বারবার প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ মানুষের সচেতনতা নিয়ে। বারংবার আমরা বলেছি মানুষ বাজারে যাচ্ছে, রাস্তায় বেরচ্ছে। সাধারণ মানুষকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীর্যক মন্তব্যও করেছি। কিন্তু প্রশাসন? যাদের হাতে আমাদের নিরাপত্তা, ভুত ভবিষ্যত বর্তমান তারা কী করেছেন? কোন ভরসায় মানুষ নিজেকে সুরক্ষিত ভাববেন? কোন ভরসায় তারা নিজেরা সচেতন হবেন? ভারতে প্রথম করোনার আগমন থেকে যদি খেয়াল করে দেখি এ দেশে করোনাকে রীতিমতো নেমন্তন্ন করে জামাই আদরে ডেকে আনা হয়েছে। আমলার সন্তান বাপ-মায়ের টাকায় লন্ডনে করোনা আক্রান্ত বান্ধবীর সঙ্গে ফুর্তি করে সংক্রমণ নিয়ে দেশে আসে, শুধু আসেই না রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক অফিসেও চলে যায়। আহা আহা আমলার ছেলে বলে কথা, তিনি তো সাধারণ নয় অসাধারণ। প্রধানমন্ত্রী দেশের মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারদের কথা ভাবেন না, তারা তো এমনিতেই দেশের আবর্জনা, বরং বিশেষ বিমানে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ফেরাতে তিনি উদ্যোগী হন। দেশের শিল্পপতি, রইসজাদা, এবং বিশেষ বিশেষ মানুষের সন্তানদের দেশে ফেরানো হয়। যারা কোনোদিনই দেশের কাজে লাগবেন বলে তো মনে হয় না।
আমাদের রাজ্যে টেস্ট হয়না, মৃতের সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে কমে যায়। দিন প্রতিদিন টেস্টের নামে প্রহসন। আসলে টেক্কা দিতে হবে অন্য রাজ্যকে। টেক্কা দিতে হবে দেখাতে হবে কাজ হচ্ছে। কাজ করে কাজ দেখানো নয়, বরং না করে লুকিয়ে রেখে দেখানো। ফল হুহু করে বেড়ে চলা করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। যথেচ্চাচার, মিথ্যাচার। সরকার যেখানে এই তার প্রশাসন তো এক কাঠি বাড়া হবেই। রেল শহর খড়গপুরকেই দেখে নিন। লকডাউনের মধ্যেই দিল্লি থেকে স্পেশাল ট্রেনে অস্ত্র বোঝাই করে আনানো হলো ২৮ জন রেলরক্ষীকে। যার মধ্যে ৯ জনই আক্রান্ত। আহা আহা অস্ত্র দিয়ে তারা করোনার মোকাবিলা করবেন। শুধু ৯ জন আক্রান্তই নন, তাদের লুকিয়ে রাখা হলো, কাউকে কাউকে তো আবার উড়িশ্যায় ফেরতও পাঠানো হলো। এবং পরে দেখা গেলো তারা আক্রান্ত। আহা। আর খড়গপুরে যাদের রেখে দেওয়া হলো তাদের কোয়ারেন্টাইন হোমে তো পাঠানো হলোই না বরং ব্যারাকেই রেখে দেওয়া হলো পর্যবেক্ষণের জন্য। আ বেল মুঝে মার। শুধু কী তাই! রোজ রোজ ব্যারাকে তাদের নিয়মিত প্র্যাকটিসও হয়েছে। আরো আছে। আমার এক পরিচিত এবং প্রিয় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ফোন করেছিলেন। সত্যি বলতে কী এত দূর থেকে নিজের খড়গপুরের সঙ্গী রিপোর্টারকে খবরটি পাশ করে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। কী