চোখে পাখি গেঁথে থাকা একটা আলো হুড়মুড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ল্যাংড়াবাড়ির ঘাসগুলোতে। এই সময় গাছের গায়ে লাঠা হয় খুব। সারি সারি লাল পিঁপড়া লাঠা পায়ে চলতে থাকে ঘাসের উপর। ঘাস চ্যাটচ্যাট হয়ে যায়। কেঁচো খেতে নামা পাখির ঠোঁট ঘাসে আটকে যায় কখনও, দু-এক সেকেন্ড। যুতসই মওকা বুঝে, উদবিড়াল পাখি মুখে গাছে চড়ে বসে। এইসব সময়েই আলো হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ল্যাংড়াবাড়ির ইতিউতি। যাদের কান ভালো তারা এসময় গাছেদের বাতচিত শুনতে পায় শুনশান আমের বাগান পেরোতে পেরোতে। আজ গাছেরা কথা বলছে না। কিংবা যে দুটি ছেলে, বাগানের ভিতর দিয়ে এমনভাবে পা ফেলছে যেন সাপের মতো বয়ে চলা সময়ের জিভ পার করে তারা আলজিভে ঢুকে পড়বে অন্য কোনো সময়ের, তাদের এখনও গাছেদের কথা শোনার কান পেতে বাকি আছে খানিক। উত্তর থেকে হাওয়া বওয়া বন্ধ হয়েছে দিন কয়েক আগে। দখিনা আর পছিয়ার আসতে আরও কয়েক দিন। এসময় গুড্ডি উড়াতে বেশ লাগে। ল্যাংড়াবাড়ির পাশের মাঠে গুড্ডি উড়াচ্ছিল ওরা। বাড়িতে বলে আসার সাহস পায়নি কেউই। হাইরোডে কেউ যেতে দেয় না আজকাল। মিলিটারিরা মার্চ করেছে নাকি দুদিন। এটা হাইরোডের উলটো দিক। একমাস ধরে শুক্রবারের হাট বসছে বাভণ পাড়ার ভিতরেই। ইস্কুলও বন্ধ অনেকদিন। চণ্ডীপুরের মসজিদের মাইক গরগর করা শুরু করলেই বড়দের কথা থেমে যাচ্ছে। আজান শুরু হলে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার গল্প শুরু করছে।
--- “চণ্ডীপুর নিয়ে ভয় নাই তেমন। কিন্তু ভবানীপুরটা খতরনাক। দ্বারবাসিনী চণ্ডীতলা নিয়েও ভয় আছে।”
--- “চণ্ডীপুরটা তো হাইরোডের ধারে। মিলিটারির ভয়েই আসবে না ওরা। কিন্তু ভবানীপুরটা আর দ্বারবাসিনী চণ্ডীতলা তো ল্যাংড়াবাড়ি দিয়ে বাগান কে বাগান ঢুকে যাবে ব্রাহ্মণপাড়ায়।”
---- “সাতশো বছর ধরে ঢোকে নি। এমনকি তিনদিন গোটা জেলা ইস্ট পাকিস্তানে থাকাকালীন ঢোকে নি। চৌষট্টিতে হজরাতবালের সময় কিছুই হল না। এখন এমন হতে পারে বলছো?”
----- “এই শোনো, সাতশো বছর দেখিও না। আর ওই তিনদিন ঢোকেনি সেরেফ শ্যামাপ্রসাদের ভয়ে, বুঝেছো? গলায় দায়ের কোপ খেলে তোমার এই একই গতে গেয়ে চলা সাতশো বছরেও তো চণ্ডীপুর, ভবানীপুর আর দ্বারবাসিনী চণ্ডীতলার নাম চেঞ্জ হলো না বেরিয়ে যাবে।”
---- “আতাউল কাকার দোকান কবে খুলবে? খবরের কাগজ দিয়ে গুড্ডি বানাতে ভালো লাগে না।”
----- “বাবু বাইরে যাবে না। ছাদে গিয়ে উড়াবে।”
----- “ভবানীপুরের মোমিনদের নিয়েই সবচেয়ে ভয় হে।”
--- “ওটার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।ভয়ের কিছু নাই। সি আর পি এফ। কাল রাতেই হয়ে গেছে। আমার ভায়রা তো ডি এস পি। ওই বললো।”
--- “দুর্লভপুরে কী হয়েছে গতবছর শুনেছো?”
---- “কী?”
----- “মহরমের তাজিয়া গেছে বামুনপাড়ার ভিতর দিয়ে! ভাবতে পারো!”
----- “পিসা, ওই খবরের কাগজটা দাও। তোমার বাম দিকে আছে।”
--- “যা চলছে, দুবছরের ভিতর এখান থেকেও বাস তুলতে হবে।”
--- “শালা !একটা মসজিদ ভাঙার জন্য এতগুলো প্রতিবাদ মিছিল বার করবে এরা!”
--- “তোরা যে কত মন্দির যে ভাঙলি সাতশো বছর ধরে!”
----- “সোভিয়েতের পতন! এইসবের জন্যই দায়ী সোভিয়েতের পতন। তুমি মিলিয়ে নিও সি আই এ ফাণ্ডিং।”
----- “আদবাণীই সিধা করতে পারে একমাত্র।”
---- “সামনের ইদেই দেখে নিও সিঁধিয়ে গেছে সব।”
--- “বাবা ইদ কবে? ইদে রাফুল্লিদের বাড়িতে পোলাও আর মুরগির ঠ্যাং খাওয়াতে নিয়ে যাবা বলেছিলা যে?”
খবরের কাগজ দিয়ে গুড্ডি বানাতে বানাতে জিজ্ঞাসা করে সে। তার কথা যেন কেউ শুনতেই পায় না। যেন পৃথিবীতে রফিউল বলে কাউকে থাকতে নেই। যেন তার বাড়িতে মুরগির ঠ্যাং খেতে তাকে যেতে নেই। কথা চলতে থাকে। নামাজের সময় আবার কান খাড়া। মাইক ঘড়ঘড় করছে। যেন এখনই ঘোষণা হবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফরমান। আজান ভেসে আসে অনেকদিনের চেনা সাদিকুল মণ্ডলের গলায়। আবার কথা। তার গুড্ডি তৈরি। তুরতুরে পা টিপেটিপে পেরিয়ে যায় এইসব কথার বার্তাদের। গুড্ডি আর লাটাই নিয়ে ল্যাংড়াবাড়ির মাঠ। পথে ফিসফিসে স্বরে ডেকে নেয় শাগরেদকে। গোটা মাঠে তারা দুজন। লাটাই থেকে সুতা খুলছে। গুড্ডিটা ধরে একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে শাগরেদ। ছেড়ে দিল। হাওয়া ধরেনি এখনও। গোঁত্তা। আবার খানিক সুতা খোলা। আবার খানিক পিছানো। গোঁত্তা। আর একটু সুতা খোলা। এবার হাওয়া পেয়েছে সে। একটু টাল খেয়ে হাওয়া ধরে নিল গুড্ডিতে। গুড্ডিটা এখন ল্যাংড়াবাড়ির বাগান ছাড়িয়ে উড়ছে। একটা ঝকঝকে নীল আকাশে খবরের কাগজ দিয়ে তৈরি সাদা-কালো দেহ ও লম্বাটে লেজ নিয়ে উড়ছে সে। লম্বা শিমুল গাছটার একদম উপরের ডালে বসে থাকা কয়েকটি দুধরাজ বকের চোখে ছায়া পড়ছে গুড্ডিটার। সেই ছায়ায় দেখা যায় গম্বুজের উপর শাবল-গাঁইতি নিয়ে উঠে পড়ছে কিছু লোক। হেলমেট পড়ে লাঠি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। একটা সুনসান রাস্তায় হাঁ করে চোখ স্থির হয়ে পড়ে আছে একটি লোক। “এক ধাক্কা অউর দো...” গায়ে নিয়ে উড়ছে গুড্ডি। বাতাস খুব জোর এখানে। হুউর টান লাগছে খুব। গুড্ডিটা কেটে গেল।
……… দে ছুট, দে ছুট......
সুতাটার যেন বুড়া বুড়া আমগাছগুলোর ফোঁকল গলে নিজের উড়ে যাওয়ার পরিধির শেষ সীমাটুকু জানার পুরকি চেপে বসেছে। আর পুরকিটা সে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের দুজনের ভিতর।
--- “আবে চোখ না আলুর ফাঁক! পিঁপড়ার ঢিপ দেখতে পাস না?” কেটে যাওয়া গুড্ডি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে চোখের তারায় বাসার দিক চিনতে না চাওয়া পাখি জুড়ে বসে। পাখি পিঁপড়া দেখতে পায় না। তাই জ্বলে উঠে পা। আমপাতা চিবিয়ে থেঁতো করে রস লাগিয়ে দেয়। ফের সুতোয় চোখ রাখা।
……… দে ছুট, দে ছুট......
খেয়ালেই আসে না পড়ে থাকা চিতিবোড়া সাপের থেঁতলে যাওয়া মুখে স্থির হয়ে থাকা চোখের বিপন্নতা, তরাস লাগা ঘাসে ভারী বুটের দাগ। মাটিতে মিশে প্রায় মাটি হয়ে যাওয়া বেলে পাথরের এক মূর্তি পুরানো এক বোম্বাই গোপালভোগ আমগাছের শিকড় থেকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ভোজবাজির মত ল্যাংড়াবাড়ির মাঠের মতই দেখতে আরেকটা মাঠ তাদের সামনে।
--- “ওই! ভুল্লার খপ্পরে পড়িনি তো? ল্যাংড়াবাড়িই ঘুরে ঘুরে আসছি না? ছোটকা জোলা কিন্তু পাশেই!”
এরা শুধু ভুল্লার গল্পই শুনেছে এর আগে। শুনেছে যে ভুল্লা অনেক বছর আগে পাঁকে ডুবিয়ে মারা খুনিদের ভূত। শুনেছে অনেক অনেক বছর আগে খুনিদের পাঁকে ডুবিয়ে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়া হত। সেই সব জীবন্ত কবর দেওয়া খুনিগুলোর ভূত হরেক রকমের ঘোর লাগিয়ে, হরেক রকমের নেশা হয়ে ফিরে ফিরে আসে। মাঝদুপুরে জলার ধারের আমবাগানে কেটে যাওয়া গুড্ডির সুতা ধরে এগিয়ে যাওয়ার নেশা হয়েও ফিরে আসে। সুতা ধরে এগোতে এগোতে মনে হয় এইবার কেটে যাওয়া গুড্ডিটা পেয়ে যাব। পেয়ে যাব সুতার শেষ। সুতো ধরে ধরে এগোতে এগোতে নিজেরাই কখন লাটাইয়ের সুতা হয়ে গেছে টের পাওয়া যায় না। সেই লাটাই ভুল্লার হাতে। গুয়ে পা পড়ছে তখন অথচ মানুষ ভাবে ফুল থেঁতলে এগোচ্ছে। পায়ে শামুকের খোল লেগে রক্ত ঝরছে, অথচ মানুষ ভাবে তার পায়ে মোলায়েম ভাবে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে কেউ। পলিতে প্রথমে পায়ের ঘুট্টি গেঁথে যায়, ভুল্লা ভাবায় নরম বিছানায় পা রাখছে ভুল্লার খপ্পরে পড়া মানুষ। হাঁটু গেঁথে গেলে মনে হয় পা শূন্যে, কোনো কষ্ট নাই আর। পেট অবধি কাদায় ঢুকে গেলে জিভে অপূর্ব সব স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে, এদিকে পেট খিদায় কাতর। তারপর বুক, নাক, চোখ। হাজার বছরের পাঁক মাখা সেই খুনির ভূত যখন দম বন্ধ করে আনে, তখন ছটপটানো মানুষ কোনোক্রমে রাম নাম নিতে চায়। ভুল্লা আরো জোরে চিল্লায় রামরামরামরামরাম বলে। খানিক বাদে পাঁকের নিচে জড়ো হয় আরেকটি মড়া। চোখ খোলা।
--- “হদ্দ্যাখ! ওরা কারা?”
--- “ভবানীপুরের মুসলা! দাড়ি দেখছিস না! প্যান্ট খুলে নুনু দেখবে। আগা কাটা নাই দেখে কেটে দিবে নুনু তারপর। কাকু বলেছে।”
---- “নুনু কাটে কেন?”
---- “আমরা নুনু কাটি না, তাই। মুসলারা আমাদের উলটা।”
--- “হদ্দ্যাখ! আমাদের গুড্ডিটা রে !”
ত্রস্ত পায়ে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে একদল মানুষকে আসতে দেখে গুড্ডিটা বোধহয় আসমানি জিরেত মাপা শেষ করেছিল। উপর থেকে ঠাওর করতে না পেরে মাটিতে নেমেছিল হয়ত।
--- “হ! রাফুল্লি! তুই এখানে!”
--- “হ! তোরা ! আজ ভাগতে ভাগতেই আম্মাকে বাতিয়েছি অম্লানদের বাড়িতেও নিশ্চয় মিলিটারি গেছে, তোদের বাড়িতেও কাল রাতে মিলিটারি ঢুকেছে, না ? চুলা, কড়াই সব ভেঙে দিয়েছে, না? তোর আম্মা কোথায়? তোদের বিচিতে লাথি মারে নাই মিলিটারি? আরে... তোদের গুড্ডি ওটা?”
--- “হ।”
--- “ছিঁড়ে গেছে তো! চল, আমগাছের লাঠা লাগিয়ে লেই। উড়াবো তারপর।”
--- “হ। হ।”
--- “মাঈ... একটু খাড়া। মাঈ গে ...একটু খাড়া। একটু গুড্ডি উড়ায়ে লি।”
এইসব সময় তেমন কান হলে গাছেদের কথা শোনা যায়।