বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে বড় একটা মাথাব্যথা দেখা যায় না আমজনতার। জ্ঞানের দৌড় ওই জগদীশ-প্রফুল্ল-মেঘনাদ আর ‘ঈশ্বরকণা’ আবিষ্কারের দৌলতে কিছুটা সত্যেন্দ্রনাথ অব্দি। তাও তাঁকে ‘বোসন’ কণা আবিষ্কারের ভুল কৃতিত্ব দিতে দেখা যায় অনেকের। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা, বা অন্যদিক থেকে দেখলে বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালির কৃতিত্ব এই আমলে অশোক সেনে এসে শেষ হয়েছে।
বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয় কিন্তু, দুশো বছর পেরিয়েছে কি না সন্দেহ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কিছুটা ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ছাপা হতে শুরু করল বাংলায় বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যবই, আর ওই শতকের মাঝামাঝি এসে আস্তে আস্তে বাজারে আসতে থাকল বিজ্ঞানভিত্তিক বইপত্তর। ওইসব বইপত্রে যে ভাষা বা বাক্যগঠন তা আজকের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল এটা সহজেই বোঝা যায়। তবু প্রথম যুগের ওই বইগুলির লেখকেরা বহু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নতুন নতুন বিষয়কে বাংলায় বোধগম্য করবার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। বহু অখ্যাত লেখকের পাশাপাশি, আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা পেয়েছিলাম দু’জন এমন ব্যক্তিকে, যাঁরা বাংলায় বিজ্ঞান-বইয়ের ভাষা বা রচনারীতি কেমন হওয়া উচিত, তার প্রামাণ্য নিদর্শন রাখতে এগিয়ে এসেছিলেন। প্রথমজন বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিতীয়জন অক্ষয়কুমার দত্ত।
তারপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে, বাংলা বিজ্ঞানবই খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব ভাষা। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বা জগদানন্দ রায়ের পাশাপাশি এই কাজে হাত লাগিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, কিছুটা জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র তো অনেকটাই, এবং চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য বা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতো গুণী মানুষেরা। আজকের দিনে, বাংলায় সর্বজনবোধ্য বিজ্ঞানের বই যে লিখিত হতে পারছে, সেই রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন এঁরাই।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার সংকলনের প্রথম পৃষ্ঠা
পাশাপাশি আর একটা দিক, বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা। পাশ্চাত্য অর্থে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম অবশ্যই সতেরো শতকের ইউরোপে, গ্যালিলিও, টাইকো ব্রাহে, কেপলার, জিওর্দানো ব্রুনো বা উইলিয়াম গিলবার্টের হাত ধরে। সেটাকেই এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন আইজ্যাক নিউটন আর রবার্ট হুক। কিছুটা ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনসও। তারপরে ওই সব দেশে বিজ্ঞান-রথ গড়গড়িয়ে চলতে থাকে। যার ফলশ্রুতি, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় আজ ওইসব দেশের চোখ ধাঁধানো উন্নতি। আমেরিকা কিছুটা পরে শুরু করলেও ইউরোপের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে এখন।
তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছি আমরা। মোটামুটি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের ধাঁচে বিজ্ঞান-চর্চা হতে শুরু করে। ‘ওঁদের’ মতো আধুনিক গবেষণা করে প্রথম যিনি দেখালেন যে ভারতীয়রাও বিজ্ঞান সাধনায় কিছু করে দেখাতে পারে, তিনি অবশ্যই জগদীশচন্দ্র। যদিও তিনি পরে সেই পথ থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ নিজের পথ গড়ে নেন, এবং মূল স্রোত থেকে সরে যাওয়ার ফলেই হয়তো, ক্রমে হারিয়ে যান বিজ্ঞান-জগত থেকে।
তার পাশাপাশি প্রেসিডেন্সির আর এক প্রখ্যাত অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায় তৈরি করেছিলেন নিজস্ব এক ছাত্রগোষ্ঠী, যাঁরা বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক শাসন করবেন ভারতীয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রটিকে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ বা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকবেন।
এঁদের পাশাপাশি কলকাতার প্রায় অখ্যাত এক বিজ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অব সায়েন্সে দিনের পর দিন গবেষণা করে এক তরুণ অধ্যাপক বিশ্বকে চমকিত করে দিলেন তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত তত্ত্বের সাহায্যের, যে আবিষ্কার তাঁকে এনে দিয়েছিল নোবেল পুরস্কার। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল এই কলকাতাবাসের দিনগুলি, ভারতবর্ষের বিজ্ঞান মানচিত্রে যা এক উজ্জ্বলবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
সব মিলিয়ে বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা এক বহুবর্ণ দৃশ্য, যাকে আজ পর্যন্ত সাদা পাতার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে খুবই কম। সেই প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে একটি আমার হাতে ধরা রয়েছে এই মুহূর্তে। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে এমন একটি বই নির্মিত হওয়া কত জরুরি ছিল এতকাল, এই বইটি পড়তে পড়তে মনে হতে বাধ্য।
বইটি প্রকৃত অর্থে পত্রিকা। বা বলা ভালো পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। আজকাল বিশিষ্ট কিছু লিটল ম্যাগাজিন নামে লিটল থাকলেও কাজে বা বহরে ‘লিটলত্ব’ পেরিয়ে আকাশ স্পর্শ করবার বাসনা আর চেহারা নিতে থাকে, এমনটা আমরা খুবই দেখতে পাই। ‘বলাকা’ নামে এই পত্রিকাটি এর আগে বেশ কিছু এমন জরুরি বিষয়কে ‘বিশেষ সংখ্যা’র বাঁধনে বাঁধার প্রয়াস নিয়েছে, এই সংখ্যাটি সেই তালিকায় উজ্জ্বলতম স্থান-ধারণ করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এই সংখ্যাটি এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে বেশ কয়েক বছর অপ্রাপ্য থাকবার পর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে একটি সম্পূর্ণ বই আকারে এই পত্রিকাটি সুলভ্য হয়ে ওঠে। তবে আরও ভালো ব্যাপার, পত্রিকাটির চেয়ে বইটি অনেক বেশি সম্পূর্ণ এবং আয়তনে বর্ধিত।
পত্রিকাটিতে ছিল চারটি পর্বে বিন্যস্ত সাঁইত্রিশটি গদ্য, বইয়ে রয়েছে ছেচল্লিশটি। পত্রিকায় প্রথম পর্বে যে ষোল জন বাঙালি বিজ্ঞানীর জীবন আর কাজ নিয়ে প্রবন্ধ ছিল, বইয়ে সেখানে আলোচিত হয়েছেন তেইশজন, পত্রিকার দুটি ইংরেজি গদ্যও বাদ পড়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালির গণিতচর্চা আর বিজ্ঞানচর্চায় বাঙালি মেয়েদের নিয়ে দুটি নতুন গদ্য। সম্পূর্ণতার দিকে এগোবার এগুলিই তো ধাপ।
পরের পর্বগুলিতে খুব বেশি গ্রহণ-বর্জন হয়নি। আর লেখক তালিকায় যেখানে স্বাতী ভট্টাচার্য, বিনয়ভূষণ রায়, সুবিমল মিশ্র, আশীষ লাহিড়ী, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য বা সুবীরকুমার সেনের মতো নাম, সেখানে এই কাজটি করাটাই তো অসম্ভব।
বইয়ের প্রবন্ধগুলি নিয়ে আলাদা করে কিছু কথা বলা যেতে পারে। বাঙালিদের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে যিনি বিজ্ঞানের কোনও বিষয় নিয়ে চর্চা করে সাহেবদের সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছিলেন, তিনি ডিরোজিওর তরুণ ছাত্র, রাধানাথ শিকদার। বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁরই, এই সত্য প্রতিষ্ঠিত আজ।
রাধানাথ শিকদার, ভারতীয় ডাকটিকিটে
তাঁকে নিয়ে প্রখ্যাত ডাক্তার শঙ্করকুমার নাথের লেখা দিয়েই সংকলনটির শুরু। এরপরে আলোচনায় এসেছেন কলকাতার চিড়িয়াখানার প্রথম সুপার রামব্রহ্ম সান্যাল, খনিজবিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র, রাধাগোবিন্দ চন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চুনীলাল বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (তাঁর গণিত প্রতিভার নিদর্শন চাপা পড়ে গেছে শিক্ষাজগতে তাঁর অন্য অবদানের অন্তরালে, এই লেখায় সেই অনুল্লেখিত দিকটিই ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে), মনোবিদ গিরীন্দ্রশেখর বসু, শিশিরকুমার মিত্র, নীলরতন ধর, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেবেন্দ্রমোহন বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, গপালচন্দ্র ভট্টাচার্য— এরকম মানুষেরা। এঁদের কেউ স্বনামে বিখ্যাত, কেউ বা কিছু কম খ্যাত। তবু প্রত্যেকের প্রতিই সমান সুবিচার করা হয়েছে। তাঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনের পাশাপাশি লেখাগুলোয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে তাঁদের কাজের কিছু পরিচয়ও।
দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে বেশ কয়েকজন বাঙালি চিকিৎসাবিদদের জীবন আর কাজের কথা। প্রথম শবব্যবচ্ছেদকারী মধুসূদন গুপ্ত বা যদুনাথ মুখোপাধ্যায়-এর পাশাপাশি আলোচিত হয়েছেন প্রায় অখ্যাত কেদারনাথ দাস বা সতীশচন্দ্র মিত্রও। আর কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারের কল্যাণে যে নামটি বাঙালির কাছে সুপরিচিত, সেই উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী তো আছেনই।
তৃতীয় পর্বে রয়েছে ছয়টি গদ্য, যেখানে নজর দেওয়া হয়েছে উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক বই আর পত্রপত্রিকার ওপরে। আর চতুর্থ পর্বের নয়টি গদ্যের অভিমুখ বাঙালির বিজ্ঞানসাধনায় বিশিষ্ট মনীষীদের ভূমিকা এবং বিজ্ঞানচর্চায় বাঙালির গুরুত্ব ও অবস্থান নির্ণয়ের দিকে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে লিখেছেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনা নিয়ে সাধন চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথেরই বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে আরও একটি গদ্য অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের, জগদানন্দ রায়ের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে লিখেছেন সুজিতকুমার বিশ্বাস, অক্ষয়কুমার দত্তকে নিয়ে আশীষ লাহিড়ী, বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে লেখাটি অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের।
সংকলনের সামগ্রিক ভাবনাটি একটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই সংকলনের সম্পাদক ধনঞ্জয় ঘোষাল, এবং ‘বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার রূপরেখা’ নামে আরও একটি প্রবন্ধে সুবীরকুমার সেন। বিজ্ঞানচর্চায় বাঙালি বিজ্ঞানীদের সাফল্য আর খামতির জায়গাটা তাঁর লেখায় চমৎকার পরিস্ফুট হয়েছে।
আজকের দিনে বিশ্ববিজ্ঞানের মানচিত্রে বাঙালির স্থান বা অবদান, বলতে গেলে নামমাত্র। সাফল্য বা স্বীকৃতির একটি মাপরেখা হিসেবে যদি নোবেল পুরস্কারকে ধরা হয়, তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই দেশ, সন্দেহ নেই অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ভারতের চেয়ে অনেক কম জনসংখ্যাবিশিষ্ট দেশ জার্মানি বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পুরস্কার পেয়েছে আশিবার, শুধু পদার্থবিদ্যায় সাতাশবার। ছোট্ট দেশ অস্ট্রিয়া পদার্থবিদ্যায় এই পুরস্কার পেয়েছে তিন বার, ডেনমার্ক তিন বার, ইতালি চারবার।
আমরা মেঘনাদ সাহা বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অল্পের জন্য নোবেল না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করি, কিন্তু পাশাপাশি এটাও ভেবে দুঃখ পাওয়ারই কথা, হাল আমলে এই পুরস্কারের যোগ্য দাবীদার হওয়ার মতো মুখও খুব বেশি নেই এই দেশে, বাংলায় তো আরও অনেক কম। তবে সে প্রসঙ্গ আপাতত সরিয়ে রাখাই ভালো।
সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানচর্চায় যেটুকু যা দাগ কেটেছেন অন্তত স্বাধীনতার আগে অব্দি বাঙালিরা, সে ব্যাপারে জানবার জন্য এই বই খুবই উপযোগী। সকলের পড়ার মতো জরুরি এই ধরনের বই আরও লিখিত হোক, পঠিত হোক; এটুকুই আশা করে থাকা যেতে পারে।
প্রবন্ধ গুলি কি মুলত জীবন-নির্ভর নাকি তাদের বিজ্ঞানচর্চার বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে? জানতে চাই।
প্রবন্ধগুলির মধ্যে কোনওটিতে লেখকের জীবনের তথ্যাদির দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে, কোনওটিতে আবার পাশাপাশি কিছু কাজের বর্ণনাও রয়েছে। যেমন জগদীশচন্দ্র বা মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে লেখাদুটিতে তাঁদের কাজের কিছু কিছু উল্লেখ, ব্যাখ্যাসহ রয়েছে। প্রথম দিকের বেশিরভাগ গদ্যই চার-পাঁচ পাতা থেকে দশ বারো পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর এই পরিসরে তাঁদের কাজের কথা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ না।
ধন্যবাদ.