'স্বপ্ন ও বাস্তব' নামে যে গল্পটি সেটির পরিপ্রেক্ষিত হল সাতশো শতকের আরব পৃথিবীর কুফা শহর যেখানে উদয় হয়েছে উময়েদ ইবন জিয়দের, কুফা ও বসরার নিষ্ঠুর শাসক, কারবালার প্রান্তরে হোসেনের হত্যাকারী, তার সময়। অন্ধকার নেমে এসেছে সেই শহরে,ফলতঃ তিন-্চারটি চরিত্র কুফা থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে ভেবে মনস্থ করে আলোকজ্জ্বল মদিনার দিকে যাবে। কিন্তু সংশয় ঘটে যে হয়ত সেই মদিনাও এতদিনে কুফার মতই পতিত হয়েছে, ফলে স্থির করে মক্কার দিকেই যাবে, যা এক শান্তিভূমি। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য রেখেও অনেক ঘুরে শেষ পর্যন্ত এসে পৌছয় কুফারই দ্বারপ্রান্তে। একদিকে মদিনা অন্যদিকে কুফা, এই দুই মেরুর মধ্যে ঘুরে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন বাস্তবের মুখোমুখি হয়, যেখানে স্বপ্নপূরণ হয়না। গল্পটি সমালোচিত হয়েছে, ইন্তিজার হুসেন এই দুই প্রান্ত ছাড়া কিছু দেখেননি, ফলতঃ তিনি শহীদদের বীরত্বও দেখেননি, ইসলামি ইতিহাসেও যা ছিল এবং এর ফলে তিনি ক্রমশঃ নীরবতা আর চুপ করে যাওয়ার দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু যারা সমালোচনা করেছিলেন তারা বোধ করি এই গল্পটির মধ্যে সমসাময়িক পাকিস্তানকে দেখতে পেয়েছিলেন, প্রায় প্যারাবল প্রতিম এই আপাত সরল গল্পটি প্যারাবলের যা গুণ অর্থাৎ সমসময়ের পরিস্থিতি বা মানুষের পরিস্থিতির দিকে নির্দেশ করা, সেসবই ধরে রেখেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের যা উদ্দেশ্য, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের নিজস্ব বাসভূমি তার সমর্থকও ছিলেন ইন্তিজার যদিও সেটা করেও প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির চিহ্নগুলিকে লেখায় ব্যবহার করতে বা লেখায় ধরে রাখা রূপনগর বা ব্যসপুরের মধ্যে দিয়ে নিজের ফেলে আসা এক সিনক্রেটিক অতীতকে লেখায় নিয়ে আসতে তাঁর আঁটকায়নি। কিন্তু পাকিস্তানের সমর্থক হয়েও অল্প কিছুকালের মধ্যেই তার স্বপ্নভঙ্গের কথা বলতে গিয়ে ইন্তিজারকে ফিরে যেতে হয়েছিল ইসলামী ইতিহাসেরই প্রথম দিকে, যখন ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধেই ইসলামের ক্ষতিই হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখি গল্পটিতে মক্কা, মদিনা এইসব জায়গাগুলি এসেছে, মক্কা থেকে মদিনায় হজরত মহম্মদের যাত্রা, হিজরাত যা, তার সাথে ইসলামী ইতিহাসের অনেক স্বপ্ন ও বাস্তবও জড়িয়ে আছে কিন্তু ইন্তিজারের গল্পে এসে, তাঁর বর্তমানের পাকিস্তান যেন ঐসকল জায়গায় পৌছতে না পেরে পথ হারিয়েছে। ফলে, মনে করি, ইন্তিজার হুসেন একজন পাকিস্তানি লেখক হয়েও নিজের দেশ নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেননি, এক সাক্ষাৎকারে (২০০০ সালের কিছু পরের) এও বলছেন যে তাঁর অনেক গল্পকেই হয়ত সমসাময়িক পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে পড়া যায়। একজন পাকিস্তানি লেখক হিসেবে তাঁর অবস্থানটি, যা একই সাথে পাকিস্তানের স্বপ্নের প্রতি উৎসুক আবার বেদ্নার আখ্যানেও স্থিত থাকছে, আরো একটা-দুটো গল্প অথবা উপন্যাসদুটি মিলিয়ে পড়লে এসবই বুঝে ওঠা যায়।
কিন্তু লেখকের তো একটা এসথেটিক্স থাকে, যতই কেননা সময়ের প্রতি দায় থাকুক আর বক্তব্য থাকুক, ঐ শিল্পভাবনাটি না থাকলে কোন লেখাই উৎরোয় না। ঐ এসথেটিক্স দিয়ে সকল বক্তব্য বা মন্তব্যকে ধারণ করতে হয়। এই যে গল্পটি, যাকে প্যারাবল বললাম, সিনিক্যালও যা, সেটি এবং আরো কিছু গল্পকে লিখিত গল্পের যা রূপ, সে রকম পুরোপুরি না হয়ে যেন মুখে বলা গল্পের যা রূপ তার কাছাকাছি রাখা যায়। কথাসরিৎ সাগর, জাতকের গল্প, মহাভারতের ভেতরের গল্প, দাস্তানগো, কিস্সা কাহিনি এই সব থেকে যেন কিভাবে লেখা গল্পকে মুখে বলা গল্পের মত করে তোলা যায় সেইসব রসদ সংগ্রহ করেছিলেন। পুরোন ঐসব লেখার প্রসঙ্গ নিজের লেখার আলোচনা করতে গিয়ে একাধিকবার এসেছে, বিষয় ও ফর্মের জন্য। এইসব গল্পের মধ্যে ইঙ্গিতেও বলা থাকত অনেক কিছু অথবা গল্পগুলি একে অপরের সাথে ক্রমাগত যুক্ত হয়ে থাকত, মূল থীমকে অক্ষুণ্ন রেখে বা কিছু পরিমাণে তার ভ্যারিয়েশন এনে গল্পগুলি চলতে থাকত। অন্যদিকে যখন প্রথম গল্প লিখছেন তখন সেই সব লেখা তার বন্ধুদের অনেকেই বুঝে ইঠতে পারত না, চেনা গল্পের ধরণের সাথে সেসব মিলত না, যেন পুরো গল্প হয়নি, স্কেচ হয়েছে মাত্র, কিন্তু সেরকম হয়ে উঠতে বাধা কোথায় যখন কিনা বিংশ শতকের পশ্চিমী সাহিত্যের কিছু লেখা পড়া তখন পড়া হয়েছে, সেরকমই বলছেন। প্রোগ্রেসিভদের লেখার যা ধরণ, সবকিছুকে সরাসরি প্রকাশ করা, সেরকম অথবা মান্টো ও চুঘ্তাইয়ের লেখায় এক্সপ্রেশন যেরকম তার সাথে ইন্তিজারের মত মিলছে না, তিনি ঢের বেশী কাছের বোধ করছেন শেকভের গল্প বা জয়েসের ডাবলিনার্সের গল্পের অভিব্যক্তিগুলিকে।
ফলে এরকম ঘটেছিল হয়ত, ইন্তিজার হুসেনের দরকার হয়ে পড়েছিল নিজস্ব এসথেটিক্স যা সমসাময়িক লেখালেখি দিতে পারছে না। পশ্চিমী সাহিত্যের আলোগুলোকে বোঝার চেষ্টা করছেন আর হয়ত প্রাচ্যের লেখালেখি কেনই বা শুধুই পশ্চিমী সাহিত্যের রীতিগুলি দ্বারা চালিত হবে, কেনই বা পুরোন ফর্মগুলি শুধুই বিজ্ঞজনেদের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে, কেনই বা সেগুলিকে বর্তমানে ব্যবহার করা যাবে না, সেরকম এক তার্কিক অবস্থান থেকে ঐসব ফর্মগুলি থেকে যা নেওয়ার নিচ্ছেন; নিজের অতীতে এসবের উপস্থিতি ছিলই, ফলে সেগুলি শুধুই তাঁর অতীতেরই অংশ হয়ে না থেকে বর্তমানের লেখালেখিকেও চালিত করছে। গল্পে গল্পে জুড়ে থাকার এই যে ব্যাপারটি যা পুরোন কাহিনিগুলিতে থাকছে, সচেতনভাবে কিনা জানিনা কিন্তু আগে বলা বৃত্ত গল্পটিতে সেরকম কিছু রয়ে যাচ্ছে; বর্তমানের লেখক তার পুরোন সত্তার সাথে যুক্ত হচ্ছেন, বর্তমানের স্বপ্ন আর স্মৃতি পুরোন লেখা আর অতীতের সাথে যুক্ত হচ্ছে, লেখক চরিত্রটিও শেষ জীবনে এসে লেখক জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ন করতে চাইছে কিন্তু হয়ে উঠছে না, একই গল্পে এসব বিষয়গুলি মিলিত হয়ে থাকছে। অতীতের সাথে বর্তমানকে যুক্ত করতে অসুবিধে হচ্ছে না, অতীতের গল্পগুলির ছায়া বর্তমানের ওপর ফেলা যাচ্ছে, অতীতের ঘটনাগুলি দিয়ে বর্তমানকেও দেখা যাচ্ছে, সময়ের উদ্বর্তনে উঠে আসা হচ্ছে না নিশ্চয় কিন্তু সময়ের এক ক্ষণবিন্দুতে অতীত আর বর্তমানকে এনে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর চেষ্টা করা যাচ্ছে, কোন ডেলিভারেন্স রয়ে যাচ্ছে কিনা বোঝার জন্য; বস্তি অথবা 'আগে সমুন্দর হ্যায়' উপন্যাসদুটিতে এসবের আরো ব্যাপক ব্যবহার ছিল বলে মনে করি।
খুব ভাল। থ্যাংক্স।
থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু