জামাত অবশেষে নিষিদ্ধ হল। এমন সময় হল আর এমন ভাবে হল যে মন খুলে উল্লাসও করা যাচ্ছে না। যে চোরাবালিতে বাংলাদেশ পড়েছে সেখান থেকে উত্তরণের কোন সম্ভাবনাই দেখছি না। অস্থির একটা সময়। ভোর হচ্ছে আতঙ্ক নিয়ে যে আজকে আবার না জানি কী হয়। দৈনিক একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছি আমরা এই চোরাবালিতে। খড়কুটো যা পাচ্ছি তাই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু সবই বিফলে যাচ্ছে। সবচেয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকেই গন্তব্য মনে হচ্ছে আমাদের। দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ? আজকে একজন আমাকে বলল দেশে না কি বিপ্লব হচ্ছে, আমরা তা ধরতে পারছি না, পুরাতন চিন্তা ভাবনা আমাদেরকে নতুন চিন্তা করতে দিচ্ছে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে বলেছে যে আমি বুঝি না কারণ বিপ্লব বুঝতে হলে প্রেম করতে হয়, যেহেতু আমি প্রেম করি নাই তাই আমি বিপ্লব বুঝি না! বিপ্লব বুঝতে হলে প্রেম করতে হলে আমার দ্বারা আর হল না মনে হয়, এই বয়সে প্রেম করে বিপ্লব বুঝতে যাওয়া আমার পক্ষে একটু কঠিনই হয়ে যাবে!
জামাত নিষিদ্ধ আমাদের প্রজন্ম, যারা জন্মের পর থেকে জামাতের আস্ফালন দেখে বড় হয়েছি তাদের বড় একটা দাবী ছিল। জামাত নিষিদ্ধ হল সন্ত্রাস বিরোধী আইনে। আমরা আশা করেছিলাম যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেই নিষিদ্ধ করা হবে। এই দলের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তাহলে সংগঠন কীভাবে শাস্তির বাহিরে থাকে? ৭২ সালের সংবিধানে জামাতকে নিষিদ্ধ করা হয় একটু অন্য ভাবে, দেশে ধর্ম নিয়ে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না, এমন একটা ধারা ছিল। আমি মনেপ্রাণে এই ধারাটাকেই চাচ্ছিলাম। বহুকিছুর সমাধান হত এতে। যাক, তবু তো হল নিষিদ্ধ। এখন জামাতের প্রতিষ্ঠান গুলো সম্পর্কে একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। টাকা পয়সায় হাত না দিলে এদেরকে বিপদে ফেলা যাবে না। দেশে শিবিরের কোন কর্মী নাই অথচ সময় মতো সবাই হাজির। এদেরকে টিকিয়ে রাখেই জামাতের এই প্রতিষ্ঠান গুলো। যেমন ইবনে সিনা ফার্মাসিটিক্যালস, এখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার। অথচ বেক্সিমকো ইবনে সিনা থেকে অন্তত তিন চার গুণ বেশি বড় একটা প্রতিষ্ঠান, তাদের ওখানে কর্মীর সংখ্যা চার হাজার সাতশ! এই বিপুল কর্মীদেরকে লালন পালন করা হয়, যারা আসলে শিবির কর্মী। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক জামাত। এগুলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত দ্রুত।
কিন্তু এখন আসলে এগুলা কোন কিছুই কোন অর্থ রাখছে না। গতকালও দেশের নানা জায়গায় তুমুল গণ্ডগোল হয়েছে। ছাত্র মৃত্যুর সংবাদ পাইনি। খুলনায় পিটিয়ে একজন পুলিশকে মেরে ফেলেছে! পুলিশ সদস্যার স্ত্রীর আহাজারি দেখলাম! একই রকম আহাজারি কত ছাত্রের মা বাবা করছে, কয়জনের কথা বলব? তীব্র আন্দোলন চলছে, একপক্ষ জীবন দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে, অন্য পক্ষ কোনমতেই সংযত হতে পারছে না। একটু যে স্থির হবে, একটু যে ভাববে, মাথাঠাণ্ডা করে দেখবে পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে তার কোন লক্ষণ নাই! জীবন দিতে চাচ্ছে কেন? এত সহজ জীবন দিয়ে দেওয়া? সরকার পতনও কী একটা জীবনের মূল্যের সমান? সব পোকামাকড়ের ম তো আগুনে ঝাপ দিচ্ছে! আশ্চর্য! কেন? আমি আমার সংস্পর্শে যাদেরকে পেয়েছি তাদেরকে বুঝতে পারছি। বলছি তোরা আমাকে শুধু একবার বুঝা যে তোরা কী চাচ্ছিস এখন? নয় দফা দাবী তো ভুয়া, নয় দফা মানলেও এখন আন্দোলন বন্ধ হবে? আরও নতুন দফা এসে হাজির হবে না? সরকার পতনের অর্থ বুঝতে হবে না? একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিপ্লব করি চল বলে বের হয়ে পড়লে বিপ্লব হয়ে যাবে? হুট করে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ জেগে উঠল আর সমস্ত সিস্টেম তোমার পায়ের তলে এসে দাঁড়াবে? কেন কারণ অকাতরে জীবন দিতে পারি! এ তো ভালো বিপদ!
দুনিয়ায় যত বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে তার সব গুলাই সফল হয়নি। মনে হয়েছে সফল, প্রাথমিক অবস্থায় মনে হয়েছে জিতছি, পতন হয়েছে সরকারের। কিন্তু পরে দেখা গেছে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। গাদ্দাফি খুব খারাপ, টেনে নামাল হল, এখন এমন অবস্থা গাদ্দাফিকে দেবতা মনে হয়! আরব বসন্ত কোন দেশের জন্য মঙ্গল হয়ে আসছে? একটু চোখ খুলে দেখলেই তো দেখা যায়। যে বিপ্লব সফল হয়েছে বলে মনে করা হয় তার প্রতিটাই দুর্দান্ত নেতৃত্বের কারণেই সফল হয়েছে। যেটার নেতা ছিল না সেটাই শেষ!
আমাকে প্রেম দিয়ে বুঝানো হয়েছে। আসলেই তাই, বিপ্লবের সাথে রোমান্টিসিজম তো জড়াজড়ি করেই আছে। আর এই রোমান্টিসিজম যে কত ধ্বংসের করণ তার হিসাব নিবে না কেউ? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়ই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মাত্র স্বাধীন হওয়া একটা দেশকে এই সস্তা রোমান্টিসিজম এক ধাক্কায় গহ্বরে ফেলে দিয়েছিল না? আবার একই চিত্র দেখছি এখন। যা বুঝি না, যার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নাই সেই জিনিস নিয়ে দৌড়াচ্ছি। যা আমার মুখে ধরবে না তা খাওয়ার জন্য হা করছি, হজম করতে পারব কি না তার তো হদিস নাইই!
আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই এই সরকার চলে গেলে। কিন্তু আমি আহাম্মকের মতো আগে নামুক পরে দেখা যাবে ধরণের তত্ত্বে বিশ্বাস আনতে পারব না। এই সরকার বা শেখ হাসিনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কেন? কারণ এই দেশের মাটিতে রাজাকারদের ফাঁসি একমাত্র উনার কারণেই সম্ভব হয়েছে। যারা রাজাকারদের আস্ফালন না শুনেছে তাদের পক্ষে ওই গর্জনের কষ্ট বুঝা মুশকিল। কিসের মুক্তিযুদ্ধ, দেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, হয়েছে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া! এগুলা শুনে শুনে বড় হয়েছি। কামরুজ্জামানকে কাছ থেকে দেখছি। ওরে বাপরে! কী তাদের প্রতাপ! যেদিন কামরুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয় তখন আব্বা বাজার থেকে এসে আমাকে ডাক দিল। বলল একজনের কথা, সে বাজারে আব্বাকে জরায় ধরছে, কান্না করছে, বলছে বিচার হইছে রাজ্জাক ভাই বিচার হইছে! আব্বা হতভম্ব! যুদ্ধের সময় আব্বা ছিল পাকিস্তানে বন্দী। ফিরেছেনও অনেক পরে। যুদ্ধের ভয়াবহতা তিনি দেখেন নাই। শুনছেন, চাকরি করছেন আবার গভীর করে ভাবেন নাই। এতদিন পরে আব্বার যেন চোখ খুলে গেল! বাড়িতে ফিরেও ঘোর কাটছে না উনার। আমি জিজ্ঞাস করলাম কে? কার কথা বলছেন? নাম বললেন। আমি চিনলাম। বললাম উনার ছেলেকে ব্রিজের নিচে গিয়ে গুলি করে মেরেছিল কামরুজ্জামান। উনি এত বছর ধরে বসে ছিলেন যে একদিন এই মাটিতে শাস্তি হবে। কামরুজ্জামানের স্ত্রীর ভাই যুদ্ধের পরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বলে গেছিলেন নিজের মাকে যে এই যে রাজাকারের সাথে বিয়ে দিলে, একদিন বিচার হবে, একদিন তোমার মেয়েকে কাঁদতে হবে! এমন হাজার হাজার মানুষের কাঙ্ক্ষিত এই বিচার! আমার আর কিছু চাওয়া নাই। শহীদ পরিবারেরা যখন দেখত রাজাকারের গাড়ি জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে এরচেয়ে কষ্টের, এরচেয়ে কুৎসিত কিছু তাদের জন্য মনে হয় না আর কিছু ছিল। তাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত বিচার এই দেশে হয়েছে। এরপরে আর আমার ব্যক্তিগত ভাবে কিচ্ছু চাই না আর। এই কারণে আমি কৃতজ্ঞ। শেখ হাসিনা ভালো মতে চলে যেতে পারলে ভালো। না হলে আমার কিছু বলার নাই।
কারণ বর্তমান সময়ে যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়ার মতো না। সমাধানের পথে যাওয়ার পরে সমাধান না হলে এক কথা। যারা বিপ্লবের ভূত মাথায় নিয়ে ঘুরছে তাঁকে আপনি ফিরাবেন গুলি মেরে? প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয়ে আসবে না? কী সেই সমাধান তা আমি জানি না। এইটা আপনাদেরই বের করতে হবে যারা এইটা সৃষ্টি করেছেন। আপনারা আমাদেরকে ফেলেছেন উভয়সংকটে। এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি ধীরে ধীরে জামাত বিএনপির হাতে চলে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষে তাদের সাথে গলা মেলানো সম্ভব না। আমাদের পক্ষে আবার দৈনিক নিয়ম করে লাশ পড়বে আমাদের অর্ধেক বয়সই কোন একজনের, এইটাও মেনে নেওয়া সম্ভব না।
জামাত বিএনপির প্ররোচনায়ই হোক বা এই প্রজন্মের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নাই দেখেই হোক, এখনই আগস্টের শোক নিয়ে মজা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ১৫ আগস্ট এইটা আরও ভয়ংকর হয়ে যাবে নিশ্চিত। সব ছাত্ররা মিলে যদি কেক কাটে আমি আশ্চর্য হব না। এখন কেউ আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝাক কেন আমার এরপরে তাদের সাথে থাকতে হবে?
ভবিষ্যৎ কী? অন্ধকার! আর কিছুই বলার নাই এখন। নিকষ কালো অন্ধকার। তুমুল গতিতে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি। সরকারের সাথে যতদিন আর্মি আছে ততদিন পতন হবে না এই সরকারের। আর্মির ভিতরে বিদ্রোহ হতে পারে। দুইটাই গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা আরও তীব্র করবে। বিএনপি জামাত হিসাব করে দেখেছে হয়ত এইটাই রাস্তা। এ ছাড়া কোনদিন ক্ষমতার আশেপাশেও তারা যেতে পারবে কি না সন্দেহ। শেখ হাসিনার কোন সেফ এক্সিট রুট নাই। এইটাই আরও বেশি ভয়ংকর করে তুলছে পরিস্থিতি। আপনাকে টিকে থাকতেই হবে আর না হলে শেষ! কাজেই মরিয়া হয়েই টিকে থাকার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রথম বাধাতেই তৃণমূল কর্মীরা হাত গুটিয়ে নিয়েছে। যে যে কয় পয়সা বানাতে পেরেছে সে ভাবছে ওইটাই আগে রক্ষা করি। চুপ করে বসে আছে এরা। ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে এইটা হচ্ছে প্রাপ্তি আওয়ামীলীগের। সরকার গর্ব করে বলে ৫০০ মসজিদ বানিয়েছে। যেন এই ৫০০ মসজিদ না হলে বাংলা মানুষ নামাজ না পড়ে বসে ছিল। অথচ এই টাকায় লাইব্রেরী বানানো যেত, উন্নত মানের গবেষণাগার বানানো যেত, হাসপাতাল বানানো যেত। দেশ ধীরে ধীরে মৌলবাদের কবলে ঢুকে গেছে এখন আফসোস করছে সবাই এমন কেন?
এখন দেশে এক দফা চলছে, আমার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু শুরুতেই যা বললাম তারপরে কী? তারপরে কী জিজ্ঞাস করা না কি বুমারদের লক্ষণ! আমরা মিলেনিয়াল বুমার হওয়ার লজ্জা(!) নিব না নিজেদের বুমার মনে করে বসে যাব বুঝতেছি না। এই আন্দোলন শুরুর পর থেকেই শুনছি জেন জি বিরাট কিছু! ভীষণ স্মার্ট! এখন আমাদের কী হবে? আমাদের সরকার একটা স্মার্ট আইডি কার্ড দিছে ওইটাও ফটোকপি করেই কাজ করতে হয়! কী একটা যন্ত্রণা না?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।