আগে ইতিহাসে লেখা থাকত - তারপরে সেনাপতি বিদ্রোহ করিলেন। কিন্তু কেন তিনি বিদ্রোহ করিলেন, দেশের কোন পরিস্থিতিতে বিদ্রোহ করা সম্ভব হল, কেন প্রজারা সেই বিপ্লবকে সমর্থন করলেন - এসব লেখা থাকত না। এর পরের স্টেজে এল ইডিওলজিকাল ইন্টারপ্রিটেশন। যেমন মার্ক্সিস্ট হিস্টোরিয়ানরা কজাল অ্যাানালিসিস করলেন ক্লাসের দিক থেকে।
অন্যদিকে এখনও অনেক ইতিহাসের চর্চা দেখি মূলতঃ প্রথম ধারার। মানের ঘটনা পরম্পরা বিবৃত করা। সময়টাকে ধরার চেষ্টা নেই। বিশেষতঃ যখন প্রোটাগনিস্টের কোন আপাতবিরোধী ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। যেমন ধরুন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর যাঁকে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সোশাল রিফর্মার বলে ভাবা হয়, বিশেষতঃ নারীবাদী হিসেবে - সেই বিদ্যাসাগরই নাটকে মেয়েদের যোগদানের খুবই বিরোধীতা করেছিলেন। এটা তো ঘটনা। এখানে "দেখ বিদ্যাসাগরের হিপক্রিসি" বলে থেমে গেলে ইতিহাসচর্চা হল না। তিনিই ভাল ঐতিহাসিক যিনি বোঝার চেষ্টা করেন কী কারণে ও অবস্থায় বিদ্যাসাগর এই পজিশন নিয়েছিলেন।
আরেকটা উদাহরণ নিই। রবীন্দ্রনাথ। অত্যন্ত আধুনিক নারীবাদী। তিনি গৌরীদান করেছিলেন। বহু ঐতিহাসিক এই বলে থেমে জাজমেন্টাল হয়ে রবীন্দ্রনাথের স্ববিরোধীতা নিয়ে পাতা ভরান। সেটায় নতুন কিছু নেই। আধুনিক ঐতিহাসিক কিন্তু তখনকার সমাজ, রবীন্দ্রনাথের পরিবার ইত্যাদি অ্যানালিসিস করছেন।
যেকোন ঐতিহাসিক চরিত্রে প্রচুর স্ববিরোধীতা। সেগুলো ডকুমেন্টেড। শুধু সেই স্ববিরোধীতার চর্চায় নতুন কিছু নেই। কজাল অ্যাানালিসিস আর ইন্টারপ্রিটেশনই আধুনিক ইতিহাস চর্চা। অন্ততঃ আমি যা বুঝি।
ভাটিয়ালি-সঞ্জাত তিক্ততার বিন্দুমাত্র রেশ না রেখে এখানে কিছু লিখতে চাই। সিএস এবং ন্যাড়া যদি আমাকে বলেন যে তাঁরাও সেই তিক্ততা ভুলে গিয়েছেন, তবেই লিখব।
এখানে লেখার মূল ঝোঁকটা আছে গান্ধীর ওপরে। তারই রেশ টেনে ন্যাড়া (নাকি সম্বিৎ-ই বলতে হবে?) বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ এনেছেন মূলত, তবে রবীন্দ্রনাথও আছেন।
এই প্রসঙ্গে আমি নিজের মতটা বলি অর্থাৎ আমি নিজে যখন ইতিহাসের চর্চা করব তখন মূলত কোন কোন দিকগুলোকে ফোকাসে রাখব, কোন কোন দিকগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে হয় আনবই না, কিংবা আনলেও কেবল ছুঁয়ে চলে যাব।
ভাটিয়ালিতে এ বিষয়ে অরণ্য আমাকে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি তাঁকে উত্তরে যা বলেছিলাম তার মোদ্দা ব্যাপারটা হল এই --- একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাস রচনা করা এখন সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেছে। যদিও আমাদের দেশে, আমি নিজে মনে করি, এই ধারার প্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো অজান্তেই। এখন খ্যাতির বিড়ম্বনা তাঁর ছিল, পাশাপাশি এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাঁর আমলে শ্রেষ্ট বাঙালি ইন্টেলেকচ্যুয়াল তিনিই ছিলেন। তো তার নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে চারিত্রপূজা-য়। সেখানে তিনি কোনও সভা বা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন, প্রবন্ধ পাঠ করেছেন কিংবা মানুষটাকে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর নিজের মতো করে সেটাই ছাপার অক্ষরে দেখি আমরা। যদিও বীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর দর্শনগত জায়গার দিক থেকে হয়তো যাঁর সম্পর্কে বলেছেন বা প্রবন্ধ পাঠ করেছেন, তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন ঘরানার।
তবে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের আর কিছু না নিলেও, অন্তত ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এই চারিত্রপূজা-র ধাঁচাটাকে আপন করে নিল। ফলে বিদ্যাসাগরের প্রথম যে চারটে জীবনী লিখলেন শম্ভুচন্দ্র, চণ্ডীচরণ, বিহারীলাল এবং সুবল চন্দ্র মিত্র সেখানে নির্ভেজাল ব্যক্তিপুজো শুরু হল। একই কথা খাটে গান্ধীর ক্ষেত্রেও। তাঁর প্রথম জীবনীকার তাঁরই নির্দেশে জীবনী রচনা করেছেন (যেমন নারায়ণচন্দ্রের অনুরোধে জীবনী রচনায় নেমেছিলেন চণ্ডীচরণ) এবং তার পরে সেই জীবনীকে আকর গ্রন্থ বিবেচনা করে একের পর গান্ধী-জীবনী রচিত হয়েছে। এই ব্যাপারটা জিবি সিং-এর বইতে ডিটেলে আছে।
এই হেজিওগ্রাফি-পর্ব শেষে শুরু হল একদম একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত অবস্থানকারী মার্ক্সিস্ট ইতিহাস বয়ান। গান্ধীর ক্ষেত্রে রজনী পাম দত্ত, বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে বিনয় ঘোষ। সেখানে শ্রেণি প্রাধান্য পেল সবচেয়ে বেশি। উন্মোচিত হল শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উক্ত ব্যক্তিটিকে বিশ্লেষণ করার এক নতুন ন্যারেটিভ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, তার সীমাবদ্ধতাও একটা সময়ে পৌঁছে প্রকট হতে শুরু করল।
এইবারে আসল ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে পোস্ট-কলোনিয়াল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক এবং সাব-অল্টার্ন দৃষ্টিভঙ্গী। এখানে ব্যাপক গুরুত্ব পেল সমকালীন সময়, তার রাজনীতি-অর্থনীতি; অন্যদিকে সাব-অল্টার্ন ইতিহাসবিদরা জোর দিলেন নিম্নবর্গের প্রান্তিক মানুষদের ওপরে।
আমি নিজে মনে করি বর্তমানের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে একজন সৎ, পরিশ্রমী ইতিহাস চর্চাকারীকে (সে তিনি যতই অ্যামেচার হন না কেন) তিনটে দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গোটা সময়টাকে বিবেচনা করতে হবে - মার্ক্সিস্ট ধারা, পোস্ট-কলোনিয়াল ধারা এবং সাব-অল্টার্ন ধারা।
এবারে গান্ধী রেসিস্ট কি রেসিস্ট নন তার প্রচুর নিদর্শন গান্ধী নিজেই রেখে গেছেন। বর্তমানে সে সব সহজলভ্য। একই সঙ্গে এই কথাও সত্য গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকা পর্ব নিয়ে সত্যিকারের ভালো বই বা লেখালেখির পরিমাণ অবিশ্বাস্য রকমের কম। তাঁর ভারতে প্রত্যাবর্তনের সময় থেকে মুলত ইতিহাসবিদরা গান্ধী নিয়ে চর্চা করেছেন। আমি নিজে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা পর্ব নিয়ে লিখতে প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি। অথচ তাঁর জীবনের এই মূল্যবান ২১টা বছর একেবারেই হেলাফেলার নয়, অপ্রাসঙ্গিক তো নয়ই।
আরও একটা বিষয় ইতিহাসের সময় বিবেচনায় খুব জরুরি। সেটা হচ্ছে আমার লেখার কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁকে যে শুধু সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে তা-ই নয়, একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে একই সময়ে তাঁর সমসাময়িকদের বক্তব্য, কাজকর্ম এবং তাঁদের সেই ব্যক্তিটি সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মূল্যায়ন। মোট কথা সাদা ফ্যাটফেটে বা কালো কুচকুচে ইতিহাস চর্চার দিন শেষ, শুরু তাঁর ধূসর এলাকার সন্ধান করা।
গান্ধীর ক্ষেত্রে এই শেষ প্যারামিটারটা খুঁজে বের করা তুলনামূলক সহজ। কারণ তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় প্রচুর রাজনৈতিক ব্যক্তির মূল্যায়ন পাওয়াটা অপেক্ষাকৃত সহজ। সেটা জিন্না-নেহরু-সুভাষ-আজাদ-আম্বেদকর-জিন্না হয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সুবিস্তৃত এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এঁদের কারও গান্ধী-মূল্যায়নই অবিমিশ্র শ্রদ্ধাজনিত নয়। বিশেষত আম্বেদকর-জিন্নার মুল্যায়ন তো মারাত্মক। এখন যে দেশে মুসলমান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, দলিতরাও প্রায় তাই; সেখানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের নেতা হয়েই কি রয়ে গেলেন গান্ধী? তাঁকে প্রোজেক্ট করা হল ১০০ শতাংশ ভারতীয় জনগণের নেতা হিসেবে?
গান্ধী নিজে গোলটেবিল বৈঠকে কতকটা সেই দাবি করেছিলেন। কিন্তু সেটা যে আদতে অসার ছিল তা বুঝতে পারা গেছে গোলটেবিল বৈঠকের মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই। আর রবীন্দ্রনাথ? তাঁর সঙ্গে প্রায় প্রথম থেকেই গান্ধীর আদর্শগত সংঘাত।
আমি এখানে বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গটা ইচ্ছে করেই আনছি না। এবং তাঁর ক্ষেত্রে এই শেষ প্যারামিটার খুঁজে পাওয়ার লোক নগণ্য। কিন্তু বিদ্যাসাগরের যে নারীমুক্তির কথা বলেছেন ন্যাড়া, খুব খেয়াল করে দেখলে সেটাও কি ওই এক-তৃতীয়াংশ নারীর জন্য নয়? কিংবা হয়তো আর কম শতাংশ নারীকে রিপ্রেজেন্ট করেন তিনি।
এভাবে কি আদৌ ভাবা যায়?
অরণ্য, হ্যাঁ 'কোনরকম ধারার ধার না ধেরে একজন সৎ, পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান ইতিহাস চর্চাকারী তথ্যের ভিত্তিতে তার নিজের ইন্টারপ্রিটেশন দিতে পারেন'। আবার সেটাকেই কেউ একটা ধারা হিসেবে বা বিভিন্ন ধারার সংমিশ্রণ হিসেবে সংজ্ঞায়িতও করতে পারেন। না-ও পারেন।
'তা সত্ত্বেও গান্ধী, বিদ্যাসাগর ইঃ-কে কেন্দ্র করে (পজিটিভ, নেগেটিভ যেভাবেই দেখানো হোক, তাদের কেন্দ্র করেই) ইতিহাস রচনা হয়ে চলেছে' কারণ কোনও ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাস চর্চা মানেই নিছক সেই ব্যক্তিটিকে নিয়ে নয়, সেই সময়টাকও ভিন্ন দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা।
এক্ষেত্রে আমি একটা উপমার সাহায্য নিচ্ছি। সেটা হল ভারতের জাতীয় পতাকা। যার কেন্দ্রে একটি চক্র রয়েছে ঠিকই, কিন্তু চক্রটাই পতাকা নয়। সে একটা আয়তাকার পতাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মাত্র। এবং এই ধরণের চর্চা এখন যথেষ্টই হচ্ছে, বাংলা ও ইংরেজি দু'ভাষাতেই।
বড়েস, 'এই ডাইকোটমিটা খুব মুশকিল করছে বিশেষ করে যেখানে একটা ভয়ন্কর ন্যারেটিভ রয়েছে যারা শুধুমাত্র খারাপ দিকটা এমব্রেস করতে বেশি উৎসাহী' কারণ আপনি যদি নীলকে সাদা বলেন আপনার অ্যাজেন্ডা পুরণ করতে, তাহলে আশা করবেন কেন অন্য কেউ তার অ্যাজেন্ডা পূর্ণ করতে তাকে লাল বলবে না? তবে যুগটা এখন বাইনারি কন্সট্রাকশন-রিকন্সট্রাকশন থেকে এগিয়ে গেছে।
আরও একটা হাহাকার ইদানীং কিছু লিবার্যালদের মুখে শোনা যায়। সেটা হল অমুকটা করা যাবে না বা তমুকের ইতিবাচক দিকটাই তুলে ধরতে হবে নতুবা বিজেপির সুবিধা হয়ে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার হাস্যকর লাগে। বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল, তাকে প্রতিহত করতে হলে ইতিহাসচর্চায় পলিটিক্যাল কারেক্টেনেস দেখানোর হদ্দমুদ্দ করা হলে না হয় সেটা ইতিহাস, না হয় কোনও রাজনৈতিক দলকে প্রতিহত করা। একটা টার্ম লিখব ভেবেছিলাম, মানে এই ধরনের শৌখিন ইতিহাসচর্চাকারীদের জন্য তবে শেষ অবধি আর লিখলাম না।
আচ্ছা, আমি তো রিফ্রেশ না করা ইস্তক নতুন লেখা কিছু দেখতে পাই না তাই টিমের পোস্ট চোখে পড়েনি। এখানে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার। এটা আমার টই নয়, আমার লেখা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে না বোধহয়, মানে আমি অন্তত যেটুকু বুঝেছি। কাজেই সে বিষয়ে এখানে আমি কিছুই বলব না। খুবই উৎসাহী হলে সে লেখায় নিজে চলে যান এবং দেখে নিন।
*কন্সট্রাকশন-রিকন্সট্রাকশন নয়, কন্সট্রাকশন-ডিকন্সট্রাকশন।
খ, জানি না টেলিপ্যাথি আছে কি না। আমি যদিও সেটাতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমার মন আজ সকাল থেকেই বলছিল যে আপনি এই টইতে না এসে থাকতে পারবেন না। গত ক'দিন এখানে যে ঝড় আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে - মানে আমাকে নাকি কোন বইমেলায় গুরুর গুরুদেবরা লাথ মারার খোয়াবেও মত্ত। আমি দাঁতে দাত চেপে লড়ে গেছি। বিশ্বাস করুন, অনেক দিন পরে আপনার ফিরে আসাতে আমি সম্ভব ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। একই রকম ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম যখন ইন্দ্রনীলবাবু ফিরে এসেছিলেন।
আপনি ফিরে এসেছেন এটা আমার পরম পাওনা। কাল থেকে আমি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি। গুরুতে নিয়মিত হয়তো আসা হবে না। বা আসলেও এনগেজ হব না। আমার অনেক বড় মাপের কাজ করা বাকি আছে। আজ থেকে সেকাজে সানন্দে মনোনিবেশ করব। শুধু একটাই অনুরোধ, আপনি ফের উধাও হয়ে যাবেন না।
আমি চললাম।