সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার সমন্বয় সমিতি থেকে আমার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে টেলিফোনে প্রশ্ন আসতে শুরু করল, “কী হয়েছে? মোর্চায় বিভেদ তৈরি হল নাকি?”
আমি উত্তর দিলাম, “একদমই না। আমি স্বেচ্ছায় সমন্বয় সমিতি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলাম। সেই ইচ্ছার কথা ৪ সেপ্টেম্বরের সভায় উপস্থাপন করা হয়। আমার পরিবর্তে জয় কিষাণ আন্দোলনের সভাপতি অভীক সাহা মোর্চার সমন্বয় সমিতির কাজে যুক্ত থাকবেন। তাছাড়াও আমাদের জয় কিষাণ আন্দোলনও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার সঙ্গে জুড়ে আছে। একজন সহযোদ্ধা হিসেবে আমি মোর্চার যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বদা প্রস্তুত থাকব।
ফোনে আরেক ধরনের প্রশ্ন ছিল, “মোর্চার সঙ্গে যদি কোনো না কোনোভাবে যুক্তই থাকেন, তাহলে সমন্বয় সমিতি ছাড়তে গেলেন কেন? শুনছি আপনিও আসলে কোনো একটা রাজনৈতিক দলের হয়েই কাজ করতে চান?” কেউ কেউ আবার গণমাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে যে আমি নাকি কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছি!
আমার এইসব বন্ধুদের প্রতি সোজাসাপ্টা উত্তর, “আমি আজ নতুন নয়, অন্তত বিগত ১০ বছর ধরে রাজনীতি করছি। আমি সব সময় বলে এসেছি, শুভ যা কিছু, তাকে সত্যে পরিণত করার নামই রাজনীতি। তাই রাজনীতি হচ্ছে আমাদের এই যুগের ধর্ম। দেশকে প্রগতির পথে অগ্রসর করাতে হলে, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই রাজনীতি করতে হবে। আমি স্বরাজ ইন্ডিয়া নামক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার মতো সৌভাগ্যবান। এখনও পর্যন্ত এই দলে, যেটা কিনা আমার রাজনৈতিক গৃহও বটে, সেখানেই আছি। কংগ্রেস আয়োজিত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-কে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত আমার ব্যক্তিগত নয়। এটা আমার দলের সকল সহযোদ্ধাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত।
আমার পদত্যাগ সংক্রান্ত এই বক্তব্য এখানে উত্থাপন করার উদ্দেশ্য এই নয়, যে আমি আমার এই সিদ্ধান্তের ওপর আলোকপাত করতে চাইছি। আসলে এই ছোট্ট উদাহরণটি আমাদের জনজীবনে একটি বড় অসঙ্গতি নির্দেশ করে। আজ আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নিছকই সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সাধারণত, রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগ নেতা-কর্মী হয় ক্ষমতা ভোগ করেন অথবা ক্ষমতার জন্য অপেক্ষা এবং ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে যান। নির্বাচনী ব্যবস্থায় এই দুটি বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে দলের সব মনোযোগ ও শক্তি নির্বাচনের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। আগে বলা হত রাজনৈতিক দল গঠনে দলীয় কর্মী, দলীয় কর্মসূচী, দলীয় কার্যালয় ও দলীয় তহবিলের মত চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমশই ফাঁপা হয়ে যাওয়ায় এই চারটি স্তম্ভ এখন ক্রমশই আবছা হয়ে গেছে। একালে রাজনৈতিক দলগুলোর বিপুল জনসমর্থন আছে, অর্থ ও মিডিয়ার বিশাল নেটওয়ার্ক আছে, নেতাদের দরবার আছে কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চার বড়ই অভাব। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই, তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তাপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করার মত উপযুক্ত কোনো পরিকাঠামো নেই।
অন্যদিকে গণ-আন্দোলনকারী সংগঠন বা ফ্রন্টগুলোর শক্তি আছে, ধারণা আছে, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা আজকের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। সম্প্রতি কৃষক আন্দোলনের শক্তি গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করেছে। দেশে এরকম আরো বেশ কয়েকটি গণ-আন্দোলনের ধারা সজীব রয়েছে, যাদেরও একইরকম শক্তি। কিন্তু এগুলি তাদের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দিল্লির বুকে একটিই জোট কায়েম করতে এখনও অক্ষম। এর মধ্যে রয়েছে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আন্দোলন, বেকার যুবকদের আন্দোলন, নারীর ক্ষমতায়নের প্রচার, নমঃশূদ্র-দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর আন্দোলন, বা কণ্ঠরোধ করার মত ইস্যুতে আন্দোলন। দেশের এমন কোনো অংশ নেই, যেখানে এমন কোনো আন্দোলন মানুষকে রাস্তায় সংঘবদ্ধ করছে না। এইসব জন-আন্দোলন, নির্বাচনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে ঠিকই, কিন্ত এগুলো তো অরাজনৈতিক নয়! এইসব গণ-আন্দোলনের মতাদর্শ, দেশ ও বিশ্বের প্রশ্নে তাদের অবস্থান এবং ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার শক্তি এগুলিকে গভীর থেকে গভীরতর রাজনৈতিক করে তোলে। কিন্তু তৃণমূলস্তরের এইসব আন্দোলনের চরিত্র এমনই, যে তারা একটি ছোট এলাকা বা ছোট একটি অঞ্চলে সংগঠিত হয়, আর সে কারণেই তাই সংসদীয় রাজনীতির প্রশ্নে, নির্বাচনী খেলায় এগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে না।
দেশের রাজনীতিতে এই দ্বিচারিতা কিন্তু নতুন কিছু নয়। আশির দশক থেকে ভারতীয় রাজনীতির পণ্ডিতরা ‘অদলীয় রাজনীতি’র ধারা চিহ্নিত করতে শুরু করেন। কিন্তু আজ সেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখনকার চ্যালেঞ্জ কেবল গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে অদলীয় রাজনীতির স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করা নয়। সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে রক্ষা করাই আজ চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় সংসদীয় বিরোধী দল ও রাজপথের বিরোধী দল অর্থাৎ গণ-আন্দোলনকারী সংগঠনসমূহের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে সত্যিকারের বিরোধী পক্ষ গঠন আমাদের চ্যালেঞ্জ।
আজ আমাদের দেশ এক নজিরবিহীন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা এক বিবৃতিতে এই বিপদের কথা জনসম্মুখে পেশ করেন — “দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হচ্ছে। ভারতের নিজস্ব ধর্মবোধ সুপরিকল্পিত আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের প্রজাতন্ত্রের উপর জঘন্য আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আগে কখনই ঘৃণা, বিভাজন ও বৈষম্যকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের ওপর এতটা নির্মম আঘাত নামিয়ে আনা হয়নি। এর আগে কখনও আমরা এভাবে এতটা গুপ্তচরবৃত্তি, অপপ্রচার ও মিথ্যের সম্মুখীন হইনি। গুটিকয়েক ব্যক্তি শাসক হিসাবে চরম বিশৃঙ্খল এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে জনগণকে চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এরকম নির্মম শাসন আমরা আগে কখনও দেখিনি।” আজ আমাদের এমন একটি হাতিয়ার প্রয়োজন যা এই জাতীয় সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম।
প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি আমাদের দেশ। আমরা স্বাধীন ভারতেও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের কিছু উজ্জ্বল মুহূর্তও দেখছি কয়েক বছর ধরে। কৃষক আন্দোলন ছিল তারই প্রাণবন্ত উদাহরণ। এছাড়াও, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের নাগরিকত্ব অটুট রাখতে এবং সমানাধিকার সুনিশ্চিত করতে রাস্তায় নেমেছেন। বহু রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ও সমাজ কর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, লেখক ও সাধারণ নাগরিক — শাসকের হুমকি ও চোখরাঙানিকে পরোয়া করেননি, এমনকি জেলে যেতেও রাজি হয়েছেন এবং ক্ষমতার সামনে সত্য কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন।
আজ গণ-অভ্যুত্থানের এই শক্তিকে সেইসব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে, যারা আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। সেজন্য আমি কৃষক আন্দোলনের পাশাপাশি অন্যান্য গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমি আমার দল ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’-র পাশাপাশি অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমন্বয় তৈরির চেষ্টা করছি। সেই কারণেই আমি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু এই লক্ষ্য কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। হাজার হাজার মানুষ যেভাবে পাগলের মতো দেশকে স্বাধীন করতে ঘরবাড়ি ছেড়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই, আজ দেশের এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে হাজার হাজার ‘আন্দোলনজীবী’র কাছে এই লক্ষ্যে পৌঁছনোটাই বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ, আর এটাকেই জীবনের লক্ষ্য বানাতে হবে।