এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধাত্রী পান্নার গল্প

    Mani Sankar Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১২ আগস্ট ২০২১ | ১৯৬৮ বার পঠিত

  • আজ এই লেখাটা লিখতে বসেও বুঝতে পারছি না, ঠিক কীভাবে এই প্রতর্কটির উপস্থাপন হওয়া উচিত। তাছাড়া এই বিষয়টিকে অ্যাড্রেস করার মতো ভাষাভুবন আমার আয়ত্তাধীন কিনা এ নিয়েও আমার নিজেরই সন্দেহ আছে।


    কাকে বলে দেশ? বহুদিন আগে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে আমরা পড়েছিলাম পোলিশ কবি চেশোয়াভ মিউশের সেই অমর পঙক্তি "কাকে বলে কবিতা যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষকে?" স্পষ্টতই বোঝা যায়, কবির কাছে দেশ আর মানুষ অভিন্ন কিছু নয়। তাহলে দেশপ্রেমই বা কী? দেশের মানুষের প্রতি প্রেম? জাতীয়তাবাদের বিপদটাই বা কোথায়? কীভাবে তা প্রকারান্তরে মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হয়ে ওঠে?
    ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ তে জওহরলাল নেহেরু লিখেছিলেন – “ভারতবর্ষকে যদি জানতে ও বুঝতে হয়, আমাদের সময় ও স্থানের ব্যবধান ছাড়িয়ে দূরে যেতে হবে।… তাহলে আভাস পাবো আমাদের দেশ একদিন কেমন ছিল, কী যোগ্যতা দেখিয়েছিল।” রবীন্দ্রনাথও বলেছেন যে ভারতকে জানতে হলে সেই যুগে যেতে হবে –“যখন সে তার আত্মাকে উপলব্ধি করেছিল, তার বাস্তব সীমা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল, যখন ভারত আত্মপ্রকাশ করেছিল দীপ্যমান মহানুভবতায়” যে ‘মহানুভবতা’ প্রাচ্যকে তথা সমগ্র মানব সভ্যতাকে আলোকিত করেছিল। অন্য ভূখণ্ডের অধিবাসীরা যে কারণেই হোক, এদেশে এসে, এই দেশকেই আপনার করে নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভারত চেতনা ছিল বিরাট এবং সামগ্রিক। তিনি একটি সুবিশাল অখণ্ড ভারত-চেতনার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, বেদ, উপনিষদ বা শ্রীমদ্ভগবদগীতা ভারতের ধ্রুপদী সংস্কৃতির কেন্দ্রে অবস্থান করলেও তা কোনোভাবেই ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার মাঝে ঐক্য স্থাপন করতে সক্ষম নয়। এখানেই স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী অরবিন্দ প্রমুখ থেকে তিনি ভীষণ রকমের আলাদা; যারা মনে করতেন হিন্দুত্বই ভারত-আত্মার সংহতির ভিত্তি।
    জার্মান-আমেরিকান দার্শনিক হানা আরেন্ট (Hannah Arendt ১৯০৬-১৯৭৫) মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ জাতির কাঠামোর মধ্যে একটি ছদ্মসম্প্রদায় (pseudocommunity) গড়ে তোলে। আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন-ও (Benedict Anderson ১৯৩৬-২০১৫) এই একই সুরে সুর মিলিয়ে তাকে কাল্পনিক সম্প্রদায় ("Nation is an imagined political community that is inherently limited in scope and sovereign in nature") বলেছেন। মহাত্মা গান্ধী যে আমৃত্যু অহিংস আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন তার কারণ তিনি মনে করতেন, সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হলো সাম্রাজ্যবাদেরই আরেক নাম। দেশপ্রেম কিন্তু দেশের সমস্ত মানুষকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেয়। জাতীয়তাবাদের মতো দেশপ্রেম কখনো মানুষের মাঝে পার্থক্য খুঁজে বেড়ায় না। আগেও বলেছি, দেশপ্রেম অনেক বেশী দেশের মানুষ বা মানবপ্রেম সম্পৃক্ত, তাকে মানচিত্র দিয়ে ভাগ করা যায় না।
    রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ভারত এক জাতি রাষ্ট্রই নয়, ভারত বহু সম্প্রদায়ের দেশ। এ দেশে জাতীয়তাবাদ অপেক্ষা দেশপ্রেমের গুরুত্ব অনেক বেশি। আবার ১৯০৮ সালে তাঁর বন্ধু আনন্দমোহন বসুকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘দেশপ্রেম আমাদের চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক আশ্রয় নয়। আমি হীরার মূল্য দিয়ে কাঁচ ক্রয় করব না। যতদিন বেঁচে আছি মানবতার উপর দেশপ্রেমকে ছড়ি ঘোরাতে দেব না। জাতীয়তাবাদ হলো বিশাল এক হুমকি। এটাই বছরের পর বছর ধরে ভারতের সমস্যার মূল কারণ।’ স্পষ্টতই তিনি জাতীয়তাবাদের ওপর দেশপ্রেম আর দেশপ্রেমেরও ওপরে মানবতাকে স্থান দিয়েছিলেন।


    এখানে যে গল্পটা বলছি, গল্পটা অনেকেই জানেন। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে দেশপ্রেমের এই গল্পগুলি আজকাল খুবই শুনতে পাওয়া যায়। যদিও যার গল্প আজ বলছি, তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হত সে সময়, তাঁর দেশের নাম কী? নিশ্চিত করেই বলা যায় না, সে কী এর উত্তর দিত! অন্তত ভারত বা ভারতবর্ষ তো নয়ই। যাইহোক এখানে আমি শুধু মূল গল্পটাই বলব। ১৬শ শতকের প্রথমদিকের কথা। মেবারের রাণা ছিলেন বিক্রমাদিত্য। এ তখনকার কথা, যখন বংশমর্যাদাই ধর্ম, ঈশ্বর। তার উপর রাণা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী শিসোদীয় বংশের সন্তান। প্রথম থেকেই রাণা ছিলেন দুর্বিনীত ও উদ্ধত। বিক্রমাদিত্যের মা, মহারাণী কর্মবতী পুত্রের ব্যাবহারে খুবই অসন্তুষ্ট হতেন। এ গল্পের মূল চরিত্রের নাম কিন্তু পান্না। পান্না ছিল রাণী কর্মবতীর খুবই কাছের, তাছাড়া তিনি রাণীর কনিষ্ঠ পুত্র উদয়ের ধাই-মাও ছিলেন। পান্নার নিজেরও উদয়ের সমবয়সী একটি ছেলে ছিল, তার নাম চন্দন। যাই হোক, যে কথা হচ্ছিল, গুজরাটের বাহাদুর শাহ, রাণা বিক্রমাদিত্যকে যুদ্ধে হারিয়ে দিলেন। কিন্তু যে সামন্তপ্রভুরা রাণার হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতেন। তাই দ্বিতীয়বারের জন্য যখন বাহাদুর শাহ আবার মেবার আক্রমণ করতে অগ্রসর হলেন, সামন্তপ্রভুরা সব বেঁকে বসলেন যে, তাঁরা কেউ আর রানাকে সাহায্য করবেন না। রানী কর্মবতী তখন উপায়ান্তর না দেখে সব সামন্তপ্রভুদের এক এক করে চিঠি লিখলেন। লিখলেন, "আমি জানি বিক্রমাদিত্যের আচরণে আপনারা ক্ষুব্ধ। আপনাদের চিতোরকে সাহায্য না করতে এগিয়ে আসার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু আজ যদি মেবারে শিসোদীয় বংশের পতন হয়, যদি চিতোরের দুর্গে বহিঃশত্রুর পতাকা ওড়ে, তা কী আপনাদেরও পরাজয় হবে না? তা কী আপনাদেরও বংশমর্যাদার অবমাননা নয়?" সেই সঙ্গে রাণী আর একটা কাজ করলেন, রাখী পাঠালেন মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে। লিখলেন আপনার বহিন আপনার সাহায্যপ্রার্থী। মেবারকে রক্ষা করুন। এদিকে সামন্তরাজারাও রাণীর আবেদনে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে রাণীর আবেদনে সাড়া দিলেন, কিন্তু একটা শর্তে। বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে সামন্তরাজাদের সমবেত যুদ্ধে, বিক্রমাদিত্যের সর্বান্তকরণ অনুপস্থিতি। অর্থাৎ সোজা বাংলায় যুদ্ধে বিক্রমাদিত্যের নেতৃত্বকে অস্বীকার করলেন এই সামন্তপ্রভুরা। বিক্রমাদিত্য কিন্তু প্যাঁচে পড়ে এই শর্ত সুড়সুড় করে মেনেও নিলেন! তবে সম্ভবত তাঁর এই শর্ত মেনে নেওয়ার পিছনে ছিল রাণী কর্মবতীর প্রভাবশালী অভিভাবকত্বও। রাণী একরকম আদেশই করলেন, বিক্রমাদিত্যকে দুর্গ ছেড়ে চলে যেতে। সুতরাং