এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ফেলুদা, শার্লক হোমস আর স্টোনম্যান (প্রথম পর্ব) #বেরসিক

    প্রলয় বসু লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ জুলাই ২০২০ | ৪৮৪৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ফেলুদা, শার্লক হোমস আর স্টোনম্যান (প্রথম পর্ব)
    #বেরসিক

    ফেলুদা ধপ্ করে একটা শব্দে বইটা বন্ধ করে, নীচু টেবিলটার উপরে রাখা ডান পায়ের উপরে বাঁ পাটা লম্বা করে তুলে, তুড়ি মেরে সিগারেটের ছাইটা ছাইদানিতে ফেলে বললো, "শার্লক হোমস।"
    ফেলুদা এতক্ষণে ধরে দুটো বই প্রায় একসাথে পড়েছিল। দুমাস আগে বিহারের শিমূলতলায় একটা খুনের ব্যাপারে অপরাধীকে জুতোর সাইজের গোলমালের সাহায্যে ধরে দিয়ে, বেশ মোটা রোজগার করে বসে আছে। ওর এখন যা পারিশ্রমিক তাতে মাসে একটা কেস হলেই চলে যায়। যদিও গত দুমাসের মধ্যে ফেলুদা কোন কেস নেয়নি। গত দুমাসে ও অনেক বই পড়েছে। যার অধিকাংশই ডিটেকটিভ গল্প, বাংলা এবং বিলিতি, দুই ভাষাতেই। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। খাতা কলম নিয়ে বসে পড়াশুনো করেছে। বই থেকে পড়ে রীতিমতো নোট করে রেখেছে। লেখালেখি করেছে। কয়েকটা মাসিক পত্রিকায় লেখা ছাপাও হয়েছে। তিন বার বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, চুল ছাঁটতে। একদিন নিউ মার্কেটে গিয়ে কয়েকটা সিরাপ কিনে এনেছে। আর দুবার সিধু জ্যাঠার বাড়িতে গিয়েছে, বইয়ের জন্যে। সিগারেট খাওয়া কমিয়েছে, দশটার থেকে আটটায় নেমেছে আর খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছে।

    আজ রবিবার, ৩ জুন, সকাল সাড়ে নটা। গরমের ছুটি চলছে। বাবা যথারীতি সুবিমলকাকুর বাড়িতে তাস খেলতে গেছে। আমি আমাদের বৈঠকখানার তক্তপোশে বসে, আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায় পরে থাকা এক গাদা পুরনো চিঠি থেকে, নেপালের স্ট্যাম্প খুঁজে আমার ডাকটিকিটের খাতায় আটকাচ্ছি। ফেলুদা একটা সোফায় বসে আছে। বই দুটোই খবরের কাগজের মলাট দেওয়া, তাই নাম গুলো পড়তে পারিনি। আমি প্রশ্ন করলাম "তুমি বুঝি এতক্ষণ শার্লক হোমসের কোন গল্প পড়ছিলে?"

    ফেলুদা চারমিনারটা থেকে পরপর দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে, চোখ বুঁজে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে বললো, "কলকাতায় শার্লক হোমসের নামে একটা ক্লাব ছিল জানিস?" আমি জানতাম না। কিন্তু আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফেলুদা বলে চললো, "১৯৮৩ সালে সৃষ্টি হলো একটা ক্লাব। বারোয়ারি পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠানের জন্যে অথবা বসে আঁকো প্রতিযোগিতা আর অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে না। বরং এই ক্লাবটি সৃষ্টি হলো বাঙালিদের মধ্যে আরো গোয়েন্দা গল্পের চর্চার জন্যে। শার্লক হোমস এবং পৃথিবীর আরো সমস্ত বিখ্যাত গোয়েন্দাদের নিয়ে চর্চা করার জন্যে। ভাবতে পারছিস গোয়েন্দা চর্চার জন্যে ক্লাব? অবাক হলেও কিন্তু এটাই সত্যি। আর নামকরণের জন্যে বেছে নেওয়া হল এমন একটি নাম যিনি সব গোয়েন্দাদের প্রতীক। শার্লক হোমস। অধিকাংশ বাঙালী তাঁর গল্প না পড়ে থাকলেও, নামটা অন্তত শুনেছেন। তাই সংঘের নাম হলো 'হোমসিয়ানা'। সুকুমার সেন, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, সন্তোষ কুমার ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমরেশ বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, বাদল বসু, দেবীপদ ভট্টাচার্য, অরুণ কুমার মিত্র, দিলীপ কুমার বিশ্বাস প্রমুখ ছিলেন সেই ক্লাবের সদস্য। চলতো, নিয়মিত গোয়েন্দা গল্প পাঠ এবং তার পর্যালোচনা।"

    আমি অবাক হয়ে বললাম, "ক্লাবের নাম 'হোমসিয়ানা' ছিল?"

    ফেলুদা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, "শোন, ‘হোমসিয়ানা’ নামকরণের কারণ ব্যাখ্যার জন্যে সুকুমার সেন একটা ছড়ায় এর রহস্যভেদ করেছেন
    "...মানবজ্ঞানের কৌতূহলী/
    শার্লক হোমসের চেলা/
    হোমসিয়ানা নাম দিয়ে তাই/
    বন্ধু পাঁচের খেলা।”
    'হোমসিয়ানা' নামকরণের আরো একটা ব্যাখ্যা আছে অবশ্য। একাধারে হোমস আর 'রামসিয়ানা' দুয়ে মিলে 'হোমসিয়ানা'। 'রামসিয়ানা' কে যদি রাম সেয়ানা বা অতি চালাক, ধূর্ত ভেবে থাকিস, তাহলে কিছু ভুল ভাবিসনি। ঠিকই ধরেছিস। আর একটু শোন, 'রামসিয়ানা' নামে একটা ঠগী সম্প্রদায় ছিল। তাই, 'হোমসিয়ানা' নামের মধ্যে মিশে আছে হোমসের মতো শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দার নাম, আবার অন্যদিকে ঠক বা অপরাধী সম্প্রদায়ের নাম। এহেন ক্লাবের প্রথম বৈঠক ছিলো, ১৯৮৩ সালের ২৭ শে আগস্ট, শনিবার। তোর মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে কেন সেই দিন? তারও উত্তর দিয়েছেন সুকুমার সেন। ১৯৮৩ সালের ২৭ আগস্ট ছিল, নষ্ট চন্দ্রের তিথি। তাই শুভ লগ্ন। প্রশ্ন করবি, কেন শুভ লগ্ন? তার উত্তরে বলবো, নষ্ট চন্দ্র নাকি চোরেদের দিন (রাত)। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নাকি সেই দিনেই 'চৌর্যবৃত্তি' তে নেমেছিলেন। সুতরাং যারা গোয়েন্দা হয়ে চোরদের তাড়া করবেন, তাঁরা তো সেই দিনটাকে বাছবেনই। আরো আছে, বাংলা ভাষায় প্রথম বারোয়ারি গোয়েন্দা উপন্যাস 'পাঞ্চজন্য' এই হোমসিয়ানা সংঘের ফসল। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। শার্লক হোমসের প্রকাশিত হবার শতবর্ষের, হোমসিয়ানার শ্রদ্ধাঞ্জলি ছিল 'পাঞ্চজন্য'। আর শার্লক হোমস যে ১৮৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই তোর মতো উজবুককেও মনে করিয়ে দিতে হবে না। সেই উপন্যাসের লেখকদের তালিকায় ছিলেন সুকুমার সেন, সমরেশ বসু, আনন্দ বাগচী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, সুভদ্র কুমার সেন। তবে এরপরে, সমরেশ বসুকে দিয়ে শুরু করে, সদস্যেদের একের পর এক মৃত্যু এই ক্লাবকে বেশী দিন সচল থাকতে দেয়নি।"

    আমি যদিও উজবুক না, তবু ফেলুদার কোন কথাই আমার খারাপ লাগে না। আসলে আমার এই খুড়তুতো দাদাটির সব কথাই আমার ভালো লাগে। ফেলুদার মুখে শার্লক হোমস সম্বন্ধে এতো কথা শুনেছি যে, এই নামটা শুনলেই চোখের সামনে কতো গুলো শব্দ চারিদিকে ভেসে ওঠে।

    ফেল্ট হ্যাট, মুখে পাইপ, কোকেনের নেশা আছে, ভাবুক, দারুন ভায়োলিন বাজাতে পারেন, গন্ধ শুঁকে তামাকের জাত বলে দিতে পারেন, কল্পনাপ্রবণ, রোগা-লম্বা, স্বভাবে বোহেমিয়ান, থাকেন নিজের খেয়ালে, রসায়ন বিজ্ঞানে পারদর্শী, প্রায় নির্ভুল অনুমান ক্ষমতা, অপরিচ্ছন্ন, অবিবাহিত, পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা অপরিসীম, হৃদয়বান। হোমসের বাড়ির ঠিকানা, ২২১/বি বেকার স্ট্রিট। আর মনে পড়ে কতো গুলো মুখ, তাঁর সহকারী ডঃ ওয়াটসন, বাড়িওয়ালি মিসেস হাডসন, তাঁর দাদা মাইক্রফট হোমস, তাঁর থেকেও বেশী বুদ্ধিমান, তবে ভীষণ কুঁড়ে আর তাঁর সবচেয়ে সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রফেসর জেমস মরিয়ার্টি।

    ফেলুদার মুখেই শুনেছি, যদিও, প্রথম হোমসের গল্প লেখা হয় ১৮৮৭ সালে, তবু কাহিনী অনুসারে হোমস ওই বাড়িতে ১৮৮১ সাল থেকে ১৯০৩ অবধি ছিলেন। আরো একটা মজার জিনিস আছে, হোমসকে নিয়ে কোনান ডয়েল ১৮৮৭ থেকে ১৯২৭ সাল অবধি লিখলেও, গল্প অনুযায়ী হোমসের সময়কাল ছিল ১৮৭৮ থেকে ১৯০৭ সাল, আর একেবারে শেষ ঘটনাটি ১৯১৪ সালের। এটাও শুনেছি যে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯–১৯৩০), এডগার অ্যালান পো আর এমিল গাবরিওর লেখা পড়েই গোয়েন্দা গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন। শার্লক হোমস চরিত্রটাই উনি নাকি সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর ডাক্তারি পড়ার সময়ে দেখা শিক্ষক ডঃ জোসেফ বেলের আদলে। ডঃ বেলের চমৎকারী পর্যবেক্ষণ দেখে, এই চরিত্রটাকে সেই ভাবেই গড়তে চেয়েছিলেন। ফেলুদা বলছিল, "কিন্তু এর পরেও তৈরী হয়েছে আরো অনেক ক্লাব, সোসাইটি। শার্লক হোমসের কাজ নিয়ে, শার্লক হোমসকে নিয়ে আলোচনা করার জন্যে, গবেষণা করার জন্যে। থেমে নেই। চলছে। হোমসের প্রতি অনুরাগ বাঙালীর কখনো যাবার নয়।"

    ফেলুদাকে এখানে থামতে হলো, কারণ বাইরে একটা ট্যাক্সি থামার আওয়াজ এলো আর তার আধ মিনিটের মধ্যেই কলিং বেলটা পরপর দুবার বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি প্রখ্যাত রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের লেখক লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ু এসেছেন। বাইরে সবুজ অ্যাম্বাসাডরটা না দেখতে পেয়ে, একটু ভুরু কুঁচকে চাইতেই উনি বললেন, "ওটা সার্ভিসিং এর জন্যে গ্যারেজে। কিন্তু আমি আর না থাকতে পেরে চলেই এলাম।" পকেট থেকে একটা নীল রঙের রুমাল বের করে, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন। লালমোহনবাবু থাকেন গড়পারে, লেখার জন্যে ব্যস্ত না থাকলে প্রায় প্রতি রবিবারেই চলে আসেন আমাদের বাড়িতে গল্পগুজব করতে। ওনার মুখের চওড়া হাসি দেখেই বুঝেছিলাম সুখবর। তবে সেটার কারণ বুঝতে পারিনি।

    ফেলুদা লালমোহনবাবুকে দেখেই বললো, "সুখবর যে বুঝতেই পারছি। নতুন ব্লেড দিয়ে কাটা ক্লিন শেভড গাল, ওল্ড-স্পাইস কোলনের সুগন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। পরপর দুবার কলিং বেলের আওয়াজেই বুঝতে পেরেছিলাম, কোন একটা সংবাদ জানাতে আপনি ব্যাগ্র। তবে সেটা সুসংবাদ না দুঃসংবাদ বুঝিনি, এখন আপনার মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে সুখবর। আর আপনি সাধারণত নটা নাগাদ আসেন, কিন্তু এখন দশটা বাজতে চৌদ্দ মিনিট বাকি। সুতরাং আপনি বাড়িতে কোন কারণে আজ অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করতে গিয়েই আপনার দেরী হয়েছে। আপনি যখন অপেক্ষা করছিলেন তখন নখ কাটছিলেন। আপনার ডান হাতের সব কটা নখ সমান করে কাটা অথচ বাম হাতের কড়ে আর তার পাশের আঙুলে এখনো নখ লেগে আছে। অর্থাৎ খবরটা পেয়েই আপনি তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছেন।" ফেলুদার এরকম পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যাই। একঝলক দেখেই ও মানুষের ছোটখাট এই পরিবর্তন গুলো লক্ষ্য করে নিতে পারে আর সেই মানুষটা সম্পর্কে অনেক তথ্য বলে দিতে পারে। আমি খালি লালমোহনবাবুর মুখের হাসিটাই লক্ষ্য করেছিলাম, কিন্তু ও সেখানে সব কিছুর নজর করেছে।

    খানিকটা অবাক হলেও, ফেলুদার কথায় লালমোহনবাবুর মুখের হাসিটা গেলো না। সোফায় বসতে বসতে বললেন, "ইনক্রেবিডেল ব্যপার মশাই।" ভদ্রলোকের ইংরেজিটা শুধরে দেবার আগেই দেখি, পাঞ্জাবির পকেট হাতড়িয়ে কিছু একটা খুঁজছেন মনে হলো। আর সেটা না পেয়ে খানিকটা বিরক্ত হলেও মুখের হাসিটা ঠিক ধরে রাখলেন। ফেলুদা ওঁর দিকে তাকিয়ে বললো, "আপনি যেটা খুঁজছেন সেটা ওই চেয়ারের পায়ায় লটকে আছে। ঘরে ঢুকে রুমাল বের করার সঙ্গে সঙ্গেই ওটা বেরিয়ে এসেছে আপনার পকেট থেকে।" কাগজটা তুলে নিয়ে দেখলাম, লেখা আছে "সেন্ডিং ফাইভ টুমরো মর্নিং। সোল্ড ফোর থাউজেন্ড কপি ইন থ্রি উইকস্"। তারিখটা দেখলাম আজকের। এবার বুঝতে পারলাম প্রকাশক নোটটি পাঠিয়েছেন আজ সকালে, আর এই চিঠির অপেক্ষা করতে গিয়েই আজ আমাদের বাড়ি আসতে দেরি করেছেন ভদ্রলোক। ফাইভ মানে যে পাঁচ হাজার টাকা, সেটাও বুঝতে পারলাম। লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, "সেলিং লাইক পান্না'স সুইটস্।" সম্প্রতি উনি বেহালার পান্না সুইটস্ এর মিষ্টি খেয়েছেন। তারপর থেকে ওঁর ধারনা হয়েছে, পান্না সুইটসের মতো আর মিষ্টির দোকান ভূভারতে নেই। অবশ্য আমাদেরও উনি সেখাকার মিষ্টি খাইয়েছেন। এবং ফেলুদাকে বেশ তৃপ্তি করে খেতে দেখে বুঝেছি, ফেলুদাও লালমোহনবাবুর সাথে এ ব্যাপারে সহমত।

    এতক্ষণে লালমোহনবাবুর মুখের হাসির কারণটা পরিষ্কার হলো। গত বৈশাখ মাসে ওঁর 'হায়নার হুঙ্কার' বইটি বেরিয়েছে। এই বইয়ে প্রখর রুদ্রকে একটা কুড়ি ফুট লম্বা হায়নার সাথে লড়াই করতে হয়েছে। লালমোহনবাবু বলেছিলেন এই হায়নার আইডিয়াটা উনি স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল' এর হাউন্ড কুকুরের থেকে পেয়েছেন। আর সেই কারণেই এই বইটা উনি 'স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে' উৎসর্গ করেছেন। যদিও এই গল্পটা বেশ জমেছিল, তবু সেই বই তিন সপ্তাহের মধ্যে চা-র হা-জা-র কপি বিক্রি হয়েছে শুনে বেশ অবাকই হলাম।

    লালমোহনবাবু আবার বললেন, "শার্লক হোমসের এ হেন মহিমা হবে কে জানতো বলুন তো? তবে আমার মতো করে বোধহয় শার্লক হোমসকে কেউ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করেননি, কি বলে ফেলুবাবু? জয়তু কোনান ডয়েল, জয়তু শার্লক হোমস।"
    আমি কোনক্রমে হাসি চেপে রাখলেও, ফেলুদা বললো, "এ তো ভক্তিরস হয়ে যাচ্ছে। আপনার তো ওতে কাজ হবে না। আপনার তো চাই শক্তিরস।" ভদ্রলোক হেঁ হেঁ করে হেসে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ফেলুদা বলে উঠলো, "শুধু আপনি নন লালমোহনবাবু, আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসকে, কে যে, কবে বাংলা সাহিত্যে টোকেনি, সেটাই রহস্য। অবশ্য শুধু বাংলা সাহিত্যের বলি কেন, বহু বিদেশী সাহিত্যই শার্লক হোমসের আদলে গড়ে উঠেছিল। আমাদের দেশের সাহিত্যের কথা বলার আগে, যদি ইয়োরোপ-আমেরিকার মাটিতে শার্লক হোমসের প্রভাব কি হয়েছিল বলি তাহলেই আপনার মাথা বনবন্ করে ঘুরবে। প্রভাব দুরকম ভাবে পড়েছিল।

    স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম ধরনে, শার্লক হোমসের পথ আঁকড়ে, পথ অনুসরণ করে। আবার কেউ কেউ সেই পথেই চলে আর একটু নতুনত্ব আনার চেষ্টা করার কথা ভেবেছিলেন। রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যানের (১৮৬২-১৯৪৩) কথা শুনুন বলি। উনিও যে শার্লক হোমসের লেখাতে থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন তা অনস্বীকার্য। তবে উনি কেবল অনুপ্রাণিত না হয়ে, শার্লক হোমসের ধারাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে অসংখ্য মিল। আবার অমিল আছে, তবে কম। দুজন বলতে একদিকে শার্লক হোমসের সাথে রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যানের ডিটেকটিভ থার্নডাইকের আবার কোনান ডয়েলের সাথে রিচার্ড ফ্রিম্যানের। কোনান ডয়েলের মতো অস্টিন ফ্রিম্যানও ছিলেন একজন ডাক্তার। দুজনেই যে প্রতিভাবান গোয়েন্দার গোয়েন্দার জন্ম দিয়েছিলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসু এবং বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে নেন। এবং দুজনেই ছাত্রাবস্থায় এমন শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছেন, যাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, তাদের গোয়েন্দাকে প্রভাবিত করেছে। শার্লক হোমসের ক্ষেত্রে আর্থার কোনান ডয়েলের শিক্ষক ডঃ বেলের ভূমিকা যেমন সবাই জানে, ফ্রিম্যানের ডঃ থর্নডাইকের উপরেও, তাঁর শিক্ষক 'তীক্ষ্মদর্শী এবং বিশ্লেষণকারী' ডঃ টেলর একই রকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ফ্রিম্যানের সৃষ্টি ডঃ জন থর্নডাইক, শার্লক হোমসের মতোই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্ত সমস্যার সমাধানের পথে হেঁটে ছিলেন। তবে এই দুজনের যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশী 'চোখে পড়ে' সেটাই বলি। শার্লক হোমসের বিশ্লেষণ অনেকটাই মনের মধ্যে, মাথার ভেতরে, যা আমাদের চোখের দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু ডঃ জন থার্নডাইকের বিশ্লেষণ পাঠকের সামনে, চোখের উপর, চোখে পড়ে, সকলেই জানতে পারে। তবে, ফ্রিম্যানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাঁর গোয়েন্দা সৃষ্টির মধ্যে না। তার গোয়েন্দা গল্পের লেখার কৌশলের মধ্যে। গল্পের বর্ণনায়। যা গোয়েন্দা গল্পের ক্ষেত্রে নতুনত্ব।

    গোয়েন্দা গল্পে গোয়েন্দার প্রবেশের আগেই ঘটে যায়, অপরাধ। অর্থাৎ গোয়েন্দা যখন প্রবেশ করে, অপরাধ তখন 'হয়ে গেছে'। তাই গল্পে গোয়েন্দা 'আসার পর' গল্পের মধ্যেই আবার অপরাধের ঘটনা পর্যন্ত পিছু হটতে হয়, অপরাধের কারণ জানতে, পিছিয়ে যেতে হয়। এতে গল্পের স্বাভাবিক অভিমুখের বিপরীতে আবার যেতে হতো। গল্পের মূল স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আবার সামনে এগোতে হয় সমাধানের উদ্দেশ্যে। গোয়েন্দা গল্পের এই চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে এসে, ফ্রিম্যান এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন। গোয়েন্দার উপস্থিতিতেই, অপরাধ সংঘটিত করলেন। অবশ্যই গোয়েন্দার অগোচরে। এতে গল্পের স্বাভাবিক অভিমুখের বিপরীতে আবার যেতে দরকার পরে না। তবে গোয়েন্দাকে ঘটনার কাটাছেঁড়া করার জন্যে, 'ছানবিন' করতে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হয়। এই অভিনব প্রয়াস রীতিমত সাড়া জাগিয়ে তুলছিল। এই পদ্ধতিকে গবেষক এবং বিশেষজ্ঞেরা নাম দিলেন 'উল্টো রীতি'। রিচার্ড ফ্রিম্যান কেবলমাত্র এই 'উল্টো রীতি'র কারণেই গোয়েন্দা গল্পের ইতিহাসে চিরস্থায়ী থাকবেন। বাংলাতেও এই রকম ভাবে গোয়েন্দা গল্প এরপর লেখা হয়েছে বহু। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের বেশ কয়েকটা গল্পের মধ্যেই এমনটা দেখা গেছে।

    এবার বরং প্রভাবের দ্বিতীয় ধাপের কথা বলি। দু-চারটে নাম বলছি, দেখুন তো চিনতে পারেন কি না?
    আর্থার মরিসনের গোয়েন্দা মার্টিন হিউয়েট,
    আর্নেস্ট ব্রামার গোয়েন্দা ম্যাক্স ক্যারাডস,
    এডমন্ড ক্লোরিহিউ বেন্টলির গোয়েন্দা ট্রেন্ট,
    ফ্রিম্যান ক্রফ্টস্ এর গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ফ্রেঞ্চ,
    জ্যাক ফুত্রেলের গোয়েন্দা প্রফেসর ভ্যান ডুসেন,
    আর্থার বি রীভের গোয়েন্দা ক্রেগ কেনেডি,
    এদের মধ্যে মিলটা কোথায় বলুন দেখি?
    এরা সকলেই শার্লক হোমসের সমসাময়িক। এছাড়া?"

    আমি জানি ফেলুদা অনেক বিদেশি ডিটেকটিভের বই পড়েছে। তবে তা নিয়ে এভাবে কাটাছেঁড়া করেছে, তা জানতাম না। আমার মতো লালমোহনবাবুও নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলেন। উনিও নিশ্চয়ই এতোটা জানেন না। আমাদের চুপ থাকতে দেখে ফেলুদা আবার বলতে শুরু করলো, "এদের সকলেরই সৃষ্টি হয়েছিল, শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তা দেখে, সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। 'রাইভ্যালস অফ শার্লক হোমস', 'ফার্দার রাইভ্যালস অফ শার্লক হোমস' বা
    'আমেরিকান রাইভ্যালস অফ শার্লক হোমস' নামে প্রকাশিত হতো, সেই সব গল্প। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী কি সত্যিই হতে পেরেছিল? তাহলে বলতে হয়, নাম গুলো কি আপনি সত্যিই আদৌ জানতেন বা শুনেছেন? শুধু আপনি কেন, অধিকাংশ লোকই জানেনা, শোনেনি, মনে রাখেনি।"
    শ্রীনাথদা প্লেটে করে তিন গ্লাস লস্যি নিয়ে আসার জন্যে ফেলুদাকে একটু থামতে হলো। ফেলুদা এমনিতে চা পছন্দ করলেও, গত কিছুদিন হলো ওর এই গরমে লস্যির প্রতি একটা দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এক চুমুকে গ্লাসের অর্ধেকটা লস্যি শেষ করে, ফেলুদা আবার বলতে শুরু করলো, "আবার, শার্লক হোমসের 'সহস্রাধিক কেসে'র মধ্যে মাত্র ষাটটার খতিয়ান দিয়ে গিয়েছিলেন ডয়েল সাহেব। অনেকেই সেই 'অনাবিষ্কৃত কেস' নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। যার মধ্যে কোনান ডয়েলের ছেলে আড্রিয়ান কোনান ডয়েলও আছেন।"

    এটা আমি জানি। একে প্যাসটিস্ (Pastiche) বলা হয়। কোন এক অন্য গ্রন্থকার বা শিল্পীর অনুকরণে রচিত সাহিত্য বা শিল্প। মানে সেই লেখকের লেখার সাধারণ বৈশিষ্ট্য গুলো অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন করে লেখা। যেমন, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাবার পর ওনার অসম্পূর্ণ শেষ 'বিশুপাল বধ' কাহিনী নারায়ণ সান্যাল লিখেছিলেন। ফেলুদা আবার বলতে শুরু করলো, "তেমনই আবার, যে ফরাসি গোয়েন্দা-পুলিশ বিভাগকে কাঠগড়ায় তুলে, 'কনসালটিং ডিটেকটিভ' শার্লক হোমসের সৃষ্টি বলে অনেকে মনে করেন, সেই দেশের মরিস লব্লাঁ তৈরী করেন আর্সেন ল্যুপ্যাঁকে। ইনি কথায় কথায় শার্লক হোমসকে বোকা বানিয়ে, হার্লক সোমস করে দিয়েছিলেন। তবে মানুষ অত সহজে বোকা হয়নি। আর্সেন ল্যুপ্যাঁকে ভুলে গেলেও শার্লক হোমসকে ভুলে যায় নি।" এখানে বলে রাখি ফেলুদা আমাকে বলেছিল, শার্লক হোমসের সৃষ্টির গল্প। কেন শার্লক হোমসকে 'কনসাল্টিং ডিটেকটিভ' হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। তবে, আজকেই যে আবার এই গল্প শুনতে হবে ফেলুদার মুখে, তা তখনো জানতাম না। তাই সেই ঘটনার কথা এখন আর আমি লিখবো না। ফেলুদার বয়ানেই লিখবো পরে। ফেলুদার মুখে এই গল্প গুলো শোনার মজাই আলাদা।

    ফেলুদা আরেক চুমুকে গ্লাসের বাকি লস্যিটা শেষ করে ঠক্ করে টেবিলের উপর রেখে আবার বলতে শুরু করলো, "ক্যানন কাকে বলে নিশ্চয়ই জানেন? আপনার কাজে লাগতে পারে, জেনে রাখুন। ভাবছেন শার্লক হোমসের গল্পে তো পাইনি, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো। জুড়ে বসেছে বটে, কিন্তু উড়ে আসেনি। বরং মিশে আছে। শার্লক হোমসকে নিয়ে, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল মোট ষাট (৬০) টা গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে লিখেছিলেন। ৫৬টা গল্প আর চারটা উপন্যাস। প্রথমটা ‘অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট’। উপন্যাস। ছাপা হয়েছিল, ১৮৮৭ সালে। 'বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এ। শেষ গল্প ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ শসকম্ব ওল্ড প্লেস’। প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে, 'স্ট্র্যান্ড’ পত্রিকাতে। হোমসের ভক্ত বা অনুরাগী, যাদের কে 'হোমসিয়ান' বা 'শার্লকিয়ান' বলে ডাকা হয়, এই ৬০টা লেখাকে ভালোবেসে 'ক্যানন' বলে ডাকেন। এই ষাটটির মধ্যে, ছাপান্নটির কথক ছিলেন ওয়াটসন, দুটি বলেছেন স্বয়ং শার্লক হোমস নিজের বয়ানে ('দ্যা ব্লাঞ্চেড সোলজার্স' আর 'দ্যা লায়ন'স মেন') আর বাকী দুটি ('দ্যা ম্যাজারিন স্টোন' আর 'হিজ লাস্ট বো') বিধাতা নিজে, যিনি আমাদের আবহমান কাল ধরে গল্প শুনিয়ে আসছেন। 'দ্যা ম্যাসগ্রেভ রিচুয়্যাল' আর 'দ্যা 'গ্লোরিয়া স্কট'' আবার শার্লক হোমস নিজের স্মৃতি থেকে ওয়াটসনকে বলেছেন। আর ওয়াটসন বাকিটা পাঠকদের কাছে বর্ণনা করেছেন। আপনার আর ধৈর্যের পরীক্ষা নেব না। জানি আপনি বাংলায় শার্লক হোমসের অনুকরণ নিয়ে জানতে চান, সেটাই বলবো। তবু ছোট্ট করে ‘এক্সট্রাক্যাননিকাল ওয়ার্কস’ এর কথা বলে শেষ করবো।"

    আমি ভাবছিলাম, 'ক্যানন' শব্দটা না হয় জানতাম, ফেলুদাই একদিন বলেছিল। কিন্তু এই ‘এক্সট্রাক্যাননিকাল ওয়ার্কস’ আবার কী? লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন। "ফুটনোটের মতো এইটুকু বলে যাই, আর্থার কোনান ডয়েলের অন্য কিছু লেখার মধ্যে, লেখার চরিত্রের মধ্যে শার্লক হোমসের আভাস পাওয়া যায়। সেই লেখা গুলোকেই 'এক্সট্রাক্যাননিকাল ওয়ার্কস' বলে। তবে কোনান ডয়েল সচেতন ভাবে সেই লেখার সময়ে শার্লক হোমসকে নিয়ে এসেছিলেন না তাঁর অবচেতন মনে শার্লক হোমস 'বাসা বেঁধেছিল' বলে, তাঁর কলমের ডগায় চলে এসেছিল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আজও বিতর্ক হয়। আমি তো বিশেষজ্ঞ নই, কোন ভাবেই। উৎসাহী বলতে পারেন। আঁধার পছন্দ করি না। রহস্য দেখলেই তার সমাধান করতে ইচ্ছে হয়। তাই একটা ছোট্ট তথ্য দিয়ে যাই। কোনান ডয়েলের যে সাত-আটটি লেখাকে 'এক্সট্রাক্যাননিকাল ওয়ার্কস' বলা হয়, তার ছটিই উনি সেই সময়ে লিখেছিলেন, যখন উনি শার্লক হোমসকে 'মেরে' ফেলেছিলেন, শার্লক হোমসকে নিয়ে লিখতেন না।

    একজন কাল্পনিক গোয়েন্দার প্রভাব এতোটাই ছিল ভাবতেও আবাক লাগে। সারা পৃথিবীতে যে ঢেউ আছড়ে পরেছিল, তার প্রভাব পরেছিল, এই বাংলাতেও। স্বাভাবিক নিয়মেই। এতক্ষণ দূর থেকে হোমসকে দেখলাম। কারণ এই হোমস ইংল্যান্ডের মানুষ। ইচ্ছে হলেই ছোঁয়া যায় না। শার্লক হোমসকে ছুঁয়ে দেখা যায়, এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যারা শার্লক হোমসকে বাঙলার মাটিতে নিয়ে এসেছিলেন। অনুবাদই বলি কিংবা প্রেরণা, শার্লক হোমস এসেছিলেন। এবার বরং দেখি, হোমসকে বাংলা সাহিত্যে কি ভাবে টেনে আনা হয়েছে। হোমস কোন একদিনে হুট করে চলে আসেনি। সচেতন ভাবেই হোক অথবা অবচেতন মনে, লেখকদের কলমে এমনিতেই চলে এসেছেন তিনি। প্রথম কার লেখায় এসেছেন তা আমি নিশ্চিত না। তবে আমার পড়া গল্প গুলোর মধ্যে প্রথম যার লেখায় পেয়েছি, তাঁর লেখা এখন আর কেউ পড়ে না। পাঁচকড়ি দে। শার্লক হোমসকে সম্ভবত বঙ্গভূমিতে টেনে নিয়ে আসেন, এই পাচকড়ি দে-ই। তবে সত্যিই পাঁচকড়ি দে-ই প্রথম বাংলা ভাষায় শার্লক হোমসকে নিয়ে এসেছিলেন, না একজন দারোগা ছিলেন, নাম সম্ভবত প্রিয়নাথ, পদবীটা ঠিক মনে পড়ছে না। মুখোপাধ্যায় বা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি প্রথম শার্লক হোমসের গল্প নিয়ে লিখেছিলেন কি না, তা জানতে একবার তোর সিধু জ্যাঠার বাড়িতে ঢু মারার প্রয়োজন।" বলে ফেলুদা একবার আমার দিকে চাইলো। "যদিও অধ্যাপক সুকুমার সেন ব্যোমকেশ সমগ্রের ভূমিকাতে বলেছেন, "পাঁচকড়ি বাবু শার্লক হোমস কে ছোঁন নি........." তবু সেই যুক্তি মেনে নেওয়া কষ্টকর। পাঁচকড়িবাবু অন্তত তিনটে গল্পে শার্লক হোমসকে টেনে এনেছেন। পাঁচকড়িবাবুর এক গোয়েন্দার নাম ছিল 'কনসালটিং ডিটেকটিভ' গোবিন্দরাম আদিত্য। বইয়ের ভূমিকায় লেখক লিখেছিলেন, "একই গ্রন্থাগারের ইংরেজি ভাষার দুখানি সর্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ উপন্যাসের ছায়াবলম্বনে গোবিন্দরাম সঙ্কলিত ..."। এখানে 'কনসালটিং ডিটেকটিভ' কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ 'কনসালটিং ডিটেকটিভ' হিসেবে সকলেই শার্লক হোমসকে চেনেন। সুতরাং 'ইংরেজি ভাষার' 'কনসালটিং ডিটেকটিভ' কথার অর্থ, না বলেও অনেক কিছুই বলা দেওয়া হয়। এটা গল্পের মধ্যে না ঢুকেই সন্দেহ হবে। এরপর পাতা উল্টে গল্পের মধ্যে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, এ হল শার্লক হোমসের বঙ্গীয়করণ। এখানে ডিটেকটিভ গোবিন্দরাম আদিত্যর সহকারী ডঃ বসু। ডঃ ওয়াটসনের বাঙালি রূপ। এবার যে দুটি বইয়ের বা উপন্যাসের কথা বলা হয়েছে তা হল, ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ (১৮৮৭) আর ‘দ্যা সাইন অফ দ্যা ফোর’ (১৮৯০)। শার্লক হোমসের প্রথম দুটি গল্প। তৈরি হল ‘গোবিন্দরাম’ ১৯০৫ সালে। গোয়েন্দা গোবিন্দরামকে কিন্তু এখানেই রেহাই দেননি পাঁচকড়ি বাবু। এর পরেও গোবিন্দরামকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘মৃত্যু-বিভীষিকা’। এই গল্পের শেষে গোবিন্দরাম একটা কুকুরকে গুলি করে মেরেছিলেন। এর পরেও কি আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন আছে যে এটা ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিল’ এর অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছিল। এরপর 'প্রতিজ্ঞা-পালন' (১৯১৪) নামেও একটা গল্প লিখেছিলেন, গোয়েন্দা গোবিন্দরামকে নিয়ে। খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তার ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে আসরে নামতে হয়েছিল বৃদ্ধ গোবিন্দরামকে। এখানে 'সুকৌশলী ডিটেকটিভ' কৃতান্তকুমার ছিল তার 'ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী'। অবশ্য গোবিন্দরাম থাকলেও এটা হোমসের গল্প না। যেমন, গোবিন্দরামকে নিয়ে লেখা ‘সতী সীমন্তিনী’ ও হোমসের গল্পের আদলে লেখা নয়। 'হরতনের নেওলা' গল্পটিও শার্লক হোমসের গল্পের অনুবাদ বলে অনেকেই মনে করেন। অধিকাংশই ‘দ্যা সাইন অফ দ্য ফোর’ এর দিকে আঙুল তুলেছেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। তিনটে গল্পের কথা বলে, এখনো পর্যন্ত দুটোর উদাহরণ দিয়েছি। তারপর থেকে 'না না' করে চলেছি। সুতরাং রইলো বাকি এক। পাঁচকড়ি দে-র ‘কৃপণের মন্ত্র’ বরং শার্লক হোমসের ‘দ্যা অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্যা মাসগ্রেভ রিচুয়াল’ এর অবলম্বনে লেখা, নিঃসেন্দহে বলা চলে।

    এরপরে, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা গোয়েন্দা গল্প শার্লক হোমসের থেকে নেওয়া, এই অভিযোগ কোথাও ওঠেনি। কিন্তু তার গোয়েন্দা রবার্ট ব্লেকের ঠিকানা ছিল, বেকার স্ট্রিটেই। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা 'শ্যাক্সটন ব্লেক' (Sexton blake) থেকে নেওয়া, সকলেই জানে। রবার্ট ব্লেকের বেকার স্ট্রিটে বাড়ির পরিকল্পনাটা কার? 'শ্যাক্সটন ব্লেকে'র লেখকদের। কিন্তু ঠিক কে প্রথম বেকার স্ট্রিটে ব্লেককে বাড়ি 'বানিয়ে' দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু যারই হোক, এটা যে শার্লক হোমসকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো, তা আন্দাজ করতে পারি। এরপর, ১৯২৭ সাল। 'মৌচাক' পত্রিকায় ‘জলার পেতনি’ নামে একটি ধারাবাহিক গল্প লিখেছিলেন, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল'এর অনুবাদ। এখানে অবশ্য কুকুর নেই। বরং কাপড়ের প্রেতিনীমূর্তির সঙ্গে জুড়েছিলেন আগুনে মোড়া বিশাল একটি ষাঁড়। তবে বাঙালীর ঘরে ঘরে যিনি, শার্লক হোমসকে পৌছেঁ দিয়েছিলেন, তিনি কুলদারঞ্জন রায়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই। বেশ কয়েকটি শার্লক হোমসের গল্পকে, বাংলাতে অনুবাদ করেছিলেন কুলদারঞ্জন রায়। 'বাস্কারভিলের কুক্কুর' নামেই বোঝা যায় এটি 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল'এর অনুবাদ। এরপর 'এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ অনুবাদ করছিলেন ‘রক্ত সমীক্ষা’ নাম দিয়ে। 'চিহ্ন চতুষ্টয়' যে 'দ্যা সাইন অব দ্যা ফোর' এর অনুবাদ সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওনার অনুবাদ গল্প গুলো নিয়ে ‘শার্লক হোমসের বিচিত্র কীর্তি’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সাল নাগাদ।

    শার্লক হোমসকে কে না, নকল করেছে বলুন তো? সব বলতে বসলে একটা আলাদা বই হয়ে যাবে। অবশ্য অনুপ্রেরণা, অনুকরণ, অনুবাদ আর আত্তীকরণ আলাদা। তবে খাতা পেনসিল নিয়ে হিসেব করতে বসলে এমন অনেক লেখাই বেরিয়ে আসতে পারে, যা হয়তো সে ভাবে কল্পনাও করা হয় নি। আসছি সেই প্রসঙ্গে। আগে অনুবাদের তালিকাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

    হেমেন্দ্রকুমার রায়, শার্লক হোমসের দুটো গল্পকে অনুবাদ করেছিলেন। যদিও ঠিক অনুবাদ নয়, অনুবাদ হলে গোয়েন্দার নাম-ধাম ওই রকম বদল হয় কি? অনুকরণ বলা যায়। শার্লক হোমসের গল্পের ছাঁচটা নিয়ে তার উপর বাঙালিয়ানা চাপানো হয়েছিল। এখানে গোয়েন্দার নাম ভারত কুমার চৌধুরী। আর ডঃ ভাস্কর হলেন তার কথক। 'দ্যা সাইন অব দ্যা ফোর' রূপান্তরিত হয়ে ‘চতুর্ভুজের স্বাক্ষর’ হলো (১৯৫৬ সালে)। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। 'চতুর্ভুজের স্বাক্ষর' গল্পে হেমেন্দ্রকুমার রায়, একজন পুলিশের নাম দিয়েছেন গোবিন্দরাম গাঙ্গুলী। কেন দিয়েছিলেন জানি না। সমাপতন না পাঁচকড়ি দে-র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি? এরপর প্রকাশিত হলো ‘নিশাচরী বিভীষিকা’ ১৯৫৭ সালে। গোয়েন্দার নাম বদলে হলো ভারত ভূষণ, কিন্তু সঙ্গী একই ডঃ ভাস্কর। এখানে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মতো তিনিও কুকুরকে বদলে দিলেন। তবে আর ষাঁড় না, আমদানি করলেন ভালুকের। হ্যাঁ, এটা 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল'এর অনুকরণ। 'নিশাচরী বিভীষিকা' দেব সাহিত্য কুটীরের ‘বিচিত্রা সিরিজ’ এর তৃতীয় বই। তাঁর জয়ন্ত-মানিক জুটির 'নেতাজীর ছয় মূর্তি' যে ‘দ্যা অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্যা সিক্স নেপোলিয়ন’ এর তর্জমা, তা পড়লেই বোঝা যায়। এখানে বঙ্গীয়করণ করতে নেপোলিয়নের মূর্তি, নেতাজীতে পরিণত হয়েছেন। শুধু তাই নয়। আদ্যক্ষর 'ন' এর মিলটাও বেশ লক্ষণীয়। এই জুটিরই ‘ফিরোজা-মুকুট রহস্য’ শার্লক হোমসের ‘দ্যা অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্যা বেরিল করোনেট’ অবলম্বনে লেখা। এছাড়া ‘ব্রহ্মরাজের পদ্মরাগ’ গল্পে ‘অ্যা স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া’ গল্পের ছোঁয়া লক্ষ করা যায়।" এখানে বলে রাখি আমার হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। আমার কাছে ওনার লেখা বেশকিছু বই আছে। উনি লিখতেন মূলত ছোটদের জন্যে। শুধুমাত্র গোয়েন্দা গল্প নয়, ভৌতিক গল্প, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, হাসির গল্প, সব কিছু মিলিয়ে, তার ভান্ডার ছিল পরিপূর্ণ। আমি জানি বহু ইংরেজি সাহিত্যকে বাংলাতে রূপান্তরিত করেছেন উনি। শার্লক হোমসের গল্প ছাড়াও, অনুবাদ করেছিলেন আগাথা ক্রিস্টির গল্প। ‘হারাধনের দ্বীপ’ আসলে আগাথা ক্রিস্টির ‘টেন লিটল নিগারস’ এর অনুবাদ। ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ আবার ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’র বঙ্গীয়করণ। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা 'দেড়শো খোকার কান্ড' মূল লেখাটি, জার্মান ভাষাতে, এরিখ কাস্টনারের, 'Emil und die Detektive', ইংরেজীতে, 'Emil and the Detectives' আমার ভীষণ প্রিয়। ফেলুদা কতো পড়েছে! সেটাই ভাবছিলাম। শুধু পড়েনি সন-তারিখ পর্যন্ত মুখস্থ করে রেখেছে। এখন একটু থেমেছে, একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে।

    লালমোহনবাবু শুধু একবার বললেন, "বাওয়া, ইএত্তো লম্বা লিস্ট! বলেন কি ফেলুবাবু? কিসুই যে জানতাম না! এতো মনে রেখেছেন কী করে?" ফেলুদা চারমিনারটায় পর পর দুটো টান মেরে, চোখ বুজে আবার বলতে শুরু করলো, "নীহাররঞ্জন গুপ্ত আবার 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল' এর অনুসরণে লিখেছিলেন ‘পদ্মদহের পিশাচ’ আর সুধীন্দ্রনাথ রাহা লিখেছিলেন 'অভিশপ্ত বংশ'। এরপর আক্ষরিক অনুবাদ করে, শার্লক হোমসকে বাংলাতে নিয়ে এসেছিলেন বেশ কয়েক জন। আমার ব্যক্তিগত ভাবে অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদ, প্রথমে ‘শার্লক হোমস অমনিবাস’ ও পরে ‘শার্লক হোমস সমগ্র’ সটিক (২০১১), খুব পছন্দের হলেও, নৃপেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়ের 'শার্লক হোমসের কথা (১৯৬১), অমিয়কুমার চক্রবর্তীর 'অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস (১৯৬৪), মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অথবা কিশোরদের জন্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সম্পাদিত ‘শার্লক হোমসের কিশোর রচনা সমগ্র’ (১৯৮৮) পাঠকদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছিল। বাংলাতে শার্লক হোমস 'সমগ্র' অথবা ‘অমনিবাস’ নামে বহু সংকলন আছে, যার মধ্যে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃথ্বীরাজ সেন আর মনীন্দ্র দত্তের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে এর বাইরেও আলাদাভাবে শুধু ‘দ্যা হাউন্ড অফ দ্যা বাস্কারভিলস’ অনুবাদ করেছেন আরো অনেকেই। এর মধ্যে অমলেন্দু সেন (১৯৬৩), সুবোধ চক্রবর্তী, ঋষি দাস (১৯৮৩), শুভদেব চক্রবর্তী (১৯৮৩), শ্রীতম শ্রীতম অধিরাজ (২০০৩) এর লেখার খোঁজ পেয়েছি।" লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওনার মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে। লস্যির ফাঁকা গ্লাসটা টেবিলে রাখতেও ভুলে গেছেন। এখনো হাতেই ধরে রেখেছেন। ফেলুদা ওদিকে সমানে বলে চলেছে, "এ ছাড়াও যদি নাম করতে হয়, তাহলে রাজশেখর বসুর 'সরলাক্ষ হোম' যে বাঙালী শার্লক হোমস, সেটা অনেকেই বুঝেছেন। সহকারী বটুক সেন এর সাথে ওয়াটসনের নামের মিলটাও খুব কিন্তু খুব বেসুরো নয়। এ প্রসঙ্গে বলি, প্রহেলিকা সিরিজের জন্যে নৃপেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়ের 'শার্লক হোমসের কথা' তে নায়কের নাম ছিল নালক হোম আর ওয়াটসনের নাম বদলে রাখা হয়েছিল আশীষ সেন। পরশুরামের (রাজশেখর বসু) 'নীল তারা' গল্পে রাখাল মুস্তাফি ছিলেন স্কুলের মাস্টারমশাই। তাঁর এই গল্পে তিনি স্বয়ং শার্লক হোমস কে কলকাতাতে টেনে এনেছিলেন। হোমসকে অবশ্য সেখানে শরণাপন্ন হতে হয়েছিল মুস্তাফি স্যারের।

    আর সব শেষে, আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ। আমার বাংলায় গোয়েন্দা রহস্য উপন্যাস দুজন লেখকের লেখাই ভালো লাগে। প্রথমজন হলেন একমেবাদ্বিতীয়ম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় জন হলেন তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়, যিনি 'গুপ্তচর' ছদ্মনামে লেখেন। 'গুপ্তচর' এর লেখা হয়তো আপনিও পড়েছেন।" লালমোহনবাবু কোনরকমে ঘাড় বাঁকিয়ে হ্যাঁ বললেন, আর আমার মনে পড়ে গেলো ফেলুদার প্রথম কেসের ঘটনা। দার্জিলিংয়ে 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি'র ঘটনা। ফেলুদা বলে চলেছে, "ব্যোমকেশ নিজের দ্যুতিতে বর্তমান। অধ্যাপক সুকুমার সেন বলেছেন "হোমস আর ব্যোমকেশের মধ্যে ওই অনুপ্রাসের ঝংকার টুকু ছাড়া মিল সামান্যই"। চরিত্রগত অমিল বাদ দিলে গল্পের প্লট দিয়ে বিচার করলে কিন্তু কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়। খুব হালকা করে কখনো কখনো হোমসের ছায়া দেখা যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, 'সীমন্ত-হিরা'র সাথে 'দ্যা সিক্স নেপোলিয়নস্' এর এক সূক্ষ্ম সাদৃশ্য আছে। আরো কয়েকটার কথা বলবো। যদিও এই মিল আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে ধরা পরেছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত জানা নেই। আমি 'হাউন্ড অফ বাস্কারভিল' এর ছায়া দেখতে পাই, 'চোরাবালি'তে। ওখানে কুকুর এখানে বাঘ বা বলা যায় বাঘের ডাক। ওই গল্পের জলা এখানে বদলে গিয়ে শুকনো খটখটে বালি, চোরাবালি। তবে দুটো গল্পের লেখার ভঙ্গি একেবারেই আলাদা। ব্যোমকেশের 'অদ্বিতীয়'র সাথে 'এ কেস অফ আইডেন্টিটি'র অথবা 'দ্যা ম্যান উইথ দ্যা টুইস্টেড লিপ' এর মিল খুঁজে পাওয়া কি খুব কঠিন কাজ? ভাল করে পড়লেই খুঁজে পাওয়া যায়। 'অগ্নিবাণ' গল্পটার কথা মনে আছে? দেশলাই বাক্সের মধ্যে রাখা দেশলাই, যার ধোঁয়া নাকে গেলেই নিশ্চিত, নিঃশব্দ মৃত্যু। আর এরই পরের গল্প 'উপসংহার'? সেই বিষাক্ত দেশলাই কাঠি ব্যবহার করে ব্যোমকেশকে মারার চেষ্টা হলো। অপরাধীকে ধরতে মৃত্যুর অভিনয় করতে হলো, ব্যোমকেশকে। চেনা চেনা লাগছে প্লটটা? 'দ্যা ইলাসট্রিয়াস ক্লায়েন্ট' গল্পটা মনে পড়ে? শার্লক হোমসকেও অভিনয় করতে হয়েছিল অসুস্থতার। ডাক্তার মানুষ ওয়াটসনকেও ছুঁতে দেননি, যদি ধরা পরে যান, সেই ভয়ে। এছাড়াও 'মণিমন্ডন' আর 'দ্যা অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্যা ব্লু কার্বাঙ্কল' চুরি করে লুকিয়ে রাখা... 'ছলনার ছন্দ' আর 'দ্যা অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্যা কপার বিচেস' একরকম দেখতে বা সাজিয়ে রাখা... 'দুষ্টচক্র' আর 'দ্যা রেসিডেন্ট পেসেন্ট' স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেম্বার সাজিয়ে রাখা... খুব বেমানান লাগছে কি? হোমসের সাহায্যকারী 'স্ট্রিট বয়'-রা, ব্যোমকেশের গল্পে এসেছে বিকাশের বেশে কিংবা বিকাশের বন্ধুর পোষাকে। আরো আছে।" বলে ফেলুদা একটু থামলো। সম্ভবত মনে মনে পরের অংশটা সাজিয়ে নিচ্ছে। আমি এতো কিছু মনে রাখতে পারতাম না, ভাগ্যিস, আমাদের সেই 'টিনটোরেটোর যীশু' ঘটনার সময় ফেলুদা একটা ছোট্ট সোনি ক্যাসেট রেকর্ডার কিনেছিল হংকং থেকে। সেটাই আজ চালিয়ে রেখেছি। পরে সব শুনে খাতায় লিখে রাখতে হবে।

    "তবে, আগেই বলেছি অনুপ্রেরণা, অনুকরণ, অনুবাদ আর আত্তীকরণ আলাদা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আত্তীকরণ করেছেন। তাই অমাবস্যার রাতে মাটিতে যতটুকু ছায়া পরে, সেই টুকুই ধরা পরে, আর কিছু না। মিল কিন্তু কেবল গল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, মিল রয়েছে দুই লেখকের মধ্যেও। কোনান ডয়েলের মতো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও পছন্দ করতেন ঐতিহাসিক গল্প লিখতে। কথক ওয়াটসনের মধ্যে দিয়ে কোনান ডয়েল যেমন নিজের পরিচয় জানিয়েছেন পৃথিবীকে। তাঁর মতো, ওয়াটসনকেও ডাক্তার বানিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর প্রকৃত পরিচয়। শরদিন্দুবাবুও সম্ভবত সেই কারণেই অজিতকে লেখক দেখিয়েছেন। যদিও শরদিন্দুবাবু ওকালতি পাস করেছিলেন, কিন্তু প্র্যাকটিস করেননি। সহকারী ওয়াটসনের ব্যস্ততার কারণে শার্লক হোমস যেমন বাধ্য হয়েছেন নিজের কাহিনী লিখতে। অজিত বই ব্যবসায় ব্যাস্ত থাকার কারণে ব্যোমকেশকেও বাধ্য হতে হয়েছে 'গল্প' লিখতে। এরপরে আর একটা শেষ মিল দেখিয়ে শেষ করবো। তবে এই মিলটা লেখকদের নয়, হোমস আর ব্যোমকেশের।
    "That proces... starts upon the supposition that when you have eliminated all which is impossible then whatever remains, however, improbable, must be the truth."
    শার্লক হোমসের উক্তি। ব্যোমকেশ প্রায় একই কথা বলেছেন "... কোন বিষয়ের যুক্তিসম্মত প্রমাণ যখন থাকে অথচ তাহা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়, তবু তাহা সত্য বলিয়া ধরিতে হইবে"। তালিকা বড়ো করতে চাইলেই বড়ো হতে পারে। কারণ শার্লক হোমস বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।" এই পর্যন্ত বলে ফেলুদা চুপ করলো। তারপর হাতদুটোকে মাথার পেছনে রেখে, ঘাড়টা পেছন দিকে হেলান দিয়ে, মাথার উপর বনবন্ করে ঘুরে চলা পাখাটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বললাম সার্থক তোমার বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাস পড়া। এভাবেও কেউ মনে রাখতে পারে, আমার জানা নেই।

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৬ জুলাই ২০২০ | ৪৮৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | 161.65.***.*** | ১৭ জুলাই ২০২০ ০৪:৪৮95267
  • অসাধারণ হয়েছে!

  • ujjwal sen | ১৭ জুলাই ২০২০ ০৯:৩৮95269
  • সকালে উঠেই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। আচ্ছা ওই যে লিখেছেন That proces... starts upon the supposition that when you have eliminated all which is impossible then whatever remains, however, impossible, must be the truth." শেষের দিক থেকে চতুর্থ শব্দটা কি improbable হবে?

  • প্রলয় বসু | ১৭ জুলাই ২০২০ ১০:২৬95270
  • @অরিন, 

    অনেক অনেক ধন্যবাদ।

  • প্রলয় বসু | ১৭ জুলাই ২০২০ ১০:২৭95271
  • @Ujjwal Sen, একদম ঠিক। ওটা improbable হবে। অনেক ধন্যবাদ। ভুলটা ধরিয়ে দেবার জন্যে।

  • :)) | 185.22.***.*** | ১৮ জুলাই ২০২০ ০৯:৩৭95278
  • হোমসের টুপি, ফেল্ট হ্যাট নয় ডিয়ার স্টকার, ক্লথ ক্যাপ। যদিও ইনফর্মাল ইংরেজিতে ক্যাপকেও হ্যাট বলে।

  • রৌহিন | ১৮ জুলাই ২০২০ ১৪:১৪95285
  • খুব সুন্দর লাগল। একই সঙ্গে, ফেলুদাকে (বা সত্যজিৎকে) আপনিও চমৎকার আত্তীকরণ করেছেন এটা বলতেই হচ্ছে। আপনার এই প্যাসটিশটিও সার্থক

  • রৌহিন | ১৮ জুলাই ২০২০ ১৪:১৫95286
  • স্টোনম্যানের অপেক্ষায় রইলাম

  • প্রলয় বসু | ১৮ জুলাই ২০২০ ২০:২৬95299
  • এইরে আপনার নামটা কী করে লিখবো? তা সে যাক। 

    :)) বাবু, ঠিক বলেছেন। 'ডিয়ার স্টকার হ্যাট' হবে। তোপসেটা মহা বদমাশ। ঠিক্করে শোনেনি। 

  • প্রলয় বসু | ১৮ জুলাই ২০২০ ২০:৩০95300
  • রৌহিনবাবু, অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো আপনাকে হতাশ হতে হবে। স্টোনম্যান আসবে ... 

  • aranya | 2601:84:4600:9ea0:3038:2932:7fa7:***:*** | ১৯ জুলাই ২০২০ ০২:২৯95319
  • বেশ লেখা
  • সুমিত রায় | 103.135.***.*** | ২৭ জুলাই ২০২০ ১০:৪৪95601
  • পড়ে অসাধারণ লাগল। হোমস আর ব্যোমকেশের মধ্যে আমিও এরকম মিল পেয়েছিলাম। ডয়েলকে অনুসরণ অনেকেই করেছেন, কিন্তু সাহিত্যে রিয়েলিস্ট পারস্পেকটিভ থেকে সমালোচনার ক্ষেত্রে আমি ডয়েলকে শরদিন্দু, সত্যজিত সবার থেকে এগিয়ে রাখব। কেন? কারণ ডয়েল তার চরিত্রের কাজগুলোর সাথে তার সাইকোলজিকাল প্রোফাইলের সামঞ্জস্য এনেছিলেন, যেটা অধিকতর রিয়ালিস্টিক বা বাস্তব ছিল। আমার জানামতে অন্য কেউই তা সেভাবে দেখাতে পারেননি। 

    শার্লক হোমসের চরিত্র দিয়েই শুরু করা যাক। ওয়াটসন বলছেন হোমস তার লাইফস্টাইল ও হ্যাবিটে বোহেমিয়ান ধরণের, অর্থাৎ তার লাইফস্টাইল আনকনভেনশনাল। হোমসের অড বিহ্যাভিয়রের কারণে তিনি তাকে একসেন্ট্রিক বলছেন, বলছেন তিনি খুব এলোমেলো ধরণের, ঘর অগোছালো, পারিপাট্যের কোন বালাই নেই.... "The Adventure of the Musgrave Ritual" এ ওয়াটসন তার সম্পর্কে বলছেন, "in his personal habits one of the must untidy men that ever drove a fellow-lodger to distraction. [He] keeps his cigars in the coal-scuttle, his tobacco in the toe end of a Persian slipper, and his unanswered correspondence transfixed by a jack-knife into the very centre of his wooden mantelpiece. ... He had a horror of destroying documents.... Thus month after month his papers accumulated, until every corner of the room was stacked with bundles of manuscript which were on no account to be burned, and which could not be put away save by their owner."

    তিনি বলছেন, সাধারণ সময়ে হোমস ঠাণ্ডা আর উত্তেজনাহীন থাকেন, এদিকে ইনভেস্টিগেশনের সময় সাংঘাতিক সতেজ ও উত্তেজিত হয়ে যান। তার মধ্যে শোম্যানশিপ আছে, ইনভেস্টিগেশনের সময় তিনি তার মেথড, এভিডেন্সগুলো থেকে তার ডিডাকশন লুকিয়ে রাখেন, পরে শেষে সেটা বলে অবজার্ভারদেরকে ইমপ্রেস করেন। নৈতিকভাবে জাস্টিফায়াবল মনে হলে তিনি পুলিসকে মিথ্যা বলেন, এভিডেন্স লুকিয়ে রাখেন, অনুমতি ছাড়া কোন বাড়িতে ঢুকে পড়েন, ক্লায়েন্টকে প্রোটেক্ট করতে তিনি নিয়মও ভঙ্গ করেন (এই দিকগুলো কেবল হোমসের মধ্যে না, অন্য অনেকের মধ্যেই দেখা যায়, এগুলো অন্য একটা বিষয় আনার জন্য নিয়ে আসছি।)

    ওয়াটসন ছাড়া হোমস অন্য কারও সঙ্গ এড়িয়ে চলেন। গ্লোরিয়া স্কটের কাহিনীতে তিনি বলেছিলেন, গত দুই বছরে তিনি কেবল একজনকেই বন্ধু বানিয়েছেন... "I was never a very sociable fellow, Watson ... I never mixed much with the men of my year" 

    স্টিমুলেশন বা উদ্দীপনা সৃষ্টি করা কেস না পেলে তিনি হোমস সেই উদ্দীপনার অভাব মেটানোর জন্য ড্রাগ গ্রহণ করেন। কখনও কখনও মরফিন, এমনকি কোকেইন পর্যন্ত ব্যবহার করেন ( দুটোই ১৯ শতকের ইংল্যান্ডে বৈধ ছিল)। ফিজিশিয়ান হিসেবে ওয়াটসন তাকে কোকেইন নিতে নিষেধ করতেন, আর তার এই ড্রাগ ব্যবহারে অতিশয় বিরক্ত ছিলেন। কেস না পেলে তার ক্ষেপাটে হওয়া, ড্রাগ নেয়া ছাড়াও সারাদিন শুয়ে থাকা, ঘুমের কথাও বলা হয়েছে। (শরদিন্দুর লেখায়ও ব্যোমকেশের চা ও সিগরেটের প্রতি আসক্তি ধরা পড়ে, তবে এগুলো ড্রাগের কাছে কিছুই না)। 

    নারীর প্রতি হোমসের বিশেষ কোন অনুরক্তি ছিল না, ওয়াটসন বলছেন তিনি ব্যাবেজের ক্যালকুলেটিং মেশিনের মত, আর একেবারেই প্রেমে পড়ার মত ব্যক্তি নন। তার কিছু কোটেশন দেখে তাকে নারীবিদ্বেষীও মনে হতে পারে, সেগুলো এখানে আনছি না, সেগুলো ১৯শ, ২০শ শতকের লেখকদের নারীবিদ্বেষ টাইপ আলোচনা বা, লিটারারি ওয়ার্কের ফেমিনিস্ট পারস্পেক্টিভের আলোচনায় আসতে পারে, কিন্তু আমার আগ্রহ এখন কেবলই রিয়ালিস্ট পারস্পেকটিভে। 

    আরেকটা জিনিসকে আনতেই হবে, সেটা হল তার সিলেক্টিভ নলেজ আর স্কিলের ব্যাপারটা। লিটারেচার, ফিলোসফি, অ্যাস্ট্রোনমি বিষয়ে তার সাধারণ জ্ঞানটুকুও নেই। এমনকি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে তাও জানেন না। পলিটিক্সের জ্ঞান খুবই কম। বোটানির জ্ঞান ভেরিয়েবল, প্র্যাক্টিকেল গার্ডেনিং সম্পর্কে ধারণা নেই, কিন্তু বেলাডোনা, আফিম সহ বিভিন্ন বিষের ব্যাপারে অনেক জানেন। জিওলজির জ্ঞান প্র্যাক্টিকেল কিন্তু সীমাবদ্ধ, মাটি দেখেই কালার, টেক্সচার বুঝে নিয়ে লন্ডনের কোন অঞ্চলের মাটি বলে দিতে পারেন। ব্রিতিশ ল নিয়ে নলেজ ভালো; কেমিস্ট্রি, অ্যানাটমি, সেন্সেশনাল লিটারেচার নিয়ে জ্ঞান অগাধ। ভাল ভায়োলিন বাজাতে পারেন, ভাল সিঙ্গলস্টিক খেলুড়ে, বক্সার ও সর্ডম্যান। 

    যাই হোক, হোমসের এই চারিত্রিক দিকগুলো আমি আনছি তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে আসার জন্য। তার মধ্যে অড, এক্সেন্ট্রিক বিহ্যাভিয়র দেখা যায়, সামাজিকতার অভাব দেখা যায়, এমপ্যাথির অভাব দেখা যায়। এগুলো তার সোশিওপ্যাথি, এন্টিসোশ্যাল বিহ্যাভিয়রকে চিহ্নিত করে। অন্যদিকে তার শোম্যানশিপ, ড্রাগ ইউস, উত্তেজনাপূর্ণ কিছুর অভাগ, কেস পেলে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, না পেলে ড্রাগ নেয়া, ঘুমিয়ে থাকা, এসব তার ইম্পালসিভনেস আর নার্সিসিজমকে ইঙ্গিত করে। আর মজার ব্যাপার হল শার্লক হোমসের অত্যধিক অ্যানালাইটিকাল ব্রেইন ও ইন্টেলিজেন্সের সাথে এই দুটো ট্রেইটই ভীষণভাবে মেলে।

    এটাও একটু স্পষ্ট করা দরকার। আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে মানুষের মস্তিষ্কে দুই ধরণের নেটওয়ার্ক থাকে, টাস্ক পজিটিভ নেটওয়ার্ক আর ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক। ২০১০ এর একটা গবেষণায় পড়েছিলাম, বেশিরভাগ মধ্যেই ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্কই প্রধাণত কাজ করে, তবে কম মানুষের ক্ষেত্রে কাজ করে প্রধাণত টাস্ক পজিটিভ নেটওয়ার্ক। ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্কটা সাধারণ বলা যায়, এই নেটওয়ার্কটা কাজ করার সময় যুক্তিত বদলে মানুষ এমপ্যাথি বা সহমর্মিতা - এসব বেশি কাজ করে। তবে তাদের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে টাস্ক পজিটিভ নেটওয়ার্কও শক্তিশালী হতে পারে। অন্যদিকে যাদের মধ্যে মূলত টাস্ক পজিটিভ নেটওয়ার্ক কাজ করে তাদের চিন্তাধারাই মূলত অ্যানালাইটিকাল। এদের মধ্যে এমপ্যাথি, সাজেস্টিবিলিটি, বিভিন্ন রকমের বায়াস খুব একটা কাজ করে না। অ্যানালাইটিকাল ব্রেইনের জন্য হাই ইন্টেলিজেন্স এদের একটা ভাল দিক বটে, তবে খারাপ দিকটা হচ্ছে এদের এমপ্যাথির অভাব। সহমর্মিতা খুব কম থাকে বলে এরা খুব একটা সামাজিক হয় না। হোমসের মধ্যে এই নেটওয়ার্কের উপস্থিতি স্পষ্ট, এটা এক দিকে তার মধ্যে এনে দিয়েছে প্রচণ্ড বিশ্লেষণী দক্ষতা ও ইন্টেলিজেন্স, অন্যদিকে কেড়ে নিয়েছে তার সহমর্মিতা, সামাজিকতাকে। 

    অন্যদিকে তার নলেজ আর স্কিলের যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখলাম তার জন্য আসলেই ভাল ইম্পালসিভনেস দরকার, তার জ্ঞানগুলো সব ভাল ডিটেকটিভ হবার জন্য দরকারী। যার দরকার নেই তার ন্যুনতম বিষয়ও তিনি জানেন না। এক্ষেত্রে তিনি বলেন গার্বেজ দিয়ে মাথার জায়গাকে পুরণ না করে দরকারী জিনিস দিয়েই জায়গা পুরণ করা উচিৎ। এই টাইপের সিলেক্টিভ জ্ঞান না থাকলে তিনি ভাল ডিটেক্টিভ হতেও পারতেন না, আর এর জন্য এরকম ইম্পালসিভনেস দরকার। ঘুরিয়ে বললে তার মধ্যে এরকম ইম্পালসিভনেস ছিল বলেই তিনি নিজেকে এভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এটা সেই সাথে তার মধ্যে অনেক নেতিবাচক বিষয়ও এনে দিয়েছেন। একটি হল তার শোম্যানশিপ, নার্সিসিজম, আর একটি হল উত্তেজনাকর কেস না পেলে তার ড্রাগ নেয়া, অলস জীবন কাটানো।

    আর্থার কোনান ডয়েল হোমসের চরিত্রটি তৈরি করার সময় কেবল কেসের প্রয়োজনে দরকারী বৌদ্ধিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলিই নায়কের মধ্যে প্রবেশ করান নি, সেই সাথে সেইসব গুণাবলি আসার জন্য সেই চরিত্রটির মধ্যে কী কী নেতিবাচক গুণও প্রবেশ করবে, তা তার জীবনধারার অন্যান্য বিষয়গুলোতে তা কিরকম প্রভাব ফেলবে সেই বিষয়েও চিন্তা করেছেন। সেই সময় সাইকিয়াট্রি আজকের দিনে এতটা উন্নত ছিল না, তারপরেও ডয়েল এরকম চরিত্র তৈরি করতে পেরেছেন তার অসাধারণ অবজার্ভেশন স্কিলের কারণেই, হয়তো তিনি নিজে একজন ডাক্তার ছিলেন বলেই তা করতে পেরেছিলেন, ডাক্তার ছিলেন বলে তাকে মানুষের ব্যক্তিত্ব, মানসিক অবস্থা নিয়েও জানতে হয়েছিল, স্টাডি করতে হয়েছিল, অবজার্ভ করতে হয়েছিল, আর তাই তার কারণেই তিনি শার্লক হোমসের মত একজন বাস্তব চরিত্রকে তৈরি করতে সক্ষম হন। অন্য অনেকেই তাকে নকল করেছেন, আত্তীকরণ করেছেন, অনুসরণ করেছেন, কিন্তু তাদের সেই নায়কের চরিত্রটি শার্লক হোমসের মত বিশ্লেষণী দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা পেলেও তার হোমসের নেতিবাচকতাগুলো খুব একটা পায়নি, তাই তারা হোমসের মত বাস্তবও হতে পারেন নি, সেই সব চরিত্রস্রষ্টা লেখকরাও ডয়েলের থেকে রিয়ালিস্ট ক্রিটিকে পিছিয়ে পড়েন, তারা ডয়েলের মত করে চরিত্র নির্মাণ করতে পারেন নি বলেই ডয়েলের মহত্ব ও গুরুত্বটা বোঝা যায়। 

    যাই হোক, বিবিসি Sharlock নামে ২০১০ সালে শার্লক হোমসের একটা মডার্নাইজড অ্যাডাপ্টেশন বের করা শুরু করে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তারা মোট ১৩টি এপিসোড বের করেছিল। বেনেডিক্ট কাম্বারবাখ শার্লকের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। আর মূল শার্লকের বৈশিষ্ট্যগুলোও তিনি তার চরিত্রে খুব সুন্দর করে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেটা দেখে না থাকলে, দেখার অনুরোধ রইল। 

  • dc | 103.195.***.*** | ২৭ জুলাই ২০২০ ১১:২৪95602
  • বিবিসির শার্লক হোমস আমার ভাল্লাগেনি, ইন ফ্যাক্ট এই মডার্ন ইনটারপ্রেটেশানের কোনটাই আমার ভাল্লাগেনা। এগুলোতে শার্লক হোমসকে সুপারম্যান বানিয়ে দেয়, কোনান ডয়েলের পুরো কনসেপ্টটাকেই ঘেঁটে ঘন্ট বানিয়ে দেয়।
  • S | 2405:8100:8000:5ca1::3d4:***:*** | ২৭ জুলাই ২০২০ ১১:৩১95603
  • বিবিসির শার্লক আমার দিব্যি লেগেছিল। বেনেডিক্টকে দিব্যি মানিয়েছিল। তাছাড়া সিনেমার পেসটাও গল্পের সঙ্গে মানানসই ছিল।
  • প্রলয় বসু | ২৭ জুলাই ২০২০ ২১:০২95613
  • ধন্যবাদ @সুমিত রায়, @dc, @S

    ভাললাগা ব্যপারটা ভীষণ আপেক্ষিক। যা আজ ভাল লাগে না, তা কাল হয়তো ভাল লাগতে পারে, তার পরিপ্রেক্ষিত জানতে পারলে। এটাও আমার একটা আপেক্ষিক মন্তব্যই। 

    তবে, এবিষয়ে একটাই কথা বলতে পারি। যদিও আমি বিশেষজ্ঞ না, একান্তভাবেই পাঠক। তবু... পাঠকেরও তো একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, সেই বিচারে।

    আসলে শার্লক হোমসের সৃষ্টিই হয়েছিল, শার্লক হোমসকে 'সুপারম্যান' হিসেবে দেখাতে। কেন? এটা আর এখানে বিস্তারিত ভাবে লিখছি না। এই লেখার দ্বিতীয় পর্বে দেওয়া আছে। সেখান পড়লেই বুঝতে পারবেন 'কেন'র উত্তর। 

  • Sumit Roy | ২৭ জুলাই ২০২০ ২৩:০৭95616
  • এরকম ডিটেকটিভ চরিত্র তৈরি করা মানেই একজন সুপারম্যানকে তৈরি করা। এই চরিত্রকে অন্য সবার থেকে অধিক বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হয়। অন্য কেউ যদি তাদের মত ক্ষমতা ধারণ করতই তাহলে তার কাছে কাউকে আসতে হত না। অন্যান্য স্টোরির মত এগুলো লাক নির্ভর না, প্রেডিক্টেবল না, এমন সব কেসই এইসব ডিটেক্টিভদের কাছে আসে যা সাধারণ বুদ্ধির মানুষ ধরতে পারেনা, অনেক সময় এর জন্য লেখক "সুপারহিরো" এর মত "সুপারভিলেইন" তৈরি করে, যেমন জিম মরিয়ার্টি ছিলেন। সুপারম্যান সমস্যা নয়, আমাদের বরং দেখতে হয় সেই সুপারম্যান কতটা বাস্তব, তার চরিত্র কতটা যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেটা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আর্থার কোনান ডয়েল অন্যদের চেয়ে নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবেন, কেন তা উপরের কমেন্টেই বলেছি। বিবিসির শার্লকেও শার্লক হোমসের চরিত্রকে আর্থার কোনান ডয়েল সুলভ বাস্তবতার ভিত্তিতেই তৈরি করা, তাই সেই শার্লক সুপারম্যান হলেও বাস্তব সুপারম্যান।

  • সৌর | 103.73.***.*** | ২৮ জুলাই ২০২০ ০০:৪৪95619
  • মূল লেখা বেশ সুন্দর। কিন্তু ফেলুদার মুখ দিয়ে বলাতে হলো কেন? তাহলে তো ফেলুদা য় শার্লকের ছায়া নিয়ে আলোচনা হবে না লেখাতে। যদিও সত্যজিৎ নিজেই স্বীকার করে গেছেন বারে বারে যে, "গুরু, তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি"। তবু প্রশ্নটা থাকে।।

  • প্রলয় বসু | ২৮ জুলাই ২০২০ ০০:৫৬95620
  • @সৌর

    লেখাটা যখন শেষ করি, তখন প্রবন্ধাকারে ছিল। কিন্তু নিরস প্রবন্ধ আদৌ লোকে পড়বে কিনা সন্দেহ ছিল। তাই... 

    আর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, ফেলুদাকে নিয়ে একটা প্যাসটিস্ লিখবো। সেই ইচ্ছেপূরণ করে ফেল্লুম, আর কি... 

  • S | 2405:8100:8000:5ca1::3ed:***:*** | ২৮ জুলাই ২০২০ ০৪:০৮95625
  • হ্যাঁ গোয়েন্দাদের এই অতিমানবীয় ব্যাপারটা মাঝে মধ্যে বিরক্তিকরই লাগে বটে। আগেকার দিনের গোয়েন্দারা তো আবার এক্দম চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। স্মার্ট ফোন ছাড়াই যখন তখন সব টপিকে সবকিছু মনে করে ফেলতে পারতো। ঐ কারণেই সিধু জ্যাঠার আবির্ভাব, যাতে একটু হলেও ব্যাপারটা নর্মালাইজড করা যায়। এই কারণে কোনও গোয়েন্দার প্রতি একটু স্নেহ না থাকলে সেই গোয়েন্দার গল্প অনেক সময়ই অবাস্তব মনে হয়।
  • ইন্দ্রনাথ মল্লিক। | 2409:4061:702:898e::2b32:***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০২০ ১২:৩৮100674
  • একইসঙ্গে, আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পল ও এরকুল পোয়ারোর আলোচনা থাকলে আরও ভালো হতো।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন