একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কী হয়েছে? কোটি কোটি মানুষ সার বেঁধে ডিজিটাল কালচারের অংশীদার হয়েছেন, ইন্টারনেটকে আপন করে নিয়েছেন অভূতপূর্ব গতিতে। ওবেরলো (OBERLO) পরিসংখ্যান জানাচ্ছে বর্তমান বিশ্বের ৬৩% মানুষ নাকি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তাতে হলটা কী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গত সাত-আট বছরে আতসকাচ হাতে বসেছেন বিশ্বজোড়া তাবড় চিন্তাবিদ। গত এক দশকে নানা আঙ্গিকে, দৃষ্টিকোণ থেকে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা; ছাপা হয়েছে প্রবন্ধ, বই, সংকলনগ্রন্থ। গবেষণার নতুন দিক সন্ধানে খুলে গেছে সাইবার-সাইকোলজি, ভার্চুয়েটিভ থিওরি ইত্যাদি সম্পূর্ণ নতুন বিদ্যাশাখা: জ্ঞাপনবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, আচরণগত মনস্তত্ত্ব, বাণিজ্য ও সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিভাগে একের পর এক নতুনতর জটিলতার আমদানি ঘটেছে। বলাবাহুল্য, আম-নাগরিকের গায়ে-মাথায় এইসব জটিল ভাবনার আঁচটুকু জারিয়ে দেওয়ার দায় অনুভব করেননি বিশেষ কেউ। অর্ক দেব, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও সিরিল স্যাম সম্পাদিত ‘ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ’ (গুরুচণ্ডালী, ২০২১) গা-ঝাড়া দিয়ে সরাসরি নেমে পড়েছে ময়দানে, আমজনতাকে রঙিন চশমা খুলে সিধে দৃষ্টির চিন্তাপথের শরিক করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে।
ফেসবুকের প্রধান কার্যালয়। মেনলোপার্ক, ক্যালিফোর্নিয়া
বইয়ের লক্ষ্য স্পষ্ট। মোট ৩০ টি স্বয়ংসম্পূর্ণ অধ্যায়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিসরে ফেসবুক কীভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার সরেজমিন তদন্ত। সাধারণত এতগুলো অধ্যায় দরকার হলে কয়েকটি পর্বে সেগুলিকে ভাগ করে নেওয়াই দস্তুর। কিন্তু এ রচনাগুলি সাজানো হয়েছে এমনভাবে যে তাদের মধ্যে এক স্পষ্ট ক্রমিক যুক্তি দেখা যায়। রচনাগুলি প্রায়ই উপসংহারে জানান দেয় পরবর্তী অংশে কী প্রত্যাশা করবেন পাঠক। এই এপিসোডিক চলন এ বইয়ের এক গঠনগত বিশেষত্ব। প্রথম কয়েকটি রচনায় পরপর ধূলাগড় (ডিসেম্বর, ২০১৬), বসিরহাট (জুলাই, ২০১৭) এবং তেলেনিপাড়া (মে, ২০২০)—তিনটি দাঙ্গাপরিস্থিতি তৈরিতে ফেসবুকের দায় কতটা, তা তথ্যসহ বিশদে দেখানো হয়েছে। পরের রচনায় পাওয়া যাচ্ছে ২০২০ সালে করোনা পর্বে পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে নানারকম গুজব ছড়িয়েছে তার একটি তালিকা। তালিকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা একই সাথে সমান্তরাল অনেকগুলি গুজবের উৎস, তাদের ছড়িয়ে পড়ার একটা মানচিত্র পেশ করে পাঠকের সামনে। এই সূত্রেই আলোচিত হয়েছে দিল্লির দাঙ্গায় (ফেব্রুয়ারি, ২০২০) ফেসবুক কীভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে সেকথাও। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কোনো অভিনবত্বের হদিশ দেওয়ার নিরীক্ষামনস্ক খেলায় আগ্রহী নন লেখক ত্রয়। বরং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেবে ঘটনাপরম্পরা এবং তার সূত্রে সমাজমাধ্যমগুলির প্রচ্ছন্ন অথবা প্রকাশ্য ভূমিকা তুলে ধরাই তাঁদের লক্ষ্য। একই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে পরবর্তীতে রোহিঙ্গা গণহত্যা, ‘ফিরে দেখা পুলওয়ামা’ ইত্যাদি অন্য অধ্যায়গুলিতেও।
পরপর এতগুলি ঘটনা ধরে বিশ্লেষণের পর খানিক বিরতির ছন্দেই আসে সম্প্রতি সারাবিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেওয়া, জেফ ওরলসকি নির্মিত তথ্যচিত্র ‘দ্য সোশাল ডিলেমা’ (২০২০) ছবিটির আলোচনা। যাঁরা তথ্যচিত্রটি দেখে উঠতে পারেননি এখনও, এবং যাঁরা দেখেছেন—দু-পক্ষই সমানভাবে চিন্তার উপাদান পাবেন এই রচনাটি থেকে।
এই লেখাটি মনে রেখেই পড়তে হবে ‘ফেসবুক: বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতার পথে যাত্রা’, ‘ফেসবুকের বিশ্বাসযোগ্যতা, আমাদের সংকট’ ইত্যাদি অধ্যায়গুলি। ২০০৩ সালে ফেসবুকে জন্মলগ্ন থেকে পরবর্তী দেড় দশকে তার সারাবিশ্বে একচেটিয়া রাজত্ব বিস্তারের পথে বিভিন্ন সময়ে উঠে আসা প্রশ্নগুলিকে একজায়গায় করেছে এই লেখাগুলি। গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, ডিজিটাল একচেটিয়াকরণের মতো বিষয়গুলি নিয়ে জরুরি কিছু প্রস্তাব উঠে এসেছে অনিবার্যভাবে।
বইয়ের অন্যতম ভরকেন্দ্র হল ‘ভারতে ফেসবুকের স্বাধীনতা: এক অলীক কুনাট্য’, ‘নরেন্দ্র মোদি এবং ফেসবুক: সম্পর্কের ভিয়েন’ এবং ‘ভারতে ফেসবুকের ব্যাবসার আয়তন বিষয়ে দু-কথা’—এই অধ্যায়ত্রয়। লেখকদের পর্যবেক্ষণে, “মুখে ফেসবুক যতই নিরপেক্ষতা দাবি করুক, ভারতবর্ষের দায়িত্বে থাকা ফেসবুকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বারবারই কার্যকলাপে প্রমাণ দিয়েছে শাসকঘনিষ্ঠতার।” এই অংশ থেকে লেখকদের পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রাযুক্ত হচ্ছে। নানাসূত্র, ফেসবুকের কোনো কর্তাব্যক্তির বয়ান, পোস্ট-কন্টেন্ট ভেদে কম অথবা বেশি রিচ, ফেসবুকে বিশেষ বিশেষ খবর বা চ্যানেলের ভিন্ন ভিন্ন রেটিং, ভিজিবিলিটি, নানা সমীক্ষা, রিপোর্ট, কেমব্রিজ অ্যানালেটিকা—ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন লেখকরা। কেন একটি নির্দিষ্ট পোস্ট বারবার ফিরে ফিরে আসে ফেসবুক ব্যবহারকারীর নিউজ ফিডে? তেমনি, কেন আচমকা কোনো একটি নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক দর্শকের সংখ্যা কমে যায়? বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রের শাসকদলের নেতার আত্মপ্রত্যয়ী মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে এই অংশে। কী করে এত গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলতে পারেন, “জনতাকে আমরা যেমন বার্তা দিতে চাই, তেমন বার্তা তৈরিতেই আমরা সমর্থ। সেই বার্তা… সত্য হতে পারে, অসত্যও হতে পারে?” কীভাবে একজন দেশনায়কের ভাবমূর্তি তৈরির উপাদান সরবরাহ করে সাধারণ মানুষের কাছে তারও যথাযথ উত্তর দেওয়া হয়েছে এই অংশের রচনাগুলিতে।
নরেন্দ্র মোদী ও মার্ক জুকেরবার্গ
পরের অধ্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকের প্রতি একগুচ্ছ প্রশ্ন। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এই ৬৪ টি প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ফেসবুকের কৈফিয়তও। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে বইয়ের শেষ অংশে বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে গুজব ছড়ানোর কল হিসেবে নানা ফেসবুক গ্রুপ, নমো অ্যাপ ইত্যাদির ভূমিকা। উদাহরণসহ দেখানো হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে কীভাবে ভুয়ো খবরের মাধ্যমে লাগাতার বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে আমজনতার মুখে মুখে। বইয়ের শেষ লেখার শিরোনামটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সামগ্রিক পরিস্থিতির এক করুণ ভাষ্য হিসেবে থেকে যায়, “আমার দু’হাত রক্তে ভরা, এক ফেসবুক কর্মীর জবানবন্দি”।
বস্তুত বইটি একদিকে যেমন গত তিন-চারবছরে বিশ্ব জুড়ে ফেসবুকের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে উঠে আসা অভিযোগ ও প্রশ্নাবলির ধারাবাহিকতার শরিক, তেমনই ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ফেসবুকের পর্দার আড়ালে থেকে সক্রিয় প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকাটিকে জনসমক্ষে আনার দিক থেকে স্বতন্ত্র। সম্ভবত বাংলা ভাষায় এই সামগ্রিক ভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার দিক থেকে এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থও বটে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই। সংগ্রহ করব।
এরকম একটা পাঠ-পর্যালোচনাই খুজছিলাম