‘র্যাপারের কি জাদু রে ভাই। বৌভাতের দিন ইয়াব্বড় এক বাক্স। মনে করলাম কী-না-কী! পরে খুলে দেখি, দু’খানা কাচের গ্লাস। ওগুলোকে কম্বলের মত জড়িয়ে রয়েছে ফোম। তিল থেকে তাল হওয়ার গল্প শুনেছি। কিন্তু তাল থেকে কিভাবে তিল হতে পারে, তা নিজের চোখে দেখলাম। হন্ডা সিটি চেপে, পাঁচজন এসে, দুটো রং ওঠা, বিবর্ণ কাচের গ্লাস দিয়ে পগারপার! র্যাপার দেখে বোঝে, কার সাধ্য!’
সাড়ে সাতশ’ টাকার প্লেট খাইয়ে ঠকে যাওয়ার গল্প বলছিল আমার স্কুলজীবনের এক বন্ধু। আর মনের দুঃখ উজাড় করে দেওয়ার সময় বারবার শুধু র্যাপারকে দুষছিল ও। বলছিল, এই র্যাপার নামক বস্তুটা আসলে এক ছদ্ম-মোড়ক। ওর অভিজ্ঞতা নাকি বলে, উপহারকে আরও বাহারি করার জন্য যতজন মানুষ র্যাপারে মুড়িয়ে দেন, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ কোনও বস্তুকে র্যাপারবন্দি করেন কার্যত ‘মন কি বাত’ ঢেকে রাখার জন্য। বলল, বেশিরভাগ গিফটের গায়েই প্রেরকের নাম লেখা নেই। আর যে উপহার যত খাজা, তার গায়ের র্যাপারের চাকচিক্য তত বেশি।
আমার স্কুলসখার মত তিক্ত অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়েছে জানা নেই, তবে র্যাপারকাণ্ডে দুনিয়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। সৌজন্য দেখানোর এক অলিখিত নিয়ম বলে, কোনও উপহার র্যাপারে না মুড়িয়ে দিলে তার জাত থাকে না। এই চকচকে কাগজের মধ্যে যেমন লুকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাস, একইরকমভাবে ঘাপটি মেরে থাকে রহস্যও। এক ধরণের কী হয়, কী হয় ভাব। আমার এক বোন আছে, প্রতি বছর জন্মদিনের পার্টির কোলাহল-হলাহলের পর্দা পড়ার পরে, অপেক্ষা করে থাকে শেষ আমন্ত্রিত ব্যক্তিটি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এরপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বেডরুমের এক কোনায় জড়ো করে রাখা যাবতীয় উপহারের উপরে। হলিউডি সিনেমার যুদ্ধের দৃশ্যে তলোয়ার চালানোর মত, কাঁচি দিয়ে নিমেষে ফালাফালা করতে থাকে যাবতীয় র্যাপিং পেপার। দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সেই চকচকে কাগজের খাঁচা। ওয়াও, অসাম্, এ বাবা, কি ফালতু জিনিস দিয়েছে রে—এ ধরণের মন্তব্য উড়তে থাকে ক্রমশ। উপহারগুলো তাদের জাত ও আভিজাত্য অনুযায়ী আলমারির শেলফে কিংবা স্টোররুমের বদ্ধ কুঠুরিতে স্থান পায়। তবে সব উপহার মুক্ত করার পরে, সেই বিপুল পরিমাণ র্যাপার কাগজ ঠেসে ঢুকে যায় রান্নাঘরের কোনায় রাখা ওয়েস্ট-বিনের গর্ভে। পুরসভার বাঁশি পরের দিন জঞ্জালের ভ্যানে চকচকে কাগজগুলোর শেষযাত্রা দেখে।
যদি আত্মজীবনী লিখতে পারত কোনও র্যাপিং কাগজ, তাহলে হয়তো বলত, উপহারের গায়ে আমাকে পরিয়ে দেওয়ার সময় লোকের হাতে যেমন পরম মমতা মিশে থাকে, উপহারের দেহ থেকে আমাকে ছাড়ানোর সময় লেপ্টে থাকে চরম অবজ্ঞা। যার জন্য সাধের উপহার অন্য মাত্রা পায়, তার আয়ু হয়তো বড়জোড় কয়েক ঘণ্টা। অভিমানী র্যাপিং কাগজের মধ্যে লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার এক অদম্য ইচ্ছে। না হলে বিশেষজ্ঞরা কেন বলবেন, উপহারের মেয়াদ ফুরোয়, গয়নার গায়ে কালো দাগ পড়ে, সাধের খেলনা হেলিকপ্টার পাখা ভেঙে পড়ে থাকে ঘরের ড্রেসিং টেবিলের তলার অন্ধকারে, তবু র্যাপিং কাগজ জেগে থাকে। আরও চকচকে, আরও ঝকঝকে করার জন্য কাগজের সার্কিট বোর্ডে মেশানো হয়েছে যে উপাদান, তা যে সহজে বিলীন হওয়ার নয়।
উপহারের গায়ে প্রসাধনের চাদর কিংবা জরির ঝালর লাগানোর জন্য কত র্যাপিং কাগজ ব্যবহার করি আমরা? যে পরিমাণ র্যাপিং পেপার উপহারের গায়ে আটকে দেওয়া হয়, তার সিংহভাগই যে ঠাঁই পায় ময়লার ভ্যাটে—তা আঁচ করার জন্য বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলেই উত্তর মেলে। পশ্চিমি দেশগুলোতে উপহার আদানপ্রদানের সেরা সময় হল বড়দিন। মার্কিন মুলুকে শুধুমাত্র বড়দিনের মরসুমে যে পরিমাণ র্যাপিং কাগজ ব্যবহার করা হয়, তার পরিমাণ নাকি চার মিলিয়ন টন। অন্য তথ্য বলে, ইংল্যান্ডে এই উৎসবের মরসুমে ব্যবহৃত র্যাপিং কাগজগুলোকে পরপর মেলে ধরলে যে দৈর্ঘ্য হয়, তা দু’লক্ষ মাইলকেও ছাপিয়ে যায় হেলায়। গ্রহের সবকটি দেশ এবং তাদের উৎসবপক্ষে ব্যবহার করা র্যাপিং কাগজের যদি হিসেব নিতে বসা যায়, তাহলে চোখে ঝিলমিল লেগে যায়। এ দেশে দিওয়ালির সময় উপহার আদান প্রদানের জন্য কত র্যাপিং কাগজ ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে বুক বাজিয়ে বলা যেতে পারে, ১৩০ কোটির দেশ অন্য নানা মহাদেশকে টেক্কা দেবে সহজে।
র্যাপিং কাগজের এই বাড়বাড়ন্ত দেখে কপালে ভাঁজ পড়ছে পরিবেশবিদদের। তাঁরা বারবার মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, নামের মধ্যে পেপার মিশে থাকলেও র্যাপিং কাগজ কিন্তু শুধুমাত্র কাগজ নয়। সাধারণ কাগজ পুনর্ব্যবহার, অর্থাৎ রিসাইকেল করা যায় সহজে। র্যাপিং কাগজকে আবার ব্যবহার করার রাস্তাটা সহজ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে র্যাপিং কাগজ যত বেশি চকচকে, তার পুনর্ব্যবহার করার সুযোগ তত কম। কারণ চকচকে র্যাপিং কাগজের মধ্যে মিশে থাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা পরিবেশের পক্ষে চরম ক্ষতিকর। মাটিতে মিশতে চায় না, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে, নদী নালা খাল বিলের মাধ্যমে সমুদ্রে গিয়ে পড়লেও এই কাগজের সলিলসমাধি হয় না সহজে। চাষবাসের পক্ষে তো বটেই, জলজ জীবনকেও অনেকটা ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এই র্যাপিং কাগজ। এই কাগজের গায়ে অলংকারের মত লেগে থাকে যে সেলোটেপ, তাও সহজে বিলীন হওয়ার নয়। মোটের উপরে, উৎসবের মরসুমে উপহার দেওয়া নেওয়ার পরিমাণ যত বাড়বে, তত বাড়বে এই র্যাপিং কাগজের পরিমাণ। প্রিয়জনের উপহারে আমাদের মুখে হাসি ফুটবে, কিন্তু একই সময়ে প্রকৃতি হয়তো খুঁজতে থাকবে চোখের জল মোছার টিস্যু পেপার।
মনোবিদরা বলেন, র্যাপিং কাগজে উপহার মুড়ে দিই যখন, আরশোলার শুঁড়ের নড়াচড়ার মত মনের মধ্যে খেলা করে স্ট্যাটাসরক্ষার দায়। সামাজিকতার এক অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী, উপহারের ঔৎকর্ষের সঙ্গে র্যাপিং কাগজের দ্যুতির এক সমানুপাতিক যোগ রয়েছে, অন্তত আপাতভাবে। তাই কোনও অনুষ্ঠানে নিজেকে আরও বেশি জাহির করার জন্য, আমরা উপহারগুলো বন্দি করি বাজারের সবচেয়ে দামী র্যাপিং পেপারে। সোনালি, রুপোলি কাগজের ছটায় ভিতরে থাকা উপহারের মান বাড়ে। পরিবেশকে ভালবাসেন যাঁরা, তাঁরা প্রশ্ন করছেন, গিফট র্যাপ করার এই যুগ শেষ হবে কবে? উপহারগুলোকে র্যাপিং পেপার দিয়ে না মুড়ে, সাধারণ খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে ফেলার দাবি উঠছে বিশ্বজুড়ে। আমরা যাঁরা এথনিক-এথনিক বলে প্রেম নিবেদন করি, আধুনিক ডিপার্টমেন্টাল দোকানগুলোতে প্লাস্টিকের থলের বদলে খবরের কাগজ দিয়ে তৈরি ব্যাগ পেলে বাহবা দিই, তাঁরাই আবার উপহার দেওয়ার সময় হলে বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসি চকচকে র্যাপিং কাগজ। গণ্ডগোলের বীজ পুঁতে রাখা রয়েছে এখানেই। এসব নিয়ে চর্চা করা মানুষদের বিকল্প পথ বাতলানোর ক্ষেত্রে কোনও ত্রুটি নেই। অনেকে বলছেন, উপহারকে খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দিতে যদি প্রেস্টিজে বাধে, তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে পাতলা কোনও কাপড়ের কথা। ছোট উপহার হলে একটা নতুন রুমাল দিয়েও তো মুড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে সাধের উপহার। বইয়ের মলাট দিই যে খয়েরি কাগজে, উপহার দেওয়ার জন্য এমন কাগজের ব্যবহার হলে মন্দ কী? অনেকের আবার দাবি, যে কোনও মহিলার কাছে রঙবেরঙের স্কার্ফের যে স্তুপ থাকে, তার থেকে কি গোটাদুয়েককে আলাদা করে উপহার মুড়িয়ে রাখার জন্য ব্যবহার যায় না? একটা স্কার্ফের কাপড়ের যা আয়তন, তা দিয়ে অনায়াসে প্যাক করা যেতে পারে অন্তত দশটি ছোট উপহার। র্যাপিং কাগজের পাশাপাশি সেলোটেপের ব্যবহারেও দাঁড়ি টেনে, বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে নারকেলের দড়ি। ব্যবহার করা যেতে পারে পুরোনো হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারের পাতা। একটু ভাবলে বোঝা যাবে, হাতের সামনে যা পড়ে আছে আমাদের, পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে আপাত বর্জ্য হয়ে যাওয়া যে উপাদান, তা দিয়েও কিন্তু উপহারদের রাঙিয়ে দেওয়া যায় দিব্যি।
অনেকে আবার এক কদম এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, বিয়ের কার্ডে কি আমরা লিখতে পারি না র্যাপিং কাগজ দিয়ে উপহার মুড়িয়ে না আনার কথা? কিছু মানুষও যদি এই অনুরোধ মেনে চলেন, মেনে চলতে শুরু করেন, তাহলেও তো বেঁচে যায় অনেক কাগজ। এই সু-অভ্যাসের আঁচ পড়তে বাধ্য অন্য উৎসব অনুষ্ঠানেও। বিন্দু বিন্দু জলে যেমন সিন্ধু হয়, ঠিক তেমনই অনেক মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় আখেরে লাভ হবে পরিবেশের। চটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাঁরা শ্লোগান তোলেন, তাঁরা বলতেই পারেন চটের হালকা কাপড় দিয়ে উপহার মুড়িয়ে দেওয়ার কথা। বইয়ের দোকানের মালিকরা যদি পরিবেশকে ভালবাসেন, তাঁরা র্যাপিং কাগজ মজুত রাখার ক্ষেত্রে দাড়ি টানার কথা ভাবতে পারেন। যোগান কম হলে মানুষও বিকল্প রাস্তার কথা ভাবতে বাধ্য হবেন ক্রমশ। চোখ বুজে মিনিটখানেক ভাবলে মাথায় আসবে, সাত মাথার মোড়ের মত চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বিকল্প পথ।
ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। ক্যাকটাস ব্যান্ডের একটি গানের লাইনে ছিল, ‘তুমিও বোঝো, আমিও বুঝি, বুঝেও বুঝি না’। অন্যকে দেওয়া উপহারের প্রাণভ্রমরা তো আসলে লুকিয়ে থাকে আন্তরিকতায়। উপহারের দামে কিংবা র্যাপিং কাগজের চমকে নয়। আমরা তা বুঝব কবে?
মূলছবি:লিঙ্ক