মায়াকে সংক্ষেপে জানালাম চেক আলফাবেটে যদিও অক্ষর বেয়াল্লিশটি, স্বর বর্ণ সাতটি, তারা এই সীমিত স্বর বর্ণগুলি অনেক ভেবে চিন্তে খরচা করেন, যেমন মৃত্যুর প্রতিশব্দ Smrt, শোনায় স্মরত্। এর পিছনে মুখের ব্যায়াম ছাড়া আর কোন যুক্তি আছে জানি না। BRNO উচ্চারণ বরনো অথবা ব্রনো। জার্মানরা অবশ্য এর একটা সহজ ভার্শন রেখে গেছে, ব্রুইন। এই রাজ্যের নাম মোরাভিয়া, চেকে মোরাভা, সেখানে ভাওয়েল আছে মাঝে ও শেষে। জার্মান আরও সহজ, মেহরেন। মেয়েকে আরেকটা ট্রিভিয়া শোনানোর সুযোগ ছাড়া গেলো না। চেক ভাষায় আনো (ano, শুনলে নো মনে হয়) হলো হ্যাঁ! আরেকটিমাত্র ইউরোপীয় ভাষায় এমনি গোলমেলে ব্যাপার আছে - গ্রিকে নে মানে হ্যাঁ! ব্যবসায়ের নামে পূর্ব ইউরোপ বেড়ানোর দিন ফুরিয়েছে। ভিয়েনায় আমার অনাদি ব্যাঙ্কের বোর্ড মিটিং সেরে গাড়ি ভাড়া করেছি চেক সন্দর্শনের বাসনায়। প্রথম স্টপ ব্রুইন, ভিয়েনা থেকে মাত্র একশ মাইল। গাড়িতে বা ট্রেনে দেড় ঘণ্টা (ভাড়া আটশো টাকা!) ইতিহাসে পড়া হাবসবুরগ সাম্রাজ্যের দিগন্ত খুলে যায় চোখের সামনে, তাকে সত্বর চেনা হয়ে যায়। ভিয়েনার শোয়েখাত হাওয়াই আড্ডা থেকে বেরিয়ে শহরে যাবার পথে নির্দেশিকা চোখে পড়ে – এই দিকে প্রাগ, ব্রুইন,ওই বুদাপেস্ত, জাগ্রেবের রাস্তা- হাবসবুরগ রাজত্বের পুরনো জেলা সদর! এককালে কাঁটাতার, ওয়াচ টাওয়ার ছিল এখন সীমানা অবধি নেই। চেনা অচেনা জায়গা পার হয়ে যাই, এমনি হঠাৎ কখন পার হয়েছি আর্কডিউক ফ্রান্তস ফারদিনান্দের স্ত্রী সোফি ফন হোহেনবুরগের পৈত্রিক জমিদারি। চেকোস্লোভাকিয়া নামের দেশ কোন কালে ছিল না; ছিল কয়েকটি রাজ্য বোহেমিয়া, মোরাভিয়া, চেক সাইলেসিয়া, আপার হাঙ্গেরি (আজকের স্লোভাকিয়া), আটশ বছর পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, তারপর হাবসবুরগ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজত্বের (১৮৬৭-১৯১৮) অংশ। আমরা বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়াকে বেশি চিনি, এদের নাম প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বোহেমিয়া আয়তনে বড়ো, প্রাগ তার রাজধানী, ব্যাভেরিয়ার সঙ্গে গায়ে লাগা, জার্মান ভাষা সংস্কৃতি ও শিক্ষার পীঠস্থান; মোরাভিয়া আজকের চেক রিপাবলিকের এক তৃতীয়াংশ, রাজধানী বরনো, চেকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর,ইউরোপের ষাট নম্বরে। ... ...
পোল্যান্ডের একটি গ্রামে কিছু পোলিশ ব্যাংকারকে জড়ো করে আমরা পশ্চিমি মুক্ত অর্থ ব্যবস্থার যে ঢক্কা নিনাদের সূচনা করেছিলাম সেটি নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ হয়। স্টচনিয়া গদিনিয়া নামক এক প্রায় দেউলে সরকারি জাহাজ নির্মাতার জন্য সিটি ব্যাঙ্ক যে সামান্য এক কোটি ষাট লক্ষ ডলার বাজার থেকে তুলতে পেরেছিল, সেটিকে পূর্ব ইউরোপের প্রথম আন্তর্জাতিক কর্পোরেট ডিলের সম্মান দেওয়া হয়ে থাকে। সেটা ১৯৯৪। পশ্চিমের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশে অচেনা বাণিজ্য সংস্থায় কিছু ব্যাঙ্ক আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ডলার লগ্নি করার সাহস দেখালেন; আমার উন্মাদনা তখন তুঙ্গে, ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে গ্রাহাম বওলির ফোন পেয়ে রীতিমত গর্বিত বোধ করি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমরা কিভাবে এই ডিলের ফি নির্ধারণ করেছি। তুলনামূলক দর বা মার্কেট রিডের কোন প্রশ্ন ওঠে না কারণ এ ধরণের ঋণের আয়োজন কখনো হয় নি। বলতে পারতাম আঙ্গুল গুণে। বলতে হলো বাজারে কোন ডিল না হয়ে থাকলেও আমরা কিছু এমপিরিকাল তথ্যের সহায়তা নিয়েছি। সেটা একেবারে বাজে কথা। ভিত্তিহীন। বাট হু কেয়ারস! এদিকে আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা ঘটনাটা যে কি, কিভাবে ঘটল সে সব না বুঝেই চতুর্দিকে প্রশংসা কুড়োচ্ছেন, পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানো হচ্ছে। পাবলিকের ধারণা আমরা কোন নতুন স্বর্ণ খনির সন্ধান পেয়েছি। স্বাভাবিক। পশ্চিম ইউরোপে মন্দার বাজার বাড়িঘরের দাম কম, শেয়ার বাজার অতল জলের সন্ধানে ধাবিত ; সেই কিছু বাঁধাধরা খদ্দের, দু পয়সা সুদ বাড়ালে তারা চোখ রাঙ্গাবে। তাই ছাড়িয়া নিশ্বাস, যতো বকরা পুবের মাঠে এই তাদের বিশ্বাস। কিন্তু ব্যাঙ্কের ঋণ যারা মঞ্জুর করেন সেই সব গুরুরা সেটা মানলে তবেই না তাঁরা সে মাঠে নামতে পারেন। ... ...
মায়া জানতে চাইলে এই একটা সাদা মাটা ঘরে কি দেখার আছে? - মায়া, চারশ বছর আগে এখানে দুই বিবাদী পক্ষের একটি মিটিং হয়েছিল। - কি নিয়ে বিবাদ? - ধর্ম এবং জমি। - দুটো আলাদা ধর্মের লড়াই? - না, ধর্মটা একই, ক্রিসটিয়ানিটি। প্রভু এক, সেই যিশুখ্রিস্ট, কিন্তু পক্ষ দুই – ক্যাথলিক, যারা পোপকে মানে আর প্রটেস্টান্ট যারা বড়ো তরফের পুরোহিতকে মানতে রাজি নয়। তাদের ভজনালয় আলাদা হয়ে গেছে, ফলে গিরজের সম্পত্তিও ভাগ হচ্ছে। এখানে সেই নিয়ে বিতণ্ডা হচ্ছিল কিন্তু দু পক্ষ সহমত হলেন না কাজেই এক পক্ষকে বেরিয়ে যেতে হলো। - সে তো হতেই পারে। - আচ্ছা ধরো তোমাদের উওকিং হাইস্কুলে কিছু ছেলেমেয়েকে যদি শিক্ষক ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন, তারা কি ভাবে যাবে? - কেন, দরোজা দিয়ে! শাস্তি হিসেবে বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকবে। - ঠিক। কিন্তু এখানে তা হয় নি। ক্যাথলিক হাবসবুরগ রাজার দুই সম্মানিত প্রতিনিধি রাজকীয় চিঠি এনে বললেন ক্যাথলিক জমিতে প্রটেস্টান্ট গিরজে বানানো যাবে না। শুনে প্রটেস্টান্ট বোহেমিয়ান কাউন্ট’রা ক্ষিপ্ত হয়ে দুই রাজপ্রতিনিধি ও তাঁদের সেক্রেটারিকে ওই জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। এর নাম ডিফেনেসট্রেশন অফ প্রাগ*। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়, জানলা দিয়ে মানুষ ছোঁড়ার অগণতান্ত্রিক কায়দা প্রাগ ও বোহেমিয়া থেকে আগেও ঘটেছে। নিচে নেমে গিয়ে দেখাবো ঠিক কোনখানে তাঁরা ভূপতিত হন। - পতন ও মৃত্যু? - না, এই উচ্চতা থেকে পড়েও তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান! ক্যাথলিকদের মতে মাতা মেরি তাদের রক্ষা করেন- ফলে হাওয়ায় ভেসে এই তিন জন সুস্থ দেহে নিচে নেমেই ভিয়েনা মুখে পালান। প্রটেস্টান্ট মত অনুযায়ী তাঁরা এই টাওয়ারের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়েন এক অশ্ববিষ্ঠা স্তূপে যা বহুকাল কেউ পরিষ্কার করে নি – ফল সফট ল্যান্ডিং! যে যেটা মানবে। ... ...
উইল আমাকে নিয়ে গেলো পুরনো প্রাগের মাঝখানে। যে ইহুদি পরিবারের বাড়িতে তেসরা জুলাই ১৮৭৫ সালে শিশু কাফকার জন্ম গ্রহণ করেন, সেটি একদা তৈরি হয়েছিল প্রাগের সেন্ট নিকোলাস গিরজের ক্যাথলিক পুরুতদের বসবাসের জন্যে! ১৮৯৭ সালে ইহুদি ঘেটোর অবসানের সময় সে বাড়ি ভাঙা পড়ে, আজ কেবল মাত্র তার পুরনো দুয়োরটা দেখা যায়। অতএব কাফকার আদি বাড়ি আপনি দেখতে পাবেন না। তাতে কি, প্রাগের সবচেয়ে প্রখ্যাত সন্তানের স্মরণে এই বছর বিশেক আগে পৌরসভা সেখানে বানিয়েছেন কাফকা স্কোয়ার (নেমেসতে ফ্রান্তসে কাফকি)। একদা সেন্ট পিটারসবুরগে আনার সঙ্গে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসে দস্তয়েভস্কির কল্পিত রাসকোলনিকভের বাড়ি, উপাসনার গিরজে খুঁজেছিলাম। উইলের সঙ্গে হাঁটলাম কাফকার স্কুলের পথে - প্রথম বিদ্যাপীঠ ডয়েচে কনাবেনশুলে বা কিন্ডারগার্টেন, আজকের মাসনা নামক পথে। মাইসলোভার বাড়ি থেকে কিন্সকি পালাস চত্বরের মধ্যে আলটষ্টেডার ডয়েচে গিমনাসিউম মিনিট কয়েকের পথ। আট বছর বাদে কাফকা গেলেন কার্ল ফারদিনান্দস ডয়েচে ইউনিভেরসিতেতে। সে সময়ে বোহেমিয়ান কার্ল বিশ্ববিদ্যালয় দু ভাগে বিভক্ত - কার্ল ফারদিনান্দে পড়ানোর মাধ্যম জার্মান, অন্যটিতে চেক মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। সেটিও হাঁটা পথ মাত্র। ধর্ম চর্চা প্রাগের সিনাগগে – তার নামটি বিচিত্র। নতুন-পুরনো সিনাগগ! সারা ইউরোপের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সেখানে সবচেয়ে দীর্ঘদিন প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিতা হ্যারমানের কঠোরতম শাসন উপেক্ষা করে যুবক কাফকা প্রতি শনিবার সিনাগগে হাজরে দিতে অস্বীকার করেন। পিতার সঙ্গে কাফকার নিরন্তর মতভেদ তাঁর ব্রিফে আন ডেন ফাটার (বাবাকে চিঠি) পুস্তকে স্পষ্ট। ... ...
সীমানা পেরিয়ে সেথায় যাওয়ার সুযোগ জুটলো এতদিনে! সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে অরটউইন ও আমি হেনরি ফোরডের প্রপৌত্রের কারখানায় বানানো একটি গাড়ি চড়ে যাত্রা শুরু করি এক দেশের পানে যার নাম চেকোস্লোভাকিয়া থেকে সদ্য চেকিয়া নামে পরিবর্তিত হয়েছে। গাড়িতে বেশিদূর যাওয়ার আগে, একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। আমার কাছে বোহেমিয়া, চেকিয়া জড়িয়ে আছে একটি পরিবারের সঙ্গে। রাজনীতির বলি হয়ে কয়েকশ বছরের বাসভূমি হারানোর সে কাহিনি বইয়ে পড়ি নি, শুনেছি হের রুডলফ ক্রাইবিখের কাছে। তখন জানতাম না একদিন সেই দেশ সেই মাঠ সেই পথ দেখব নিজের চোখে, অনুমান করতে চাইব ছিন্নমূলের বেদনা। কাজটা সহজ নয়। কয়েকশ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষ রাজস্থান থেকে সুদূর পূবে এই বাংলায় বাসা বেঁধেছিলেন। তাঁদের উত্তর পুরুষ আজও পুজোর সময়ে গ্রামের আটচালায় বসে নক্ষত্রের পানে চেয়ে তাদের স্মরণ করতে পারে। মোড়ল পুকুর, বেলে মাঠ, শাঁখের চক আমি তেমনই দেখেছি যেমন আমার বাবা দেখেছিলেন। র্যাডক্লিফের ছুরিতে যখন পূর্ব বাংলা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, আমাদের পরিবারের গায়ে পড়েনি তার কোন আঁচ। আমাদের সেই পুকুর মাঠ বাগান থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অন্তত যতদিন না কেউ কাগজ চাইবেন বা বলবেন আপনারা তো বিদেশি। ... ...
ইন্টারকমে ফোন করে সেক্রেটারি ক্রিস্টেলকে বলে দিলেন আমার সঙ্গে তিনি আসন্ন অডিট নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত আছেন, কেউ ফোন করে যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। - আপনারা পাবে যখন বিয়ারের অর্ডার করেন, তখন বলেন না ‘আইন পিলস বিটে'? - হ্যাঁ, মানে সোনালি রঙের যে বিয়ার সেটাই তো, তাকে পিলস বলে। - পিলস কথাটা এলো কোথা হতে জানেন কি? আমার দেশের প্লজেন শহরের নাম থেকে! দুনিয়া জোড়া বিয়ারের ব্যবসায় এই শহরের নাম জড়িয়ে আছে! জলে বার্লি ও খামির গেঁজিয়ে বিয়ার বানানোর পদ্ধতিটা অন্তত দশ হাজার বছর প্রচলিত, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো অ্যালকহলিক পানীয়। বিয়ার জলের বিকল্প। মিশরের পিরামিড কর্মীদের বেতনের অংশ ছিল বিয়ার,চার হাজার বছর আগে বিশ্বের অন্যতম আইন প্রণেতা (ল গিভার) হাম্মুরাবির কোডে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিয়ারের বিশেষ ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়েছে। রাজা এর উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং সামাজিক সম্মান অনুযায়ী দৈনিক বিয়ার বিতরিত হবে ; আমলারা পাবেন পাঁচ লিটার, মজুরেরা দু লিটার। বিয়ারের ইতিহাসে বোহেমিয়ার বিশিষ্ট অবদান আছে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, চারটি বিভিন্ন জলধারার সঙ্গমে প্রতিষ্ঠিত ছোট্ট শহর প্লজেনের(জার্মান পিলসেন) আড়াইশো নাগরিককে বিয়ার বানানোর অধিকার দেন বোহেমিয়ান রাজা ওয়েনসেসলাস। প্রাগ শহরের মধ্যমণি আজ ওয়েনসেসলাস চত্বর; তিনি চেকিয়ার রক্ষক সন্ত -প্যাট্রন সেন্ট। কালে কালে নাগরিকরা গড়ে তোলেন আমাদের আমূল দুধের মতন এক বিয়ার সমবায়! কিন্তু সে বিয়ার ক্রমশ মুখে দেওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হলে উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি একদিন সাড়ে তিন হাজার লিটার বিয়ার প্লজেন শহরের মাঝে এক নর্দমায় ঢেলে দিয়ে নগর পিতারা কোন সুযোগ্য বিয়ার জাদুকরের সন্ধানে গেলেন ব্যাভেরিয়া। বিয়ার বানানোয় ব্যাভেরিয়ার বিশেষ সুনাম ছিল -তাদের এক রাজা ১৫১৬ সালে শুদ্ধতার আইন প্রচলন করেন-সে মোতাবেক জল বার্লি এবং হপ (এক ধরনের গাছের ফল যা থেকে বিয়ারের তিক্ততা আসে) ছাড়া বিয়ারে কিছুই মেশানো যাবে না, কোন কেমিক্যাল তো নয়ই। ইস্ট অথবা খামির সম্বন্ধে কোন নির্দেশ দেওয়া হয় নি এই বিধানে। ব্যাভেরিয়াতে সন্তরা বিয়ার গ্যাঁজাতেন গোপনে পাহাড়ের গুহায় অর্থাৎ তাঁদের পদ্ধতি ছিল কোল্ড, বটম ফারমেনটেশান যার স্বাদ অতি উত্তম কিন্তু বর্ণ ছিল ঘোলাটে। প্লজেনের বিয়ার গোয়েন্দারা ভুলিয়ে ভালিয়ে অর্থের প্রলোভন দিয়ে উনত্রিশ বছরের ইওসেফ গ্রোল নামের এক ব্যাভেরিয়ান সাধুকে তিন বছরের চুক্তিতে পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। সাল ১৮৪২। খানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ইওসেফ গ্রোল সোনালি রঙের এক অসাধারণ পানীয় প্রস্তুত করলেন – তার নাম দেওয়া হলো প্লজেন্সকি প্রাজদ্রোই। অস্ট্রিয়ান হাবসবুরগ সম্রাটের আমলে প্লজেন শহরের জার্মান নাম অনুযায়ী নগর পিতারা এই বিয়ারের নাম দিলেন পিলসনার উরকেল (পিলসেন আদি উৎস)! ... ...
আলাপ জমে গেলো ফ্রান্তিসেকের সঙ্গে। টি টুয়েন্টি নামক দানবের দুরাচার শুরু হবার আগে টেস্ট ক্রিকেটের মাঠে গল্প বেশি জমতো - অনেকক্ষণ যাবত মাঠে কিছুই ঘটে না, স্যাকরার ঠুক ঠাক চলে ব্যাটে বলে। ফুটবলের মাঠে সেটা সম্ভব নয়। তবু খেলার আগে, মাঝে, হাফ টাইমে কিছু কথা। আমরা তাঁকে একাধিক বিয়ারে আপ্যায়িত করেছি, কিছুতেই দাম দিতে দেব না! ভারত ও পূর্ব ইউরোপের ভাইচারা যুগ যুগ স্থায়ী হোক। দুজন ভারতীয়ের সঙ্গে এই ফ্রাঙ্কফুর্টের মাঠে দেখা হবে তিনি ভাবতে পারেন নি! আমার ট্রিভিয়া লাইব্রেরির শ্রীবৃদ্ধির জন্য যত না প্রশ্ন, ভারত সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানস্পৃহা অনেক বেশি। ততক্ষণে তাঁর টিম আইনত্রাখত ফ্রাঙ্কফুর্টের হাতে বেশ ঝাড় খাচ্ছে, ৩-০ গোলে পিছিয়ে এবং তাঁর মনোযোগ বিভ্রান্ত। তাই প্রস্তাব দিলাম- তিনি যদি চান আমরা একত্র হেঁটে শহরে ফিরতে পারি, এক ঘণ্টার পথ। ট্রামে বেজায় ভিড় হবে। ফ্রান্তিসেক বললেন যদি আমরা তাঁকে ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি অবধি সঙ্গ দিতে পারি তাঁর খুব উপকার হয়, রাতের ট্রেন ধরবেন। সেটাই আমাদের লজিস্টিক, ফ্রাঙ্কফুর্ট হাউপটবানহফের সামনে আমরা বারো নম্বর ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরব। ... ...
ভোরের ফ্লাইট। যখন শহরে ঢুকছি তখন আবছা আলো। ট্যাক্সির জানলা থেকে দেখি আট তলা দশ তলার অ্যাপারটমেনট, ধূসর বর্ণ, বহুকাল দেয়ালে কোন রঙের পোঁচ পড়ে নি। বাতাসে টু স্ট্রোক এঞ্জিনের ফেলে যাওয়া আধ পোড়া পেট্রোলের গন্ধ। আমার হাতের চিরকুটে লেখা ঠিকানা দেখে ট্যাক্সি আমাকে যেখানে নামিয়ে দিলো সেটা একটা টিপিকাল কমিউনিস্ট আমলের পাঁচ তলা অ্যাপারটমেনট ব্লক। কাচের জানলা হয়তো পঞ্চাশ বছরের পুরনো। দু পাশে ফ্ল্যাট, মধ্যিখানে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি। নিচের তলায় একটি দরোজার সামনে লাইন দিয়ে মোটামুটি নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছু মানুষ। কেউ কেউ ধূমপানে রত। এতো বছর সিটি ব্যাঙ্কে কাজ করছি ততদিনে অন্তত পঞ্চাশটা দেশে সিটি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ দেখেছি তার সঙ্গে এ একেবারে মেলে না। ঠিক জায়গায় এসেছি কিনা সন্দেহ হলো। দোতলায় যেতে হবে জানা ছিল (প্রিভে প্রশদিয়ে)। মাঝের সিঁড়ির দরোজায় বেল নেই, পরিচিতি জানানোর ওঠে না। সে সিঁড়ির চেহারা বড়ো বাজারের কোন পুরনো বাড়ির মতো , দেওয়ালে পানের পিকটাই যা নেই। দোতলায় উঠে চমকাতে হলো। হলদে রঙের একটা ঝাঁ চকচকে দরোজার ওপরে সিটি ব্যাঙ্ক লেখা দেখে। এমনকি এন্ট্রি ফোন! বেল টিপলে এক মহিলার কণ্ঠ শোনা গেলো। তিনি ঘণ্টি বাজিয়ে আমাকে দরোজা ঠেলতে বললেন -একেবারে স্টেট অফ দি আর্ট ! যিনি দেখা দিলেন তাঁর নাম ইওয়ানা, এতক্ষণ তিনি আমার পথ দেখছিলেন বলে জানালেন। এক নজরেই বোঝা গেলো এটি একটি স্ট্যান্ডার্ড তিন কামরার কমিউনিস্ট কালের ফ্ল্যাট যার তুল্য দেখেছি সারা পূর্ব ইউরোপে। ঢুকতেই বাঁ হাতে টয়লেট, ডাইনে রান্নাঘর, হলের তিন দিকে তিনটি ঘর । উত্তরে টালিন বা সেন্ট পিটারসবুরগ ( পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি প্রথম পর্ব পশ্য, ছবি সহ) থেকে দক্ষিণে স্কোপয়ে অবধি সমস্ত অ্যাপারটমেনট একই বিশ্বকর্মার প্ল্যান বা মর্জি মাফিক তৈরি। তফাৎ শুধু ঘরের সংখ্যায়, দুই বা তিন । তবে এ ফ্ল্যাটের অন্দরের চাকচিক্য আছে- সিটি ব্যাঙ্ক বলে কথা ! যদি লন্ডন থেকে আমাদের ডেপুটি সিইও ডেভিড গিবসন হঠাৎ এসে হাজির হন , তাঁর কাছে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। বাইরেটা দেখেই অবশ্য তিনি মূর্ছা যেতে পারেন। ... ...
কোন একদিন মারটিনে যাবার ইচ্ছে থেকে গিয়েছিল তার সুযোগ একদিন জুটল। কোসিতসে থেকে ব্রাতিস্লাভা যাবার পথে নেমেছিলাম, খানিকটা কাজে খানিকটা কৌতূহলে। মারটিনে পথ চলতে চোখে পড়ে বাড়ির গায়ে আঁকা প্রকাণ্ড মুরাল। তারা হয়তো কোন গভীর অর্থ বহন করে, জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে নি। দক্ষিণ জার্মানির ব্যাভেরিয়াতে দেখেছি এমনি দেওয়ালজোড়া স্থির চিত্র, যাকে জার্মানে বলে হাওয়াই চিত্রকলা (লুফতমালারাই)। তবে তার সাইজ অনেক ছোটো। হোহে তাতরা বা উঁচু তাতরা পর্বতের নাম শুনেছি জার্মানিতে। সেটা যে ঠিক কোথায় জানতাম না, সে আমলে ফ্রাঙ্কফুর্টের পূর্বে কোথায় কি আছে জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। পূর্ব ইউরোপে আসা যাওয়া শুরু হলে জ্ঞান বাড়লো - আল্পস থেকে যে পর্বতমালা শুরু হয়ে টানা হিমালয়ে গিয়ে মিশেছে ইউরোপে তার নাম কোথাও উলিয়ান আল্পস (স্লোভেনিয়া), তাতরা (স্লোভাকিয়া), কারপাত (রোমানিয়া)। এই অখণ্ড শৈলশ্রেণি স্লোভাকিয়ার উত্তরে পোল্যান্ডের সঙ্গে সীমানা নির্দেশ করে। পোলিশ অংশে আছে জাকোপানে যেটি পোল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কি রেসর্ট, দীর্ঘদিনের পোলিশ বান্ধবী ক্রিস্টিনা প্রতি বছর স্কি করতে যায়। সেই তাতরার দর্শন পেলাম দক্ষিণ প্রান্ত থেকে। মারটিন শহর তার ছায়ায়, তুরেতস নদীর কোলে আশ্রিত (জার্মান নাম তুরতস সাঙ্কট মারটিন) পথ চলতে দূর পাহাড়কে কাছের মনে হয় সঞ্জীবচন্দ্রের পালামউ ভ্রমণ মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে জলপাইগুড়ির দিনগুলি – প্রসন্ন দিনে দিগন্তে হিমালয়ের রেখা, কাঞ্চনজঙ্ঘার ইশারা। ... ...
ব্রাতিস্লাভায় সিটি ব্যাঙ্কের নবীন কর্মী মারেক পটোমা বলেছিল নিজের দেশ না হলে আইস হকিতে স্লোভাক প্লেয়ারদের জায়গা জুটবে না তাই আমরা আলাদা হয়েছি! দেশ ভাগের এর চেয়ে জোরালো যুক্তি আমি অন্তত খুঁজে পাই নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে উইলসন ডকট্রিন মাফিক ইউরোপে স্বায়ত্ত শাসনের যে দাবি উঠেছিল তার ফলে পুরনো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ মিলে তৈরি হলো চেকোস্লোভাকিয়া, এই মাত্তর ১৯১৮ সালে। ক্যাথলিক ধর্মের প্রাধান্য দুই অঞ্চলে, চেকের সঙ্গে স্লোভাক ভাষা প্রায় ৮৫% মেলে; আমার প্রাক্তন সহকর্মী ইভেতার (এখন আবু ধাবিতে) কাছে গল্প শুনেছি – অফিসে সে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে এক চেক কলিগের সঙ্গে। আরেক স্থানীয় সহকর্মী জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোন ভাষায় কথা বলছ? ইভেতা বলে, নিজের নিজের মতন, আমি স্লোভাক এবং উনি বলছেন চেক! আমাদের হিন্দি/উর্দু সংলাপের মতন। ... ...
প্রায় ষাট বছর আগের এই ফলকে বানান অন্য রকম হলেও জওহরলাল নেহরুকে চিনলাম। ইংরেজি বাদে প্রায় কোনো ইউরোপীয় ভাষায় ‘জ’ ধ্বনির সমার্থক কোন অক্ষর নেই। স্লোভাকে ডি জেড দিয়ে সেই ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়েছে (জার্মান ভাষায় এই একই ধাঁচে লেখা হয়) কিন্তু নেহরুর পরে যিনি উল্লেখিত,তাঁকে আমরা চিনি অন্য নামে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নাম পরিবর্তন করে তাঁকে গান্ধিওভা বানানো হয়েছে। তাঁরও ছাড় নেই, তাঁকেও পরিচিত হতে হবে স্লোভাক কায়দায়,স্বামীর নামের সাথে ‘ওভা’ যুক্ত হয়ে। বিশ বছর বাদে,১৯৫৮ সালের কার্লোভি ভারি (জার্মান কারলসবাদ,চার্লসের স্নানাগার!) ফিলম ফেস্টিভালে মাদার ইন্ডিয়া ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন নারগিসোভা! এখানে একটু শর্টকাট নেওয়া হয়েছিল,সঠিক আইন মানলে পুরস্কার ফলকে লেখা হতো নারগিস রাশিদোভা (তাঁর বাবার নাম আবদুল রাশিদ) সুনীল দত্তের সঙ্গে ততদিনে বিয়েটা হলে তিনি হতেন নারগিস দত্তভা (প্রসঙ্গত এক মেক্সিকান অভিনেত্রীকে বাদ দিলে কার্লোভি ভারি ফেস্টিভালে নন কমিউনিস্ট দেশের কেউ পাত্তা পেতেন না – নারগিস সেই ট্র্যাডিশন ভাঙ্গেন,এর পরে ১৯৭২ সালে রঞ্জিত মল্লিক ইন্টারভিউ ছবির জন্য বেষ্ট অ্যাকটর এ্যাওয়ার্ড পান)। স্লোভাকিয়াতে ফিল্মের পোষ্টারে,খবর কাগজে,টেলিভিশনে শ্যারন স্টোন হন শারনে স্টোনোভা, মেরিলিন মনরো হয়ে যান মেরিলিন মনরোভা। ... ...
একদা ইউরোপের মাঝখানে কোথাও বসবাস করতেন স্লাভ জাতি। কালে খাদ্যের অকুলান হলো, নিয়মিত তুরকিক অভিযানে জীবন বিপর্যস্ত–দেড় হাজার বছর আগে ভাগ্য সন্ধানে তাঁরা ইউরোপের তিন দিকে বেরিয়ে পড়লেন। পোল্যান্ডের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী তিন স্লাভিক ভাই, লেখ চেখ রুশ গেলেন তিন দিকে–উত্তর দিকে লেখ, পুবে রুশ দক্ষিণে চেখ। লেখ বাসা বাঁধলেন আজকের পোল্যান্ডে (লেখ নামক বিয়ার তাঁর নামকে অমর করে রেখেছে) বেলারুশ; রুশ যেখানে থামলেন সেটি আজকের রাশিয়া, ইউক্রেন (আক্ষরিক অর্থে সীমানা), চেখ ভাই গেলেন দক্ষিণে, আজকের বলকান অবধি। কালক্রমে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন সকলে। পশ্চিমে কেন যান নি তার কোন ব্যাখ্যা পাই নি। হয়তো বর্বর গথ ভিসিগথ জাতির নৃশংস আচরণের কাহিনী শুনেছিলেন অথবা এই তিন অঞ্চলে তাঁরা পেলেন বাসযোগ্য ভূমি; লোভ বাড়ান নি। ... ...
যাব ব্রাতিস্লাভা। স্লোভাকিয়া দেশটি সবে আপন পতাকা উড়িয়েছে; আগে সে দেশে যাওয়ার পথ ছিল পুরনো চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ দিয়ে (১৯৭৭ সালে প্রথম ইউরোপে পৌঁছে সেখানে প্লেন বদল করেছি)। রাজধানী হলেও ব্রাতিস্লাভার বিমানবন্দর আকারে অতি ক্ষুদ্র। ১৯৯৬ সালে ব্রাতিস্লাভা এয়ারপোর্টে নেমে কোন ট্যাক্সি পাই নি। আরেকজনের সঙ্গে কোনমতে বাবা বাছা করে ভাগের গাড়ি চড়ে শহরে গিয়েছি। লন্ডন থেকে কোন প্লেন সরাসরি সেখানে যায় না- ইউরোপের কোথাও প্লেন বদলাতে হয়। ভিয়েনা-ব্রাতিস্লাভার ফ্লাইট কিছুকাল চালু ছিল কিন্তু মাত্র দশ মিনিটের এই উড়ানে খরচা পোষায় না বলে সেটি বাতিল হয়ে গেছে। তার চেয়ে সহজ তাদের প্রাক্তন প্রভুর দেশ, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে গিয়ে গাড়ি, নৌকো ( স্পিড বোট ) বা ট্রেন ধরা। সময় লাগে বড়জোর এক ঘণ্টা। দূরত্ব মেরে কেটে ৮০ কিমি। সীমান্ত খুলে গেছে। ব্রিটিশ পাসপোর্ট দেখালেই অবারিত দ্বার; বড়জোর একটা ছাপ মেরে দেবে। ... ...
সুবা বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানান দোষগুণ বহুল আলোচিত এবং এই নিয়ে প্রচুর লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ইতিহাসের সহজলভ্য জনপ্রিয় সূত্রগুলি দেখলে, সেখানে সচরাচর তাঁকে নিয়ে একতরফা বিরূপ অভিমতই চোখে বেশি পড়ে, যেমন- সর্বসাধারণের তথ্য সংগ্রহের প্রধান উৎস উইকিপিডিয়া তে সিরাজ যে তথ্য পাওয়া যায় তা বাঙালির পক্ষে খুব স্বস্তিকর নয়। শুধু সিরাজ নয়, ওই শতকের বাংলার ইতিহাস আমরা সচরাচর যেভাবে পাই তা যেন বাংলা ও বাঙালির প্রতি একটু বেশিই বিরূপ। ইতিহাসের student হয়ে ইতিহাসচর্চা করতে গিয়ে জেনেছি ঐতিহাসিক বিবরণ লেখার প্রধান শর্ত হল নিরপেক্ষতা বা পক্ষপাতিত্ব ত্যাগ করা। সময় বা মহাকাল ও সেই নিয়ম মেনে চলে। তবে ওই অষ্টাদশ শতকের বর্ণনা একটি জাতির প্রতি কীভাবে এত বিরূপ হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে, খটকা লাগে। এই লেখা সেই খটকা, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। ... ...
পাঁচশ বছরের অটোমান রাজত্বে মাসিদোনিয়া কোন রাজ্য (সঞ্জক) ছিল না, ভারদার নদী বয়ে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, সেই নদী অথবা প্রধান শহর উস্কুপ (আজকের স্কপয়ে) এর নামেই তার নাম। ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনসের (এন আর সি) প্রশ্ন ওঠে নি, কোনো রাজদপ্তরে পাসপোর্ট জন্মকুণ্ডলীর কাগজ দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় নি, তাঁরা কেউ ঘুসপেতিয়া নন। মাসিদোনিয়ানরা কোন স্বতন্ত্র জনজাতি নয়, আজকের বুলগারিয়া গ্রিস আলবানিয়া সর্বত্র মিলে মিশে বাস করেছেন – তাঁরা সংখ্যালঘু কিন্তু সুলতানের কাছে সবাই প্রজা। ... ...
মাসিদোনিয়াতে তাঁরা জনসংখ্যার পঁচিশ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী স্রেভেনকোভস্কি বললেন জনশ্রুতি এই যে মাসিদোনিয়ান সরকার তাঁদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছেন, আলবানিয়ান ভাষা শেখানো হয় না, ছেলে মেয়েদের আলবানিয়ান নাম দেওয়া নিষিদ্ধ, সরকারি দফতরে, আর্মিতে চাকরি জোটে না। ক্লিনটন সরকার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কিন্তু আপনাদের জানাতে পারি এটি সম্পূর্ণ অসত্য। মুশকিল হলো প্রধানমন্ত্রী স্রেভেনকোভস্কি এমন সব রাজনৈতিক ইসু তুলে ধরলেন যার বিষয়ে আমাদের কিছুই জানা ছিল না। ... ...
"ইংরেজের যতোই টেকনিকাল জ্ঞান থাকুক না কেন, জমির মালিক কনস্তানতিনোপেলের অটোমান সুলতান ; তিনি খামখা কূটবুদ্ধি ইংরেজকে রেল লাইন পাতার জন্য জমি দেবেন কেন? তিনি বললেন কেটে পড়ো, দান খয়রাতি করলে রাজ্য চলে না। ততদিনে ইংরেজ সেই লাইনের মাপজোক, এমনকি কোন খানে লাইন পড়বে তার অঙ্ক অবধি কষে ফেলেছে। খরচা হয়েছে, উশুল নেই। এবার তারা নরম সুরে ধর্ম সহিষ্ণু সুলতানের কাছে ইংরেজ (এবং কিছু ফরাসি) আবেদন জানাল, জাহাঁপনা, আপনি ক্রিস্টিয়ান, ইহুদিদের ধর্মস্থলের মেরামত করে দিয়েছেন, আপনার মহিমা অপার। একবার ভেবে দেখুন যাঁদের জন্য আপনার এই অসামান্য অবদান, তাঁদের, মানে ইহুদি ক্রিস্টিয়ান তীর্থযাত্রীদের পুণ্য শহর জেরুসালেমে পৌঁছুনোর পথে অনেক ঝকমারি, জাহাজ থেকে নেমে দুর্গম গিরি পার হতে হয়। সেই সব তীর্থ যাত্রী যদি জাফা (তেল আভিভের পত্তন এই মাত্তর ১৯০৯ সালে ; জাফা অতি প্রাচীন শহর) বা হাইফাতে জাহাজ থেকে নেমে ট্রেন ধরে সিধে জেরুসালেম যেতে পারেন তাহলে যাত্রী সংখ্যা ও সুলতানের তিজউরিতে অর্থাগম বাড়ে (জিজিয়া কর অবিশ্যি ততদিনে উঠে গেছে)। এই কাহিনি শুনে সুলতানের উজির বললেন হঠাৎ ইংরেজ ফরাসি এ তল্লাটে কেন হাজির হলেন তাঁরা নিজের রাজত্ব সামলান গিয়ে। এ হলো গিয়ে ১৮৬৫ সালের কথা।" ... ...
সাফ সুতরো পবিত্র সমাধির গিরজেতে দেখা দিলো এক ধর্ম সঙ্কট। যিশুকে ঈশ্বরের সন্তান জ্ঞানে বন্দনা করার অধিকার সকল ক্রিস্টিয়ানের। কিন্তু তাদের মধ্যে গণ্ডগোল বাধল সেই বন্দনার আচরণ প্রক্রিয়া নিয়ে - কে কোথায় কি ভাবে কোন ঘণ্টা বাজিয়ে কোন ধুনো দিয়ে কবার পাখা নেড়ে দিনের মধ্যে কতবার প্রার্থনা করবে তাই নিয়ে লড়াই চলে ; দেবস্থানের ঠিক কোন কোণায় কে দাঁড়াবে তার মীমাংসা হয় নি, এই নিয়ে মারামারি হয়েছে প্রভুর ক্রুশের সামনে। ধর্মের এই কুরুক্ষেত্রের লিগে ছজন প্লেয়ার, ছয় পুরুত, পূজারী পক্ষ – গ্রিক অর্থোডক্স (তাদের গলা সর্বদা উঁচুতে, আমাদের ভাষায় বাইবেল লেখা হয়েছে, বাবা, নইলে কি কেউ জানতে প্রভু এয়েছেন?), আর্মেনিয়ান চার্চ (দুনিয়ার পয়লা ক্রিস্টিয়ান দেশ, যখন বাকিরা পুতুল পুজোয় ব্যস্ত), মিশরের কপটিক (প্রভুর বাল্যকাল কেটেছে আমাদের দেশে), ক্যাথলিক (রোমের সে মহান গিরজে কে বানালো শুনি?), ইথিওপিয়ান চার্চ (সলোমনের বউ আমাগো দ্যাশের মাইয়া), সিরিয়ান চার্চ (ক্রিস্টিয়ানের পয়লা দীক্ষা, দামাস্কাসের পথে?)। প্রত্যেকে চান তাঁদের আপন নিয়ম মাফিক এই গিরজের পরিচালনার ভার এবং চাবি। ... ...
কতটা বিভক্ত এই দেশ? তেল আভিভ হতে ডেড সী যাবার মোটরওয়েতে বারবার চোখে পড়বে বড়ো অক্ষরে লেখা A B C : এটি কোন বর্ণ পরিচয়ের পাঠশালা নয়। এই অক্ষর মালা নির্দেশ করে কোন অঞ্চল কার তাঁবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পরেও ব্রিটিশ ফরাসি আমেরিকা এই তিন মিত্র শক্তি শাসন করেছে পশ্চিম বার্লিন। আপনি হাঁটছেন, হঠাৎ দেখলেন একটা মানুষের সাইজে সাইনবোর্ড – তাতে লেখা ‘আপনি ফরাসি সেক্টর পরিত্যাগ করিলেন’। এবার আপনাকে আরেকটি সাইনবোর্ড আমেরিকান সেক্টরে আপনাকে স্বাগত জানায়। মিত্র শক্তির এই দফায় দফায় দেওয়া নোটিসে আপনার চলা ফেরার কোন অসুবিধে হতো না কারণ কেউ আপনার পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা করতে চায় নি ( যদিও সে ক্ষমতা তাদের ছিল। এক সেক্টর ছেড়ে অন্য সেক্টরে প্রবেশ করলে কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না, কেবল পুলিশের, সৈন্যের পোশাকটা বদলে যায়। মুশকিল ছিল সোভিয়েত সেক্টর নিয়ে, সেখানে উঁচু দেওয়াল। ... ...