোষবাবু, মৃত্যু কামনা করার দরকার নেই। পরিবর্তন আসুক, কিভাবে আসবে জানি না অবশ্য।