আজ হয়তো এ-কথার গুরুত্ব কেউ টের পাবেন না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, এমন একদিন আসবেই, যেদিন গর্ব করে বলব— ‘আমরা সন্দীপ দত্তকে চিনতাম।’ তরুণ প্রজন্ম বিস্মিত হয়ে আমাদের মুখ থেকে শুনবে তাঁর কথা। শুনবে তো? লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র ও অস্তিত্ব নিয়ে বর্তমানে যেখানে প্রশ্নচিহ্ন ওঠে বারবার, সেখানে সন্দীপ-উত্তর যুগে কী হবে তার চেহারা?
ভবিষ্যৎ হয়তো বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের জমানাকে তিনভাগে ভাগ করবে— সন্দীপ-পূর্ব, সন্দীপ ও সন্দীপ-উত্তর যুগ। একজন ব্যক্তি কীভাবে লিটল ম্যাগাজিনের সময়কালকে সূচিত করতে পারেন? এর ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে সন্দীপ দত্তের জীবনেই। সত্তরের দশক থেকে আজ, এই ২০২৩-এর ১৫ মার্চ পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে সমার্থক ছিল তাঁর নাম। সম্পাদক হিসেবে নয়, সংগ্রাহক হিসেবে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে সংগ্রহ করেছেন একের পর এক ছোটো পত্রিকা, ভরিয়ে তুলেছেন লাইব্রেরি। ১৯৭৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র’ আজ মহীরুহ। লাখ ছুঁই-ছুঁই পত্রিকার সমাবেশ সেখানে। এসবের নেপথ্যে একজনই— দ্য গ্রেট সন্দীপ দত্ত।
বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে যদি একটি প্রতীক দিয়ে চিহ্নিত করতে হয়, সেই প্রতীক সন্দীপদা। জীবন্ত কিংবদন্তি— মৃত্যুর পরেও ‘জীবন্ত’ শব্দটায় জোর না-দিয়ে উপায় নেই, কেন-না তাঁর বিপুল সংগ্রহের আয়ু ফুরোবে না কোনোদিন। যতদিন এই বাংলায় ‘লিটল ম্যাগাজিন’ শব্দদ্বয় উচ্চারিত হবে, নেপথ্যে ওই মানুষটির মুখ ভেসে উঠবে বারবার। বাংলা ছোটো পত্রিকা— নামিদামি বইপত্র থেকে দূরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গ্রহের খনিজ নিয়েও যে আর্কাইভ গড়ে তোলা যায়, পাঁচটি দশক আগে টের পেয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত। এ আসলে একক মানুষের লড়াইকাহিনি। তিলে-তিলে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছেন একের পর এক দুষ্প্রাপ্য ও সমসাময়িক পত্রিকা। ছোট্ট লাইব্রেরিটি ভরে উঠেছে দিনে-দিনে। যে-সমস্ত লিটল ম্যাগাজিন স্বল্পায়ু ও অখ্যাত, সেগুলিকেও অমরত্ব দিয়েছেন সন্দীপদা। আজও তাঁর লাইব্রেরি ঘাঁটলে কোনো-না-কোনো কোণে পাওয়া যাবে অজানা অজস্র পত্রিকার হদিশ। প্রশ্ন হল, চিনিয়ে দেবেন কে? কে বলবেন সেসব পত্রিকার ইতিহাস?
আমাদের মতো যাঁদের বাৎসরিক ওঠা-বসা-খাওয়া-আড্ডা ওরফে দিন কাটানোর ঠিকানা নন্দন ও বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন চত্ত্বর, সন্দীপদা তাঁদের আত্মার আত্মীয়। কখনো অভিভাবকের মতো পরামর্শ দিয়েছেন, কখনো বন্ধুর মতো মিশেছেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, ব্যাকব্রাশ চুল, পরনে প্যান্ট আর টি-শার্ট, কাঁধে ঝোলাব্যাগ— সন্দীপদাকে একা-একা হেঁটে বেড়াতে দেখেছি বিভিন্ন পত্রিকার টেবিলে। থামছেন, পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখছেন, সম্পাদকের থেকে সংগ্রহ করছেন নয়তো কিনে নিচ্ছেন নিজেই। বেশিরভাগ সময়েই সন্দীপদার সঙ্গী থাকত না কেউ। একমেবাদ্বিতীয়ম তিনি— প্রৌঢ় বয়সেও অদম্য শক্তি। দেখেছি— শিখেছি কি কিছু? লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও শ্রমের উত্তরাধিকার কি আমরা বহন করতে পারব কেউই?
সময় বদলে গেছে। সন্দীপ দত্তের মতো লিটল ম্যাগাজিনের জন্য জীবনপাত করার লোক চারপাশে আর দেখি কই! টেমার লেনের লাইব্রেরিটির ভবিষ্যৎও অজানা। বিপুল ও দুর্লভ সব পত্রিকার দেখভাল করবেন কে এবার? সন্দীপ দত্ত চলে গেলেন। আমাদের কাছে রেখে গেলেন স্মৃতি ও প্রশ্ন। বেশ-কিছু দায়ও, যা হয়তো পালন করতে পারব না কোনোদিনই। শুধু গর্বের সুযোগ ফিরে-ফিরে আসবে— ‘আমরা সন্দীপ দত্তকে চিনতাম।’ এ-ও কি কম প্রাপ্তি?