#ব্যোমকেশের খোঁজে
#বেরসিক
প্রথম অধ্যায়। পর্ব দুই।
১৯২০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ব্যোমকেশ (১)। এরপর বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হয় ইন্টারমিডিয়েটে। ১৯২১ সালে, ব্যোমকেশ যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, বয়স মাত্র সতেরো বছর, পর পর বাবা আর মা মারা যান। দুজনেই মারা যান দুরারোগ্য যক্ষ্মা রোগে। তাঁর জীবনে শুরু হয় এক অদম্য লড়াই, একলা চলার লড়াই। আত্মীয় স্বজন কেউ খোঁজও নেয়নি ব্যোমকেশের। ব্যোমকেশ পড়াশোনা চালতে থাকে 'জলপানি'র (স্কলারশিপের) টাকায় (২)। এইসময়টাই ব্যোমকেশের জীবন দর্শনকে গঠন করেছিল। জীবনের এক গভীর 'সত্য'কে আবিষ্কার করেছিল ব্যোমকেশ। বুদ্ধি তো ছিলোই, কিন্তু মানুষের গভীর মনস্তত্ত্বকে বুঝতে শিখেছিল এই সময়েই। সত্যান্বেষণ হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই সত্যান্বেষণ আসলে মনস্তত্ত্বকে নিরীক্ষণ। এই সময়েই সম্ভবত ব্যোমকেশের 'ব্রিজের নেশা' হয়েছিল। "আমারও একসময় ব্রিজের নেশা ছিল" বলেছে ব্যোমকেশ। স্কুল জীবনে 'জনপ্রিয়' ব্যোমকেশ সম্ভবত কলেজ জীবনে গুটিয়ে গেছিল নিজের মধ্যে। গুটিয়ে যে গেছিল তা সত্যি। কোন সন্দেহ নেই। এর প্রমাণ এখন না দিয়ে পরে দেওয়া যাবে। সেই গুটিয়ে যাওয়া ব্যোমকেশের সঙ্গী হয়েছিল তাস আর 'ব্রিজ'। বাবা-মায়ের মৃত্যু, সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের ব্যবহার সব কিছু মিলে হয়ে উঠেছিল অসহ্য। আর অসহনীয় সেই সময়েই ব্যোমকেশ সবকিছু ভুলতে সঙ্গী করেছিল 'ব্রিজ' আর সেই কারণেই বহুবছর (১৯৫২ সাল) পরে ভূপেশবাবুর কষ্টের গভীরতাকে বুঝতে পেরেছিলো সে (৩)। আন্দাজ করতে পেরেছিল, ভূপেশবাবুর পুত্র এবং স্ত্রী হারানোর শোক।
এই সময়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো ব্যোমকেশের জীবনে। যেটা হয়তো তাঁর জীবনের মোর ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। 'সে সময় কলকাতা শহরে হঠাৎ জহরত চুরির ধুম পড়ে গিয়েছিল'।
১৯২১ সাল। মহারাজ রমেন্দ্র সিংহের রক্তমুখী নীলা চুরি যায়। পুলিশ মহলে এবং সংবাদ পত্রের তোলপাড় আরেকজনের মন বিশেষভাবে আন্দোলিত হয়েছিল। আর সেটা যে ব্যোমকেশ এটা ভাবতে খুব কষ্ট করার দরকার হয়না। সুদূর বহরমপুরে বসেও সংবাদ পত্রের মাধ্যমে কলকাতার সে খবর পৌছেছিল ব্যোমকেশের কাছে। নিজের আগ্রহেই খানিকটা খোঁজ খবর করেছিলো ব্যোমকেশ। যদিও অপরিচিত ব্যোমকেশকে নীলা উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত করার কথা কেউ ভাবেনি। স্বাভাবিক। মূল সন্দেহভাজন রমানাথ নিয়োগীর থেকেও সেই নীলা পাওয়া যায় নি, যদিও বাদবাকি সমস্ত চোরাই মাল পাওয়া গেছিল। পুলিশের বড় গোয়েন্দা নির্মলবাবুও পারেননি সেই রক্তমুখী নীলা উদ্ধার করতে (৪)। যদিও দশ বছর পরে (১৯৩১ সালে), এক দুর্ভাগ্যজনক এবং 'ভয়ঙ্কর' মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ব্যোমকেশ সেই নীলা উদ্ধার করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। পরের কথা থাক। আগের কথা বলতে গিয়ে বারবার পরের কথায় চলে যাচ্ছি। এই আমার বদস্বভাব। কিছুতেই গুছিয়ে লিখতে পারি না। সব কেমন যেন আগে পরে হয়ে যায়। তা সে আমার কথা থাক। ব্যোমকেশে ফিরে আসি। আমাদের ব্যোমকেশের 'সত্যান্বেষী' হয়ে উঠবার পটভূমিতে চলি। যে সময়টা নিয়ে কখনো আলোচনা করা হয়নি, সেই সময়ে চট করে ফিরে যাই। তা মহারাজার 'রক্তমুখী নীলা' তো পাওয়া গেল না। রমানাথ নিয়োগী জেলে গেলো। কিন্তু ব্যোমকেশকে এক নেশায় চেপে বসলো। সত্যান্বেষণের নেশা। ব্যোমকেশের ভবিষ্যতের পেশা। "তখন আমি সবেমাত্র এ কাজ আরম্ভ করেছি - তোমার সঙ্গে দেখা হবারও আগে -"। তখন সবে নেশা। পেশা নয়। ভাললাগে তাই। এই সময়েই ব্যোমকেশ তাঁর জীবনের প্রথম বড়ো সাফল্য পায়। "পেশোয়ারী আমির খাঁ, যে মেয়ে-চুরির ব্যাবসাকে সূক্ষ্ম ললিতকলায় পরিণত করেছিল" তাকে ধরে ব্যোমকেশ। নিজেই খানিকটা অনুসন্ধিতসাবশত সত্যানুসন্ধানে নেমে, তাকে ধরে ফেলে ব্যোমকেশ। ১৯২২ বা ১৯২৩ সাল নাগাদ। "বিচারে পিনাল কোডের কয়েক ধারায় তার (আমির খাঁর) বারো বছর জেল হয়" (৫)। 'নিজেই' কেন বললাম এখানে? কেন আবার, অপরিচিত, অনাহূত ব্যোমকেশের কাছে কেই বা আর তখন এই সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে যাবে। সুতরাং 'নিজেই' যে উদ্যোগী হবে, এটা ভাবতে খুব কষ্ট করতে হয় না। যথাযথ এবং চিত্তাকর্ষক কাজ পেলে বা 'কেস' দেখলে ব্যোমকেশ যে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে 'কাজে' নেমে পরে তা আমরা পরেও দেখেছি। তা 'পথের কাঁটা' তেও দেখেছি, দেখেছি 'চিত্রচোর'-এর ক্ষেত্রেও। সম্ভবত এই ঘটনার পরেই ব্যোমকেশ নিজের জীবনের ভবিষ্যতের পেশাকে খুঁজে পায়। খুঁজে পায় জীবনের দিশা। 'সবেমাত্র এ কাজ'-এ নেমে এহেন সাফল্য ব্যোমকেশের মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। বরং এই কাজকেই নিজের ভবিষ্যতের পেশা হিসেবে বেছে নেয়।
[টিকা - ৩
(১) শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালে। "জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি ১৯১৫ সালে... ১৯১৯ সালে বি এ পাস করি"।
তখন ম্যাট্রিকুলেশনের পর দুবছর ইন্টারমিডিয়েট আর দু বছর ব্যাচেলর ডিগ্রি পড়তে হতো (সূত্র: University of Calcutta; Regulations 1914)। ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১৫ সালে অর্থাৎ ষোল বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন আর ১৯১৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯১৯ সালে বি এ পাশ করেন, যথাক্রমে আঠারো এবং কুড়ি বছর বয়সে।
তাই ব্যোমকেশ ১৯০৪ সালে জন্মগ্রহণ করে, ১৯২০ সালে মানে ষোল বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে। ১৯২২ সালে ইন্টারমিডিয়েট আর ১৯২৪ সালে কলেজের পাঠ শেষ করে, স্নাতক হয়।
এখানে একটা জিনিস নিয়ে সমস্যা আছে। 'ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালকাটা - রেগুলেশন ১৯১৪' তে একটা নিয়ম নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তিন নম্বর নিয়মটি হল, 'No one shall be admitted to the Matriculation Examination, unless he shall have completed age of sixteen years on the first day of the month in which he appears at the examination' (সূত্র: University of Calcutta; Regulations 1914; Chapter XXX; Matriculation Examination; Regulation no: 3; Page: 117) অর্থাৎ সোজা বাংলায়, পরীক্ষার্থীর বয়স ষোল পূর্ণ না হলে তাকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবেনা। সমস্যা কোথায়? আচ্ছা এবার দেখুন, এখন ব্যোমকেশের জন্ম সাল ১৯০৪ - আমরা দেখেছি আর জন্ম তারিখ ১৩ জুলাই, তাও দেখেছি। ১৯২০ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাটি শুরু হয় পয়লা মার্চ (সূত্র: University of Calcutta; The calendar for the year 1920 & 1921; page: 18)। ব্যোমকেশের বয়স পয়লা মার্চ তো ষোল পূর্ণ হচ্ছে না। ব্যোমকেশ ১৯২০ সালের বদলে ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসলে 'মহাভারত অশুদ্ধ' না হলেও অনেক হিসেবে গোলমাল হবে। তাহলে উপায়? খোঁজ খোঁজ খোঁজ। বের করলাম ১৯১৫ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার তারিখ। সেটিও পয়লা মার্চ। (সূত্র: University of Calcutta; The calendar for the year 1915; page: 5)। কেন হঠাৎ ১৯১৫ সালের ম্যাট্রিকুলেশনের খোঁজ করলাম? কারণ, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন দিয়েছিলেন। এবং ওনারও পয়লা মার্চ ষোল বছর পূর্ণ হচ্ছে না। প্রসঙ্গক্রমে জানাই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম তারিখ ৩০ মার্চ ১৮৯৯ সাল। এখন যদি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ষোল বছর পূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষায় বসতে পারেন। তাহলে ব্যোমকেশও ১৯২০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসতে পারে। ব্যস্। খানিকটা গাজোয়ারি আর কি। প্রসঙ্গত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন পুর্নিয়া জেলা (বর্তমান বিহার) থেকে। আর তখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির অধিনে ছিল বাংলা, বিহার, বার্মা, ওড়িশা আর আসাম (সূত্র: University of Calcutta; Regulations 1914; Act number VIII of 1904; The first schedule (section 5);
Page: 32)। অবাক হচ্ছেন? সারা ভারতে তখন মাত্র পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, বম্বে ইউনিভার্সিটি, মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি আর এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি।
ছোটবেলায় কোন স্কুলে পড়তো ব্যোমকেশ? ছোটবেলা না হোক কোন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন দিয়েছিলেন ব্যোমকেশ?
এটা কল্পনা করা খুব কঠিন। ব্যোমকেশ ইন্টারমিডিয়েট আর বি এ পড়েছিল বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে। ভুরু কুঁচকে যাওয়া কোন কারণ নেই। একটু পরেই উপযুক্ত প্রমাণ দেবো। আপাতত মেনে নিন। ব্যোমকেশের কলেজ নিয়ে আর খানিকক্ষণের মধ্যেই আলোচনা করবো। তখন দেখবেন। এখন শুনুন, কলেজ বহরমপুরে হলে যে তাকে সেখানেই থাকতে হবে এমন মাথার দিব্বি কেউ দিয়েছে কী? না দেয়নি। আর তার সপক্ষে কোন প্রমাণও নেই। ব্যোমকেশের ছোটবেলা যে বহরমপুরেই কিংবা মুর্শিদাবাদে কেটেছে, এটা প্রমাণ করা খুব শক্ত। বরং ব্যোমকেশের গল্পে তার বিপক্ষেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেটা কেমন? 'আদিম রিপু'তে ব্যোমকেশের এক বন্ধুর খোঁজ পাওয়া যায়, নাম রমেশ মল্লিক, থাকতেন ডায়মন্ডহারবারের খেজুরহাটে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। তখন অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত। সে যদি সুদূর চব্বিশ পরগনা থেকে বহরমপুরে পড়তে যেতে পারে তাহলে ব্যোমকেশের ছোটবেলা যে শুধু মাত্র বহরমপুরেই কেন, মুর্শিদাবাদেই যে কেটেছে, তার স্থিরতা নেই। অন্য যে কোন জেলা থেকেই ব্যোমকেশ এসে বহরমপুরে কলেজে পড়তে আসতে পারে। তবু। তবু যদি কল্পনা করি ব্যোমকেশ বহরমপুরের ছেলে। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে বহরমপুরে। তাহলে? তাহলে কোন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসেছিল? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে, সমগ্র মুর্শিদাবাদের মাত্র তেইশটি স্কুলের নাম অন্তর্ভুক্ত (অ্যাফিলিয়েশন) ছিল ম্যাট্রিকুলেশনের জন্যে। বহরমপুরের মাত্র একটি স্কুলই অন্তর্ভুক্ত ছিল। বহরমপুর কে এন (কৃষ্ণনাথ) কলেজিয়েট স্কুল। তাহলে কী ব্যোমকেশ এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন? জানা নেই। কিন্তু কল্পনা করতে ক্ষতি কিছু আছে কি? (সূত্র: University of Calcutta; The calendar for the year 1920 & 1921; page: 437)
(২) আদিম রিপু; পৃষ্ঠা: ৪৩৪; ব্যোমকেশ সমগ্র; আনন্দ পাবলিশার্স; ত্রয়োবিংশ মুদ্রণ
(৩) হেঁয়ালির ছন্দ; পৃষ্ঠা: ৮২২; ব্যোমকেশ সমগ্র; আনন্দ পাবলিশার্স; ত্রয়োবিংশ মুদ্রণ
(৪) রক্তমুখী নীলা; পৃষ্ঠা: ২০৫; ব্যোমকেশ সমগ্র; আনন্দ পাবলিশার্স; ত্রয়োবিংশ মুদ্রণ
'রক্তমুখী নীলা' গল্পে শুরুতেই দেখতে পাচ্ছি 'দৈনিক কালকেতু' পড়ছে ব্যোমকেশ। খবরের কাগজ দেখে অজিতকে বলছে, 'খবর গুরুতর - দু'জন দাগী আসামী সম্প্রতি মুক্তিলাভ করেছে। একজন হচ্ছেন শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন - তিনি মুক্তিলাভ করেছেন বিচিত্রা নামক টকি হাউসে; আর একজনের নাম শ্রীযুত রমানাথ নিয়োগী - ইনি মুক্তিলাভ করেছেন আলিপুর জেল থেকে। দশ দিনের পুরনো খবর, তাই আজ 'কালকেতু' দয়া করে জানিয়েছেন।"
শেষে এই 'দশ দিনের পুরনো খবর' বলতে সম্ভবত শ্রীযুত রমানাথ নিয়োগীর কথা বলেছেন। 'চরিত্রহীন' সিনেমার কথা বলা হয়নি। কারণটা পরে বলবো। 'পরে' বলতে, ঘুরতে ঘুরতে যখন 'রক্তমুখী নীলা'র সমাধানের প্রসঙ্গে যাব, তখন বলবো। আপাতত... কেন 'রক্তমুখী নীলা' চুরি যাবার ঘটনা ১৯২১ সালে ঘটেছিল বলছি, তার রহস্য উদ্ঘাটন করা হোক।
ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি 'চরিত্রহীন' মুক্তি পায়, ৯ই মে (শনিবার) ১৯৩১ সালে।
(সূত্র: ১। https://www.moviebuff.com/charitraheen-1931-bengali
২। https://m.imdb.com/title/tt0214576/
৩। https://indiancine.ma/APP/info)
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'চরিত্রহীন' উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্বাক চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন, প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া (পি সি বড়ুয়া), দেবকী কুমার বসু, দীনেশ রঞ্জন দাস, কালীপদ দাস, সবিতা দেবী, হেম গুপ্ত। প্রসঙ্গত ১৯৭৫ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতীয় সিনেমার জগতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার 'দাদাসাহেব ফালকে' দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয়, যে 'চিত্রা নামক টকি হাউসে' 'চরিত্রহীন' মুক্তি পেয়েছে বলে ব্যোমকেশ বলছে, সেই 'চিত্রা'তেই একদিন ব্যোমকেশ বায়স্কোপ দেখতে যাবে, 'অর্থমনর্থম' গল্পে করালী চরণ বসুর হত্যার মীমাংসার জন্যে। (সূত্র: অর্থমনর্থম; পৃষ্ঠা: ১২০; ব্যোমকেশ সমগ্র; আনন্দ পাবলিশার্স; ত্রয়োবিংশ মুদ্রণ)
এখানে আরো একটা বিষয় বলতে ইচ্ছে করছে। করছে যখন বলে ফেলাই ভালো কী বলেন? কেন 'চরিত্রহীন' সিনেমার কথাই এসেছে গল্প প্রসঙ্গে। সে বছর তো আরো অনেক সিনেমাই এসেছিল। তাহলে? তাহলে চলুন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়রিটা একটু ঘেঁটে দেখি। ১১-৯-১৯১৮ তারিখে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন "'চরিত্রহীন' আজ শেষ হয়ে গেল। অনেকে বলে বইখানা রুচিবিরুদ্ধ। যারা বলে তারা সাহিত্যিক নয়। এ বইয়ের প্রত্যেক পাতা ফুলের মতো শুভ্র - অভ্রের মতো নির্মল! আমি এমন বই পড়িনি, যার সব চরিত্রগুলোই মহান, অভ্রভেদী, বৃহৎ। 'চরিত্রহীন' একটা মহাকাব্য। ... এ যেন একটা উদার, স্বর্গীয় মহাসঙ্গীত। এর মধ্যে সমাজের সঙ্কীর্ণতা নেই - আবার বিচারের ক্ষুদ্র শুচিতা নেই - সবই যেন একটা বিরাট মহত্ত্বের স্পর্শে পবিত্র হয়ে গেছে। ... সতীশের মতো চরিত্রহীনতা যদি কারো থাকে সে ধন্য; সাবিত্রীর মতো ভ্রষ্টা যদি কেউ থাকে সে সার্থক; কিরণময়ীর মত অপরাধিনীর অপরাধ যার সে মহান!" (সূত্র: শরদিন্দু অমনিবাস; প্রথম সংস্করণ ১৩৬৩; আনন্দ পাবলিশার্স; দ্বাদশ খন্ড; দিনলিপি - পৃষ্ঠা: ২৭১)।
যে উপন্যাস সম্বন্ধে তাঁর এই উপলব্ধি, সেই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর, সুযোগ পেয়ে সেই সিনেমাকে নিজের গল্পে স্থান দিয়ে সেই উপন্যাসকেই যথোপযুক্ত সম্মান জানিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কেবলমাত্র 'চরিত্রহীন' সম্পর্কেই তাঁর এই মূল্যায়ণ ছিল না, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁর এক অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল। ভালোলাগা ছিল। যা তাঁর ডায়েরিতে বারবার চোখে পড়েছে। তাই বোধহয় তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্দ্বিধায় 'সাহিত্য সম্রাট' বলে দিতে পারেন 'হেঁয়ালির ছন্দ' গল্পে। (সূত্র: হেঁয়ালির ছন্দ; পৃষ্ঠা: ৮৩১; ব্যোমকেশ সমগ্র; আনন্দ পাবলিশার্স; ত্রয়োবিংশ মুদ্রণ)
অর্থাৎ রমানাথ নিয়োগী জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে, ১৯৩১ সালে। রক্তমুখী নীলা তে ব্যোমকেশ বলেছে, "নিয়োগী মহাশয় নিতান্ত অপরিচিত নয়। কয়েক বছর আগে তাঁর নাম খবরের কাগজে খুব বড় বড় অক্ষরেই ছাপা হয়েছিল... দশ বছর হয়ে গেল কিন্তু এখনও ঘটনাগুলো বেশ মনে আছে... তোমার সঙ্গে দেখা হবারও আগে"। ১৯৩১ সালে বসে 'দশ বছর' আগে সুতরাং ১৯২১ সালে ঘটেছিল, রক্তমুখী নীলা চুরির ঘটনা।
(৫) উপসংহার; পৃষ্ঠা: ২০৪; ব্যোমকেশ সমগ্র; আনন্দ পাবলিশার্স; ত্রয়োবিংশ মুদ্রণ
১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে (এখন প্রশ্ন করবেন না, কেন ১৯৩৩ সালে 'উপসংহার' ঘটেছিল। একটু ধৈর্য ধরুন, ঠিক সময়ে মানে যখন 'উপসংহার' এর আলোচনা হবে তখন, সন-তারিখ সব মিলিয়ে দেবো। কথা দিলাম। এখন একটু মেনে নিন। প্লিজ) ব্যোমকেশ বলছে (পরে আবার এই প্রসঙ্গে আসবো), "পেশোয়ারী আমির খাঁ... বিচারে পিনাল কোডের কয়েক ধারায় তার (আমির খাঁর) বারো বছর জেল হয়।" ব্যোমকেশের গল্প গুলো পড়লে দেখা যায় প্রায় অধিকাংশ সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীকেই জেলে 'ভালো' হয়ে থাকার জন্যে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে জেল থেকে। উদাহরণ স্বরূপ 'উপসংহার' গল্পে অনুকূল চক্রবর্তী, 'রক্তমুখী নীলা' গল্পে হরিপদ রক্ষিত আর 'ছলনার ছন্দ' গল্পে নরেশ মন্ডলের কথা বলা যায়। এই আমির খাঁ ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে জেল থেকে ছাড়া পায় নি, সুতরাং অন্তত ১৯২২ বা ১৯২৩ সালে শাস্তি পেয়েছে। অতএব 'কেস সলভ' হয়েছে, ১৯২২ বা ১৯২৩ সালে। তারপর বিচার এবং জেল, ১৯২৩ সালে, সম্ভবত। এটাই ব্যোমকেশের প্রথম 'বড়' কেস।]
ইন্টারেস্টিং। পড়ছি।
স্বাতী রায়,
ধন্যবাদ