ভেবেছিলুম, কিছু লিখবো না আজ। পিতৃপুরুষদের নিয়ে বারবার মুগ্ধতা জানানো একধরনের প্রগলভতা। এক ধরনের অহমও। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, দেখো আমাদের পূর্বপুরুষদের গরিমা। তাঁদের আলোর বিচ্ছুরণ চুরি নিজেদের অন্ধকার লুকোনোর ছেলেমানুষি। তাঁর গান নিয়ে লিখেছি অনেকবার। আবার লিখবো। যতোদিন লিখতে পারবো। যতোদিন মাথা কাজ করবে। কিন্তু সচেতনভাবে ‘মানুষ’টিকে নিয়ে লেখালেখি করিনি। সেই মানুষ ও তাঁর জীবন আর শিল্প পুরো জড়াজড়ি করে থাকে। একটা জানলেই অন্যটা জানা হয়ে যায়।
আজ দেখছি বন্ধুদের লেখায় তিনি বারবার আসছেন। প্রলুদ্ধ হচ্ছি কি? নাহ, আজ তাঁর গানের কথা থাক। মানুষটিকে কেন্দ্রে রেখে যেসব গল্পসল্প জেনে এসেছি সেকালের নানা গুণী জনের কলমে, তার কিছু আজ স্মরণ করতেই পারি।
'... বরং আমার মন আনন্দে নেচে ওঠে, যখন চেতলায় যেতে-আসতে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দক্ষিণের ফুটপাথে গাছের তলায় পাড়ার লোকের চাঁদায় তৈরি হেমন্তের আবক্ষ মূর্তিটা আমার চোখে স্মিত হাসিতে ভেসে ওঠে। সাধারণ মানুষের ভালবাসার কাছে ক্ষমতান্ধ রাজানুগ্রহ নিতান্তই খোলামকুচি বলে মনে হয়।'
(সুভাষ মুখোপাধ্যায় -২৯।১২।১৯৯৫)
'গান অনেকেই গায়। নামও অনেকের। কিন্তু সবাই অজাতশত্রু হয় না। হেমন্ত সেদিক থেকে সত্যিই ভাগ্যবান। যেখানেই যাই শুনি- হেমন্তের মতন মানুষ হয় না। শুনে আমরা যারা তার ছেলেবেলার বন্ধু-আমাদের বুক দশ হাত হয়। নাম অনেকেই করে, কিন্তু সর্বজনীন ভালবাসা ক'জন পায়? বোম্বাইতে বেশ কয়েকবার আমি এর সাক্ষী। একবার এক ট্যাক্সিতে উঠে বলেছিলাম- ফোর্টিন্থ রোড যাব। তারপর একটু বাজিয়ে দেখার জন্যই বলেছিলাম হেমন্তকুমারের নাম। শোনা মাত্র ট্যাক্সি ড্রাইভারের সে কী উচ্ছ্বাস। তারও সেই এক কথা - অমন মানুষ হয় না।'
(হেমন্তর কী মন্তর-সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
'বাঙালিয়ানা' বলতে কী বোঝায়, একালের ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন করে। তারা মুক্ত বাজারের মানুষ। মানুষের 'বাজারে' 'বাঙালিয়ানা' নামে কোনও স্পেকস হয় না। ভাষণ দিয়ে বোঝানো যায় না। বরং বলি, বাঙালিয়ানা মানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর থেকে বেশ খানিকটা তফাতে থাকলেও আরেকটা নাম আসবে বোধ হয়। উত্তম কুমার। তারা খুব সহজে বুঝে যায়। রবীন্দ্রনাথের নাম অপব্যবহার না করেও, অথবা স্বামীজি বা নেতাজি ধরনের স্টারেদের ছেড়ে দিলেও, নতুন প্রজন্মকে 'বাঙালিয়ানা' বোঝানো যায়। এই গরিমায় পৌঁছোনো কঠিন। এ হলো মধ্যবিত্তের এক্সেলেন্স। তার উপরের বা নিচের স্তরে প্রতিবিম্বটি ধরা যাবে না। আয়নাটিতে অতোটাই ধরে। না হয় 'মধ্যবিত্ত'ই হলো। শব্দটা তো গালাগালি নয়। নয়, কোনও অপরাধের নাম। একটা মনোজগত মাত্র। তাই নিয়েই জন্মেছি। সেভাবেই চলে যাবো। পূর্ণ হবে না কখনও, কিন্তু 'আপওয়র্ড মোবিলিটি'র অসীম তৃষ্ণাটি রয়ে যাবে। 'অপরাধ' বলতে ঐটুকুই।
হেমন্তকে কপি করা কতো সহজ। হাত গোটানো শাদা শার্ট। ধুতি, ব্যাকব্রাশ, কালো ফ্রেমের চশমা। আমাদের সময়ে একজন গান গাইতেন। চিত্তপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। গান গাওয়ার ধরন, কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ, সাজপোশাক, ভাবভঙ্গি সব কিছুই স্বয়ং হেমন্তের থেকেও 'হৈমন্তিক' ছিলো। একবার কোনও এক অনুষ্ঠানে পকেটে কোঁচা গুঁজে, কোমরে হাত দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। যেন অবিকল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁকে দেখে বন্ধু গীতিকার মিল্টু ঘোষ বলে ওঠেন 'এই চিত্ত, হাত নামা কোমর থেকে। তুই কি হেমন্তদা হয়েছিস?' সুবীর সেনের এক উদীয়মান গায়ক বন্ধু খুব গোপনে জানিয়েছিলেন কী করে হেমন্তদার মতো গলা বার করা যাবে? সুবীর চমৎকৃত। অমন 'ঈশ্বরে'র গলা কীভাবে পাওয়া যায়? বন্ধু চুপি চুপি খুব সিরিয়সভাবে জানান, গানের আগে একটা বিড়ি টেনে নিলেই অমন গলা বেরোবে।
'তিনি যেন বাংলা সঙ্গীত পরিবরের একজন সংবেদনশীল অভিভাবক'। বলেছিলেন বিখ্যাত কম্পোজার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সারা জীবন হেমন্তের থেকে অকৃপণ ভালোবাসা, দাক্ষিণ্য পাবার ভাগ্য করেছিলেন। হেমন্তের কাছে গান গাওয়া কোনও জীবিকা ছিলো না। ছিলো 'জীবনসাধনা'। বাইরে অনুষ্ঠান করতে গেছেন। সঙ্গে অনুজ গায়িকারা আছেন। রাতের বেলা তাঁদের ঘরের দিকে চটির শব্দ এগিয়ে আসে। হ্যাঁরে, তোদের সব খাওয়াদাওয়া হয়েছে? হ্যাঁ দাদা। তবে এবার শুয়ে পড়। কালকে তো আবার গান আছে। চটির শব্দ দূরগামী হয়ে যায়। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার অনেকেই দেখেছেন। ছোটো বোনের প্রতি বড়ো দাদার স্নেহ অনুচ্য অনুভব হয়ে মুগ্ধ করে। দর্শকরা সবাই জানেন। 'বাঙালিয়ানা' বোধ হয় সেরকমই কিছু।
হেমন্তকুমার তখন বম্বেতে সুপার সফল শিল্পী। সেখানকার বিখ্যাত গায়করা তাঁকে ধরে পড়েন তাঁরা হেমন্তের সুরে পুজোর গান করতে চান। হেমন্ত ভাবেন, সে তো ভালো কথা। এতো জন বিখ্যাত গায়ক যদি বাংলা গান করেন তবে সারা দেশে বাংলা গানের একটা প্রতিষ্ঠা হবে। গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তা পি কে সেনও এ প্রস্তাবে খুশি। কিন্তু কোম্পানির মেজ কর্তা পবিত্র মিত্র পড়লেন বিপদে। তিনি হেমন্তকে জনান্তিকে জানালেন, 'ভাইব্যা দেখেন, বম্বের শিল্পীর তো সারা বসর কত কাম আসে। তারা প্রচুর অর্থ পায় বসর ধইর্যা। কিন্তু কইলকাতার শিল্পীগো তো একমাত্র ভরসা ঐ পুজার গান। হের সাফল্যের উপর তাগো সারা বসর প্যাট চলে। এখানের শিল্পী সব বাদ যাইবো। আপনি চিন্তা করেন, কী করবেন?' হেমন্ত বুঝতে পারেন কী ভুল হচ্ছিলো। তৎক্ষণাৎ বলেন, ' সরি, ভাববেন না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমি একজনেরও গান করবো না। আমি আপনাকে কথা দিলাম।' উদ্যোগটির সঙ্গে হেমন্তের কী পরিমাণ উপার্জন জড়িয়ে ছিলো সে কথার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। অভিজিৎ বলেছিলেন 'হেমন্তদা জাত Humanist, জাত বাঙালি'। বাঙালিয়ানা, কী এরকমই কিছু?
তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ধুলোমুঠি সোনা। বাংলা ছবির এক অকালপ্রয়াত কলাকুশলীর পরিবারের সাহায্যের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে। তাঁরা হেমন্তকে অনুরোধ করলেন। তিনি এলেই আশাতিরিক্ত অর্থসংগ্রহ করা যাবে। সব শুনে তিনি রাজি হলেন। তবে বললেন তাঁর পুরো পারিশ্রমিক ও বম্বে-কলকাতা বিমানভাড়া তাঁকে অগ্রিম পাঠাতে হবে। তবেই তিনি গান করবেন। সংগঠকদের রাজি না হয়ে উপায় ছিলো না। তিনি ছাড়া টিকিট বিক্রি হবে না। কিন্তু আড়ালে গালাগালি দেওয়া শুরু হলো। হেমন্ত সবই জানতে পারছেন। কিন্তু কোনও মন্তব্য করছেন না।
অনুষ্ঠানের শুরুতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রয়াত সজ্জনের সহধর্মিণীকে ডেকে নিলেন তিনি। বলতে শুরু করলেন, 'হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অমুক হয়ে গেছেন, তমুক হয়ে গেছেন। এত টাকা নিয়েছে, প্লেন ফেয়ার নিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি সবই আমার কানে এসেছে। সবই সত্যি।' তিনি স্বীকার করলেন, অনেক টাকা নিয়েছেন। কেন? 'সাধারণত এই সব Charity Programme-এ যাঁর জন্য Charity তিনি কিছুই পান না। তাই আমি আমার সব পাওনা নিয়েছি আর সেই সব অর্থটাই আমি বৌদির হাতে তুলে দিচ্ছি, যাঁর সাহায্যার্থে এই অনুষ্ঠান।' প্রেক্ষাগৃহের মানুষ , তাঁদের মুগ্ধতা বন্ধহীন হয়ে ফেটে পড়ে করতালিতে। 'জাত বাঙালি'?
যখন রোগে কণ্ঠ অবসন্ন হয়ে পড়েছে, তখনও তিনি কেন গাইছেন এ প্রশ্ন উঠতো বার বার। তাও যদি কেউ বলতো, ভালো লেগেছে। তিনি বলতেন, অনেক দিন তো ভালো শুনেছো। এবার একটু খারাপ শোনো। সহধর্মিণী বেলা একদিন বলতে যান, গান ভালো হয়েছে। হেমন্ত উত্তরে বলেন, 'কাকে কী বোঝাচ্ছো?'
একজন তাঁকে বহুদিন ধরে অনুরোধ করছিলেন একটি ক্যাসেটে যদি হেমন্ত দুটি গান গেয়ে দেন, তবে পাঁচ হাজার টাকা দেবেন। তিনি সময় পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ তিনি একদিন নিজেই ফোন করে সেই মানুষটিকে ডেকে পাঠান। বলেন, 'যদি কালকের মধ্যে দশ হাজার টাকা দাও, তবে চারটে গান গেয়ে দেবো। চাও তো পুরো ক্যাসেটটা গেয়ে দেবো।' শেষে কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে পুরো ক্যাসেটটাই তিনি গেয়ে দিলেন। তার পর তিনি বললেন, 'তুমি আমায় বাঁচালে- আমার একটা টাকা আসতে দেরি আছে। কিন্তু মাসটা কাবার হলেই বাড়ি বাড়ি খাম পাঠাতে হবে-না হলে তাদের সংসারে অসুবিধে হবে।‘ 'বাঙালিয়ানা'?
একবার পুজোর সময় ঠিক, হেমন্ত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গান গাইবেন। সবাই তাই জানে। হঠাৎ হেমন্ত জানালেন কোনও অনিবার্য কারণে মুকুল দত্তের গান তাঁকে নিজের সুরে গাইতেই হবে। তাই অভিজিতের গান এবার গাইতে পারবেন না। অভিজিৎ হেমন্তকে জানালেন এমন হলে তাঁর জীবিকায় সমস্যা হবে। তখন হেমন্ত বলেন, বেশ তিনি মুকুল দত্তের একটি গান গাইবেন। অন্যটি অভিজিতের হবে। তবে একটি শর্ত আছে। মুকুল দত্তের যে গানে তিনি সুর দেবেন সেটিও অভিজিতের নামেই বিজ্ঞাপিত হবে। সেই গান দুটি 'আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো' আর 'অনেক অরণ্য পার হয়ে'। বাঙালির সাইকির গভীরে রয়েছে তারা। অভিজিৎ দুটি গানের জন্যই রয়্যালটি পেলেন। আমাদের সমাজে অনুজের অভিভাবক হ'ন তাঁর বড়ো ভাই। 'বাঙালিয়ানা' তারে কয়?
শেষ জীবনে অমিতাভ চৌধুরির বাড়ির রবিবারের আড্ডা হেমন্ত নিয়মিত আসতেন। তিন তলায় উঠতে কষ্ট হতো, তবু। সেই আড্ডায় আসতেন, সুচিত্রা সেন, বসন্ত চৌধুরি, নির্মলেন্দু চৌধুরি, বিকাশ রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, বিজয় চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। কখনও বা সুনীল-শক্তি। সস্ত্রীক সুধীন দাশগুপ্ত। হেমন্ত আড্ডা উপভোগ করেন। কথা কম বলেন। একদিন বলেন, ‘তোমরা ভাবো আমি ব্যস্ত, কাজের মানুষ, আসি কী করে? কিন্তু এখন আর আমি ব্যস্ত নই। বাড়ি থেকে কদাচিৎ বেরোই । একাই থাকি। স্ত্রী বেলা গানটান ছেড়ে শুধু তাস খেলেন। অনেক কাজের লোক আছে। তাই সেরকম অসুবিধে নেই।‘ বাংলা সাহিত্যের সব খবরাখবর রাখেন। বম্বে যাননা আর। তাঁর চিন্তা চারজন বন্ধুকে নিয়ে। তাঁর যৌবনকালের বন্ধু। সমরেশ রায়, অজিত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁদের পারিবারিক খরচ তিনি বহন করেন। 'তাদের তো ফেলে দিতে পারিনা। ওরাও সুখে থাকুক'।
অন্তিম অসুস্থতার সময় হাসপাতালে যাবার আগে নিজে 'খাম' গুলো সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। বলে গিয়েছিলেন নিয়ম মতো তাদের যেন পৌঁছে দেওয়া হয়। যথাসময়ে, নয়তো বন্ধুদের অসুবিধে হয়ে যাবে। সম্পন্ন 'মধ্যবিত্তে'র 'বাঙালিয়ানা'। একটি মানুষ যখন কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন, তাঁকে ঘিরে গল্পেরা গড়ে ওঠে। উঠতেই থাকে। হেমন্তকে ঘিরে গল্পের শেষ নেই। কতো আর লিখি? মানুষ সেই সব গল্প শুনতে ভালোবাসে। যে যাই বলুক, মানুষ তো শেষ পর্যন্ত 'তিমিরবিনাশী'ই হতে চায়। হেমন্ত ছিলেন বাঙালি মূল্যবোধের সময়প্রহরী। গুরু রবীন্দ্রনাথের থেকে ব্যক্তিসত্ত্বা আর শিল্পসত্ত্বাকে মিলিয়ে জীবনে যাত্রাপথের যে কম্পাস তিনি পেয়েছিলেন, তার দিক কখনও ভুল হয়নি। এমনি এমনি একটা মানুষ হাত বাড়ালেই আকাশ ছুঁতে পারে না।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বলতেন 'দেবশিল্পী'। সলিল চৌধুরী বলতেন, 'হেমন্তদা বা লতা যখন আমার গানের শিল্পী, তখন কল্পনা আমার দিগন্ত ছাড়িয়ে যায়। Sky is my limit.'
আকাশই তাঁর সীমা হতে পারে। আকাশ পেরিয়ে ঐ পারেও রয়েছে তাঁর রাজপাট। বাঙালি হয়ে জন্মাবার সুবাদে যেসব ওয়রিশন ফাঁকতালে পেয়ে গেছি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে একটি সেরা অহংকার। নীল ধ্রুবতারা। সব প্রশ্ন থেমে যায় সেদিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে থাকাটাই আমাদের প্রাপ্তি । অমলিন উজ্জ্বল উদ্ধার।
.
লেখা যথারীতি দারুণ লাগলো।
কিন্তু আমার ক্ষুদ্র বিচারে এই লেখায় বেশ কিছু জায়গায় হেমন্তের আচরণকে যে 'বাঙালিয়ানা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা মনে হয় ঠিক বাঙালিয়ানার থেকেও এক বড় মনের মানুষের লক্ষণ
ভারি ভালো লাগলো। অনেক পুরোনো কথা মনে পড়লো।
মিত্র ইন্সটিটিউশনে আমি যখন প্রাথমিক স্তরে, প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সরস্বতী পুজোয় আসতেন। আন্দাজ করছি সাতাশি সালের কথা। আমার স্মৃতিতে খুব অস্পষ্ট সেই ঘটনা। সরস্বতী পুজোয় ভিড় তো এমনিতেই খুব হত, তার ওপর হেমন্তবাবু আসায় আরো ভিড়। চাপা গুঞ্জন, "হেমন্ত এসেছেন হেমন্ত এসেছেন"। মা বলে, এর মধ্যেই আমার জনৈক সহপাঠী নাকি সামান্য অসহিষ্ঞু হয়ে "হেমন্ত কই? কোথায় হেমন্ত?" বলে একটু চেঁচিয়ে ওঠে। তার তেমন দোষ নেই, ঐ হাইট থেকে, ভিড় ছাপিয়ে, পাশ দিয়েই হেঁটে যাওয়া হেমন্তবাবুকে দেখা তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। অতঃপর দীর্ঘকায় হেমন্তবাবু নাকি এক ঝটকায় শিশুটিকে কোলে নিয়ে, "এই যে বাবা আমিই হেমন্ত" বলে তাকে শান্ত করেন।
আমার ছোড়দা Shib Chaudhury লিখছেনঃ
আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো। এক এক বন্ধুুর মধ্যবর্তিতায় বিভিন্ন জগতের বহু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। তদ্ধেতু অভিজ্ঞতার ঝুলিও সমৃদ্ধ হয়েছে।
এদেরই একজন পিন্টুদা, পিন্টু ভট্টাচার্য। আমার থেকে প্রায় ছ'বছরের বড়। ফলে বন্ধুতার সঙ্গে সঙ্গে স্নেহ আর পক্ষপাতিত্ব পেয়েছি অফুরান। তৎসত্ত্বেও বয়েসের কারণে কোনো আলোচনাতেই অস্বস্তি হয়নি কোনোদিন।
পিন্টুদার সবথেকে প্রিয় বন্ধু এবং তবলায় সহযোগী ছিলেন বুল্টুদা অর্থাৎ সুব্রত বসু। আজও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই গভীর। এই দুজনের জন্য সেই সময়ের আধুনিক সংগীত জগতের প্রায় সমস্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে প্রণাম করার সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে স্নেহমধুর ব্যবহারের মিশ্রণ বিস্ময়কর।
কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোটভাই অমলদার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। উনি একবার আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন ওনার বাড়িতে। পিন্টুদা বুল্টুদা আমি আর আরো দুজন। দু-তিনজন গায়ক গায়িকা আর বুল্টুদা মানেই প্রচুর গান বাজনা। শেষ বিকেলে অমলদার বাড়ি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল গান বাজনা। অমলদার এক বিশেষ গুণ ছিল যেকোনো লেখা এমনকি খবরের কাগজও হাতে ধরিয়ে দিলে মুহূর্তমাত্র সময় না নিয়ে সুর তৈরি করে হারমোনিয়ম সহযোগে গেয়ে দিতেন। আমি একবার পিন্টুদার ভাইঝির বিজ্ঞানের বই ধরিয়ে ছিলাম। উনি নির্দ্ধিধায় গান তৈরি করেছিলেন।
যেহেতু খুব ঘনিষ্টদের উপস্থিতি ছিল তাই হারমোনিয়ম তবলার সমভিব্যাহারে ফিশফ্রাই আর হুইস্কি এসে গেল। গান-আড্ডার আসর বেশ জমে উঠেছে। বোম্বাই-এর এক নায়কের দান ধ্যান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অমলদা উঠে বাড়ির ভিতরে গেলেন। ভাবলাম টয়লেট অথবা ডিনারের তত্ত্বাবধানে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন। হাতে এক বাঁধানো খাতা। খাতাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, দ্যাখো। খুলে দেখলাম রুলটানা খাতা, তার প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে নাম আর ঠিকানা লেখা। নিচে পেন্সিলে খোপ কাটা। তাতে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর লেখা, তার পাশে পাশে টাকার অঙ্ক তারিখ আর স্বাক্ষর। 128পৃষ্ঠার খাতার প্রায় 115-16 পৃষ্ঠাতেই বিভিন্ন ব্যক্তির নাম লেখা। টাকার অঙ্ক দেখলাম এক এক জনের এক এক রকম। 150 টাকা থেকে 1200 টাকা। যা তখনকার দিনে বেশ বড় অঙ্ক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মাসের প্রথমেই টাকা পাঠিয়ে দেন। আর অমলদার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে গোপনে সাহাজ্য পৌঁছে দেওয়া।
অমলদার সঙ্গে বহুদিনের সম্পর্ক। সেদিন ভাগ্যিস অমলদার পানের মাত্রা একটু বেশি হয়েছিল !
লেখা নিয়ে কিচু তো বলার নেই, ছবিখানা মনোহরা। সাধু সাধু।
আজকালের হেডলাইন - "শরতে হেমন্তপতন"।
আচ্ছা, এই গানটা --" এমন একটা ঝড় উঠুক, পৃথিবীতে কোন ফুল যেন ফুটতে না পারে" কি হেমন্তকুমারের গাওয়া? কথাগুলো স্মৃতিতে একটু এদিক ওদিক, হয়তো। আসলে সত্তরের শেষের দিকে কোলকাতায় এসে ছন্নছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি। চারদিকে যুব কংগ্রেসের নেত্য! সেই মনখারাপের দিনে মাইকে বাজতে থাকা ওই গানটা আমাকে আপ্লুত করেছিল।
কেউ যদি বলতে পারেন তো ভাল লাগবে।কথা সলিলের বলেই মনে হচ্ছিল --তাই।
Haa
খোদ সলিলের লেখা গণ নাট্য মঞ্চের গান
শিল্পী - ভাইও অউর বাহেনো , আপ সব কি মনপসন্দ হেমান্থ কুমার
রঞ্জনদা ও কুশানবাবু, দুটো গানই সলিল-চ্যালা অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ও সুর করা। প্রথমটার কথায় সলিলের ছায়া খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে, কিন্তু আমার কানে দুটোই অসলিলিয় কিন্তু অসাধারণ সৃষ্টি। অভিজিতের সলিল ছায়া পাই খুব স্পষ্টভাবে আশা ভোঁসলের "ও পাখি উড়ে আয়" আর মান্নাবাবুর "কে তুমি কে তুমি শুধুই ডাকো"-র সুরে। দুটোই ছবির গান।