শঙ্খ ঘোষের কবিতার স্বর আমাদের সহজেই স্পর্শ করে। তার করুণা-সংবেদনা, আবেগময়তা, তার বৌদ্ধিক বৈভব অপ্রতিম বলেই পরিচিত থাকবে। ওঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিন ডজন। এর মধ্যে ‘বাবরের প্রার্থনা’ ১৯৭৭ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পায়। উনি ‘সরস্বতী সম্মান’ পেয়েছেন, ২০১৬ সালে অলংকৃত হয়েছেন ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কারেও। তবে তাঁর পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কার এই যে, বাংলাভাষী সমাজে, এবং ভারতীয় সাহিত্যে এমনই একজন কবি ও লেখক হিসেবে তিনি সমাদৃত যিনি নিরন্তর এমনই সাহিত্য রচনা করে চলেছেন যার মানবিক সংবেদনাসিক্ত শক্তি এবং বৌদ্ধিক বৈভবের ধার অনন্য। এবং যার নৈতিক সমৃদ্ধি অনেকের কাছেই এক বিরাট সম্বল। তিনি পশ্চিমবঙ্গে যতটা পঠিত ততটাই বাংলাদেশে। ইংরেজি এবং বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। অন্যান্য ভারতীয় ভাষাতেও তাঁর কাব্যের কিছু কিছু অংশের তরজমা পাওয়া যায়।
তবে উনি একজন গদ্যকারও। এবং বিবিধ বিষয়ে তাঁর গদ্য বাংলা ভাষায় বড়ো সরস বড়ো সহজ ভাবে পরিবেশিত হয়। একদিন প্রতিদিনের অতি সাধারণ নানা কিছু থেকে জীবনের বিবিধ আশঙ্কা-আকাঙ্ক্ষার মর্মে প্রবেশ করেন তিনি। বইয়ের দুনিয়া নিয়েও তাঁর ভারী সরস একটি গ্রন্থ রয়েছে—বইয়ের ঘর।
সেটা পড়তে পড়তে মনের মধ্যে একটা নির্মল (এমনকি পবিত্র) ভাবও জেগে ওঠে। স্বভাবে তিনি একান্তে-থাকতে-ভালোবাসা মানুষ, অন্তর্মুখীও, তবে তাঁর বাড়িতে কিন্তু বরাবরই আড্ডা জমেছে, আর তাতে যে-কোনো পাঠাক ও সাহিত্যরসিক শামিল হতে পারেন। সভা-অনুষ্ঠানে তিনি পিছনের দিকে বসাই পছন্দ করেন। যদি কখনও কিছু বলেন, তবে তাকে ‘বিরল’ ঘটনা বলা যেতে পারে।
প্রায় পঁচিশ বছর আগে তাঁর দু-তিনটি কবিতার বাংলা থেকে (হিন্দিতে) তরজমা করেছিলাম। আর তার জন্য ওঁর অনুমতি চেয়েছিলাম। জবাবে সুন্দর একটা চিঠি পেলাম। সঙ্গে তরজমার অনুমতি। এরপর ১৯৮৩ সালে ভারতভবনের একটা প্রকল্পে অদ্ভুত একটা সুযোগ হয়ে গেল—ওঁর মুখোমুখি হওয়ার। উনি কলকাতা থেকে ভূপাল এলেন, আমি পৌঁছোলাম দিল্লি থেকে। সেবার দিন পনেরো ভূপালে ছিলাম। প্রত্যেক দিন ওঁর সঙ্গে বসে ওঁর কবিতার তরজমা করতে থাকলাম। আমার কাছে সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। নিজের কয়েকটি বইতেও উনি এই ভূপালবাসের কথা লিখেছেন। একবার একসঙ্গে সাঁচী গিয়েছিলাম। সেবার শিল্পী জগদীশ স্বামীনাথন এবং কৃষ্ণ খান্নাও সঙ্গে ছিলেন। পরে তিনি এই সাঁচীযাত্রার উপর একটি কবিতাও লেখেন।
বাংলা ভাষায় এখনও তৎসম শব্দ প্রচুর ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এবং শঙ্খ ঘোষ তেমন শব্দকে সাধারণ আটপৌরে শব্দের পাশাপাশি এমন ভাবে ব্যবহার করেন যে তা থেকে এক অদ্ভুত ছটা প্রতিফলিত হয়। শব্দের মধ্যে পুরে দেওয়া ধ্বনির সাথে সাথে তা মর্মার্থের গুঞ্জন দিতে থাকে। তার আবার তৈরি হয় নানা স্তর, বিবিধ রূপ।
শিল্পী প্রয়াগ শুক্ল। নানা দেরাজে পুরোনো চিঠির ঝাঁপি। কার্ডবোডের উপর গাউশ।
জনাকীর্ণ কলকাতার পুরোনো গলিঘুঁজি রাস্তা, এসব যেমন তাঁর কবিতায় রয়েছে, তেমনই সেই মাত্রাতেই রয়েছে প্রকৃতির, পশুপাখির কাজ কারবারের গতিবিধিও। আর সেসব তাঁর কবিতায় আসে মানবিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত হয়ে। যেমনটা বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায় তাঁর এই কবিতাটিতে—
জ্যাম
ভালুকের পেটে ভালুকের থাবা।
স্থির হয়ে আছে কালের অসীম।
ঝুলে পড়ে আছে জিরাফের গলা
ঝাঁপ দিয়ে ওঠে জেব্রা ক্রসিং।
ঝটপট ক’রে ক’হাজার হাঁস
ছিঁড়ে নিতে চায় এ ওর পালক—
বাতুল দুপুরে ডুগডুগি নিয়ে
গান গেয়ে যায় ভিখারি বালক।
মাঝে মাঝে শুধু খসে পড়ে মাথা
কিছু-বাপুরোনোকিছু-বাতরুণ।
হাঁক দিয়ে বলে কনডাকটর:
পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন।
শিল্পী প্রয়াগ শুক্ল। স্কেচ। কাগজের উপর কালি-কলম
তাঁর কাব্যের পরিধি বিপুল ও বিস্তৃত। রাজনীতিতে তিনি কোনোদিনই ‘আমরা’ ‘ওরা’ বিভাজনের কোনো পক্ষেই থাকেননি। কিন্তু কবি ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর উচ্চতা এমনই যে, বিশেষ করে বাংলায় তাঁর কথা সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন উভয়কেই প্রভাবিত করে।
শিল্পী প্রয়াগ শুক্ল। কাগজের উপর জলরং
সব পাঠকের কাছেই তিনি এমনই প্রিয় যে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর নানা লেখা মাঝে সাঝেই কোনো না কোনো সাহিত্যপ্রেমী একত্র করে তাঁকে দিয়ে বলেন—এবার এগুলির একটা সংকলন করে ফেলুন। মানে, কবিতার টীকা-টিপন্নি-ব্যাখ্যার কোনো বই করলে কেউ যেন সেগুলিকে ভুলে বাদ না দিয়ে দেন! আবার তিনি যদি কখনও নিজের কোনো লেখা খুঁজে না পান, তবে তা খুঁজে এনে দেওয়ার মানুষেরও কোনো কমতি নেই। ওঁর সঙ্গে কিছু সময় কাটানো নানা দিক থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। বছরে, কী ছ-মাসে, একবার কলকাতা গেলে তাঁর বাড়িতে কিছুটা সময় কাটানোর চেষ্টা অবশ্যই করে থাকি।
উনি মানুষটি ‘গম্ভীর’। তবে নিকটজনেরা জানেন, হাসি-ঠাট্টার গুণটিও তাঁর বিলক্ষণ রয়েছে। (এ গুণটা খুব শালীনতার সঙ্গে তাঁর লেখালিখিতেও প্রতিভাত হয়)। শঙ্খ ঘোষ বিশ্বসাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক। তাঁর একটা কাজ, সৃষ্টিশীল কাজ, শিশুদের জন্য লেখালিখিও। ১৯৯৪ সালে বাংলার বিশিষ্ট ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকা তাঁর উপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে ছিল তাঁর লেখালিখি নিয়ে বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের লেখা। অনুষ্টুপের এই সংখ্যায় ওঁর নিকটতম বন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেছিলেন শঙ্খবাবুর নানা গুণের কথা। তার মধ্যে একটা ছিল কর্তব্যবোধ। তা কবিতা লেখার কাজে হতে পারে, অধ্যাপনার কাজে, কিংবা মানুষের প্রতি কর্তব্য, কিংবা নিজের পাঠকদের সঙ্গে একটা মানবিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে। আসলে তাঁর কৃতিত্ব আর ক্রিয়াকাণ্ডের তালিকাটা খুব লম্বা। যেমনটা আগেই বলেছি, শিশু-কিশোরদের জন্যও তিনি ছড়া-কবিতা লিখেছেন।
শেষ করব আর-একটি কথাই বলে—শঙ্খ ঘোষের কবিতার মূল বাংলার রীতিনীতি, বাংলা কবিতার পরম্পরা, এবং বঙ্গভূমির গভীরে প্রোথিত। তবু, একথা আরও একবার মনে করে নিতে চাই যে, তাঁর কবিতার আবেদন সীমিত নয়। কোনো বিশেষ অঞ্চল, বিশেষ প্রেক্ষিত, বিশেষ রেফারেন্সের মধ্যে বেঁধে ফেলা যাবে না তাঁর কবিতাকে। খুব উন্নত অর্থে তাঁর কবিতা ভারতীয় কবিতা। সর্বজনীনও। নীচের কবিতাগুলি এর সুনিশ্চিত প্রমাণ—
ঘর-২
যে চায় তাকে আনিস
যে চায় তাকে আনিস
যে চায় তাকে আনিস ডেকে আনিস—
ঘরের কাছে আছে অনেক মানুষ।
যে যায় দূরে অনেক দূরে অনেক দূরে-দূরে
অনেক ঘুরে-ঘুরে
যে যায় তাকে আনিস ডেকে আনিস ঘরে আনিস
ঘরের কাছে আছে ঘরের মানুষ!
মেঘের মতো মানুষ
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ওই এক মেঘের মতো মানুষ
ওর গায়ে টোকা দিলে জল ঝরে পড়বে বলে মনে হয়
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ওই এক মেঘের মতো মানুষ
ওর কাছে গিয়ে বসলে ছায়া নেমে আসবে মনে হয়
ও দেবে, না নেবে? ও কি আশ্রয়, নাকি আশ্রয় চায়?
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ওই এক মেঘের মতো মানুষ
ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনোদিন
হতে পারি মেঘ!
ভাষা
এই তো, রাত্রি এল। বলো, এখন তোমার কথা বলো।
কিন্তু বলবে কোন ভাষায়? না, এই পুরোনো ক্ষয়ে-যাওয়া কথা তোমার ঠোঁটে
ধোরো না—সেই তোমার ঠোঁটে, যাকে দেখেছিলুম মলিন মেঘের মতো ঝিমিয়ে
থাকতে, কিংবা উথলে উঠতে ঝোড়ো রাতে পদ্মার মত্ত ভালোবাসায়, না—তোমার
সেই ঠোঁটে তুলে নিয়ো না কত জন্মের এই ব্যবহৃত ভাষা, জীর্ণ, উচ্ছিষ্ট।
বলবে কোন ভাষায়? যে ভাষায় বাচাল প্রকৃতি চিৎকার করতে থাকে আমার
চোখের সামনে, তার সব রং একত্রে এসে ঘুলিয়ে দেয় আমার আনন্দের স্বাদ,
‘সরে যাও’ ‘সরে যাও’ বলে দৌড়ে বেড়ায় অন্তরাত্মা, না সেই দারুণ প্রকৃতির
রহস্য তুমি তুলো না তোমার ঠোঁটে?
এই পৃথিবী না থাকলে থাকত শুধু অন্ধকার। কিছুই থাকত না এই সৌরলোক
না থাকলে। কিন্তু কোথায় থাকত সেই না-থাকা, কোন পাত্রে? অন্তহীন এই নাস্তি
যখন হাহা করে এগিয়ে আসে চোখের উপর, দুলে ওঠে রক্ত—তখন তুমি কথা
বলো মহাশূন্যে অন্ধকারের ফুটে ওঠার মতন, সেই তোমার ভাষা হোক প্রথম
আবির্ভাবের মতো শুচি, কুমারী—শষ্পের মতো গহন, গম্ভীর
এই তো, এই তো রাত্রি হলো। বলো, এখন তুমি কথা বলো।
শিল্পী বালমুকুন্দ। বিহারের পাটনা নিবাসী নবীন কবি বালমুকুন্দ হিন্দি ও মৈথিলি ভাষায় লেখেন। প্রয়াগ শুক্ল-র তরজমায় শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে বিশেষ করে এই সংখ্যার জন্য পোস্টারটি তৈরি করে পাঠিয়েছেন বালমুকুন্দ। জানিয়েছেন প্রবীন কবিকে তাঁর প্রণাম।
প্রয়াগ শুক্ল কবি, কথাকার, শিল্পসমীক্ষক, প্রাবন্ধিক এবং তরজমাকার। দ্বিজদেব সম্মান, শরদ জোশী সম্মান, শ্রীনরেশ মেহতা বাঙ্ময় সম্মান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ হিন্দিতে তরজমার জন্য সাহিত্য অকাদেমি-র অনুবাদ পুরস্কারে ভূষিত। প্রয়াগ শুক্ল হিন্দিতে তরজমা করেছেন শঙ্খ ঘোষের কবিতা। সেই সংকলনের নাম ‘মেঘ জ্যায়সা মনুষ্য’। এই লেখাটি সে বইয়েরই ভূমিকা। লেখকের সঙ্গে পরামর্শ করে সামান্য কিছু রদবদল করা হয়েছে। লেখার তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। এই নিবন্ধের সঙ্গে ব্যবহারের জন্য তাঁর নিজের আঁকা তিনটি ছবি বিশেষ করে পাঠিয়েছেন তিনি।
হিন্দি থেকে তরজমা: নীলাঞ্জন হাজরা
শঙ্খ ঘোষের ছবি সৌজন্য : সন্দীপন চক্রবর্তী ও ফেসবুকের ‘শঙ্খ ঘোষ পেজ’
সম্পাদনা : নীলাঞ্জন হাজরা