‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই – বার বার নষ্ট হয়ে যাই’ এই লাইনটা এরপর কোনদিন বললে বদলে নিতে হবে। ‘নষ্ট হয়ে যাই’ আর বলতে পারব না এরপর মনে হয়, আর তো স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ‘প্রভু নষ্ট হয়ে গেছি’।
বারে বারে নষ্ট হচ্ছিলাম – এই আমি এবং আমরা। বুঝতে পেরেছি অনেক সময়, অনেক সময় বুঝতে পেরেও তেমন কিছু করতে পারি নি। আর এখন তো চাইলেও কিছু করতেই পারছি না।
লকডাউনে আমাকে ঘর থেকে কাজ করতে হয় বাকি আর সবার মতই – খাবারে কোন টান নেই এখনো, কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর সুইজি, জমাটো-র হোম ডেলিভারী আবার চালু হয়ে গেছে। বিগ বাস্কেট বাড়িতে আবার দিয়ে যেতে শুরু করেছে দুধ, মনোহারী জিনিস পত্র। লিসিয়াস আবার দিতে শুরু করেছে ডিম, মাংস। আমাদের গেটেড-কমিউনিটির গ্রুপে আমরা আলোচনা করি কেন কাজের লোক আসবে না! কিভাবে ওরা নিজেরা ঠিক করে নিতে পারে যে কাজ করতে আসবে না? নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনের করিডোর টুকু পরিষ্কার করার জন্য বারে বারে ভলেন্টিয়ার ডাকা হতে থাকে। কেউ কেউ ক্ষোভ উগরে দিই এই জন্য যে আমাদের গেট পর্যন্ত গিয়ে পিৎজা ডেলিভারী নিতে হচ্ছে বলে! পিৎজাবালক দোরগোরায় আসছে না।
আমি বোর হই – খুব বোর হলে নেটফ্লিক্স, আমাজন, হটস্টার আর যা কিছু আছে মাঝে মাঝে দেখতে থাকি। আমার খাওয়ার সময় এখনো মেনটেন করতে পারছি – সকালে দুধ দিয়ে কফি খাচ্ছি – বাড়ি থেকে কাজ বলে খুব সকালের বাস ধরার তাড়া নেই। নিজের বিছানা ছেড়ে উঠছি একটু দেরী করে – আলস্যে ভরা শরীর নিয়ে।
আর তারপর? কখনও কখনও বাড়ির লোকের সাথে কথা বলি, কথা হয় নিমোর ভাই বন্ধুদের সাথে। লকডাউনের অন্যদিকের গল্প কেমন গড়াচ্ছে, সেটা জানতে আমাকে ফেসবুক দেখতে হয় না, না শুনে বিচার করতে হয় ওই মিডিয়ার খবর।
তর্কে যাব না – কিন্তু ফ্যাক্ট এটা যে সরকারের কাছে, বর্তমান প্রশাসনের কাছে ওই তথাকথিত ঘর ছেড়ে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক – দিন মজুর, যাদের গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাইগ্রেটেড লেবার’ – তাদের জীবনের কোন দাম নেই। এবং সেই নিয়ে সরকার মাথা ঘামাতেও রাজী নয় বেশী।
হাজারে হাজারে লোক যাচ্ছে নিমোর উপর দিয়ে দল বেঁধে হেঁটে – ঘরে ফিরছে চাইছে তারা, জি টি রোড বরাবর, রেললাইন বরাবর হেঁটে যাচ্ছে তারা কলকাতার দিক থেকে ঝাড়খন্ড, বিহারের দিকে। পিঠে, কোলে বাচ্ছা – বড় বড় বাক্স-ব্যাগ নিয়ে ফিরছে। নিমোর রাস্তার ধারে প্রতিদিন প্রায় ১৫০-২০০ জন লোক খাচ্ছে – চাল, আলু ইত্যাদি জোগাড় হয়েছে। কিন্তু শেল্টার? ইচ্ছা করলেই আপনি ২৫-৫০ জনকে নিয়ে ভাবলেন গ্রামের কোথাও রেখে দেবেন, খাওয়াবেন – সেসব অত সোজা নয়। প্রশাসনের অনুমতিই মোষ্ট লাইকলি আপনি পাবেন না। যে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, তাকে যেতে দাও – শ্রমিক-মজুর এদের কষ্ট-মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামাবার মতন সময় নেই বড়কর্তাদের।
আমাদের নিমো গ্রামের শিল্পপতি রাজুর সাথে অনেক কথা হল আজ। এই নীচের ঘটনাটা রাজুর বলা এবং ছবি গুলোও সে পাঠালো। কাল পড়ন্ত বেলায়, প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে তখন – রাজু গিয়েছিল নিমো স্টেশনের দিকে। স্টেশনে এককোণে সে দেখে এক ফ্যামিলিকে গুটি সুটি মেরে বসে থাকতে – বাবা, মা এবং একটা বছর ছয়েকের মেয়ে। মেয়েটা খুব কাঁদছে। রাজু কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে মেয়েটি সারাদিন কিছু খেতে পায় নি বলে কাঁদছে। ওরা নিমোর কিছু দূরের গ্রামের মাঠ থেকে রওনা দিয়েছে – বাড়ি গিরিডি। হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যাবেলা নিমো স্টেশনে এসেছে – ভাবছে যে একটা ট্রেন পেলে তাতে উঠে বর্ধমান যাবে এবং সেখান থেকে গিরিডি। কিন্তু ট্রেন তো বন্ধ – মাঝে মাঝে চার কামরার ট্রেন চলে, তবে সেটা স্পেশাল, রেলের নিজের লোক এবং পুলিশের জন্য। তাই তাতে উঠতে দেবে না সেটা রাজু ওদের জানালো।
এই তিনজন এসেছিল আমাদের পাশের গ্রামের দিকে জমিতে আলু কুড়াতে। কয়দিন আগে সব জমিতে আলু তোলা হয়েছে – চাষী আলু তুলে নিলেও কিছু কিছু আলু পড়েই থাকে মাটি চাপা। আর সেই মাটি চাপা আলু তুলে কিছু পয়সা ইনকামের জন্য সেই সুদূর গিরিডি থেকে এরা বাবা-মা-বেটি এসেছে এখানে। চার বস্তা আলু কুড়িয়ে পেয়েছিল – দু বস্তা বিক্রি করে গত সাতদিন চালাচ্ছে কোনমতে তারা। আর মাথায় করে বাকি দু বস্তা নিয়ে ফিরছে গিরিডি – প্রায় ৩০০ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে।
রাজু ওদের বলে রাতে গ্রামের ভিতর আসতে তার বাড়ি – রাতে থাকবে সেখানে এবং খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে সে। কিন্তু এই ফ্যামিলিটা ওর কথা বিশ্বাস করতে চায় না – ভাবে কোথায় কেন নিয়ে যাবে। আসলে এই ফ্যামিলিটা কোন কারণে অন্য দলের সাথে ছিল না। রাজু অনেক বলে টলেও তাদের রাজী করাতে পারে না তার সাথে আসতে। তখন বলে, যদি তোমাদের মত বদলায় তাহলে গ্রামের ভিতরে গিয়ে বলবে রাজুর বাড়ি যাব – কেউ না কেউ দেখিয়ে দেবে।
বাড়ি এসে চা-টা খায় রাজু, একটু রাত হয়। কি মনে হয় তার যে, লোকটা তার ফ্যামিলি নিয়ে নিশ্চয়ই আসবে খুঁজতে। রাস্তায় বের হয় রাজু – সামনে একজনকে দেখে জিজ্ঞেস করে কেউ তাকে খুঁজছিল কিনা। সে জানায় হ্যাঁ, একটা লোক মাথায় বস্তা ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে ঘুরছিল, রাজুর বাড়ি যাবেও বলেছিল – কিন্তু কে যেন তার কথা বিশ্বাস না করে চোর ইত্যাদি হতে পারে বলে তাকে চলে যেতে বলেছে। রাজু তখন হন্ত দন্ত হয়ে খুঁজতে বেরোয় তাকে। নিমো স্টেশনে গিয়ে আবার পায় দেখা – কিন্তু এবার আর সে আসতে চায় না, বলে আমাকে মারবে গেলে! আর তা ছাড়া ওই আলুর বস্তা বয়ে নিয়ে গিয়ে সে খুব ক্লান্ত।
যাই হোক, অনেক বলে কয়ে রাজু তাদের নিয়ে আসে গ্রামের ভিতরে। নিয়ে গিয়ে তার পুরানো কারখানায় ঘর খুলে দেয় থাকার জন্য – কিন্তু তারা কিছুতেই ঘরে শোবে না – বলে আমরা দরজার সামনেই শোব। আর একটু রাতে রাজু ভাত নিয়ে গিয়ে দেখে তারা সব অঘোরে ঘুমাচ্ছে – সারা দিনের পরিশ্রম। ডেকেডুকে তুলে ভাত খাইয়ে, মশারি ইত্যাদি খাটিয়ে, ফ্যানের ব্যবস্থাও হয়।
আজ সকালে রাজু চা নিয়ে গিয়ে খাওয়ায় তাদের। তারপর প্রস্তাব দেয় যে – এই তোমার এত ছোট বাচ্ছা নিয়ে গিরিডি এতটা কি করে হেঁটে যাবে? এখানেই থেকে যাও লকডাউন না ওঠা পর্যন্ত। লকডাউন উঠে গেলে বর্ধমান থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি যাবে না হয়। খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে – কিছু সমস্যা নেই।
লোকটা কাঁদতে শুরু করে – বাড়িতে সে রেখে এসেছে বুড়ি মায়ের কাছে দেড় বছরের ছেলেকে। দিন পাঁচেকের মধ্যেই ফেরার কথা ছিল, সেই মত চাল-ডাল দিয়ে এসেছে বুড়ি মা-কে। তা এখন যদি সে না যায়, তাহলে তার বুড়ি মা কি করবে? না খাতে পেয়ে মা আর তার দেড় বছরের ছেলে দুই জনাই মারা যাবে।
ওরা আর অপেক্ষা করে না – রাজু বলল, সুকান্তদা চোখে জল চলে এল আমার। বাড়িতে বুড়ি মা আর দেড় বছরের ছেলে এদের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে – কিভাবে আটকাই এদের!
সাথের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওরা নিমো গ্রাম ছাড়ছে গিরিডির উদ্দেশ্যে।
প্রার্থনা করুন যেন ওরা ফিরতে পারে জীবিত অবস্থায় – এবং ফিরে জীবিত বুড়ি মা আর দেড় বছরের বাচ্ছাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে আবার।
এই লেখা নিয়ে কোন কথা হবে না ।
গুরুগাঁওয়ে নিরাপদে বসে চারপাশে যা টের পাচ্ছি তা নিমোর থেকে খুব আলাদা কিছু নয়। একটি বড় এনজিও আছে এন সি আরে। সারাবছর ফুটপাথবাসী এবং তাদের বাচ্চাদের জন্যে খাবার এবং জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করে। তারা মাইগ্রেন্ট লেবারের জন্যে করবে জেনে সামান্য কিছু টাকা অনলাইনে পাঠিয়ে নিজের বিবেককে চোখ মেরে রয়েছি।
ছোট বেলায় বার্ষিক শিশুসাথীতে পড়া কালিদাস রায়ের একটি কবিতার লাস্ট লাইন মনে পড়ছে ঃ
" এ কি দয়া? না না, তাতো নয় কদাচন,
এ শুধু অন্তরের অস্বস্তিমোচন",
অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছি।
হ্যাঁ, এই লেখাটা ফিরে ফিরে পড়ি। ছবিটা দেখি।