১৯৪৭ এর এক সন্ধ্যায় লেখকের মা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি স্কুলে যেতে চাও?’ পরিবারে তাঁর দাদা ওয়ালেশ মোয়াঙ্গি এবং কয়েকজন তুতো ভাই অতীতে স্কুলে গেছে, কিন্তু পয়সার অভাবে দু এক বছর বাদেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। মেয়েদের অবস্থা তো আরও করুণ, তাঁরা কেউই এক বছরও ক্লাস করে উঠতে পারত না। বাড়িতে অক্ষরজ্ঞান অর্জন করতো যাতে অন্তত বাইবেলটা পড়তে পারে। তাই মা যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন তিনি বিহ্বল বোধ করেন। যখন তিনি কোনও মতে সম্মতি প্রকাশ করেন, মা তাঁকে জানিয়ে দেন যে তাঁরা গরীব, এবং তাঁর দুপুরের খাবার নাও জুটতে পারে। ‘কথা দাও ক্ষুধা বা কষ্টের কারণে তুমি কখনো পড়াশোনা ছাড়বে না। এবং তুমি সব সময় তোমার সেরাটা দেবে।‘ স্কুল এবং ইউনিফর্মের খরচ তাঁর মা খেতের ফসল বাজারে বিক্রি করে যোগাড় করলেন। একটি দোকানে পোশাক কিনতে গিয়ে নয় বছর বয়সি বালক দেখল দেয়ালে চশমা পরা এক ভারতীয়ের ছবি টাঙান রয়েছে। কয়েক বছর বাদে জানলেন তিনি এম কে গান্ধী যাঁর সাথে ১৯২১ সালে গঠিত ‘ইস্ট আফ্রিকান এ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা হ্যারি থুকু সংযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং সেই সূত্রে স্থানীয় ভারতীয় ও তাঁদের নেতা মণিলাল এ দেশাই-এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে ছিলেন। ... ...
গল্পের চরিত্রগুলি যেমন সৃষ্টিকর্তার জবাবদিহি দাবি করে, একই ভাবে মর্ত্যে নামাবলী গায়ে যারা ধর্মের ধামাধরা তাদেরকেও লেখিকা নিন্দা, সমালোচনায় বিদ্ধ করেন। ‘ব্ল্যাক কোবরা’ গল্পে জুলেখা, এক আলোকপ্রাপ্ত নারী, আশরফকে বলে নবীর নিজের কন্যা সন্তান ছিল। বিবি ফতিমা তাঁর জান ছিলেন। শোনো, শুধুমাত্র যুদ্ধের সময় যখন অনেক পুরুষ মারা যায়, কিংবা কারো স্ত্রী যদি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, কিংবা বন্ধ্যা হয়, কিংবা স্ত্রী যদি তাকে সন্তুষ্ট না করতে পারে, তবেই সে চারটে বিয়ে করতে পারে। করলেও তাকে সব স্ত্রীকে সমান সুবিধা দিতে হবে, অর্থাৎ একজনের জন্য বাড়ি বানিয়ে দিলে, শাড়ি কিনলে, অন্যজনের জন্যও সেটা করতে হবে। আশরফ এত কিছু চায় না, সে শুধু তার রুগ্ন শিশুর চিকিৎসার জন্য কিছু পয়সা চায়। ... ...
‘আই এম অন দ্য হিট লিস্টঃ আ জার্নালিস্টস মার্ডার এন্ড দ্য রাইজ অফ অটোক্রেসি ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে লেখক রোলো রোমিগ প্রতিবাদী সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের এক ভিন্নধর্মী জীবনী রচনা করেছেন। লেখক এই জীবনী রচনা করতে গিয়ে লিখছেন তিনি তিনটি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যের কাহিনি লিখবেন। দক্ষিণের রাজ্য কেন? কারণ তিনি গত এক দশক ধরে এই রাজ্যগুলি নিয়ে লেখালেখি করছেন এবং তাঁর স্ত্রী দক্ষিণ ভারতীয় মুসলিম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল একটা উপদ্বীপের মতো, যে কারণে এখানে বাণিজ্য আছে এবং বাণিজ্য থাকার কারণে শিক্ষা আছে। এর প্রভাব দেখা যায় কেরালায় যেখানে মুসলিম বাচ্চারা ক্যাথলিক স্কুলে যাচ্ছে, হিন্দুরা বিখ্যাত মসজিদে প্রার্থনা করছে, ক্যাথলিক সাধ্বীরা হিন্দু উৎসবে নৃত্য করছে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে গৌরীর একটা ফেসবুক পোস্টে এর প্রতিফলন দেখা যায়। স্থানীয় একটা ফসল কাটার উৎসবে, ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীরা হিন্দু নাচ, তিরুবতীরকলির তালে তালে নাচছে। গৌরী লিখছেন, আমার মাল্লু (মালয়ালাম) বন্ধুদের দেখো, কী ভাবে তারা ধর্মনিরপেক্ষতা উদযাপন করছে……। ... ...
সাতগাঁয়ের পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাসের মতই এই কাহিনীতে বাস্তবের সাথে মিলেমিশে আছে পরাবাস্তব, ইতিহাসের টুকরো টাকরা। এখানে কলার মান্দাসে ভেসে আসা মেয়ের পাছায় থাকে হার্মাদদের ক্রীতদাসত্বের সিলমোহর, পর্তুগিজ ভাষায় খিস্তি করা কাকাতুয়া মানুষমেয়েকে গর্ভবতী করতে পারে। বাপ্পার দিদিমা গঙ্গায় ডুব দিয়ে দূরবর্তী আত্মীয়া, বান্ধবীদের সাথে কথাবার্তা বলতে পারেন, সাতগাঁয়ের অন্য মেয়েদের সে কৌশল শিখিয়ে দিতেও পারেন। ... ...
এই উপন্যাসে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন দু’ভাবেই রাজনীতির অবিসংবাদিত ভূমিকা। প্রথমত, দেশভাগ ও তার পরবর্তী কালের দুই বাংলার রাজনীতি ; দ্বিতীয়ত, এই বাংলার সাম্প্রতিক কালের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। অখণ্ড ভারতের দ্বিখন্ডীকরণে তৎকালীন অনেক রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থান্ধ সক্রিয়তার পাশাপাশি কয়েকজন নেতা ও সাধারণ মানুষের যথার্থ দেশপ্রেম এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বস্ত বাস্তবতা এখানে ধরা পড়েছে। লেখকের কাছে আতিকুজ্জমান ও তার দুই ছেলে কাহিনিতে গান্ধী,নেহেরু ও জিন্নারই রূপকপ্রতিম হয়ে উঠেছে। বাবার ‘হাঁটানো মেয়েকে’ পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে বড়ো ছেলে রব বন্ধুকে দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, এই হত্যাকে সামনে রেখে কট্টরবাদী রব চেয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে। আতিকুদ্দিন আর তার অন্য ছেলে রহিম কিন্তু এই সর্বনাশা ক্রিয়া-কর্মের বিরোধী। এভাবেই লেখক অত্যন্ত সাবলীলভাবে বাস্তবতার ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, আলাদা করেছেন মৌলবাদীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে। ... ...
দুদুটো জীবন পাশাপাশি চলছে। বয়সের তফাৎ মাত্র ছয় বছর। সমান্তরাল জীবনের সূচনা সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকা থেকে, সেখানে তিনি লিখতেন ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পাহাড়ের মত মানুষ’। সেদিন থেকে তাঁকে চিনি। যেমনভাবে লেখককে পাঠক চেনে তার বেশি নয়। ধারাবাহিক পড়তে তখন ভালো লগত না কিন্তু নামটা আমাকে টেনেছিল। তারপর যেদিন প্রথম দেখি, তাও আবার রাস্তায়। কফি হাউসের উল্টোদিকের রাস্তায় তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন কলেজ স্কোয়ারের বইয়ের দোকানগুলোর সামনে রাস্তার দিকে লোহার রেলিং ছিল। তিনি রেলিংএর ওপারে, অর্থাৎ ফুটপাথে, আমি রাস্তায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়, শচিন দাশ আরও অনেকে তাঁদের ঠিক মনে করতে পারছি না। সেই প্রথম দেখা পাহাড়ের মত মানুষকে। এই গৌড়চন্দ্রিকা করার একটাই কারণ তিনি আত্মজীবনী লিখেছেন। নাম দিয়েছেন, ‘পেন্সিলে লেখা জীবন’। ... ...
বাংলা গদ্যে যে ধারায় জীবনানন্দ, উদয়ন ঘোষ, সন্দীপন, অরূপরতন বসুরা লিখে গেছেন, রবিশংকর বলও সেই ধারাতেই। অর্থাৎ নিজের জীবনকে আয়নায় দেখে নিস্পৃহভাবে লিখে রাখা আর তাকে কখনো গল্প কখনো উপন্যাস বলে ছাপিয়ে দেওয়া। জাগরণের দিনলিপির পাশাপাশি বাকিদের থেকে তিনি সফলভাবে স্বপ্ন কাহিনিগুলিও লিখে রাখতে পেরেছেন এবং সেখানেই তার স্বতন্ত্রতা। ... ...
আবার কখনো কখনো এত গাম্ভীর্য। এত উদাসীন! এত ঈর্ষান্বিত! এত কষ্ট! অভিমান! অভিযোগ! আসলে কমলদা কখনো নিজেকে আড়াল করেন নি। তাঁর লোভ ছিল, তাঁর ইচ্ছে আছে, তিনিও চান, তিনিও পেতে পারেন, তাঁরও যোগ্যতা আছে— সবকিছুই তিনি বলতেন। তাঁর কথায় বোঝা যেত তিনিও যোগ্য। তিনি আড়াল জানতেন না। আবার হয়তো কখনো কখনো বর্ম এঁটে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতেন একের পর এক নগ্নরূপ। আমি যদিও কখনো চাইতাম না তাঁর চোখ দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে দেখতে, তিনিও হয়ত চাইতেন না, কিন্তু তাও তাঁর অনবদমিত মন সেইসব কষ্টের কথা বলে ফেলত। বলত, উপেক্ষা, অবজ্ঞার কথাও। বোঝাতে চাইতেন, বাংলা সাহিত্য ফুরিয়ে যাবে নাহয়। এসব জেনেও মেনে নেব আমরা! ইত্যাদি ইত্যাদি! তিনি বলতেন, বাংলার বাইরে থেকে লেখালেখি করার অসুবিধে। কষ্ট। উপেক্ষার কথাগুলো। ... ...
জোহানেস ভার্মিয়েরের আঁকা, হ্যান্স এন্ডারসনের ছোট জলকন্যার গল্প, নরওয়ের দেবতা জেন্ডার ফ্লুইড লোকি, একানড়ে সব মিলেমিশে যায় এই দুনিয়ায়। সেখানে আলোর অন্যরকম রং। কথা বলা খরগোশ, ভেড়ার ছানা, জ্ঞানের পেঁচা লেখককে সেই দুনিয়ার দরজার সন্ধান দেয়। সেখানে লেখক 'রাইড দ্য ওয়াইল্ড হর্স' ধ্যানের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন যেখানে প্রতিটি অনুভূতি একেকটা উদ্দাম বুনো ঘোড়ার মত। অভিযোগ একটিই, বইটি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। ... ...
দেবজ্যোতি রায় গল্প, গপ্প, কাহিনি, ছোটোগল্প কিছুই লিখতে চাননি। তিনি একটি দর্শন রচনা করতে চেয়েছেন। তিনি একটা নিজস্ব গদ্যসরণিতে হেঁটে যেতে চেয়েছেন। যে পাঠক গদ্যসরণি, অস্তিত্বের আত্মখননে আসতে চান তাকে স্বাগত, যে চান না তাকে সদম্ভে নিকুচি করা। তিনি কোনো লক্ষে পৌঁছতে চাননি। অস্তিত্বের জায়মান অন্ধকারে যে বিদ্রোহ, আত্মগ্লানি, সংশয়, যৌন পিপাসা, বিভ্রান্ত প্রবণতা, সংস্থিতির অহমিকা, মরবিড, অ্যাবসার্ড তাই দেখাতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্ত মেকিবোধের সমূল উৎপাটন ঘটাতে চেয়েছেন। ফলে তাঁকে নেমে যেতে হয়েছে অন্ধকারের জগতে। সভ্যতার জাতীয় সড়ক দিয়ে না গিয়ে জাতীয় সড়কের আশেপাশে যে অলিগলি, যেখানে মানুষ আত্মত্রাণের জন্য নীরবে অবস্থান করে অথবা নিজের চাহিদা-পিপাসা মেটাতে গোপনে প্রবেশ করে সেই বন্ধ দুয়ারে প্রবেশকের তালাচাবির আবিষ্কারক তিনি। ... ...
২০২১ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে লেখা ষোলটি গল্পের সংকলন ইন্দ্রাণীর তৃতীয় গল্প সংকলন।হরিণের কাছাকাছি। পড়লেন দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায়। ... ...
ইমানুলদার এই বই আমাকে এমনভাবে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, এই বই নিয়ে লিখতে বসে আমার নিজের এক আখ্যান লেখা হয়ে যাবে এত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। বইটার পরতে পরতে তখনকার সমাজ ব্যবস্থা, দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের খুঁটিনাটির এমন বর্ণনা আছে যে যেকোনো পাঠকের চোখেই সেসময়ের দৃশ্যকল্প তৈরি হতে বাধ্য। পড়তে পড়তে কখনো সখনো মনে হয়েছে ইমানুলদার ছিল সচ্ছলতা আর অসচ্ছলতার পর্যায়ক্রমিক পৌনঃপুনিকতা… একটা অন্যরকমের লড়াই ছিল। এরকমই এক প্রেক্ষাপটে ... ...
পুজোর লেখার তাড়া তো রয়েইছে। তাই বলে তো আর হুমড়ি খেয়ে সবসময় লেখা যায় না, তাই লেখা, পড়া, সংসারের কাজ, প্রায়ই বিরাট দেশটার অলিগলি চিনে নেবার জন্য বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি, এইসবের ফাঁকে ফাঁকে খুব ভালো বই পেলে এখনও গোগ্রাসে পড়ে ফেলি। সেইরকম বইয়ের সংখ্যা দিন দিন আমার দেরাজে বর্ধমান! এবার আসানসোলে বসেই পড়ে নিলাম জয়া মিত্র-দির “স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন” আর তার পরেই একেবারে অন্য স্বাদের আর একটি, অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর “নয়নজোড়া কৌমুদী।” ... ...
প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা যেভাবে প্রত্যাঘাত করেছে, সেটাকেই নজরুল শব্দের স্বচ্ছন্দ গতিতে রূপান্তর ঘটিয়ে গেছেন বরাবর, কিছুটা একবগগা এবং ছেলেমানুষের মতই। গূঢ় দর্শন তাঁর লেখার বাঁধনহারা উচ্ছলতায় খাদ মেশায় নি কখনও, তেমনই পুনরাবৃত্তিও পিছু ছাড়েনি। নজরুল ঠিক এখানেই স্বেচ্ছাচারী অসংযমী অসচেতন, এবং তাঁর সৃষ্টির অনেকাংশই গভীর ভাবলোকে অনুত্তীর্ণ। তবে ওই ঐচ্ছিক খামতিগুলোই কি তাঁকে অনন্য করেনি? তিনি তো একাই হয়ে উঠেছেন একটা ঘরানার আদি ও অন্ত। পূর্ব ও উত্তরসূরি না থাকা এক অদ্বিতীয় ধারা। এমনই এক তেজস্ক্রিয়তা, অর্ধ জীবনকালের সূত্র মেনে যার ফুরিয়ে যাওয়াটা নির্ধারিত। সেই ফুরিয়ে যাওয়াতেও অবশ্য তাঁর মস্ত সাফল্য। ... ...
ঘৃণা, হিংসার এই বাতাবরণে একজন লেখক কী করবেন? রুশদি মিথিক্যাল গ্রিক পয়গম্বর, সংগীতকার অরফিউয়াসকে স্মরণ করছেন। তাঁর মাথা ছিন্ন করে যখন তাঁকে হেব্রাস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখনও অরফিউয়াস গান থামাননি, তাঁর সংগীত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ভয়াবহতার আবহে আমাদেরও আজ গান গেয়ে যেতে হবে, জোয়ারের দিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ... ...
‘আমার জার্মানি’ বইটা পড়ে শেষ করার পর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ বলেন যে আমি এই বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি তাহলে তাঁকে বলতেই হবে যে ক্ষমা করবেন মহোদয়, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে’, কারণ ওটা সম্ভব নয়। এ বই পড়তে হবে থেমে থেমে , রসিয়ে রসিয়ে, অনুভব করে করে, প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের মর্ম অনুধাবন করে। ... ...
বিজ্ঞাপনের মোহিনী মায়া, সংবাদের আলো-আঁধারি ভাষা, কুঞ্ঝটিকা, বাজার ধরার কৌশল সমস্ত মিলিয়ে যে ফাঁদ তার প্রগাঢ় ভাষ্য উপল নির্মাণ করে নেন। সেই নির্মাণে গপ্প হিসেবে উপলকে অনেক সময়ই বাস্তবের আড়ালে চলে যেতে হয়। বাস্তবকে ধরে অপ্রচ্ছন্ন বাস্তবের প্রতিমূর্তি গড়ে তোলেন। সেই অপ্রচ্ছন্ন বাস্তবের ছায়ামূর্তির মধ্যেই বাস্তবের প্রতিমা লুকিয়ে আছে। সেখানে পাঠক বাস্তবকে আবিষ্কার করবেন বা প্রত্যাখ্যান করে অধিবাস্তবের স্বরকে দেখবেন সেটা পাঠকের প্রত্যাশার উপর ছেড়ে দেন। পাঠকের ভাষ্যে তা শিল্প হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সেসব নিয়ে উপলের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি শিল্প বা না-শিল্প বৃত্তের ভাবনায় পাঠককে যে মাতিয়ে রাখতে পারেছেন সেটাই তাঁর সার্থকতা। হ্যাঁ তিনি রীতিমতো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যান। গদ্যসেতু ধরে ভাবনার তরঙ্গ বিচ্ছুরণে পাঠকের মস্তিষ্কে একাধিক বিরোধাভাসের জাল বুনে দিতে চান। সেখান থেকে পাঠক বাস্তবের সত্যে ফিরুক বা বাস্তবকে অস্বীকার করে শিল্পের সত্য বুঝে নিক। ... ...
বইটি পড়া শেষ করে মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে যে এই বইটি না পড়ে মরে গেলে বড্ড অন্যায় হয়ে যেতো। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার মনে হয়েছে যে এই বই আমার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে মনে করে লেখা হয়েছে। এই বই আমার একান্ত নিজস্ব জীবন দলিল বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। ... ...জীবন মানেই উৎসব, জীবন মানেই সম্ভাবনা। আপনার লেখাগুলো প্রতি মুহূর্তে সেই জীবনেরই জয়গান গেয়েছে। কাদামাটির হাফলাইফ জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই জীবনকে উপলব্ধি করতে শেখাবে, এই বিশ্বাস জারি থাকল। ... ...
এই জীবনের তিনকাহন-এর প্রথমপর্ব, ‘বাপের বাড়ি’। লেখিকার জন্ম ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এ বাড়ি। ঠাকুরদা, ঠাকুমা, বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসি সকলে মিলে বিশাল এক যৌথ পরিবার। চন্দননগরে সংস্কৃত টোল পণ্ডিতের বংশগত জীবিকা ছেড়ে শিক্ষা-চাকরির জন্য ঠাকুরদার কলকাতায়ন। তারপরে কলকাতায় বাড়ি বানিয়ে পাকাপাকি ভাবে বসবাস। বাবা-কাকা-জ্যাঠারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা আইনজীবী। বাড়ি ভর্তি ভাই-বোনেরা, আর আছেন গোপালজিউ। সেইজন্য বাড়িতে আমিষ খাবারের প্রচলন নেই। ভাই-বোনেরা মিলে বাড়িটাকে পুরো মাতিয়ে রাখে। কখনও থিয়েটার, কখনও হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ, আবার কখনও বা নিখাদ দুষ্টুমি। সঙ্গে বিজয়া, দোল, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার মতো চিরাচরিত উৎসব পালন তো লেগেই আছে। সেখানেও অবশ্য পারিবারিক বৈশিষ্ট্যের বিশেষ কিছু স্বাক্ষর আছে। অন্দরের অন্তর লেখিকার লেখায় এক নিরবচ্ছিন্ন চিত্রপটে ধরা দিয়েছে। ... ...