বক্তব্য আমার সেই পরিচিত মানুষটির? দিল্লি থেকে ফেরা ওই রেলরক্ষীরা কোয়ারেন্টাইনে থাকা তো দূর (অথচ রেল পুলিশের দাবী তারা ব্যারাকেই ছিলেন) শহরে যথেষ্ট ঘুরে বেড়িয়েছেন, বাজার হাট করেছেন, রেগুলার টহল দিয়েছেন। শুধু তাই নয় তারা বারবার বলা সত্ত্বেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। আমার সঙ্গী রিপোর্টার জানালেন, সে তার পরিচিত আরপিএফের মাধ্যমে জেনেছে যে ব্যারাকে আক্রান্ত এবং যারা আক্রান্ত হননি তারা একসঙ্গে খেয়েছেন, বাথরুম ব্যবহার করেছেন, পাশাপাশি শুয়েছেন, এবং রেগুলার তাদের রুটিন অনুযায়ী অভ্যাসও করেছেন। যে খড়গপুর শহর করোনা মুক্ত ছিল সেখানে এখন সংখ্যাটা ১৫র বেশি ছড়িয়ে গিয়েছে। এই যে ২৮ জন রেলরক্ষী ফিরল দিল্লি থেকে তাদের মধ্যে ৯ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। সবচেয়ে মজার কথা কী জানেন আক্রান্ত ৯ জনের মধ্যে আবার ৬ জনের খোঁজও মিলছে না। আহা সতর্কতার কী ছিড়ি। সম্পূর্ণ খড়গপুরে শহর জুড়ে রয়েছেন ৬০০জন রেলরক্ষী। এইবার খবর ছড়াতেই শুরু হয়েছে সতর্কতা। দোষারোপ এবং পাল্টা দোষারোপ। যেখানে ট্রেন চলাচলই প্রায় বন্ধ সেখানে আক্রান্তদের ব্যারাকে লুকিয়ে রাখার দরকারটা কী? কেনো তাদের হাসপাতালে পাঠানো হলো না? উত্তর নেই। শুধু দোষ এবং পাল্টা দোষ।
খড়গপুরের অবস্থাটা এই মুহূর্তে কী? দিল্লি থেকে যে ২৯ জন এসেছিল তাদের মধ্যে ৯জনের রিপোর্ট পজিটিভ। তার মধ্যেই একজন চলে যান বালেশ্বরে, যেখানে তিনি চিকিৎসাধীন। নতুন করে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের একজন রয়েছেন মেচেদায় আর আরেকজন উলুবেড়িয়ায়। রইল বাকি ছয় খড়গপুরেই। বালেশ্বরে থাকা কনস্টেবলের সংস্পর্ষে আসা ১৮জনকে রেলপুলিশের মতে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছিল, যাদের ৮জনের রিপোর্ট নাকি নেগেটিভ আর গত বৃহস্পতিবার ১০জনের রিপোর্ট আসে পজিটিভ। এখন রেলপুলিশের টনক নড়েছে তারা খোঁজ খবর করছে ওই ১৮ জন কার কার সংস্পর্শে এসেছিলেন! তা ওই ১৮ জন যে রেলরক্ষীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের না হয় খোঁজ পাওয়া গেলো, কিন্তু তারা যথেচ্ছভাবে শহরে যে ঘুরে বেড়ালেন, কাদের কাদের সংস্পর্শে এলেন, খড়ের গাদায় সূঁচ খুজবেন কোথায়? আরো আছে তালিকা। দাঁড়ান দাঁড়ান সবে তো কলির সন্ধ্যে। খড়গপুরে যে কোয়ারেন্টাইন আবাস তৈরি হয়েছে, তার দেওয়াল ঘেঁষেই হাট বসেছে শুক্রবারে। হাহাহাহা। সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর রেলের সিনিয়র ডিভিশনাল সিকিউরিটি কমিশনার সংবাদমাধ্যমকে কী বলেছেন? শুনে নিন। কমিশনার বিবেকানন্দ নারায়ণ বলেছেন, “আমরা খুব সতর্ক নজর রাখছি। দিল্লি থেকে ফেরা কর্মীদের পরোক্ষভাবে সংস্পর্শে আসা কর্মীদের খোঁজ চলছে। ১৩-১৪ জনকে নিউ সেটলমেন্ট কোয়রান্টিন কেন্দ্র-সহ কয়েকটি জায়গায় ইতিমধ্যে কোয়রান্টিন করা হয়েছে।” অর্থাৎ চোর পালানোর পর তাদের বুদ্ধি বেড়েছে। এখন মনে হচ্ছে সব দিক খতিয়ে দেখা আর সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা দরকার। এদিকে আরেক কেলোর কথা শুনবেন? আমার ওই পরিচিত জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই তাদের পাড়ার একজন কলকাতা থেকে কোনো মতে একটা ট্র্যাক ম্যানেজ করে খড়গপুরে পালিয়ে এসেছেন। আমার ওই পরিচিত এবং তাদের পড়শিরা ওই যুবককে এবং তাদের বাড়ির লোককে বলেছিলেন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাড়িতেই। তারা খাবার দাবার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেবেন ওই যুবকের বাড়ি। কিন্তু শোনেননি তিনি। এরপর আমার ওই পরিচিত এবং তাদের পড়শিরা পুলিশে জানান। পুলিশে বক্তব্য ছিল জানেন আমাদের কত কাজ? আমরা কী করব। এমনকী লোকাল কাউন্সিলরও হাত তুলে নেন। পড়ে আবারও ফোন করায় এবং মিডিয়ার ভয় দেখানোর পর আইসি জ্ঞান ট্যান দেওয়ার পর দেখছি বলে জানিয়েছেন। দেখেছেন কিনা ভগাই জানে। মেদিনীপুর এবং খড়গপুর আমার প্রিয় শহর। আমার কিছু ঘনিষ্ঠ এবং কাছের মানুষ ওই শহরে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্ত হয়ে আসার পর প্রথমে জামসেদপুর, এবং পরে রেল শহর খড়গপুরের সুভাষপল্লীতে বড়োসড়ো পরিবার আর কিছু মোষ নিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন আমার ঠাকুরদা। কাজও করতেন রেলে। এছাড়াও লেখালেখির সূত্রে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব থাকে। অভিনন্দন-রাজেশ্বরী, স্নেহাশিস দা, নিসর্গ, রোহন নাম্বিয়ার, আমার নিজের ভাগনে সৌমেন সকলেই মেদিনীপুর নয়ত খড়গপুরের বাসিন্দা। কিন্তু সরকারী প্রহসনে এবং প্রশাসনের গাফিলতিতে তারা সকলেই আজ বিপদের মুখে। হাজার হাজার খড়গপুরবাসী আজ বিপদের মুখে। এদের কিছু হলে সরকার ওই ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে হয়ত দায় সারবে। কিন্তু তাদের পরিবারের দায় নেবে কে? একদিকে তথ্য গোপনের এই খেলা অন্যদিকে জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ভাইরাস দেশে এবং রাজ্যে ডেকে আনা। সরকার হয়ত আজ জবাব দিচ্ছে না, কিন্তু জবাব সাধারণ মানুষ নিয়েই ছাড়বে। ইতিহাস সাক্ষী জনতার আঁতে ঘা লাগলে তারা কোনো শাসককেই কখনো রেয়াত করেনি। তবে ভারতের জনতা তো হয়ত রেয়াতও করতে পারে, নইলে শালা বিজেপির মতো একটা দল এখানে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় পরপর দুবার।
পেছনের দিকে আমরা এগিয়ে চলবোই।
ভুল তো বলেন নি, ওই ছেলেটির দেশে আসার আগে পার্টি করা অত্যন্ত ইরেসপন্সিবল স্টেপ ছিল বাপ-মার পেটানো উচিৎ ছিল স্রেফ এই কারণেই।