যেটুকু জীবন বেঁচেছি আর যতদিন বাঁচবো, দেখতে পাচ্ছি জীবনের ছাঁচ বদলাচ্ছে রোজ। জীবন মাস্টার কখনো নিজেই হাত ধরে শেখাতে চায়, কখনো দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে মুচকি হাসে।
অঙ্কোলজি, বিশেষ করে বাচ্চাদের অঙ্কোলজির চিকিৎসা শিখতে শুরু করেছি, ওদের সঙ্গে কাটানো প্রত্যেক ঘন্টা নতুন নতুন গল্প বলে গেছে। বড়দের চিকিৎসা আর বাচ্চাদের চিকিৎসা অনেকটা আলাদা এইখানে, যে বহু ক্ষেত্রেই বড়দের চিকিৎসা Life prolonging, মানে আর যদি কিছু মাস তাঁকে দেওয়া যায়, উদ্বৃত্ত কাজগুলো শেষ করে যেতে পারেন নিশ্চিন্তে, নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে। বাচ্চাদের আয়ু কয়েক মাস বাড়ানো শুধু চিকিৎসার ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়।
২০১৯ এ আমার ছেলের জন্মের মাসখানেক পরেই একটি সিজারিয়ান অ্যাটেন্ড করেছিলাম। অত্যন্ত সপ্রতিভ মায়ের এক ছোট ফুটফুটে মেয়ে হয়। অল্পবয়সী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত স্বামী স্ত্রীর প্রথম সন্তান। নাম রাখা হয় নদী। সদ্যোজাতার আগমনী উৎসব শেষ হতে না হতেই নিজের ব্রেস্টে লাম্প খুঁজে পান মা। FNAC তারপর Biopsy তে malignancy আর তারপর COVID এর প্রথম ঢেউ। সময় বয়ে যায় বেশ খানিকটা। কর্কট অপেক্ষা করেনি। দেরীর কথা জেনে আতঙ্কিত আমার পরামর্শে বেশ কয়েক মাস পরে PET CT জানিয়ে দিল ক্যান্সার ছড়িয়েছে সারা শরীরে, লিভারে, ভার্টিব্রায়।
১ বছরের নদী আর ভালোমানুষ স্বামীর মুখ চেয়ে মা শক্ত করে রাখলেন নিজেকে। ক্লিনিকে যখন মেয়েকে নিয়ে আসতেন, মুখস্থ বলে যেতেন মেয়ের রোজনামচা, ওষুধের এতটুকু নড়চড় হতো না। পেইনকিলার বাড়ছিল দিনে দিনে। হরমোনাল থেরাপিতে মেটাস্ট্যাসিস বাড়ছিল। কমছিল আশা আর আয়ু। ছোট্ট হয়ে যাচ্ছিলেন দিনের পর দিন। খেতে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন একদিন, নদীর কি ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা আছে? বললাম জিন টেস্টিং এর কথা, কিন্তু আপাততঃ আপনার খুব প্রয়োজন সুস্থ থাকার।
উত্তর পেলাম, আমার পরিবার টা ভেসে যাচ্ছে। আমার বরটি নিজে থেকে কিচ্ছু খুঁজে পাননা। রুমাল, পার্স আমাকেই খুঁজে দিতে হতো। এখন সব নিজে করছে, রান্নাও। Dependent হয়ে পড়েছি তো! নিজেরই খারাপ লাগছে খুব।
হায় রে, বাঙালি প্রেমিকা, একাধারে প্রেয়সী, বান্ধবী ও স্নেহময়ী।
মাঝখানে দেখা হয়নি কয়েক মাস। মাসখানেক আগে আবার এসেছিল নদী। এবার এক মাঝবয়সী মহিলার কোলে চেপে। ২ বছর পেরিয়ে গেছে সদ্য। উচ্চতা কম। ওজন বেশ খানিকটা কম বয়সের তুলনায়। বাবার চোখগুলো দেখছে সব, অথচ কিছু পড়ছেনা। উদভ্রান্ত। ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে নদীর মা'কে মাস দুয়েক আগে আগে। ব্যথা বেড়ে গেছিল অসম্ভব। কড়া ডোজের মরফিনে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, চিনতে পারতেননা কাউকে। একটা সময় পরিবারের সবাই চাইতে শুরু করলেন, চলে যাক এই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করার চেয়ে।
নদীর দেখাশোনা করছেন দূর সম্পর্কের পিসি। তিনি ও হয়তো ফিরে যাবেন মাস দেড়েক পর। নিজের পরিবার ছেড়ে ক'দিন থাকা যায়! নদী ভুগছে psychosocial dwarfism এ। Emotional deprivation আরো specifically maternal deprivation এ বৃদ্ধি আটকে রয়েছে। জেদী, একবগ্গা, tantrum করা মেয়েটাকে আমি চিনতে পারলাম না।
Solid tumor যখন চিকিৎসায় সাড়া দেয় না, ফিরে আসে আবার, আমি ভয় পাই, ভীষন ভয়। অজস্র ছোট ছোট মাংসপিন্ড গজিয়ে উঠতে শুরু করে শরীর জুড়ে। কোনোটা ঠিক পিত্তনালির মুখ টা আটকে দেয়, কোনো টা আটকে দেয় মূত্রথলি। কষ্ট বাড়তে থাকে দিন দিন। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে অর্ধ চেতন শরীর আর দিশেহারা স্বামীর ওপর বোঝা হবার আক্ষেপ। একটু একটু করে পিছলে যাওয়া মেয়ের স্মৃতি, তারপর শুধু নিশ্ছিদ্র নিকষ আঁধার। একটাই আকুতি শেষ পর্যন্ত: পরিবার টা যেন ভেসে না যায়!
সঙ্গে সঙ্গে আমার আরেকটি অনুভূতি হলো, নিজের জীবনে আমি লোকটা protagonist, কিন্তু এই পরিবারের জীবনের চলচ্চিত্রে আমি জীবনের এক অন্ধকার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা এক চরিত্র। এক মহাজাগতিক উইপোকার ঢিপির অজস্র ক্রসরোডের একটা অকিঞ্চিৎকর মোড়ে এই পরিবারের সঙ্গে আমার দেখা। ছোট্ট কোণায় আমার জীবন বেঁচেছি, এদের জীবনও তেমনই আরেক কোণায় চলছে। এদের জীবনের ট্র্যাজেডি এরা সবটা দিয়ে অনুভব করছে, আমি তার খানিকটা পারছি।
জন কোনিগ নামে এক ভদ্রলোক কিছু নতুন শব্দ আনলেন, The Dictionary of Obscure Sorrows নামে এক অনলাইন শব্দসংগ্রহ, তথাকথিত ডিকশনারিতে জায়গা হয়নি এখনো শব্দগুলোর। তাতে রয়েছে 'sonder' নামের একটি শব্দ। এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে the realization that each random passerby is living a life as vivid and complex as your own—populated with their own ambitions, friends, routines, worries and inherited craziness.
এই গিজগিজ করা শহরটাকে মাটির কাছাকাছি নেমে যখন দেখি, কোটি কোটি গল্প হেঁটে যায় সামনে দিয়ে। আমার কাছে অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু নিজের গল্পে আমি হয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য সেই গল্প গুলো ঘোর বাস্তব। যে সমস্যাগুলো আমার কাছে দু'ছত্র খসখসানো প্রেসক্রিপশন, দুঃস্বপ্নের মতো সেই দুঃখগুলো টেবিলের অপর প্রান্তের জীবনে আতসকাচ দিয়ে দেখার মতো ম্যাগনিফায়েড।
Sonder আমাকে জানিয়ে দিলো, life prolongation একটা মিথ্যে প্রবোধ ছাড়া কিছু নয়। টেবিলের এপার থেকে স্বজন হারানোর পর থেকে যাওয়া শূন্যতা বিচার শুধু empathy দিয়ে অসম্ভব। জীবন শুধু উইল বানানোয় সম্পূর্ণ হয়না। আসন্ন বিচ্ছেদের সাবধান বাণী শোনাই বইয়ে পড়া life expectancy বিচার করে, আমার বোধগম্য হয়না যে উদ্বৃত্ত কাজগুলো কখনো শেষ হয়না। নিঃশর্ত মুক্তি কেউ চায়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতে একদিন আমাদের end of life counseling এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। ততদিন মনে রাখব, আশা শেষদিন পর্যন্ত শেষ হয়না। মনে রাখব জীবন প্রলম্বিত করার জন্য যথেষ্ট সময় বলে কিছু নেই। Life prolongation আমাদের জন্য আসলে একটা ব্যর্থ বোঝাপড়া।