একটা গল্প বলি।
একটা ছেলে, বছর বারো বয়স। শান্ত প্রকৃতির। অনুভূতিপ্রবণ। ছবি আঁকতে ভালোবাসে। খেলাধুলোয় খুব চৌকস নয়। কিন্তু খেলা দেখতে বা খেলতে বেশ ভালোবাসে। গল্পের বই পড়ার খুব নেশা। এমনিতে অন্তর্মুখী, কিন্তু ঠিকঠাক সঙ্গী পেলে প্রাণ খুলে আড্ডা মারতে ভালোবাসে। বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসে। পড়াশোনায় মন্দ নয়। সোজা কথায় দিব্যি ছেলে।
ছেলেটার সবই ভালো, কিন্তু হাঁটাচলায় একটু নমনীয় ভাব। ওই মাচো ব্যাপারটা নেই। এবার একদিন হঠাৎ করে দেখল তার বন্ধুরা তাকে লেডিস বলে ডাকতে শুরু করেছে। ছেলেটা বুঝতে পারছে না, হঠাৎ কি হয়ে গেলো যে ওকে মেয়েলি বলে মনে করা হচ্ছে। ওর মধ্যে সেরকম কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। বয়ঃসন্ধির নিয়ম অনুসারে ওর শরীর মনে যত রকম পরিবর্তন আসার কথা, সেগুলো সবকটাই স্বাভাবিক ছন্দে ওর সাথে হয়ে চলেছে। কোথাও ওর নিজেকে অন্য রকম বলে মনে হয় নি। এদিকে লেডিস কথাটার সাথে যে একটা ব্যঙ্গাত্মক দ্যোতনা জড়িয়ে আছে সেটা ওকে ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছে।
দু’দিন পরে সেই ব্যঙ্গ বিদ্রূপ একটু চড়া দাগ নিলো। হাঁটতে চলতে হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ টিটকিরি কাটছে। উৎকট আওয়াজ বের করছে গলা দিয়ে। ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কিছু বলছে না। ওর সাথে বিদ্রূপ না করলেও, এই টিটকিরির প্রতিবাদও করছে না। ওর ভীষণ একা লাগে।
কিছুদিন পরে ও দেখল ওর ক্লাসের বন্ধুরা এবার নতুন নাম জোগাড় করেছে। বিজ্ঞানে ওরা পড়েছে কেঁচো হল উভলিঙ্গ প্রাণী। ওকে এবার পেছন থেকে সেই বন্ধুরা এই নামেই ডাকা শুরু করেছে। প্রতিদিন যেন আরো বিষাক্ত হয়ে উঠছে ওর কাছে। ক্লাস এইট থেকে নাইন হয়ে টেনে উঠে পড়েছে ছেলেটা। কিন্তু এই বিদ্রূপ বন্ধ হয় নি। নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছে নিজের ভালো লাগার বিষয়গুলোতে। কাছের কিছু বন্ধুর সাথে অন্যান্য বিষয় আলোচনা করে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রাখছে। কিন্তু মনের কোনায় কোথায় যেন একটা গুমোট ভাব। সারাক্ষণ। কানের মধ্যে সেই কেঁচো কেঁচো ডাকটা ঘুরে বেড়ায়।
ছেলেটা জানে ওকে জীবনে অনেক কিছু করতে হবে। লম্বা দৌড়। ও দৌড়ে নেবে। কিন্তু এই অপমান ও আর নিতে পারছে না। মাঝে মাঝে ক্লাসে/বাসে/রাস্তায় ও ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে। অবচেতন হয়তো ভাবছে এইভাবেই ও নিজের স্টিগমা কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু কষ্টটা আরো চেপে বসছে গলার ওপর।
মাধ্যমিক এগিয়ে আসছে। স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার পরে শেষ কটা সপ্তাহ। সবাই খুব উৎসাহিত, দুঃখিতও বটে। আর যে বন্ধুদের সাথে মজা করা হবে না। এদিকে ছেলেটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আর ওই ক্লাসরুমে যেতে হবে না। আর শুনতে হবে না ওই অসহ্য ডাক। স্কুলের শেষদিনে সবাই ঠিক করেছে ফটো তোলা হবে। শেষ স্মৃতি। সবাই মিলে একসাথে। সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। জীবনে এই দিন একবারই আসে। মধ্যবয়সে স্মৃতিচারণ করতে হবে না?
ছেলেটা আগের দিন রাতে ঠিক করলো স্কুলে যাবে না। যে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, যে স্কুলে ওর জীবনের প্রথম সবকিছু, বন্ধুতা, উদযাপন, সেই স্কুলের শেষদিনে ও ঠিক করলো ও আর বন্ধুদের সাথে দেখা করবে না। যারা খারাপ তাদের সাথে না, যারা ভালো তাদের সাথেও না। ছেলেটা বাড়িতে বসে উত্তর লেখা অভ্যেস করলো। বন্ধুরা ছবি তুলল, অনেক মজা, স্মৃতি, উচ্ছ্বাস।
মাধ্যমিক হয়ে গেলো, বন্ধুরা ছড়িয়ে গেলো বিভিন্ন স্কুলে। ছেলেটা আর চেয়েও সেই দিনটা ফেরত পেলো না। মুহূর্তের কাছে ঋণী হয়ে রইলো ওর চেপে রাখা কষ্টগুলো।
অনেক অনেক বছর পরে যখন সোশ্যাল মিডিয়া এসে গেলো, বন্ধুরা আবার জুড়তে শুরু করলো। পুরোনো অ্যালবাম ঘেঁটে সবাই সেই স্কুলের শেষ দিনের স্মৃতিচারণ করে। ছেলেটার জীবনে সেই স্মৃতির কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণটা ও জানে। ক'জন সেটা জানে বা মনে রেখেছে সেটা ওর জানা নেই।
এখন ওকে লেডিস, কেঁচো ইত্যাদি বলে কেউ আর bully করে না। ছেলেবেলার ওই ট্রমার কথাও ওর অত মনে পড়ে না আর। কিন্তু এই স্মৃতি না থাকার ক্ষত ওর সারা জীবনের জন্য বন্ধু হয়ে থেকে গেলো। হয়তো থেকে যাবে শেষ দিন অবধি। কেন ওরা এরকম করতো বা করেছিল সেটা ও আজও বুঝতে পারলো না। ও কিন্তু কোনোদিনও ওদের সাথে দুর্ব্যবহার করেনি। খুব বন্ধুত্ব হয়তো ছিল না। কিন্তু শত্রুতাও তো ছিল না। তবু কেন করতো ওরা এরকম? উত্তর চাইলেও আজ আর পাবে না ও। সেই বন্ধুরা তো মনেই করতে পারবে না। হয়তো অস্বীকার করবে।
ছেলেটা কোনোদিনও কাউকে বলেনি এসব। মা, বাবা, প্রিয় বন্ধু, প্রেমিকা কাউকে নয়। এখন সবই ধোঁয়াশার মত লাগে। হয়তো দুঃস্বপ্ন। ভ্রম। হবেই বা। হলেই বা কী! এখন সবাই তো নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে। কি আর হবে এসব ভেবে।
একদিন সেই বন্ধুদের মধ্যে একজন যোগাযোগ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দিব্যি আলাপচারিতা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেসোনেটও করে দু’জন। ছেলেটার মনে পড়ে পুরোনো কথা। আবার। মুচকি হেসে এগিয়ে যায় ও। স্মৃতি সততই সুখের নয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে অতীত আর বর্তমান মেশে। স্মৃতির ভারে উপচে পড়ে চোখের কোণ।