এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  ইতিহাস

  • বেগম হোসনে আরা মুক্তা ও হাজেরা খাতুন: অসামান্য প্রাণের সাক্ষ্য

    হাসান মোরশেদ
    আলোচনা | ইতিহাস | ১৬ আগস্ট ২০২৩ | ৭৫৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কেরোসিন, দেশলাই ও ১৯৭১ | বেগম হোসনে আরা মুক্তা ও হাজেরা খাতুন
    এই বিবরণটি আসলে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিতব্য 'নারীসাক্ষ্যে জেনোসাইড' বইটির ১৬টি সাক্ষ্যের একটি। সাক্ষ্য নিয়েছেন হাসান মোরশেদ। গুরুর বই প্রকাশের ব্যাপারটা যাঁরা জানেন, তাঁরা দত্তকের বিষয়টাও জানেন। আমাদের বই বেরোয় সমবায় পদ্ধতিতে। নানা মানুষের আর্থিক সাহায্যে। তাকে আমরা বলি দত্তক। উদ্যোগে তাঁদের নাম জড়িয়ে থাকে, বইয়ে ছাপাও হয়। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও, যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান, আংশিক অথবা সম্পূর্ণ খরচ বহন করে পাশে থাকতে চান, তাঁরা একটু মেল করে জানাবেন। guruchandali@gmail.com এ। এ নিয়ে সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা: এখানে



    ২০ মে, ২০১৮
    রোজার তৃতীয় দিন। সিলেট থেকে সকাল আটটায় বের হই আমি ও আশরাফ কবীর। এনা পরিবহনে উঠি। গন্তব্য ভৈরব। রোজার সকালে রাস্তাঘাট ফাঁকা, এনা বিখ্যাত/কুখ্যাত গতির জন্য। আশুগঞ্জের কাছে কয়েক মিনিট যাত্রা বিরতি, ভৈরব পৌঁছে যাই আমরা ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে।
    ঢাকা সিলেট মহাসড়কের উপর ভৈরব খুবই ব্যস্ত জায়গা। সড়ক সোজা চলে গেছে ঢাকার দিকে। ডানে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ। আমাদের গন্তব্য কিশোরগঞ্জ।

    বেশ কয়েকদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে স্থির করতে হয়েছে কাজের পরিকল্পনা। একবার ভেবেছিলাম ভৈরব থেকে শুরু করব। ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নিকলীর কাজ শেষ করে যাব কিশোরগঞ্জ শহরে। শহরের কাজ শেষ করে করিমগঞ্জ, তাড়াইল।
    কিশোরগঞ্জ জেলায় তেরোটি উপজেলা — সদর, করিমগঞ্জ, তাড়াইল, পাকুন্দিয়া, কটিয়াদী, ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, হোসেনপুর, নিকলী, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম।
    প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানে পেয়েছি এই তেরোটি উপজেলার প্রতিটিতেই মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা জেনোসাইড ঘটিয়েছে। তার মানে, প্রতিটি উপজেলাতেই যেতে হবে—এবার আমরা থাকব সর্বোচ্চ সাতদিন। সবগুলো এবার সম্ভব হবে না।

    কিশোরগঞ্জ জেলা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিন নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল।

    জয়দেবপুরে অবস্থিত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপঅধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ বিদ্রোহ করে ২৮ মার্চ জয়দেবপুর থেকে। ময়মনসিংহে সমবেত হয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পরে সবাইকে নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন কিশোরগঞ্জে। পরে মেজর খালেদ মোশারফের আহ্বানে তাঁর ইউনিট নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে তেলিয়াপাড়ায় গিয়ে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সাথে মিলিত হন। এখানেই ৪ এপ্রিল তারিখে কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানীর উপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক অফিসারদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

    জুলাই মাসে আরেকটি সম্মেলনে সারা দেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হলে এই অঞ্চল ৩ নং সেক্টরের অধিভুক্ত হয় এবং অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মেজর সফিউল্লাহ। সেক্টর হেডকোয়ার্টার প্রথমে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মনতলায় এবং পরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হোজামারা জেলার সিমনায়।
    অক্টোবরে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ‘এস’ ফোর্স গঠিত হলে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর এএনএম নূরুজ্জামান।
    সমগ্র কিশোরগঞ্জ জেলা ছাড়াও হবিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর,আখাউড়া সহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অর্ধেক এবং নারায়নগঞ্জের আড়াই হাজার ও রূপগঞ্জ অঞ্চল সহ মোট ৯,৮০০ বর্গ কিমি এলাকা নিয়ে ছিল ৩ নং সেক্টরের অপারেশন এরিয়া।
    এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ৩০ হাজারের বেশি। এদের মধ্যে ৬৬৯৩ জন ছিলেন নিয়মিত বাহিনীর যোদ্ধা, বাকি প্রায় ২৫ হাজার ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা — ছাত্র, কৃষক, সাধারণ মানুষ।

    ভৈরব থেকে কিশোরগঞ্জ বাসে যাওয়া যায়, সিএনজি চালিত অটোও আছে। আমরা অটোতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। রাস্তার অবস্থা ভালো না। ৫১ কিমি রাস্তা, যেতে সময় লেগে যায় দুই ঘণ্টা।
    কিশোরগঞ্জ শহরে এসে পৌঁছাই, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। রোজার তৃতীয় দিবসের আলসেমি শহর জুড়ে। কিশোরগঞ্জ এই প্রথম আসা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটি মূলত নরসুন্দা নদী তীরে গড়ে ওঠা একটি সমৃদ্ধ গঞ্জ, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থান। আবাসিক শহর পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন চলছে পুরোদমে, এখন ব্যস্ত শহর কিশোরগঞ্জ।
    সরু রাস্তাগুলো দখল করে ছুটছে ইলেক্ট্রিক বাইক।

    আগে থেকে বুক করা ছিল হোটেল পার্ক, রথখোলা এলাকায়। একটি মার্কেটের তৃতীয় তলায়, কয়েকটা রুম নিয়ে। পরিচিত একজনের বড় ভাইয়ের হোটেল, আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আর ভালো রুমটা রাখা হয়েছে। চওড়া বারান্দা আছে, তার ওপাশেই নরসুন্দা নদী। নদীর পাড়ে কৃত্রিম পার্ক তৈরি হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নরসুন্দা নদী। নরসুন্দার দুই পাড়েই শহর বিস্তৃত হচ্ছে। এপাড় ওপাড় যাতায়াত সহজ করতে শহরের ভেতরেই নদীর উপর নয়টি ব্রিজ করা হয়েছে। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি নদীর দুই পাড় ধরে পাকা করে হাঁটার রাস্তাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু নদী শুকিয়ে গেছে, নদী ভর্তি কচুরিপানা। যে নরসুন্দাকে ঘিরে একসময় গঞ্জ গড়ে উঠেছিল সেই প্রবাহমান নদী মৃতপ্রায়। পরে জেনেছি নদীর দুইপাড় আরো বাজেভাবে দখল হয়ে গিয়েছিল, দুই পাড় ধরে নদী ভরাট করে দোকান পাট তোলা হচ্ছিল। সৈয়দ আশরাফ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর, তার নির্দেশে দখল উচ্ছেদ করে ব্রিজ এবং ওয়াকওয়ে করা হয়েছে। তবু নদী সংস্কার করে নরসুন্দার প্রবাহমান জলধারা ফিরিয়ে আনা জরুরি।

    কিশোরগঞ্জ আসার আগে বন্ধুদের মাধ্যমে বেশ কিছু যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। মূলত এই যোগাযোগগুলোর ভিত্তিতেই কাজ শুরু করতে হবে।

    প্রথম কাজ বেগম হোসনে আরা মুক্তার সাথে।
    তাঁর ছেলে অনুপম মাহমুদ, ঢাকায় থাকেন। অনুপম তাঁর মায়ের ফোন নম্বর দিয়েছেন।

    খুব দূরে না। রথখোলা থেকে সোজা পশ্চিমে, আখড়া বাজার। আখড়াবাজার মসজিদের পরেই একতলা পুরোনো দালান। আছরের আজানের পরপরই আমরা যাই।
    কফি কালার গেটে রঙ লাগানো হচ্ছে। আমরা গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকি। দু-বার কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খোলা হয়। আকাশি রঙের তাঁতের শাড়ি—বেগম হোসনে আরা মুক্তা। বয়স নিশ্চয় ষাট পেরিয়েছে — চেহারা, গায়ের রং, ব্যক্তিত্বে তাঁকে অনবদ্য লাগে।

    প্রথমে ড্রয়িং রুমে বসি আমরা। দেওয়ালে ঝোলানো একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের ছবি। স্টাইলিস্ট, কেতাদুরস্ত। বুঝে নিই ইদ্রিস আলী সাহেবের ছবি—অনুপমের বাবা, বেগম হোসনে আরার স্বামী। আমরা এর আগে জেনেছি মুক্তিযুদ্ধকালে ইদ্রিস আলী ছিলেন কিশোরগঞ্জের নিকলী অঞ্চলের তরুণ ছাত্রনেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। যুদ্ধ শুরু হলে ছয় মাসের সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে প্রশিক্ষণে চলে যান। বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর হয়ে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ শেষে এই অঞ্চলে ফিরে এসে যুদ্ধ করেন। পরে তিনি নিকলী উপজেলা চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে মারা যান মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী।

    কিছু পরে আমরা ভেতরের ঘরে গিয়ে বসি। হোসনে আরা মুক্তা তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বলা শুরু করেন। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল ইদ্রিস আলীর সাথে। একাত্তরের মার্চে তাঁর কোলে প্রথম সন্তান—ছয় মাসের, নিজের বয়স ও পনেরো-ষোলোর বেশি নয়। ছাত্রলিগ নেতা হিসাবে ইদ্রিস আলী খুব সক্রিয় ছিলেন স্বাধীকার আন্দোলনে।
    যুদ্ধ শুরু হলে—অবধারিতভাবেই তিনি সীমান্ত পাড়ি দেন প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ইদ্রিস আলী। মা, বাবা, ছয় মাসের সন্তান এবং সদ্য তরুণী স্ত্রী রয়ে যান যুদ্ধ সঙ্কুল নিকলীতেই।

    প্রশিক্ষণ শিবির থেকে সহযোদ্ধাদের মাধ্যমে চিঠি পাঠাতেন ইদ্রিস আলী। চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী হোসনে আরা মুক্তা এখান থেকে টাকা পয়সা, ঔষধ, কাপড় পাঠাতেন। অনেক তরুণ আবার তাঁর প্রণোদনায় যুদ্ধে যোগ দিতেও গিয়েছেন। ইদ্রিস আলী একবার চিঠি পাঠিয়েছেন, তাঁকেও চলে যেতে। কিন্তু ছয় মাসের শিশু সন্তান আর বৃদ্ধ শ্বশুড় শাশুড়িকে রেখে তিনি আর যেতে পারেননি।




    বেগম হোসনে আরা মুক্তা স্মৃতিচারণ করেন— যুদ্ধ যত বেগবান হয় তাঁদের জীবনযাপন তত অসহনীয় হয়ে ওঠে। নিকলীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে, রাজাকারদের দৌরাত্ম্যও বাড়তে থাকে। ইদ্রিস আলীরই একজন বন্ধু দালাল হয়ে যায়, তাঁকে ধরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। টানা ত্রিশ দিন তিনি লুকিয়ে থাকেন, রাজাকাররা তাঁর বাড়ি খুঁজে তল্লাশি করলে গোয়াল ঘরে গরুর সাথেও রাত কাটাতে হয়।
    যেদিন তাঁর শ্বশুড় বাড়ি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দেয়, এর আগের নৌকায় করে লুকিয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল বাবার বাড়িতে। সেদিনের বর্ণনা দেন হোসেন আরা মুক্তা, সেই সাথে দামপাড়ার নৃশংস গণহত্যার সাক্ষ্যও।

    “যেদিন আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিল, তখন চারদিকে কানাকানি, গুনগুন হচ্ছে। তখন আমি বুঝতে পারছি, কী একটি ঘটনা ঘটছে কিন্তু আমাকে কেউ আর প্রকাশ করে না। তখন আমি খুব অস্থির হয়ে গেছি জানার জন্য- ‘তোমরা বলো না কেন? কী হয়েছে?’ কেউ বলতে চায় না। আমি মামার বাড়ির দালানে ছিলাম। কাউকে না বলে লুকিয়ে আমি ছাদের উপর গিয়েছি। যেয়ে দেখি ছাদ থেকে—নৌকা দিয়ে মিলিটারিরা আমার বিছানা, আমার বালিশ, আমার তোষক, আমার কোল বালিশ, আমার বেড কাভার— আমি এগুলো দেখে চিনে ফেলেছি। ওরা নৌকায় আরাম করে শুয়ে। আমি তখন চিৎকার করছি। আমার বান্ধবীরা— খালাতো, মামাতো বোনরা ছিল। ওরা দৌড়ে গিয়েছে আমাকে থামানোর জন্য। তখন তো জেনেই ফেলেছি যে আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিয়েছে।
    সময়টা খুব কষ্টের। খুব কষ্টে আমার সময় গিয়েছে। আমার তো এমনও হয়েছে—কখন অ্যাটাক করে, কখন কোনদিক থেকে ধরে নিয়ে যায়। তবে আমাদের গ্রামের মানুষ, দেশের মানুষ আমাকে সবসময় পাহারা দিয়ে রাখত।

    অনেক মানুষ মেরেছে ওরা, অনেক। আমাদের দামপাড়াও মেরেছে। আমাদের দামপাড়ায় একটি হিন্দু পাড়া—পুরোটা। পুরো পাড়াটা। কোনো পুরুষ মানুষ রাখে নাই—সবাইকে মেরে ফেলেছে এক রাত্রে। সেই বিভীষিকাও আমি দেখেছি।
    আমি তখন নিকলীতে।
    কাক কা কা করছে। মানুষের একটি কানাঘুষা, কানাকানি... আর কাক ঘুরছে অবিরাম। তারপর আমি দালানের উপর গিয়ে দেখছি—মানুষ! কত কষ্টের জীবন মানুষের। মানুষের পা হাত ঝুলে রয়েছে। নিজের চোখে দেখা এগুলো রক্ত পড়ছে, সাদা কাপড়।
    ওরা ভয়ে সাদা কাপড়, সাদা টুপি মাথায় হিন্দুরা। ধুতি ছেড়ে ওরা লুঙ্গি, পায়জামা পাঞ্জাবি তারপর টুপি তসবিহ হাতে। তারপরও ওরা বাঁচতে পারে নাই। ওদেরকে মেরে ফেলছে। মেরেছে আগের রাত্রে। মারার পরে বিকেল বেলা, হাজার হাজার কাক উড়ছে আর চিৎকার করছে কা কা কা ... আর সাদা কাপড়গুলো। লাশ দেখা যাচ্ছে, একজনের উপর আরেকজন পড়া। আমি যেখানে ছিলাম কাছেই, নদীর এপাড় আর ওপাড়। খুব দূরে না কাছাকাছি। ঐ যে ঝুলে রয়েছে, দেখেছি।
    ওরা কিন্তু আমার পাড়ার প্রতিবেশী। আমি সবাইকে চিনি। কত ভালো মানুষ ছিল। অনেক মানুষ তখনো জীবিত—নড়তেছে, নড়তেছে তখনো। আমার চোখের সামনে দেখলাম নদী দিয়ে নিচ্ছে—নড়তেছে।

    উপরে চট দিয়ে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে, তখনো নড়ছে—নিজের চোখে দেখা। রক্তে নৌকা ভরে গেছে। টিন দিয়ে নৌকা থেকে রক্ত ফেলছে। তখন খেতে পারি নাই, ঘুমাতে পারি নাই। এই মানুষগুলো আমাদের কাছের পাড়ার। মিস্ত্রী ওরা, ওরা আমাদের বাড়িতে কাজ করত। আমার দাদার, আমার আব্বার অনেক নৌকা ছিল। ওরা বারো মাস কাজ করত। আমার চেনা, কাকা ডাকতাম ওদের। দাদা ডাকতাম।

    নারী নির্যাতন হয়েছে। তখন যে নারীদের উপর নির্যাতন হয়েছে মুখ খুলে নাই। এই যে সামাজিকভাবে আমাদের একটি লজ্জা, কেউ মুখ খুলে নাই। নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু নির্যাতিত তো হয়েছে রাজাকারদের হাতে, রাজাকাররাই সাহায্য করছে। পাঞ্জাবিরা তো আর জানে না।
    এইগুলো ভুলা যায় না। ভুলে যাওয়ার কথা না তো। এই স্মৃতি কি ভুলা যায় কখনো? কখনো ভুলা যায় না।”

    নিজের সংকটকালের চেয়েও দামপাড়া গণহত্যায় নিহত মানুষগুলোর জন্য তাঁর যে শোক ও বেদনাগাঁথা সেটা আমাদেরকে স্পর্শ করে ভীষণভাবে। সেই বেদনা যেন এত বছর পর তেমনই গভীর, আন্তরিক। এতগুলো মানুষ, নিরীহ মানুষ, সাধারণ...

    কিছুটা সময় আমরা চুপ করে থাকি। পুরোনো দেওয়াল বেয়ে যেন শূন্যতা নেমে আসে।
    পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকেন প্রায় শতবর্ষী একজন। হোসনে আরা তাঁকে ধরে নিয়ে এসে বসান। তাঁর মুখের দিকে তাকাই। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, শতরেখা তবু যেন উজ্জ্বল এক দ্যুতি ছড়িয়ে আছে। তিনি হাজেরা খাতুন—ইদ্রিস আলী সাহেবের মা, হোসনে আরা মুক্তার শাশুড়ি।
    হাজেরা খাতুনের হাত স্পর্শ করি। শতবর্ষী মানুষটির সব মনে আছে? দুঃখ ও দুঃসময়ের স্মৃতি মনে করাও কষ্টের, এই কষ্ট তাঁকে দেওয়া কি ন্যায্য?
    আস্তে করে বলি— “দাদী আম্মা, যুদ্ধের কথা কি মনে আছে?”
    আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সেই শতবর্ষী নারী বলে ওঠেন, “সবকিছু মনে আছে আমার।”
    আশ্বস্ত হই। ক্যামেরা অন হয়। হাজেরা খাতুনের সাক্ষ্য রেকর্ড হতে থাকে—

    “আমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ইন্ডিয়া গিয়েছিল, ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং দিয়ে এসেছিল। নয় মাস। আর আমার বাড়ি পুড়ছে। ৪ টা ঘর ছিল। ৩০ মণ পাট ছিল, সেই সময় শিলায় জমি নষ্ট করে দিয়েছিল তাই ধান কম ছিল। ঘরের জিনিসপত্র — খাট পালং সোফা টোফা যা ছিল সব পুড়িয়ে ফেলছে। আর কিছু ছিল, ওগুলো যেদিন বাড়ি পুড়ায় সেদিন নিয়ে গেছে।
    পিতলের কলস, পিতলের কুপি—পিতলের কলসে কাঁঠালের বিচি ভরা ছিল। এই কলসটা নিয়ে গেছে। আমার চারটা স্বর্ণের চুড়ি নিয়ে গেছে, আমার ছিল বারোটা স্বর্ণের চুড়ি—অনেক অলংকার। লুকিয়ে রেখেছিলাম—সব নিয়ে গেছে।
    আমি ঐদিন আমার বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। আমার স্বামী ছিল বাড়িতে, কাজের মেয়ে ছিল বাড়িতে।
    আমার স্বামী জোহরের নামাজ পড়ে কাজের মেয়েকে বলেছে—আমাকে ভাত দাও। জায়নামাজে বসেই বলেছে। যখন ভাত নিয়ে এসেছে—খায়নি তখনো, এর মধ্যেই মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে ‘মিলিটারি আসছে নৌকা নিয়ে’। ভাত সরিয়ে রেখে ডিঙি নৌকা নিয়ে পাট খেতের ভেতর গিয়ে লুকিয়েছে।
    আর এদিকে চারটা ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।
    আশেপাশের মানুষ বলছে আমার স্বামীকে পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ উড়াতে। উনি বলছে—আমি মরবো তবু পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ উড়াবো না। আমার ছেলে যুদ্ধে গেছে আর আমি বাঁচার জন্য পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ উড়াবো?
    আমি যখন কাঁদছি বাড়ি পুড়িয়ে ফেলার পর তখন আমাকে বলে— কান্দো কেন? আমার মাঠের জমি কি পুড়িয়ে ফেলেছে? আমার বাড়িই না হয় পুড়েছে। আমার ইদ্রিছ যদি বেঁচে থাকে আমি মাঠে ঘর বানিয়ে থাকব।
    উনি একবার ইন্ডিয়া চলে গেছে ছেলেকে দেখার জন্য। ছেলে ঘি পছন্দ করত। এক কেজি ঘি নিয়ে অনেক কষ্ট করে গেছে।”

    কাজ শেষে আমরা সব গুছিয়ে উঠি। দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন দুই নারী। একজন মধ্যবয়স পেরিয়েছেন, আরেকজন ছুঁয়ে যাচ্ছেন শতবর্ষ।
    দুই নারীই স্মৃতি আঁকড়ে আছেন—তাঁদের স্বামী ও পুত্রের। দুই নারীই স্মৃতির আকর—একটি সময়ের, মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এক জেনোসাইডের।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    কেরোসিন, দেশলাই ও ১৯৭১ | বেগম হোসনে আরা মুক্তা ও হাজেরা খাতুন
  • আলোচনা | ১৬ আগস্ট ২০২৩ | ৭৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৬ আগস্ট ২০২৩ ২০:৪৬522541
  •  যতবার পড়ি দম বন্ধ হয়ে আসে... 
  • মতামত | 2405:8100:8000:5ca1::7e:***:*** | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৫৫522557
  • বইটা কবে থেকে পাওয়া যাবে দাদা? কলেজ  স্ট্রীটে পাব?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন