এখন যখন আমরা পত্রিকার পাতায় পড়তে বাধ্য হই তিন দিনের সদ্যজাত শিশুকে ডাস্টবিন হতে তুলে বাঁচাল ক্ষুধার্ত কুকুর, তখন আমাদের মনে পড়ে যায় ৬১ বছর আগে লেখা হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’ নামের গল্পটির কথা। যদিও সেই গল্পে কাদু শেখের বিধবা বোনকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল, চিহ্নিত করা গিয়েছিল শকুনদের, কিন্তু এই ২০২১ সালে যখন নগরের ডাস্টবিনে বা নালায় মাঝে মধ্যেই সদ্যজাত শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তখন সেই মা-দের আর চিহ্নিত করা যায় না। চিহ্নিত করা যায় না শকুনদেরও। এই ৬১ বছরের ব্যবধানে দেশটা ছেয়ে গেছে কাদু শেখের বিধবা বোন আর অসংখ্য শকুনে! কিন্তু হাসান আজিজুল হক আর নেই!
বর্ধমানের যব গ্রাম ছেড়ে কৈশোরত্তীর্ণ হাসান আজিজুল হক যখন পূর্ব বাংলায় এলেন, তার মাত্র ক’বছর আগে বাংলা ভাগ হয়েছে। পূর্ব বাংলার নিজস্ব সাহিত্য নির্মাণের চেষ্টা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আবার শুরু হয়েছে ভাষার ওপর দখলদারিত্ব। হাসান আজিজুল হক যখন নিজের বাংলা ছেড়ে আন-বাংলায় আসতে বাধ্য হলেন, তার দু’বছর আগে সেই বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার। ভাষা আন্দোলন তখনো চলছে।
সেই ভাষায় সাহিত্য রচনার, বাঁচিয়ে রাখার, সমৃদ্ধ করার দায় নিয়ে হাসান আজিজুল হক লিখতে শুরু করলেন একের পর এক গল্প। দেশভাগের মর্মান্তিক বেদনা, শেকড় চ্যুত মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামী চেষ্টা, নতুন প্রশাসনিক রাষ্ট্রে নতুন শোষণের উত্থান, আপাত বিজয়ী মানুষের আনন্দময় জীবনে ধীরে ধীরে ‘পরাজিত’র বোধ তৈরি হওয়ার গল্পগুলো হাসান আজিজুল হক ইতোমধ্যে দেখে নিয়েছেন। সেইসব পরাজিত হত দরিদ্র মানুষের বেদনার গল্পগুলো জেনেছেন পরম মমতায়। ঘাসের আর ধুলোর ওপর আলতো পড়ে থাকা শরতের শিশির ভেজা শিউলি ফুলগুলো যেভাবে কিশোরী মেয়ে তুলে নেয় আপন কোচরে, তেমনি হাসান আজিজুল হক তাঁর পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতাগুলো তুলে নিয়েছেন গল্পে।
কোথাও খুব উচ্চকিত হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। লাঠি বল্লম নিয়ে নায়ককে ছুটিয়ে দিতে হয়নি জোতদারকে মারতে। গ্রামের সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাষায় কথা বলে গেছে তাঁর চরিত্রেরা। কিন্তু গল্পের আনাচে কানাচে হাসান আজিজুল হক বুনে গেছেন প্রতিবাদের ভাষা। “আমার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একটা বিশ্বস্ততা কাজ করে, কেউ বন্ধু চিরকালের জন্য বন্ধু। আর আমি দেখেছি, মধুর ব্যবহার করলে মানুষ খুব আনন্দ বোধ করে। কটকট করে কথা বললেও কাজ হয়, সবই হয়। কিন্তু ওই পরিবেশটি নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে হয়ত ভাষাটা এভাবে তৈরি হয়েছে”- নিজের গল্প ভাষা নিয়ে এভাবেই বলেন তিনি।
১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘শকুন’ গল্পটি। আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ একটা গল্প। গ্রামের কিছু কিশোর- যাদের মধ্যে কৃষক আছে, স্কুল পড়ুয়া আছে, আবার সকালে স্কুল, বিকেলে খেতমজুরও আছে, ভীতু আছে, সাহসী আছে- সেই কিশোরদের সামনে এক সন্ধ্যার অন্ধকারে আবির্ভূত হয় আরো দূর অন্ধকার এক মাংস-পিণ্ড। যেন আকাশ থেকে নেমে আসে। বস্তুটা কী তা প্রথমে ঠাহর করা যায় না, ধীরে ধীরে কিশোরেরা বুঝতে পারে এ এক শকুন। সারাদিন যে কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে পচা মাংস খেয়েছে, এখনো যার ঠোঁটের ডগায় আর পালকে লেগে আছে পচা মাংসের স্বাদ। সারাদিনের লড়াইয়ে ক্লান্ত, আহত, যথাসময়ে বাড়ি ফিরতে না পেরে দিকভ্রান্ত সেই শকুন যখন কিশোরদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে, যখন সে উড়তে পারে না আর, তখন কিশোরদের রোখ চেপে যায়। এই শকুনকে তারা ধরবেই। ধরে কী করবে তা কেউ জানে না, কিন্তু ধরতে তাকে হবেই। শকুনের পিছু পিছু ছুটে চলে অবিরাম, মাঠ পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে, কাঁটাঝোপ পেরিয়ে তারা শকুন শিকারে ছুটে চলে। কাঁটায় তাদের জামা ছিঁড়ে যায়, শরীর কেটে যায়, কিন্তু শকুনকে বাগে পেয়ে তাকে বধ করার তাদের অদম্য বাসনা কেউ রুখতে পারে না। কারণ ইতোমধ্যে তারা অসংখ্য মানুষরূপী শকুন দেখে ফেলেছে। যারা তাদের পিতৃপুরুষদের নিঃস্ব করে ছেড়েছে, যারা তাদের ক্রমাগত গ্রাস করে চলেছে এই শকুনের মতই। সেই মানুষরূপী শকুনদের কিছু করার ক্ষমতা এই কিশোরদের নেই, তাই এই আহত দিগভ্রান্ত শকুনটার ওপরই চাপিয়ে দিতে হবে সবগুলো ক্রোধ। তাই তারা ছুটে চলে।
তারপর সেই শকুনের সবগুলো পালক তারা তুলে নেয়, কেউ তা দিয়ে কলম বানাবে, কেউ বানাবে মাথার মুকুট। শকুন বধের আনন্দ নিয়ে যখন তারা বাড়ি ফিরছে তখন তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় আরো এক অবয়ব। কিন্তু এই অবয়ব অন্ধকারের চেয়ে আরো দূর অন্ধকার না, এই অবয়ব শকুনের মত কালো না, এই অবয়বটি সাদা! এই সাদা শাড়ি পরা অবয়বটির নাম নেই কোনো, সে কাদু শেখের বিধবা বোন।
সকালে গ্রামের মানুষেরা দেখতে পায় সেই মরে থাকা শকুনটিকে। তারা দেখতে পায় গ্রামের আকাশে ভিড় করে আসছে আরো আরো শকুন। কিন্তু শকুন তো শকুনের মাংস খায় না! তখন তারা দেখতে পায় মৃত শকুনের পাশেই শায়িত এক অর্ধস্ফুট মানবশিশুকে। যার মাংস খেতেই শকুনেরা ভিড় করে এসেছে। গ্রামের সবাইও সেই দৃশ্য দেখতে আসে ভিড় করে, শুধু কাদু শেখের বিধবা বোনটি আসে না, তার মুখাবয়ব আরো বেশি ফ্যাকাসে হতে থাকে।
তখন আমাদের মনে পড়ে যায় ছেলেগুলো যখন শকুনকে ধাওয়া করে দৌড়চ্ছিল, তখন তাদের যে অনুভবের কথা হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন, সেটুকুর কথা আমাদের মনে পড়ে যায়- “শকুনটাকে দেখে তাদের রাগ লাগে, মনে হয় তাদের খাদ্য যেন শকুনের খাদ্য, তাদের পোশাক যেন ওর গায়ের গন্ধ ভরা নোংরা পালকের মত; সুদখোর মহাজনের চেহারার কথা মনে হয় ওকে দেখলেই। নইলে মহাজনকে লোকে শকুন বলে কেন। কেন মনে হয় শকুনটার বদহজম হয়েছে। যে ধূসর রংটা দেখলেই মন দমে যায় তার সঙ্গেই এর রং-এর এত মিল থাকবে কেন। প্রায় জীবন্ত, ফেলে দেওয়া যে শিশুগুলোকে গর্তে, খানা-ডোবায়, তেঁতুল তলায় ছেলেরা দেখে, না বোঝার যন্ত্রণায় মন যখন হু হু করে ওঠে, তখন তাদের কচি মাংস খেতে এর এত মজা লাগে কিসের!”
এভাবেই, খুব আলগোছে হাসান আজিজুল হক আমাদেরকে বলে যান সময় আর মানুষের কথা। সাদা আর কালোর দ্বন্দ্বের কথা। মানুষকে তিনি মহান করে তোলেন না, কিংবা করে তোলেন না অমানুষ। তাঁর গল্পের চরিত্রেরা শুধুই মানুষ- ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি। তিনি গল্পটা বলে যান, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না পাঠকের কাঁধে, পাঠককে নিজের আন্দাজে বুঝে নেওয়ার অবকাশ দেন। যেমন আমরা কখনো জানতে পারি না শকুন গল্পের কাদু শেখের বিধবা বোনটির গর্ভের শিশুটি কি প্রেমের না জবরদস্তির ফসল।
এই ভীষণ পরিমিতিবোধ আবার খুব অপরিমেয় হয়ে যায় যখন তিনি প্রকৃতির বর্ণনা দেন। এতো বিস্তারিত যে চোখ বন্ধ করে দেখা যায় সবটুকু। “গোটানো ঘনবুনুনির পালক মেলে গেল। বুনট যেন পাতলা হয়ে এল। স্তরে স্তরে সাজানো পালক পাশাপাশি চওড়া হয়ে কারকিত করা গালিচার মত বিছিয়ে গিয়েছে তার পালক। এখন তাই অনেক ফাঁক। পাশাপাশি পালক অনেক ছিটেনো ছিটেনো। দুই ডানা অসহায়ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল শকুনটা।”- একজন শকুনের শরীর থেকে গর্বের পালকগুলো তুলে নিলে যে কতোটা অসহায় হয়ে যায়, এরচেয়ে সুন্দরভাবে তা আর বর্ণনা করা সম্ভব কি না জানি না।
আমাদের গর্তে, খানা-ডোবায়, তেঁতুল তলায় এখনো প্রায় জীবন্ত ফেলে দেওয়া শিশুরা কাঁদে, কাদু শেখের বিধবা কিংবা অ-বিধবা বোনেদের চেহারা এখনো ফ্যাকাসে হয়ে আসে, শকুনেরা কিলবিল করে আমাদের চারপাশে- শুধু সেই শকুনের কথা লেখার জন্য হাসান আজিজুল হক আমাদের মাঝে আর নেই!
‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’- গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘শকুন’
হাসান আজিজুল হক
প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ
দাম: ২১৩ টাকা
বাড়িতে বসে বইগুলি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।