এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • সৌদামিনীর ঘরে ফেরা - পর্ব ৪

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৬৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)


  • আজ দুপুরে মৃগাঙ্কর খাওয়াটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। তার পাশে বাবাও খাচ্ছিলেন, আর মা, পিসিমা ছিলেন পরিবেশনে। “আরেকটু নে”, “কিছুই তো খেলি না”, “মেসে না খেয়ে খেয়ে তোর খিদে মরে গেছে”, “কাল রাতে প্রায় কিছুই খাসনি”। এই সব মন্দ-মধুর অনুযোগ শুনলে বেশি না খেয়ে উপায়ও থাকে না। তবে এটাও ঠিক, মেসে রোজকার একঘেয়ে খাওয়ার পর, বাড়ি ফিরে এমন তরিবত করে খাওয়ায় তৃপ্তি হয় খুব। মৃগাঙ্ক ভেবে খুব আশ্চর্য হয়, মেসের ওড়িয়া ঠাকুরের হাতে কী জাদু কাজ করে? প্রত্যেকদিন মাছের ঝোলের এমন নিখুঁত বিস্বাদ স্বাদ কী ভাবে একই রাখতে পারে! কলকাতা শহরে এমন সবজি নেই যা পাওয়া যায় না। কিন্তু মেসের মেনুতে কুমড়ো, লাউ, পেঁপে আর আলু ছাড়া কোন সবজি থাকে না বললেই চলে। শীতে ফুলকপি বা গরমে পটলের তরকারি হলে, ভোজ মনে হয়।

    খাওয়ার পরে মায়ের কাছে একটা পান চেয়েছিল মৃগাঙ্ক। এমন তৃপ্তির খাওয়ার পর ভাজা মৌরি দেওয়া একটা পান বড়ো ভাল লাগে। আবার আয়ুর্বেদ মতে পান হজমিও বটে। মা বললেন, তুই ওপরে যা, আমি পাঠাচ্ছি। নিজের ঘরে এসে, পশ্চিমের জানালা দুটো বন্ধ করে, পুবের আর দক্ষিণের জানালাদুটো খুলে দিল। পশ্চিমের রোদ আসবে না, কিন্তু হাওয়া ঢুকবে অন্য জানালাগুলো দিয়ে। কাচের পাল্লা দেওয়া কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখল কিছুক্ষণ। এই আলমারিটা আশালতার সাজানো। নিচের দুটো তাকে নানা রকমের শোপিস পুতুল। কাচের সায়েবমেম। মাটির পটল, বেগুন, কলা, আম। ওভাল শেপের একটা ফ্রেমে কুরুশের কাজে শুকশারি পাখির ছবি। তার ওপরে লেখা “ভালোবাসা ছাড়া”, নিচেয় লেখা “কেমনে গাহিবি গান”। কাঠের গরুর গাড়ি।

    তার ওপরের দুটি তাকে বই। এই বইগুলির অধিকাংশই তাদের বিয়েতে পাওয়া। কিছু মৃগাঙ্কর বন্ধুবান্ধবের দেওয়া, কিছু আশালতার আত্মীয়স্বজনের দেওয়া। পাতলা একটা বই বের করল মৃগাঙ্ক। বাঁধানো বই, প্রচ্ছদে নববধূর সাজে একটি মেয়ের ছবি। উপরে বইয়ের নাম “যাও সখি, নিজগৃহে”। লেখক শরৎচন্দ্র চ্যাটার্জি। একটু হাসল মৃগাঙ্ক এ শরৎ চ্যাটার্জি জাল, “চরিত্রহীন” শরৎবাবুর সুনাম ভাঙিয়ে বই লিখেছে, যদি কিছু বিক্রি হয়। আজকাল জাল জিনিষে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে। বইটা হাতে নিয়ে মৃগাঙ্ক বিছানায় বসল। বিছানায় বসে ঘরের চার দিকে তাকিয়ে দেখল, এই ঘরের সব কিছুতেই আশালতার হাতের ছোঁয়া। বিয়ের আগেও এই ঘর তারই ছিল। বিয়ের পর চার মাসের মধ্যেই আশালতার স্পর্শ, এই ঘরে এনেছে আমূল পরিবর্তন, এনে দিয়েছে অদ্ভূত শ্রী। কতদিন হয়ে গেল সে কাছে নেই। অভিমানে রুদ্ধ হয়ে এল মৃগাঙ্কর কণ্ঠ, আমাকে কি ভুলেই গেলে আশা?

    হাতে বইটা নিয়ে মৃগাঙ্ক শুয়ে পড়ল বিছানায়। প্রচ্ছদ উল্টেই তার চোখে পড়ল ঝরনা কলমে ঝরঝরে হাতের লেখা, “নিজ গৃহে যা, সই”। তার নীচে লেখা, “তোর শশী”। শশীটা কে? লতার বান্ধবী? এত সুন্দর ঝরঝরে লেখা কি কোন মেয়ের?  কিন্তু বাসর ঘরে লতার যে সব বাচাল ও মুখরা বান্ধবীরা ছিল, তাদের মধ্যে শশী নামের কোন মেয়ের কথা মনে করতে পারল না মৃগাঙ্ক। এ শশী কী শশীমুখী, শশীবালা কিংবা শশীকলা? নাকি শশীভূষণ, শশীশেখর, শশীচরণ? মৃগাঙ্কর মনের মধ্যে জমে ওঠা অভিমান এবার সন্দেহের দিকে বাঁক নিল। এই জন্যেই কি আশার বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে না?

    গভীর ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় তীব্র অধিকারবোধ। মৃগাঙ্ক বহুবার তার কালেজের বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে তীব্র বিতর্ক করেছে, গোলদীঘিতে বসে। এই অধিকারবোধ থেকেই আসে ঝগড়া, ঈর্ষা, ভুল বোঝাবুঝি। রবিবাবুর চোখের বালি, শরৎবাবুর গৃহদাহ থেকে টেনে এনেছে অনেক উদাহরণ। মৃগাঙ্ক বলেছিল, অত্যন্ত ভালোবাসার লোককেও, তার নিজের ভাবনা চিন্তার জন্যে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। বট গাছের একটি চারাকে যদি বেঁধে দাও সংকীর্ণ বেড়ার বাঁধনে, সে না পারবে নিজের মতো বাড়তে, না পারবে বিশাল ছায়া হয়ে সংসারের মাথায় আড়াল হতে। আজ, এই বইটা হাতে নিয়ে সে সব ভাবনা চিন্তা মৃগাঙ্কর মনেও এল না। বরং বিয়ের পর থেকে বাপের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আশালতার সমস্ত কথাবার্তা, মান-অভিমান, আচার-আচরণ তার মনে পড়তে লাগল। আর এই সমস্ত স্মৃতির মধ্যে থেকে, সে জোর করেই মনের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে লাগল দ্বিচারিণী এক নারীর লক্ষণ। হতাশায় আর রাগে তার মাথা গরম হতে থাকল।

    মাথার বালিশের পাশে একটা তালপাতার হাতপাখা ছিল, তার ধারগুলো নীল হলুদ শাড়ির পাড়ের কুঁচি দিয়ে সেলাই করে মোড়া। এটাও আশালতারই কাজ। এ বাড়িতে যতগুলি হাতপাখা আছে সবগুলি খুব যত্ন নিয়ে সে মুড়ে দিয়েছে রঙিন শাড়ির পাড়ে। সকলেই খুশি হয়েছিল, এর দৃষ্টি শোভনতায় আর উপযোগিতায়। সেই হাতপাখাটি নিয়ে বার কয়েক হাওয়া খাওয়ার পর মৃগাঙ্কর চোখে পড়ল ওই শাড়ির পাড়। চোখে পড়া মাত্র তার মনে হল এই হাত পাখার হাওয়ায় যেন তীব্র গ্রীষ্মের দাবদাহ। ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের মেঝেয়।

    “ও কিরে খোকা, ঘুমোলি নাকি? হাত থেকে পাখাটা পড়ে গেল”? কখন কে জানে পিসিমা চুপিসাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার খাটের পাশে। “এই নে, পান আনতে বলেছিলি। নিচের কাজ সেরে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল”।
    মৃগাঙ্ক উঠে বসল খাটে। পিসিমার হাত থেকে পান নিয়ে মুখে দিল। পিসিমা মেঝে থেকে পাখাটা তুলে আবার বিছানায় রাখল, বলল, “খুব গরম পড়েছে এবার না রে? চোখ বন্ধ করে একটু শো, তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। আরাম লাগবে, ঘুম এসে যাবে। সারা হপ্তাটা তোর কী যায়, সে কি আর জানি না? পরের ছেলে পেয়ে অফিসের মিনসেরা নাকে দড়ি দিয়ে কী খাটায়, সে বাপু আমি জানি”। বাধ্য ছেলের মতো মৃগাঙ্ক, চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। পিসিমা বালিশের পাশে বসে, এক হাতে মাথায় হাত বোলাতে লাগল, আর অন্য হাতে নাড়তে লাগল হাতপাখা। একলা ঘরে মৃগাঙ্কর মনের মধ্যে তীব্র আবেগ থেকে যে রাগ আসছিল আশালতার ওপর, সেটা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এল পিসিমার স্নেহ স্পর্শে।

    “পুরুষ মানুষের শরীর, তেতেপুড়ে এসে একটু আরাম চায়, একটু শান্তি চায়। এই কথাই তোকে সকালে বলতে চাইছিলাম, খোকা। বৌদিমণি ভুল বুঝল, বলল আমি নাকি তোর কান-ভাঙানি দিচ্ছিলাম। আচ্ছা আমি কি তোর পর। না হয় তোকে আমি পেটে ধরিনি, তাই বলে কি আমি তোর মায়ের থেকে কম, বল? তা নাহলে আর পিসিমা বলবে কেন, বল? আমি চাইব, তোর সংসারে ভাঙন ধরাতে? বৌদিমণি আমাকে কী চোখে যে দেখে বুঝতে পারি না, বাপু। বৌদিমণির কোল আলো করে তুই যখন এলি, আমার তখন সবে বারো। কি সুন্দর তুই ছিলি, রে! ঠিক যেন পুতুল। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নাড়তিস, গুলু গুলু চোখে তাকিয়ে থাকতিস মুখের দিকে। তোকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে, আমি ঘুরে বেড়াতাম পাড়ায়। কি সুন্দর হাসতিস, হাত বাড়াতিস আমার কোলে আসার জন্যে। তারপর যখন তোর কথা ফুটল, তুই ডাকলি পি-তি-মা”।

    পিসিমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল কান্নায়। মৃগাঙ্ক চোখ মেলে একবার তাকাল পিসিমার মুখের দিকে। বলল, “পিসিমা, কেঁদো না, সংসারে থাকলে ওরম ঠোকাঠুকি একটু আধটু হয়”।

    আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে ধরা গলায় পিসিমা বলল, “তা হয়। সে কি আর জানি না। বড়দা বল, তোর মা বল, আমি - তোর এই পিসিমা বল, সবাই কার মুখ চেয়ে সংসার করি, বাবা? তোর মুখ চেয়ে। কোন ভাবে আমি তোর অকল্যাণ চাইব, এ হতে পারে খোকা? তুই ছাড়া আমার এই সংসারে কিসের টান বল দেখি, বাবা? আমার তো কোথাও কোন বাঁধন নেই। ভাঁটার স্রোতে কচুরিপানা হয়ে কখনো ভেসে যাই সাগরের দিকে, জোয়ারের ধাক্কায় আবার ফিরে আসি সংসারের ঘাটে”।

    পিসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মৃগাঙ্ক চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে পারল তার পাশে বসে থাকা এই নারীর বাস্তব নিঃস্বতা।
    “খোকা ঘুমোলি”?  চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করল পিসিমা।
    “না। শুনছি তোমার কথা”।
    “ভাবছি, কাশী যাবো”।
    “পিসিমা, আমিও যাবো, তোমার সঙ্গে”। মৃগাঙ্ক ছোট্ট ছেলের মতো লাফিয়ে উঠে বলল।
    “কথা শোন পাগল ছেলের, তুই কেন কাশী যাবি, বাবা”?
    “বারে, তুমি যাবে, আর আমি যাবো না? চলোনা, পিসিমা চলো না। অনেক গল্প শুনেছি, পড়েছি। বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট, অহল্যাবাঈ ঘাট। কাশীর গলি। ষাঁড়। খাঁটি দুধ। রাবড়ি, পেঁড়া, পুরি, কচৌরি। দাঁড়াও সন্ধ্যেবেলায় বাবার সঙ্গে কথা বলি। আমি বললে বাবা, না করতে পারবেন না”।
    মৃগাঙ্কর আনন্দ দেখে পিসিমা বিষণ্ণ হাসল, মৃগাঙ্কর চুলের মধ্যে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আমি আর ফিরবো না রে, খোকা। আমি চলেই যাবো তোদের এই সংসার ছেড়ে। আমার পোড়াকপালের দোষে তোদের কোন অকল্যাণ হয়, এ আমি চাই না, বাবা”।
    “ধ্যাত, তুমি এত বাজে বকো না, পিসিমা”। মৃগাঙ্ক পিসিমার কোলে মাথা রাখল, পিসিমা পরম মমতায় মৃগাঙ্কর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “দেখিস। একদিন ঠিক চলে যাবো”।
    “থাক, খুব হয়েছে। মাথায় থাকুন বাবা বিশ্বনাথ। কাজ নেই আমাদের কাশী বেড়ানোয়”।



    দুটো ঘি মাখানো রুটি। করেলার সবজি। একটু খানি আচার। ছোট্ট বাটি উপুড় করা আতপ চালের ভাত। টক দই। বিশেষের খাওয়ার এই বহর দেখে হীরালালজির পত্নী খুব দুখী হয়ে গেলেন।
    “বেটা তু কুছ ভি নেহি খায়া। ইতনাসা খাকে কোই জি শকতা, ভলা? তেরা পসন্দিদা খানা নেহি মিলা, এহি হ্যায় না? হাঁ জি, শুনতে হো, বচ্চে কো ছোড় দো। বাহার সে খানা খাকে ইধার আ জায়েগা”। হীরালালজির পত্নী বিশেষের খাওয়া দেখে বললেন। বিশেষ হাসতে হাসতে বলল, “বহোত খা লিয়া, মাজি। বাস মজা আ গিয়া। আপ সোচিয়ে মত, ম্যাঁয় বিলকুল খুশ হুঁ”।
    “বাঙ্গালিলোগ অ্যায়সাই হোতা হ্যায়, উমা। খাতে হ্যায় কম, দুধ দেতা জ্যাদা” হীরালালজি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন। তারপর বিশেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি রে ঠিক বলেছি, তুই তো আবার বারিন্দির বামুনের ছেলে। শুনেছি বামুনের গরু - খায় কম, দুধ দেয় বেশি”। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন হীরালালজি। তারপর বললেন, “বুরা মত মান না বেটা। তু একদম বাপ পর গয়া। একদম, সহি মে”। বিশেষ হাসল। অবাঙালী বয়স্ক এই মানুষটির আন্তরিকতা তার খুব ভালো লাগল।

    খাওয়ার পর বিশেষ নিজের কামরায় এল। ঘড়িতে দেখল দুটো দশ বাজে। দুপুরে ঘুমোনো তার পোষায় না। ফোনে বাবাকে লিখল, “ঘর দখল। চান খাওয়া সব হয়ে গেল”।
    উত্তর এল, “কেমন মনে হচ্ছে, হীরালালজিকে”?
    “দারুণ। তোমাকে খুব ভালোবাসেন”
    “আই নো। সেই জন্যেই তো পাঠালাম তোকে। ধর্মশালায় থাকতে একটু কষ্ট হবে, তা হোক। ইউ উইল লাভ ইট”।
    “আয়্যাম লাভিং বাবা। দে আর গ্রেট, দিলদরিয়া, হাসিখুশি”।
    “দেখলে বোঝা যায় না, ভীষণ পণ্ডিত মানুষ। সংস্কৃত, হিন্দী, ইংরিজি, বাংলা গুলে খেয়েছেন”।
    “তোমার সম্বন্ধে, আজেবাজে বলছিলেন”।
    “তাই? হা হা হা হা। বলতেই পারেন না। তুই আমার লেগপুল করছিস? নিজের বাবাকে”?
    “ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেণ্ড, বাবা”।
    “আই নো। আয়্যাম প্রাউড অফ ইউ, বিয়িং ইয়োর ফাদার”।
    “তোমাকে উনি খুব রেসপেক্টও করেন”।
    “না রে, স্নেহ করেন। ভালোবাসেন। ভাবি কেমন আছেন”?
    “ভালো”।
    “এখন কী করছিস”?
    “ঘরে রয়েছি। এবার বেরোবো। তোমার অতীতের ভারতকে খুঁজবো”?
    “আমার অতীত না তোর বাবার অতীত”?
    “তাই তো বললাম। হা হা হা হা”।
    “ও তাও তো বটে। আমিই তো তোর বাবা। ঘুরে আয়, সন্ধে বেলা ফিরে এসে তোর ফোন থেকে আমাকে কথা বলাবি”।
    “ওক্কে”।
    “এনজয়, বাই”।
    “বাই”।

    ঘরের দরজা চেপে দিয়ে বিশেষ নিচেয় নামল সিঁড়ি দিয়ে। প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় পা দিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। বারান্দায় জনা পঁচিশেক বুড়ি বসে রয়েছে। অধিকাংশই খুনখুনে, বয়েস সত্তরআশির কম নয়। সকলেই বিধবা, সকলেরই পরনে ভীষণ সস্তার সাদা শাড়ি। নোংরা, মলিন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, বাংলায়। সকালে যখন এসেছিল, সব কটা ঘর বন্ধ আর নির্জন দেখেছিল। এখন বারান্দার দুখানা ঘরের দরজা খোলা। এরা কি তীর্থযাত্রী, দলবেঁধে এসেছে তীর্থ করতে? হয়তো বাঁকুড়া, বর্ধমান কিংবা হয়তো জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে বাস রিজার্ভ করে।

    বিশেষকে দেখে সকলেই কথা বন্ধ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আচমকা ওদের মধ্যে একজন বুড়ি হঠাৎ তার শীর্ণ কংকালসার হাত বের করে বলল, “দশটা টাকা দিবি, বাবা”?

    বিশেষ চমকে উঠল। বাস রিজার্ভ করে সুদূর বাংলা থেকে এরা কি এসেছে ভিক্ষে করতে? ওই বুড়ির বাড়ানো হাত, আর বাকি সকলের চোখের দিকে তাকিয়ে বিশেষ যেন ভয় পেল। প্রত্যেকের চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিছু একটা প্রত্যাশা নিয়ে। যে ভিক্ষে চাইল, সে যেন সকলের প্রতিনিধি। সকলেই যেন ভিক্ষে পেলে বর্তে যাবে। বিশেষ লক্ষ্য করল, প্রত্যেকের শরীর একই ধরনের জীর্ণ। সে জীর্ণতা শুধুমাত্র বয়সের জন্যে নয়। দীর্ঘদিন অসম্ভব দৈন্য আর অসহনীয় ক্ষিদের সঙ্গে যুঝতে থাকার লক্ষণ সবকটি শরীরে। তাদের শুকনো খড়িওঠা মুখ। চোখের চাউনি, ক্লিন্ন চোখের কোল। তাদের হাত-পায়ের আঙুল, আঙুলের দীর্ঘ ময়লা নখ। বিশেষ বিপন্ন বোধ করল। ওদের সামনে তার বহুমূল্য ব্র্যাণ্ডেড জিন্‌স্‌, শার্ট, স্নিকারে মোড়া সুষম পুষ্টির যুবক শরীর একদম খাপছাড়া মনে হল। অসহায় অনুভূতিতে স্থাণু দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ।

    “যাইয়ে জি, যাইয়ে। ঘুমকে আইয়ে। বৃন্দাবন দর্শন করকে আইয়ে। ইয়ে বুড়িয়াঁ অ্যায়সাই হ্যায়, ইনকি কভি ভি দিল নেহি ভরতি। হর টাইম ভিখ মাংতি রহতি হ্যাঁয়। ইনকি বাতোঁ মে মত যাইয়ে”।
    চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে বিশেষ দেখতে পেল, রামু ভাইকে। সম্বিত ফিরে পেল, বিশেষ। মাথা নিচু করে খুব দ্রুত নেমে গেল উঠোনে, হেঁটে গেল সদর দরজার দিকে। যেতে যেতে তার কানে এল, কেউ একজন খনখনে স্বরে বলল, “মরাটা এসে ব্যাগড়া না দিলে, ছোঁড়াটাকে বেশ কাবু করে ফেলেছিলাম”।
    প্রেতের হাসির মতো আওয়াজ তুলে হেসে উঠল বুড়ির দল। আরেকজন কেউ বলল, “মরা না মরা। আগের জম্মে মরা মরা করে, আজ রামু হয়ে উঠেছে, আবাগির বেটা, বেআক্কেলে, মুকপোড়া মিন্‌সে”।

    বিশেষ রাস্তায় পা দিয়ে স্বস্তি পেল। ওই বুড়িগুলোর সামনে সে কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন বাঁধা পড়ে গিয়েছিল শীর্ণ-জীর্ণ অতীতের মাঝখানে। কোনমতে টিকে থাকা ওই প্রাণগুলো যেন বিগত-জীবন। শেষ দুপুরের উজ্জ্বল আলোয় ব্যস্তসমস্ত লোকজন, দোকান পাট, পথে হেঁটে চলা তীর্থযাত্রীর দল তাকে ফিরিয়ে আনল জীবনে। রাস্তার ধারের দোকানের একটি লোককে জিজ্ঞাসা করে সে রওনা হল যমুনার দিকে। বাবার কাছে বিশেষ শুনেছে অতি প্রাচীন এই জনপদ, বিস্মৃতির জঙ্গলে ঢাকা পড়েছিল বহুদিন, প্রায় ষোড়শ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত। ১৫১৫ সালে শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর দৈবী দৃষ্টিতে, এই পতিত জঙ্গলের মধ্যে থেকে খুঁজে আবিষ্কার করেছিলেন পৌরাণিক সমস্ত ক্ষেত্রগুলি, কেশী ঘাট, গোকুল, সেবাকুঞ্জ বা নিকুঞ্জবন, নিধিবন, গিরি গোবর্ধন। বৃন্দাবন ফিরে পেয়েছিল তার হারানো ঐতিহ্য। তারপর থেকে শুরু হয়েছিল বৈষ্ণব ভক্তদের বিপুল আনাগোনা। গড়ে উঠতে শুরু করেছিল অজস্র ছোট-বড়, সাধারণ-অসাধারণ মন্দির।

    কেশীঘাটে যমুনার পাড়ে এসে খুবই হতাশ হল বিশেষ। এই সেই নীল যমুনা! ঠাকুমার মুখে গল্প শোনা পবিত্র স্বচ্ছতোয়া যমুনা। স্কুল জীবনে পড়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং দু চারটে বৈষ্ণব পদাবলীর পদ্যের বর্ণনা থেকে যমুনার যে রূপ তার কল্পনায় ছিল, তার সঙ্গে এই যমুনার কোন মিলই খুঁজে পেল না। প্রায় স্রোতহীন, নোংরা এই যমুনার জলে শ্রীকৃষ্ণ কিংবা শ্রীরাধা নিশ্চয়ই অবগাহন করেননি। সে যমুনা ছিল অন্য কোন যমুনা। শ্রীরাধাকৃষ্ণের যত বড়ো ভক্তই কেউ হোক না কেন, এই যমুনা নিয়ে রোমান্টিক কল্পনার কোন অবকাশ নেই। এই যমুনায় ডুব দিলে মোক্ষলাভ যে হবে না সে কথা নিশ্চিত বলা যায়, কিন্তু ভয়ংকর চর্মরোগ যে হবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। যমুনা দর্শন সেরে এবার বিশেষের লক্ষ্য ইমলিতলা, তারপর নিকুঞ্জবন।



    কপালে নরম হাতের স্পর্শে মৃগাঙ্কর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখল, খুব সুন্দর মুখের একটি মেয়ে নিচু হয়ে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। মুখে তার হাল্কা হাসি, কপালে টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর। নাকে ছোট্ট নোলক, কানে দুল, কণ্ঠে সোনার হার। ঘোমটা নেমে গেছে ঘাড়ের কাছে। দু হাত বাড়িয়ে মৃগাঙ্ক মেয়েটির মুখটা টেনে নিল খুব কাছে, তারপর তার অধরে ডুবিয়ে দিল নিজের ঠোঁট। ...
     
     
    (চলবে...)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৬৬৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন