“তাআআআ বটে। কত দিনের কত কথা জমে ছিল বুকের ভেতর...। তোর মতো কেউ কোনদিন...। সেদিন সকালে দাদা খোকাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। বিকেলে আমার স্বামী গেল বন্ধুদের সঙ্গে তাদের তাসের আড্ডায়। পাছে আড্ডার বন্ধুরা তাকে খোঁটা দেয় – বউ পেয়েই আমাদের সবাইকে ভুলে গেলি, মন্টু? সেখান থেকে বেশ একটু রাত করে ফেরার পথে তাকে সাপে ডাঁশল। জাত সাপ। একবন্ধু দৌড়ে এসে খবর দিতে, বাড়ির লোকরা ধরাধরি করে যখন তাকে নিয়ে এল, তার তখন শেষ অবস্থা। এমন সুস্থ সবল জলজ্যান্ত সুন্দর মানুষটা এত সহজে মরে গেল? আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি আমার ঘরের দরজায় নির্বাক পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। উঠোনে শোয়ানো আমার স্বামীর দেহের উপরে আছড়ে পড়ে কাঁদছে, আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে, আমার শাশুড়ি, ননদ সবাই। হঠাৎ আমার সেজজা, আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, ওই যে, ওই সেই রাক্ষুসি, ডাইনি, পিচেশ, ওই খেয়েছে ছোট ঠাকুরপোকে। অন্য দুই জা এসে আমাকে উঠোনে টেনে নামালো। আমার শরীর থেকে খুলে নিলে সমস্ত গয়না, জল দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে দিলে আমার সিঁথির সিঁদুর, কপালের রাঙা টিপ। ঠুকে ঠুকে ভেঙে দিল হাতের শাঁখা-পলা। সে কি আক্রোশ তাদের। আমি পাথর হয়ে পড়েই রইলাম উঠোনে। আমার অনেক ভাগ্য করে পাওয়া স্বামীকে ওরা শ্মশানে নিয়ে গেল, বলহরি হরিবোল আওয়াজ দিতে দিতে”।
বুড়ি মুখ তুলে একবার দেখল বিশেষের দিকে, ভুরু কুঁচকে কিছু বোঝার চেষ্টা করল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, “তিনদিনের মাথায় সব মিটে গেল। আমার এই সংবাদ পেয়ে আমাকে দেখতে এসেছিল দাদা। দাদাকে দেখে আমি ভেঙে পড়লাম কান্নায়। দাদা কিই বা বলবে, কিই বা সান্ত্বনা দেবে, আমাকে। আমার শাশুড়ি আর বড়ো ভাসুর দাদাকে বলল, আমার আর ওই বাড়িতে একদিনও ঠাঁই হবে না। আমি ডাইনী, আমি পিশাচ। এ বাড়ির যা অমঙ্গল হয়েছে, তারপরে আর কোন অমঙ্গল তারা চায় না। পোড়াকপালি ছোটবোনকে দাদা আবার ফিরিয়ে আনল বাপের বাড়ি।
কিন্তু ছদিন আগে যে মেয়েটা তার বাপের বাড়ি ছেড়েছিল, আজ সেই মেয়েটাও তো আর আগের মেয়ে নয়। সে বাড়িও আর তার আগের বাপের বাড়ি নয়। সে মেয়ে এখন কপালপোড়া হতভাগী বিধবা। বিধবাদের দিয়ে কোন মঙ্গল কাজ হয় না। তার স্পর্শে সর্বদাই অকল্যাণ। আমাকে নিয়ে সংসারে ঠোকাঠুকি, কান্নাকাটি, বকাবকি চলছিলই। কিন্তু বিপদ শুরু হল দাদার ছেলের বিয়ের পর। নতুন বউ এল দাদার ঘরে। বৌদির মনে হল, তার ছেলের নতুন সংসারে পিসিমার অমঙ্গলের আঁচ এসে লাগছে বারবার। আর সহ্য করা গেল না কিছুতেই। গ্রামের কিছু বুড়ি সেবার দলবেঁধে তীর্থে বেরিয়েছিল, তাদের সঙ্গে আমি চলে এলাম কাশীতে। কাশী জায়গাটা দেখার ইচ্ছে আমার যে ছিল না তা নয়। আমার ইচ্ছে ছিল দু চারমাস থেকে আবার বাড়ি ফিরে যাবো।
আমার কোন ইচ্ছেই পূরণ হবার নয়, এটাই বা কেন হবে? কাশীতে একটা আস্তানা ঠিক করে আমাকে রেখে, সেই তীর্থযাত্রীর দল চলে গেল এলাহাবাদের দিকে। বলে গেল, তীর্থযাত্রার শেষে ফেরার পথে তারা আমাকে নিতে আসবে। ছমাস গেল, একবছর ঘুরে গেল, কেউ এল না। যে আস্তানায় থাকতাম, তার বাড়িওলার নামে মাসে মাসে টাকা আসত। কত টাকা জানি না। কোন মাসে সে আমার হাতে তুলে দিত তিরিশ, কোন মাসে চল্লিশ। বাকি টাকাটা সে নাকি বাড়ি ভাড়া হিসেবে কেটে নিত।
বছর দুই কি আড়াই হবে, ঠিক মনে নেই, এভাবে চলার পর আর চলছিল না। দাদাকে চিঠি লিখলাম। আমার এখানে মন টিকছে না, দাদা। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, অভাগী ছোট বোনটাকে ক্ষমা করে দাও। আমি বাড়ি যাবো, টাকা পাঠাও। পাঁচমাসের মধ্যে পরপর চারবার। কোন উত্তর পেলাম না। এদিকে আমার বাড়িওয়ালা বলল, গত তিনমাস নাকি কোন টাকা আসেনি, আমাকে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। বাড়িওয়ালা একদিন সকালে সত্যি সত্যি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলে। রাস্তায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে আমার সামান্য যা কিছু জিনিষপত্র ছিল।
জিনিষপত্র গুছিয়ে, কী করবো, কোথায় যাবো, ভাবছি। গঙ্গার ঘাটে আরো কজন বেধবার সঙ্গে আলাপ হল। তাদের দশাও আমারই মতো। তারা বললে, চল বেন্দাবন যাই। বেন্দাবনে নাকি মন্দিরে কেত্তন গাইলে খেতে দেয় দুবেলা। নামগানে পাপ খণ্ডে যাবে, তার সঙ্গে পেটটাও ভরবে। কাশীতে তাদের আস্তানায় দিন তিনেক থেকে, আমরা রওনা হলাম বেন্দাবন। বাস, সেই থেকেই চলছে এই বেন্দাবন বাস। তা প্রায় পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর তো হলোই, বেশিও হতে পারে। অত আর মনে রাখতে পারি না রে”।
বুড়ি চুপ করে গেল। আগের মতোই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল বিশেষের মুখের দিকে তাকিয়ে। মাথা নিচু করে বিশেষ শুনছিল। এখন মুখ তুলে তাকাল বুড়ির দিকে। ভাবলেশহীন বুড়ির ভাঙাচোরা মুখে কোথাও কোন দুঃখ, বিশেষের নজরে এল না। চোখের কোণায় এতটুকু জলও জমে ওঠেনি। কত বয়েস হবে এখন বুড়ির, আশি, নব্বই? পঞ্চাশ বছর ধরে একটা মড়া জীবনকে যে ঘষটে টেনে নিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। তার অন্তরে অভিমান, দুঃখ, শোকের ছায়া কল্পনা করাও অন্যায়।
বিশেষ আবার বুড়ির কাছে মুখ নিয়ে গেল, জিজ্ঞাসা করল, “বুড়িমা, তোমার সেই গ্রামের নাম কি? কি নাম তোমার সেই দাদার”?
বুড়ি হেসে ফেলল এবার হে হে করে। এমন হাসি বহুকাল হাসেনি। এ ছোঁড়াটা তো বেশ। বুড়ি ভাবল। কাল রাত থেকে ছোঁড়াটা কিসের জন্যে তার পেছনে লেগে আছে, বুড়ি বুঝতে পারছে না। এর আগেও তার জীবনে দু একজন এমন দয়া দাক্ষিণ্য দেখিয়েছে। দু একদিন খাইয়েছে। শীতের চাদর কিনে দিয়েছে। কিন্তু এত কথা কেউ বলেনি। কেউ জিজ্ঞাসা করেনি তার জীবনের কথা। বুড়ি হাসি মুখে বলল, “কী করবি জেনে”?
“কিচ্ছু না, কী আর করবো। তোমাকে কি ফিরিয়ে দিতে পারবো, তোমার সেই গ্রাম, সেই বাড়ি ঘরদোর? তোমার সেই ফেলে আসা জীবন? এমনি”।
“গ্রামের নাম কুসুমপুর, দাদার নাম শশাংক। আমি কপালপোড়া সদু, সৌদামিনী”।
১৩
গত আড়াই বছরে মৃণালিনীর জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তাঁর বয়েস আড়াই নয় বেড়ে গেছে দশ বছর। তাঁর মাথার চুলে পাক ধরেছে। শরীরেও দেখা দিয়েছে ভাঙনের লক্ষণ। তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা স্থায়ি আস্তানা গেড়েছে। মাত্র মধ্য চল্লিশেই তাঁকে এখন দেখলে বুড়ি মনে হয়। বাংলার ঘরে মেয়েরা অবিশ্যি কুড়িতেই বুড়ি হয়, এমন প্রবাদ আছে। কিন্তু এই কবছরে তাঁর এই আকস্মিক পরিবর্তন চোখে না পড়ে উপায় নেই।
(আগামী পর্বে সমাপ্য..)