বিক্রমাদিত্য, উদয় সিংহ এবং উদয়ের ধাত্রী-মাতা পান্না চিতোর ছেড়ে চলে গেলেন বুঁদিতে। পান্নার একমাত্র সন্তান চন্দনও থাকল ওঁদের সঙ্গে। কিছুদিনের ভিতর খবর এলো, রাজপুত সৈন্যরা সামন্তপ্রভুদের নেতৃত্বে যথেষ্ট লড়াই করেও শেষমেশ পরাজিত হয়েছে এবং রাণী কর্মবতী ‘জহরব্রত’ পালন করেছেন। ইতিমধ্যে অবশ্য মুঘল সম্রাট হুমায়ুন প্রেরিত মুঘল সৈন্যরা এসে পড়ায় বাহাদুর শাহ আবার চিতোর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। এখানে একটা বিষয় সকলকে লক্ষ্য করতে বলব, একজন মুসলমান সম্রাট সাহায্য করছেন এক হিন্দু রাণীকে। হিন্দু রাণীকে ভগ্নী-জ্ঞানে রক্ষা করছেন মুঘল সম্রা, যার রাজ্য হানা দিয়েছে একজন মুসলমান হানাদার। যাই হোক মূল কাহানীতে ফিরে আসি। রাণা বিক্রমাদিত্য ভাই উদয় সিংহ কে নিয়ে নিশ্চিন্তে ফিরে এলেন চিতোরে। ফিরে এসেই রাণা কিন্তু আবার দুর্বৃত্তদের পাল্লায় পড়লেন। এবারে তো রাণী কর্মবতীও নেই, সুতরাং অসৎ সঙ্গ হতে সাবধান করবারও কেউ থাকল না। শাসন তো দূর অস্ত। যাদেরকে এড়িয়ে চলা উচিত ছিল, তাদের নিয়েই চলতে শুরু করলেন রাণা। এই দুর্বৃত্তদের মধ্যে প্রধানতম ছিলেন বনবীর। বনবীরকে রাণা বিক্রমাদিত্যের পিতা রাণা সংগ্রাম সিংহ নির্বাসনেও পাঠিয়েছিলেন। আজ রাণা তাদেরকে নিয়ে বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিলেন। যারা চিতোরের শুভাকাঙ্ক্ষী, যারা চিতোরের প্রয়োজনে মেবারের হয়ে যুদ্ধ করেছে, বা ভবিষ্যতেও করবে, তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, ছদ্মবেশী শত্রুদের নিয়ে রাণার এখন রোজকার আমোদ-প্রমোদ। বনবীর কিন্তু সবসময়ই ছক কষছিলেন কীভাবে রাণাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। বনবীর স্পষ্টত বুঝেছিলেন, অভিভাবকহীন মেবারের সিংহাসন আর তাঁর মধ্যে একমাত্র বাঁধা নির্বোধ বিক্রমাদিত্য ও তাঁর ভাই উদয়।
    একদিন, সারাদিন শিকার করে সন্ধ্যায় উদয় আর তার সর্বক্ষণের সঙ্গী চন্দন বাড়ি ফিরে এসেই পান্নার কাছে খেতে চাইলেন। বলাই বাহুল্য এই যে মহলে উদয় সিংহ থাকতেন, রাণীর অনুপস্থিতে ধাই-মা পান্নাই ছিলেন মাতৃস্থানীয়া। তিনিই দেখা-শোনা করতেন কিশোর উদয়কে। সেদিনও ক্লান্ত দুটি সমবয়সী কিশোর উদয় ও চন্দনকে খাইয়ে ধাই পান্না রোজকার মতো পাশাপাশি দুটি পালঙ্কে ওদেরকে শুইয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর যখন পান্না নিজেও সারাদিনের কাজকর্ম করে ক্লান্ত, রাতের আহার করে শুয়ে পড়েছেন, এইসময় অন্তঃপুরের এক দাসী এসে খবর দিল যে, বনবীর রাণা বিক্রমাদিত্যকে হত্যা করেছে। দাসী রাজমণি জানাল, যখন সে বাসন মাজছিল তখন বারি (অন্তঃপুরের দূত) এসে তাকে খবর করে যে, সে দেখছে বনবীর উদ্ধত খোলা তলোয়ার দোলাতে দোলাতে, বিক্রমাদিত্যের শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছে। তখনও তাঁর তলোয়ার থেকে রক্ত ঝরে পড়ছিল আর বনবীরের মুখে ছিল ক্রুর হাসি। পান্না বিদ্যুৎগতিতে তাঁর পরবর্তী কর্মপদ্ধতি ঠিক করে ফেললেন। উদয়কে বনবীরের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। তৎক্ষণাৎ উদয়কে ঘুম থেকে নিঃশব্দে তুলে তাকে একটা ফলের ঝুড়িতে বসিয়ে দিলেন। তারপর ফল দিয়ে ঢেকে দিলেন উদয়কে। অন্দরমহলের চাকরদের বললেন পিছনের দরজা দিয়ে ঝুড়িটা বাগানের পথ দিয়ে বের করে দিতে এবং একটা নির্দিষ্ট স্থানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে। সম্ভবত তারপরই তাঁর মাথায় সেই অমোঘ চিন্তাটা এলো। বনবীর তো এখুনি আসবে এ কক্ষে, উদয়ের খোঁজ করতে! তিনি বাতায়ন দিয়ে দেখলেনও বনবীর শ্বাপদের ভঙ্গিতে দ্রুত তাঁদের মহলের দিকেই এগিয়ে আসছে। পান্না তৎক্ষণাৎ নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন তাঁর ঘুমন্ত কিশোর-পুত্রের দিকে। চন্দন! বুক ভেঙ্গে গেলেও দৃঢ়চেতা পান্না একটা চাদর টেনে মুখটা ঢেকে দিলেন চন্দনের। ততক্ষণে বনবীর পৌঁছে গেছে সেখানে। পৌঁছতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘উদয় কোথায়?’। পান্না দেখিয়ে দিলেন চাদর-ঢাকা চন্দনকেই। চন্দনকে তলোয়ারের এক আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন বনবীর। ভাবলেন, মেবারের সিংহাসনে বসবার শেষ কণ্টকটিকেও তিনি উপড়ে ফেলেছেন। যদিও সেই রাতে পালিয়ে যাওয়া উদয়, এক সামন্তপ্রভু কুম্ভলমীরের শাসক রাও আশা শাহর কাছে কয়েকবছর প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং অন্যান্য সামন্ত প্রভুদের সহায়তায় মেবারের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু সেই নৃশংস রাত্রিটির কথা আমি যখনই ভাবি, ভাবি এই দৃশ্যটির কথা, পান্না ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে নিজের সন্তানের মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন, আমি বুঝতে চাই তাঁর অন্তর্নিহিত মনস্তত্ত্ব! তাঁর চালিকাশক্তি! ঠিক কতখানি মানবিক বলা চলে এই দেশপ্রেম? নিজের অবুঝ (কোনো একদিন খেলতে খেলতে চন্দন তাঁর মাকে বলেছিল যে, সে মেবারের জন্য প্রাণ বিসর্জন করতে প্রস্তুত) ঘুমন্ত পুত্রসন্তানের প্রাণের বিনিময়ে রাজপরিবারের প্রতি এই যে আনুগত্য প্রদর্শন, একে তো অহিংসা বলে চলে না! নিজের সন্তানের প্রতি এই যে 'নিষ্ঠুরতা', এর সঙ্গে জাতীয়তাবাদের দূরত্বই বা কতটুকু? আজকাল যে অনার কিলিং-এর কথা শুনি তাও কী বস্তুত পারিবারিক সম্মান, জাত্যাভিমান, এই একই অক্ষাংশ বা দ্রাঘিমাংশ থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় না? এর সঙ্গেও কী জাতীয়তাবাদ আলগা ভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়? না, আমি এই সরল ধর্মপ্রাণ মানুষটির চরিত্রের বিশালতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করি না। বরং তাঁর অতুলনীয় 'দেশভক্তি' এবং স্বার্থহীনতাকে প্রণাম জানাই। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা এবং ন্যায়নিষ্ঠতাকে। তবে একথাও অস্বীকার করা যায় না, পান্নার সমসময়, তখনকার রীতি, ধর্মবিশ্বাস (মনিব, বিশেষত সেই মনিব যদি হয় রাজবংশীয়, তবে তো মনিবের স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করাও একপ্রকার ঈশ্বরসেবা, ধর্ম) প্রথা (জহরব্রত, সতী) ইত্যাদি নিশ্চয়ই 'সাহায্য' করেছিল পান্নাকে। সত্যি বলতে কী আজকের দিনে চরিত্রের এই বিশালতার কথা ভাবাও যায় না। কিন্তু চরিত্রের এই সরলরৈখিকতা আমাকে আক্রমণও করে। আমি আমার ঘুমন্ত শিশুকন্যার দিকে তাকাতে পারি না। ‘আমার পক্ষে অকল্পনীয়’ এই যে দেশপ্রেম, তা-কী মানবিক সম্পর্কের থেকে বড়, অন্তত এই বিশ্বনাগরিকত্বের দিনে? শুরু করেছিলাম, চেশোয়াভ মিউশের একটা পঙক্তি দিয়ে। শেষও করি তাঁকে দিয়েই, মিউশ লিখেছিলেন, "কোনো দেশকে ভালোবেসো না; দেশগুলো চট করে উধাও হয়ে যায়।" বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, এখানে দেশ মানে মানুষ নয়, দেশ নয়, জাতিসত্তা নয়, স্রেফ একটা পলিটিক্যাল এনটিটি, রাষ্ট্র। 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১২ আগস্ট ২০২১ | ১৯৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন