এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • তিব্বতে তথাগত (পর্ব - ১৫)

    সৈকত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৪ জুন ২০২০ | ১৯৭০ বার পঠিত
  • “প্রায় সেরকমই। শান্তরক্ষিতকে তিব্বতে নিয়ে আসার জন্য রাজাদেশ নিয়ে বা সালনাং যখন রওয়ানা দিলেন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে ঠিস্রোং দেচেনের কয়েকজন মন্ত্রী এসে রাজাকে বলল, ভিনদেশ থেকে সাধু সন্ন্যাসী আনতে তো বললেন - কিন্তু রাণী জিনচেং-এর কথা এত জলদি ভুললে তো চলবেনা মহারাজ। খোটান দেশীয় সেই সব সাধুরা আসার পর কী হয়েছিল মনে আছে তো? শেষ অবধি আমাদের রাণী সাহেবাকে কিন্তু সেই মহামারীতেই প্রাণ হারাতে হয়েছিল। সুতরাং সাধু সাবধান…”
    “হেব্বি চুকলিবাজ তো!” শুভ মন্তব্য করল।
    “তুই ভাব, যদি তোর প্রোজেক্টে অন্য একটা প্রোজেক্ট থেকে একজনকে ধরে এনে লিড বানিয়ে দিল - আর সে তোর ডানা ছেঁটে দিল - কেমন হবে? এও তাই। রাজনীতি সর্বত্রই। ঠিস্রোং দেচেনের যে সমস্ত মন্ত্রীরা ভেবেছিল যে এদেশে বৌদ্ধ ধর্মর বিকাশে আখেরে হয়ত তাদের ধর্ম ব্যবসার ক্ষতি, তারা তো বাগড়া দেবেই - এতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন বুদ্ধিমান ছিলেন। মন্ত্রীদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারলেও তাদের কথা একেবারে উড়িয়ে দিলেন না। কথা দিলেন যে আচার্য লাসাতে প্রবেশ করা মাত্র তাকে গৃহবন্দী রাখা হবে ‘জোখাং’ মন্দিরে। এতে সুবিধা দুই - এক, রাজপারিষদরা খুশি থাকল এই ভেবে যে রাজা তাদের মতামতের গুরুত্ব দেন - এর ফলে অশান্তির সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, আচার্যকে বৌদ্ধ মন্দির জোখাং-এ রাখলে আচার্যের প্রতিও অসম্মান হবেনা। তিনি নিজের পূজা-প্রার্থনা, লেখা লিখি নিয়ে নিভৃতে নিজের মত থাকতে পারবেন। আর সম্রাট নিজেও আচার্যের প্রজ্ঞা এবং তিনি এই গুরুভার বহনের উপযোগী কি না - সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চান। সুতরাং শান্তরক্ষিত লাসা নগরে এসে কোয়ারেন্টাইন্ড হলেন জোখাং মন্দিরে। টেস্টামেন্ট অফ বা বলছে, রাজা পরীক্ষা করতে চাইলেন নেপাল থেকে আসা এই ভিনদেশি সন্ন্যাসীর সাথে কোনও কালো-জাদু বা অশুভ আত্মা এসে উপস্থিত হয়েছে কি না। তাই আচার্য কে অনুরোধ করা হল কিছুকাল ‘হেন খাং’-এ থাকার জন্য।”
    “এই একবার বলছ ‘জোখাং’ একবার বলছ ‘হেন খাং’। ‘হেন খাং’টা আবার কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
    “হ্যাঁ। ভাল প্রশ্ন। টেস্টামেন্ট অফ বা-এর যে দুটি টুকরো নিয়ে স্যাম আর ওর কোলিগ পরীক্ষা করছিল - সেখানে লেখা আছে ‘বেন খাং’। এ ছাড়া অন্যান্য সংস্করণে অন্য যে সব নাম পাওয়া যায় সেগুলি হল - ‘পে হার’, ‘হেন খাং’, ‘স্তোন খাং পে হার’ ইত্যাদি।”
    “পে হার? এটা কি কোন ভাবে ‘বিহার’এর অপভ্রংশ? ভারতবর্ষ থেকে শব্দ নিয়ে তিব্বতিরা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে - সেটা তো আগেই বললে।” মঞ্জুশ্রী বলল।
    “ডি লা গ্র্যান্ডি! ঠিক বলেছিস। ‘পে হার’ শব্দটি যে সংস্কৃত শব্দ ‘বিহার’ থেকে এসেছে - তাতে সন্দেহ নেই।‘বেন খাং’ বা ‘হেন খাং’ বা ‘স্তোন খাং’ আসলে একটি নির্দিষ্ট মন্দিরকেই নির্দেশ করে। ‘মন্দির’ বা ‘বিহার' যাই বল। কিন্তু কোন মন্দির? অন্যান্য সূত্র ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে লাসার ‘জোখাং’ মন্দির সম্রাট স্রোংচান গামপো যখন নির্মান করান, এর নকশা করা হয়েছিল ভারতবর্ষের কোন একটি বিহারের অনুকরণে। আর সেই ভারতীয় বিহারটিকে তিব্বতি টেক্সটে ‘হেন খাং’ বা ‘বেন খাং’ বলে বর্ণনা করা আছে। সুতরাং জোখাং মন্দিরকেই যে টেস্টামেন্ট অফ বা-এর সম্পাদকেরা ‘বেন খাং’ বা ‘হেন খাং’ বলে বর্ণনা করেছেন - সেটা সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। অতএব শান্তরক্ষিতকে ‘জোখাং’ মন্দিরে থাকতে আদেশ দিলেন সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন।”
    “তারপর? রাজা নিশ্চিন্ত হলেন কীভাবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
    “তিন মন্ত্রীকে রাজা পাঠালেন আচার্যের কাছে। উদ্দেশ্য যাচাই করে নেওয়া। রাজা নির্দেশ দিলেন, তোমরা গিয়ে আগে আচার্যকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবে। তারপর তার সাথে আলোচনা করবে। আলোচনার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করবে যে তিনি সত্যিই প্রজ্ঞাবান নাকি পোষা অপদেবতা দিয়ে আমার তথা এই সমগ্র তিব্বতের ক্ষতি করার তালে আছেন। রাজার কথা মত মন্ত্রীরা জোখাং-এ গেলেন। আচার্যকে প্রণাম করে রাজমন্ত্রী প্রশ্ন করলেন, হে আচার্য, আমরা জানি আপনি সেই গৌতম বুদ্ধের দেশ ভারতবর্ষ থেকে এতখানি পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের রাজার আহ্বানে এসেছেন। এর জন্য আমরা সম্রাটের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে আমরা আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক। আপনি যদি আদেশ করেন। আচার্য সব শুনে স্মিত হেসে বললেন, বাপু হে তোমরা এতক্ষণ যা বললে তার এক বর্ণও আমার বোধগম্য হল না। তোমরা কি সংস্কৃত বা অন্য ভারতীয় ভাষা জান? এবার মন্ত্রীদের মাথা চুলকনোর পালা। আচার্যের কথা তারা কিছু বুঝতে পারলেন না। তাহলে কথাবার্তা হবে কী করে? এক মন্ত্রী বললেন, দোভাষী চাই। খোঁজ লাগাও কে সংস্কৃত বা সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন কোন ভারতীয় ভাষা এবং তিব্বতি ভাষা দুই জানে। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল অনন্ত নামে এক ব্রাহ্মণকে। ভদ্রলোক আদতে কাশ্মীরী। কোনও এক অপরাধের জন্য বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিব্বতে। তিনিই শেষ পর্যন্ত এই ভাষা সমস্যার সমাধান করলেন। রাজমন্ত্রীরা অনন্তকে আচার্যের স্থায়ী দোভাষী হিসাবে নিযুক্ত করে আবার প্রশ্ন করার অনুমতি চাইলেন। আচার্য বললেন, নিশ্চয়ই। মনে কোন সংশয় না রেখে বল - কী জানতে চান সম্রাট। মন্ত্রী বললেন, আমাদের সম্রাট জানতে চান আপনার নিজস্ব নীতি সম্পর্কে। উত্তরে আচার্য বললেন, আমি যুক্তিবাদী। যুক্তির মাধ্যমে যা প্রতিষ্ঠা করা যায়, যুক্তি দ্বারা পরীক্ষা করে যাকে সঠিক প্রমাণিত করা যায় তাকে আমি অনুসরণ করি - অযৌক্তিক বস্তু এবং চিন্তাকে আমি বর্জন করি। এই আমার নীতি - এই আমার মতবাদ। মন্ত্রীরা আরও কিছু প্রশ্নের পর রাজার কাছে ফিরলেন। রাজা সব শুনে আবার পরীক্ষার জন্য পাঠালেন তাদের। এভাবে নাকি প্রায় তিনমাস ধরে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আচার্যের পরীক্ষা চলেছিল। শেষ অবধি রাজা খুশি হয়ে শান্তরক্ষিতকে আহ্বান করলেন প্রাসাদে।”
    “বাপরে! এতো একেবারে এফ বি আই! তিনমাস ধরে গ্রিল! স্পাই থ্রিলার মনে হচ্ছে শুনে।” আমি বললাম।
    “এরপর তাহলে শান্তরক্ষিত বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করলেন?” আমার কথার মধ্যেই মঞ্জুশ্রী প্রশ্ন করল জয়দাকে।
    “দিল্লি আভি ভি বহোৎ দূর হ্যায়!” বলে জয়দা একটু রহস্যময় হাসল।

    *******

    ঘরের দরজা এঁটে শুভ ক্লাস নিচ্ছিল।
    প্রতি রবিবার সকালে দু ঘণ্টার ক্লাস। নটা থেকে এগারোটা। ওবেলা দুই ঘণ্টা সামলাতে হবে মঞ্জুশ্রীকে। বিকেলবেলা খেলাধুলো করে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসতে না চাওয়া ছানাগুলোকে পড়ানোর মত দুরূহ কাজ একমাত্র ওর পক্ষেই সম্ভব। অসীম ধৈর্য তার। কে ঢুলে পড়ছে, কে পেন্সিল দিয়ে অন্যকে খোঁচা মারছে - সেসব দেখে শুনে বকাবকি করে এগারোর নামতা মুখস্থ করানোর ক্ষমতা ওরই আছে।
    ‘নামে মঞ্জুশ্রী, কাজে য়েশে চোগিয়াল!’ জয়দা বলল। আমি আর জয়দা আপাতত ঘরের এসি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাইরের ঘরের সোফায় আধশোয়া। জয়দা কী একটা বই নিয়ে মুখের উপর মেলে রেখেছে। আমি মাথার উপরের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ফ্যানখানির চেন্নাইয়ের এই গরমকে সরিয়ে আমাদের ‘তৃষ্ণার শান্তি’ জাতীয় কিছু দেওয়ার করুণ প্রচেষ্টাকে মনে মনে তারিফই করছিলাম। এমন সময় অপার নীরবতাকে ভঙ্গ করে জয়দা ওই মন্তব্যটা করল।
    আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সে আবার কে?”
    “পদ্মসম্ভবের বৌ। এই যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এমন সাধনা - কাউকে দেখেছিস?”
    “তা বটে! এত যুদ্ধ করে ল্যাপটপ পৌঁছে দিয়ে আসা। তারপর আবার পড়ান - একেবারে ধন্যি মেয়ে!” আমি সমর্থন করলাম, “কিন্তু আমাদের এই বগলাচরণের নাম ‘শুভ’ কেন হল বলতে পার?”
    “পদ্মসম্ভব হওয়া উচিৎ ছিল - বলছিস?” জয়দা মুখের থেকে বইটা সরিয়ে বলল।
    আমি সবে এমন অসম্ভব নামকরণের কারন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় রবি ঠাকুর দরজা ঠেলে প্রবেশ করল। বাজারে গেছিল। লকডাউনের বজ্রা-আঁটুনি এতদিনে ফস্কা গেরোতে পরিণত হয়েছে। গলির ভিতরের দোকানপাট খুলে বসেছে আবার। রাস্তায় জনসমাগম অপেক্ষাকৃত বেড়েছে। শহরে প্রাণ ফিরছে। কিন্তু অন্যদিকে করোনার আক্রমণ থেমে নেই। চিন্তা সেখানেই।
    রবিকে পাঠিয়েছিলাম পাড়ার দোকান থেকে একটু আনাজপাতি নিয়ে আসতে। অনলাইন গ্রোসারির বিস্বাদ সবজি খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গেছে। তাই মুখ বদলের জন্য বললাম কচি পটল পেলে নিয়ে এস। আর ফেরার সময় কৃষ্ণা সুইটসে যদি কালোজাম পাওয়া যায় - তাহলে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’-এর জন্য তাও খান দশেক আনতে বলেছিলাম। রবি ঘরে ঢোকা মাত্র হাতে কৃষ্ণা সুইটসের প্যাকেটটা দেখে জয়দা সোফা ছেড়ে ‘মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ’ গাইতে গাইতে উঠে রবির দিকে এগিয়ে গেল। আমিও পদ্মসম্ভব-টম্ভবকে মনের মধ্যে চেপে রেখে কালোজামের দিকে চিত্তকে ডাইভার্ট করে দিলাম। শুভর পড়ানো হয়ে গেলে আমাদের কপালে এসব আর জুটবে কি না সন্দেহ।

    “পদ্মফুল ইয়েস, পদ্মগোখরো ইয়েস, পদ্মলোচন ইয়েস, এমনকি পদ্মনাভও ইয়েস - বাট নো পদ্মসম্ভব!”
    সন্ধ্যেবেলা মঞ্জুশ্রী পড়ান হয়ে গেলে আমাদের ঘরে এসেছিল। শুভ নাকি খবর দিয়েছে যে কালোজাম এসেছে। তাই চেখে দেখার জন্য এসেছে। অবিশ্যি সকালে আনা কালোজাম সন্ধ্যে অব্ধি থাকত না। কিন্তু মহীয়সী আমাকে আর জয়দাকে হোয়াটস্যাপ করে ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছিল যে কালোজাম না পেলে অনাসৃষ্টি কাণ্ড বাধাবে। আমরা তাই ভয়ে ভয়ে খান দুয়েক বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।
    ঘরে ঢুকেই কালোজাম দুখানা টপাটপ মুখে ফেলে দিয়ে প্যাকেটটাকে মুড়িয়ে ফেলে দিয়ে হাত দিয়ে মুখটুখ মুছে যেন কিছুই হয়নি এমন একটা নিষ্পাপ মুখে মঞ্জুশ্রী বলল, “গল্প বল।”
    জয়দা চশমা এঁটে প্রচণ্ড ভুরু কুঁচকে ল্যাপটপে ওর টিমের কার একটা কোড রিভিউ করছিল। আর মাঝে মধ্যে ‘লুপের মধ্যে লুপহোল বানিয়ে রেখেছে!’, ‘এটা কোড না কোমোড!’ ইত্যাদি অনুপ্রাস যুক্ত গালাগালি বিড়বিড় করে যাচ্ছিল। আমি আমার খাটে বসে একটা গ্রাফিক নভেলে মনোনিবেশ করেছিলাম। মঞ্জুশ্রীর ‘গল্প বল’ শুনে জয়দার দিকে তাকালাম। জয়দা স্থিতপ্রজ্ঞমুনিপ্রবরের মত কোড থেকে মুখ তুলল না অবিশ্যি। মঞ্জুশ্রী আবার বলল, “কী গো! আমাদের ‘র‍্যাক্সিট’ কী করলেন তারপর? বলবে তো!”
    জয়দার কানে কথা পৌঁছল এবার। তবে নজর ঘুরল না। মুখ না তুলেই বলল, “র‍্যাক্সিটের এক্সিট হয়ে গেল। পিকচারে এলেন দ্য লোটাস বর্ন - পদ্মসম্ভব। নাম শুনেছিস?”
    অমনি খাটের উপর কেমন একটা গোঁত্তা খেয়ে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে শুভ জানিয়ে দিল পদ্মফুল, পদ্ম গোখরো, পদ্মলোচন মায় পদ্মনাভ অবধি ওর বিদ্যে আছে - কিন্তু পদ্মসম্ভব সিলেবাসের একেবারে বাইরে। আমার বা মঞ্জুশ্রীরও যে সিলেবাস ‘পদ্মসম্ভব'কে মনে রেখেছে - তা নয়। কিন্তু সিকিমের কোনও এক মোনাস্ট্রির ভিতরে বুদ্ধদেবের মূর্তির পাশে অন্য এক ব্যক্তির মূর্তি দেখিয়ে বাবা বলেছিল, ‘ইনি পদ্মসম্ভব’ - সেটা মনে পড়ল। কিন্তু তিনি যে কে - সেটা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি বাবার কাছে। জয়দাকে বললাম সে কথা।
    “ঠিক। তবে আরো খোঁজ করলে জানতে পারতিস ওই সিকিমেই একটি লেক আছে। গুরুদোংগমা।”
    “হ্যাঁ জানি তো। গেছি আমি। ষোলহাজার ফুটের উপর অল্টিটিউড। কিন্তু তার সাথে পদ্মসম্ভবের কী সম্পর্ক তা তো জানিনে!” মঞ্জুশ্রী স্কুলের ছাত্রীর মত হাত তুলে বলে উঠল।
    “গুরু পদ্মসম্ভব যখন তিব্বত থেকে ফিরছিলেন, ফেরার পথে দেমোজং-এর, যাকে আমরা এখন সিকিম নামে জানি, তার উত্তর প্রান্তে এই হ্রদের ধারে এসে পৌঁছন। পদ্মসম্ভব নির্ণয় করেন যে ওই হ্রদ এক পবিত্র স্থানে অবস্থিত। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডার জন্য নাকি হ্রদটি সারা বছরই প্রায় জমে থাকে। এ জন্য স্থানীয় অধিবাসীরা গুরুর কাছে এসে অনুরোধ করেন যে এই হ্রদের জলকে ব্যবহারোপযোগী করে দেওয়ার জন্য। পদ্মসম্ভব তখন নাকি হাত দিয়ে জলকে স্পর্শ করা মাত্র বরফ সরে গলে গিয়ে জল বেরিয়ে পড়ে। সেই স্পর্শধন্য হওয়ার কারণে এই হ্রদ আজও বৌদ্ধদের কাছে ভীষণ পবিত্র।”
    “ওরে বাবা! পদ্মসম্ভব এসব ম্যাজিক জানতেন নাকি? কিন্তু তিনি কে? তিব্বতে গেলেন কেন? আর বৌদ্ধদের সাথেই বা তার কী সম্পর্ক?”
    মঞ্জুশ্রীর এতগুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে জয়দা কেমন ফিচেল মার্কা হাসি হেসে শুধু বলল, “ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া।”

    মঞ্জুশ্রী অবিশ্যি কম যায় না। সাথে সাথে বলল, “ওই জন্যই তো বলছি - তোমার দূরের গাথা তোমার বনের বাণী যা আছে চটপট শুনিয়ে ফেলতে। এত রহস্যের কী আছে তো বুঝিনা!”
    ওর ইন্স্যুইংগারকে যে কেউ এমনভাবে মাঠের বাইরে চালান করে দিতে পারে সেটা জয়দা বুঝতে পারেনি। গম্ভীর হয়ে গলা ঝেড়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে বলল, “হুম। তাহলে আবার ফেরত যেতে হবে যেখানে ছেড়ে এসেছিলাম। আচার্য শান্তরক্ষিত তো রাজসকাশে গেলেন। সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন আদর আপ্যায়ন করে আচার্যকে তার মনের অভীপ্সার কথা খুলে বললেন - তিনি দুটি কাজে সাহায্যের জন্য শান্তরক্ষিতকে আসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এক, এই মূর্খ তিব্বতবাসীর মধ্যে বৌদ্ধধর্মের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি যেন রাজাকে সাহায্য করেন। দুই, নালন্দার মত এখানেও তিনি একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করতে ইচ্ছুক। তার জন্য জায়গা জমি দেখে রেখেছেন তিনি। লাসা থেকে কিছুটা দূরে - ইয়ার্লুং সাংপোর তীরে ‘সাম-য়ে’ নামে একটি স্থান। এবার আচার্য যদি সম্মত থাকেন তাহলে বিহার নির্মাণের পরে ওই বিহারের দায়িত্ব সম্রাট তার হাতেই সমর্পণ করতে ইচ্ছুক। আজীবনকাল তিনি বিহারের অধ্যক্ষ হিসাবে তিব্বতি জনজীবনে মহামানব বুদ্ধের বাণী প্রচারের দায়িত্বে থাকবেন। রাজার প্রস্তাব শুনে আচার্য দ্বিরুক্তি করলেন না। তার মত পরম মহাযানী বৌদ্ধর কাছে এই অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকা তিব্বতিদের মধ্যে ভগবন বুদ্ধের বাণী, মতবাদ প্রচার করে এদের তথাগতর শরণাগত করার চেয়ে বড় কাজ আর কীই বা হতে পারে? জগতের উদ্ধারই তো তার জীবনের মূলমন্ত্র।”
    “অফার অ্যাক্সেপ্ট করে নিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
    “হ্যাঁ। সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন ওই জোখাং মন্দিরেই আচার্যের বাসস্থান নির্দিষ্ট করে দিলেন। আর প্রতিশ্রুতি দিলেন সবরকম সাহায্যের। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় এক!”

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৪ জুন ২০২০ | ১৯৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৫ জুন ২০২০ ০৬:০৬94339
  • শুধু পদ্মসম্ভব বলে নয়,  ভক্তিবাদের ধর্মই দেবত্ব আরোপ, তাই তথাগতসহ তারও মূর্তি হবে,  তিনিও পূজিত হবেন,  এমনকি সংশ্লিষ্ট দেশে মূল ধর্মেও যুক্ত হতে পারেন,  এই যেন স্বাভাবিক।  

    আরও পরে খ্রিস্ট ধর্মেও দেশে দেশে  যীশুর মূর্তির পাশাপাশি ধর্ম প্রচারক বিভিন্ন সাধুও ছোট ছোট আইকনে  পূজিত হন। 

    তবে এটি বিস্ময়কর গৌতম বা যীশু কেউই তাকে মৃত্যুর পরে পূজা দিতে বলেন নি, গৌতম তো আরও বিস্ময়কর,  ভগবান-স্বর্গ- নরক সম্পর্কে কোনো ধারণাই দেন নি। 

    সে ভিন্ন প্রসংগ। আরও গল্প হোক                         

  • :|: | 174.255.***.*** | ২০ জুন ২০২০ ১১:০৬94476
  • পরের পর্ব কখন আসবে? পর্বে পর্বে বেশী গ্যাপ হয়ে গেলে নামগুলো ভুলে যাই যে!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন