এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • দুনিয়ার সকল ফিল্ম-গোষ্ঠী ও সিনেমাপ্রেমী বন্ধুদের কাছে একটি আবেদন

    সাহরা কারিমি
    আলোচনা | রাজনীতি | ১৮ আগস্ট ২০২১ | ২২৩৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • এই খোলাচিঠিটি তালিবানের হাতে কাবুল পতনের আগে লেখা। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, স্লোভাক ফিল্ম আকাদেমি এবং ইউক্রেনিয়ান এবং তুর্কি সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চিঠির লেখিকা, চলচ্চিত্র-পরিচালক সাহরা কারিমি বর্তমানে জীবিত ও নিরাপদ। কিন্তু তাঁর দেশ নিরাপদ নয়।


    আমি, আফগানিস্তানের একজন চিত্রপরিচালক ও আফগানিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব ফিল্ম কোম্পানি “আফগান ফিল্ম” এর সাধারণ নির্দেশক, সাহরা কারিমি বলছি।

    আজ ভগ্নহৃদয়ে ও গভীর আশা নিয়ে আপনাদের উদ্দেশে এই আবেদন লিখতে বসেছি। আপনারা এগিয়ে আসুন। তালিবানের হাত থেকে আমাদের এই সুন্দর দেশ, তার ফিল্মজগৎ ও চিত্রপরিচালকদের রক্ষা করুন। আপনারা জানেন, বিগত কয়েকদিনে তালিবান আমাদের দেশের সিংহভাগ দখল করে নিয়েছে। তারা অসংখ্য দেশবাসীকে হত্যা করেছে, শিশুদের অপহরণ করেছে, বহু কন্যাসন্তানকে জবরদস্তি বিয়ে দেওয়ারর নাম করে নিজেদের দলবলের কাছে বিক্রী করে দিয়েছে, তাদের ফতোয়া দেওয়া পোশাক না পরার অপরাধে ইতিমধ্যেই এক মহিলাকে তারা হত্যা করেছে, আর একজনের চোখ উপড়ে নিয়েছে। দেশের এক জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতাকে, এক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও কবিকে, এবং দেশের সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের এক প্রধানকে তারা হত্যা করেছে। বেশ কিছু মানুষকে তারা প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছে। গৃহহারা হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। অধিকৃত অঞ্চলের বহু মানুষ কাবুলের বিভিন্ন অস্থায়ী শিবিরে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছে, যে শিবিরগুলো আবার লুট করতে শুরু করেছে তালিবানরা। সেই শিবিরগুলোয় ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না, সেখানে আশ্রয় নেওয়া শিশুরা পর্যাপ্ত দুধের অভাবে ধুঁকছে। আমাদের দেশ জুড়ে মানবতার এ এক সর্বগ্রাসী সংকট, অথচ এর মধ্যেও, বাকি দুনিয়া নীরব ও নিশ্চুপ।

    এই নীরবতা অপ্রত্যাশিত নয় ঠিকই, ন্যায্যও নয়। বহু আগে থেকেই আমরা এই নীরবতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমরা জানি, আমাদের দেশের অসহায় জনগোষ্ঠীকে সমূহ বিপদে ফেলে এক বৃহৎশক্তির একতরফা সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তই এই সংকটের জন্য দায়ী। আমরা জানি বিশ্বব্যাপী ঠান্ডা লড়াইয়ের সমাপ্তির জন্য পশ্চিমা-দেশগুলোকে সাহায্য করতে আমাদের দেশের মানুষকে ঠিক কতটা ত্যাগস্বীকার করতে হয়েছে। সেকথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে তাঁদের, বিশেষ করে আমাদের তরুণ সম্প্রদায়কে, বিগত কুড়ি বছর ধরে যারা তাদের জীবনযাত্রায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার স্পর্শ পাচ্ছিল – তালিবান শাসনের হাতে তড়িঘড়ি সমর্পণ করে সেই বৃহৎশক্তি আজ বিদায় নিচ্ছে। এর মত অমানবিক, হৃদয়হীন কাজ আর নেই। সৈন্যপ্রত্যাহারের এই একতরফা, দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের ফলে আবার সেই অন্ধকার যুগই ফিরে আসবে।


    বন্ধুগণ, আজ এই নিদারুণ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে, আমরা চাই, আপনাদের কণ্ঠ সরব হোক আমাদের পক্ষ নিয়ে। সারা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি, সরকার, গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলি আজ আমাদের দুর্দশা নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব – ভাবখানা এমন, তালিবানের সাথে এই তথাকথিত “শান্তি চুক্তি” যেন সর্বসম্মত ও আইনসিদ্ধ। কখনোই না। আমার দেশের মানুষের এই চুক্তিতে কোনও সম্মতি নেই। বরং, এই আইনি স্বীকৃতি তালিবানকে পুনর্বার ক্ষমতা দখল করার এক অবৈধ ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। চুক্তির আলোচনা আরম্ভ হবার সময় থেকেই, ক্ষমতার আঁচ পেয়ে তালিবানরা মানুষের উপর নির্যাতন করা শুরু করে দিয়েছে।
    একজন চিত্রপরিচালক হিসেবে, বিগত বহুবছরের পরিশ্রমে, আমি এদেশে ফিল্ম-শিল্পের যে পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম – আশঙ্কা হয়, তা অচিরেই ধ্বংস করে ফেলা হবে। পুরোদস্তুর তালিবান শাসন শুরু হলেই তারা সব ধরনের শিল্প ও চারুকলার চর্চাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। আমি এবং আমার সকল সতীর্থ তাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠব এবং আমাদের সবার নাম তাদের হিট লিস্টে উঠে যাবে। নারীর সকল অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হবে অন্তপুরের অন্ধকারে, তাদের সমস্ত অভিব্যক্তির কণ্ঠরোধ করা হবে। ইতিপূর্বের তালিবান শাসনে একটি মেয়েও স্কুলে ছিল না। গত কুড়ি বছরে ৯০ লক্ষেরও বেশি আফগান মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করেছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, যে ‘হেরাত’ শহরের (যা ইতিমধ্যে তালিবান দখলে চলে গেছে) বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ভর্তির প্রায় ৫০%-ই ছিল মেয়েরা। এমন সব সাফল্যের খবর কিন্তু বাকি দুনিয়ার কাছে পৌঁছয়নি।
    মাত্র গত কয়েক সপ্তাহে তালিবানরা অসংখ্য স্কুল ধ্বংস করেছে আর তার ফলে প্রায় ২০ লক্ষ মেয়েরা আবার স্কুল-ছাড়া।

    আমি এই নিশ্চুপ বিশ্বকে বুঝতে পারি না। এই নীরবতার মানে বুঝি না। তবু আমি হার মানবো না। এদেশে থেকেই আমি দেশের জন্য লড়বো। কিন্তু এ আমার একার কাজ নয়। আপনাদের মত বন্ধুদের প্রয়োজন। আমাদের এই নিদারুণ সংকটের কথা আপনাদের দেশের সমস্ত গণমাধ্যম ও প্রভাবশালী অন্য মাধ্যমকে জানান। সবাইকে জানান আফগানিস্তানে কি ঘটে চলেছে। আফগানিস্তানের বাইরে আপনাদের কণ্ঠই আমাদের কণ্ঠ হয়ে উঠুক।
    তালিবান কাবুলের দখল নিয়ে নিলে হয়তো এখানে ইন্টারনেট বা অন্য সব যোগাযোগ-ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে যাবে। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ – আপনার দেশের সমস্ত চিত্রপরিচালক, শিল্পী ও শিল্পকর্মীদের কাছে আবেদন করুন আমাদের পাশে দাঁড়াতে, আমাদের কথা ছড়িয়ে দিতে।

    এ লড়াই কোন গৃহযুদ্ধ নয়। এ এক ছদ্মলড়াই, প্রক্সি যুদ্ধ। এ লড়াই আফগানিস্তানের মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আর এর কারণ কেবলমাত্র মার্কিন-তালিবান হঠকারী চুক্তি। এই সংকটের কথা আপনারা আপনাদের দেশের সব মাধ্যমে – বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিন। সবাই জানুক।

    বাকি দুনিয়া আমাদের এই দুঃসময়ে মুখ ফিরিয়ে থাকলে আমরা নিঃসহায়। আফগানিস্তানের সমস্ত নারী, শিশু, শিল্পী ও চিত্রপরিচালকদের হয়ে আপনাদের কণ্ঠস্বর-ই এই মুহূর্তে সবথেকে জরুরী সাহায্য।

    হাতে একটুও সময় নেই। দু’-একদিনের মধ্যেই হয়তো কাবুলের পতন হবে। তার আগেই আমাদের সাহায্য করুন। আমাদের প্রিয় আফগানিস্তানকে এক বর্বর শক্তির হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলুন। আপনাদের এই সহৃদয় সহযোগিতার জন্য আমরা, আফগানিস্তানবাসীরা, আপনাদের কাছে সাতিশয় কৃতজ্ঞ থাকবো।

    শুভেচ্ছাসহ,
    সাহরা কারিমি




    অনুবাদ: পার্থপ্রতিম সেনগুপ্ত


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৮ আগস্ট ২০২১ | ২২৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন