মেয়েমানুষদের মাইকেল ২
(প্রমীলা -প্রসঙ্গ)
ঝোড়ো হাওয়া যেমন আপন খেয়ালে মাটির বুকে ঝরা পাতার কলমে দু একটা অনুভবের আঁচড় কেটে যায়, তেমনি বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম মধুকবি' র কালজয়ী মহাকাব্য 'মেঘনাদ বধ কাব্য' সম্পর্কে দু একটা অনুভব। কিন্তু লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছিল, এ যেন কিছুই নয়। মধুকবির নিদাঘ এমনই প্রখর যে একটি বৃষ্টিবিন্দু মাটিতে পড়তে না পড়তেই মাটি তাকে শুষে নেয়। তার সিক্ত সূক্ষ্ম অভিঘাত কতটুকুই বা...
তাই মনে হয়েছিল আরও সহস্রধারা লেখার কথা কিন্তু কোন পথে আসবে তারা... ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না, কিন্তু অবশেষে সে পথ খুলে গেল একটি প্রশ্নের অন্বেষণে..
প্রশ্নটি এরকম-
প্রমীলার মতো এমন এক বীরাঙ্গনাকে কবি নির্মাণ করলেন, এ কথা ঠিক। 'নারী' বলতেই যে যে বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়সাধক এক ব্যক্তিত্বের কথা আমাদের মনে আসে, প্রমীলা তার থেকে অনেকটাই আলাদা। রীতিমতো 'পুরুষোচিত'। তাহলে প্রশ্ন এই, মধুসূদন তাঁর মানসকন্যাকে পতির সঙ্গে সহমরণে পাঠালেন কেন?
এখন এই প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম যখন, মাথার মধ্যে আরও অনেক প্রশ্ন জেগে উঠল। সেই প্রশ্নগর্ভা প্রশ্নকে খুঁড়তেই খুঁড়তেই উল্টে পালটে দেখলাম পৌরাণিক অভিধানের পাতা, রাজশেখর বসুকৃত রামায়ণের অনুবাদ। তাতে যা উদ্ধার হল-
প্রমীলা সর্বক্ষেত্রেই মেঘনাদের স্ত্রী। এইই তাঁর পরিচয়। মেঘনাদের মৃত্যুর পর তাঁর পরিণতির কথা আলাদা করে কোথাও উল্লেখ করা নেই।মধুকবি আদিকবির এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে প্রমীলাকে পাঠালেন পতির সঙ্গে সহমরণে। কিন্তু কেন?
কারণ প্রমীলার মতো বীরাঙ্গনার এর চেয়ে বীরোচিত মৃত্যু এবং তাঁর মতো প্রেয়সীর এহেন প্রেমলীন সমাপ্তি আর কোন পন্থায় সম্ভব ছিল না।
নবম সর্গে ইন্দ্রজিৎ হত হওয়ার সংবাদ নিয়ে সরমা এলেন অশোক-বনে সন্ত্রস্ত সীতার কাছে। এখন সাতদিন কেউ অস্ত্রধারণ করবে না। সমস্ত লঙ্কা বিষাদ - সিন্ধুতে নিমজ্জিত। রাবণের প্রিয়তম পুত্রের প্রেতকার্য সম্পন্ন হবে এবং...
'দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী -
বিদরে হৃদয়, সাধ্বি, স্মরিলে সে কথা!
প্রমীলা সুন্দরী ত্যজি দেহ দাহস্থলে
পতির উদ্দেশে সতী, পতিপরায়ণা
যাবে স্বর্গপুরে আজি!
এখানে সরমার কথার মধ্যেই প্রমীলার বৈরাগ্যময়ী রূপটি ফুটে উঠেছে। এ যেন মরণ নয় ;পতির উদ্দেশে সতীর যাত্রা অন্ত্যমিলের চরিতার্থতায়।
কিন্ত এই বৈরাগ্যেও তাঁর বীরোচিত দীপ্তি এতটুকু ম্লান হয়নি। নবম সর্গেও প্রথমে তিনি বড়বা অর্থাৎ ঘোটকীতে আরোহণকারিণী যোদ্ধাবেশী বীরাঙ্গনা।
'প্রমীলার বীরবেশ শোভে ঝলঝলে
বড়বার পৃষ্ঠে,- অসি, চর্ম্ম, তূণ, ধনুঃ
কিরীট, মণ্ডিত, মরি অমূল্য রতনে! '
আবার চলন্তিকায় দেখছি 'বড়বা' পুরাণোক্ত অগ্নিমুখী সমুদ্রঘোটকীও বটে। বড়বা'র পৃষ্ঠে বসেছেন প্রমীলা। ইন্দ্রজিৎ বিহনে যে অন্তহীন দুঃখের আগুনে পুড়ছেন তিনি, সেই শোকানলই যেন তাঁকে চিতানলের দিকে বয়ে নিয়ে চলেছে।
এরপরেই অবশ্য তাঁর বেশভুষা -ভঙ্গী পরিবর্তিত হতে দেখি
'সুবর্ণ- শিবিকাসনে, আবৃত- কুসুমে,
বসেন শবের পাশে প্রমীলা সুন্দরী
মর্ত্ত্যে রতি মৃত কাম সহ সহগামী!
ললাটে সিন্দুর- বিন্দু, গলে ফুলমালা,
কঙ্কণ মৃণালভুজে ; বিবিধ ভূষণে
ভূষিতা রাক্ষসবধূ।'
এই যে বেশবাস ও পট পরিবর্তন- এ যেন তার অন্তঃকরণে এক আবেগ থেকে আরেক আবেগের পরিবর্তনের দ্যোতক। তাঁর সেই 'রোষাবেশ' ঝরে গেছে। পতি বিহনে প্রমীলার শোক তাঁকে টেনে নিয়ে গেল পতির প্রতি অনুরাগের অন্তচূড় অবধি। চূড়ায় পৌঁছোতেই তিনি দেখলেন বৈরাগে আকাশ ছেয়ে গেছে।
সংরাগ থেকে বৈরাগে পা রাখলেন তিনি। এরপরে আমরা দেখব এই বৈরাগই তাঁর মনের মধ্যে কেমন একটু একটু করে বিকশিত হচ্ছে।
মুখচন্দ্রে তাঁর যে জ্যোতি সর্বদা প্রতিভাত হোত, সে জ্যোতি আজ কিছুমাত্র নেই। মধুর - অধরের সেই সুচারু হাসি তাঁর কোথায় হারাল?
'মৌনব্রতে ব্রতী বিধুমুখী-
পতির উদ্দেশে প্রাণ ও বরাঙ্গ ছাড়ি
গেছে যেন যথা পতি বিরাজেন এবে!
শুখাইলে তরুরাজ ; শুখায় রে লতা,
স্বয়ম্বরা বধূ ধনী।'
অর্থাৎ 'প্রমীলা' আর নেই। শুধু তাঁর দেহটাই পড়ে আছে। তিনি তো যেখানে তাঁর পতি আছেন, সেখানেই গেছেন। তিনি তো 'সহগামী'। শুধু 'খোল'টা ছাড়ার অপেক্ষা..
উদাসীন মৌন প্রমীলা পৌঁছলেন সিন্ধুতীরবর্তী শ্মশানে। স্নানপর্ব চুকলে ' বিবিধ ভূষণে ভূষিতা রাক্ষসবধূ ' গা থেকে একটা একটা করে গয়না খুলে বিলিয়ে দিলেন দৈত্যবালাদের মধ্যে।
'অবগাহি দেহ
মহাতীর্থে স্বাধ্বী সতী প্রমীলা সুন্দরী
খুলি রত্ন - আভরণ বিতরিলা সবে।'
''মধুরভাষিণী' প্রমীলা গুরুজনদের প্রণাম সেরে দৈত্যবালাদের বললেন যে এতদিনে তাঁর জীবলীলা সাঙ্গ হল, সেকথা তাঁর পিতাকে তারা যেন জানিয়ে দেয়। তারপর-
'বাসন্তি! মায়েরে মোর"-হায় রে, বহিল
সহসা নয়নজল। নীরবিলা সতী;-
কাঁদিল দানববালা হাহাকার রবে।
'মুহুর্ত্তে সংবরি শোক...'
হায় রে, মায়ের কথা মনে হতেই তাঁর চোখ থেকে জল পড়ল।নীতিবাগীশ দার্শনিকরা বলবেন, এইতো! এই ক্ষণিকের অশ্রুমোচনই তো তাঁর বীরোচিত বজ্রকঠোর ব্যক্তিত্বে কোমল অপ্রতিভ মরচেটুকু মিশিয়ে দিল। কিন্তু আমরা রসিকজন জানি, ভাগ্যিস এই 'সহসা'টুকু ছিল, নইলে প্রমাণ কি করে হোত যে তিনি অসামান্যা হলেও রক্তমাংসের প্রতিমা। তাঁরও সুখ - দুঃখবোধ আছে। কতটুকুই বা বয়স তাঁর! যৌবন- নিকুঞ্জে পাখির কলস্বর শোনার বয়স যাদের, সেই বয়সে অগ্নিরথে হিমায়িত যাত্রায় বেরোতে হল। নিশ্চয় মনে সাধ ছিল তাঁর, একদিন তিনিই হবেন লঙ্কেশ্বরী। লঙ্কেশ্বর হবেন তাঁর প্রাণেশ্বর। সন্তান- সন্ততি নিয়ে জীবন বিছিয়ে দেবেন- কিন্তু ফুল না ফুটতেই ধরণীতে ঝরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সেই 'শান্তিময় শূন্য পরিণামের' কথা অনুধাবন করে 'সহসা' দু ফোঁটা নয়নজল যদি বয়েই যায়, সে অবকাশটুকুও তাঁকে দেওয়া যাবে না! বরং এটাই লক্ষ্যণীয় যে কীভাবে নিজেকে মহীয়সী গাম্ভীর্যে মুহুর্তে সংবরণ করে নিয়ে বললেন, মা'কে তোমরা বোল, মেয়েকে যার হাতে তারা সঁপেছে মেয়ে এখন তাঁর সঙ্গেই চলেছে তা । 'পতি বিনা অবলার কি গতি জগতে?'
এই আত্মনিবেদন, স্বর্বস্ব - সমর্পণের সঙ্গে যদি আমরা সহমরণ প্রথাটির তুলনা করি, তাহলে আঘাত পেতে হবে।
পিতৃতন্ত্রে নারীর দুই কাজ- রমণ ও সন্তান উৎপাদন। একজন বিধবা, যিনি 'অফিশিয়ালি' এই দুটোর কোন কাজেই পারঙ্গমা নন, সেই বোঝা বা আপদকে দুবেলা ডাল-ভাত খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখে বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিই বা বাড়বে? তাই তাকে অধর্মের ভয় দেখিয়ে স্বর্গসুখের লোভ দেখিয়ে আফিম খাইয়ে স্বামীর চিতায় তুলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মতো বর্বরতার সঙ্গে প্রমীলার চিতারোহণের তুলনা করলে তা প্রমীলার ভালবাসার চরম অপমান হবে। কতখানি অপমান হবে এখানে তার প্রমাণ দিই
'চিতায় আরোহি সতী (ফুলাসনে যেন!)
বসিলা আনন্দমতি পতি - পদতলে ;
প্রফুল্ল কুসুমদাম কবরী- প্রদেশে।'
কতখানি আন্তরিক উজাড় থাকলে চিতাকে ফুলাসন মনে হয়! খোঁপায় ফুলরাজির মতো মৃত স্বামীর পদতলে আনন্দমতি হয়ে বসা যায়!
কেন জানি না চিতায় বসা 'আনন্দমতি' প্রমীলার মুখে আরেক দুঃখিনীর ছায়া গাঢ় হয়ে আসে।
কার্থেজের রাণী দিদো। রোমান মহাকাব্য ঈনিডের নায়ক ঈনিস ভাগ্যতাড়িত সর্বহারা হয়ে দিদোর শরণ নিলেন। রাণী দিদো তাকে দিলেন আশ্রয়, ধন- সম্পদ, নির্ভরতা, সাহচর্য, প্রেম.. এক ঘন কালো মেঘ- মুহুর্তে আরণ্যক গুহায় প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে নিজের কাঁপনধরা দেহলতা দান করলেন ঈনিসকে।
এত কিছুর পরেও ঈনিস যখন কর্তব্যের তাড়নায় তাকে ছেড়ে চলে গেলেন, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বেছে নিলেন অগ্নিস্পর্শী পথ। অন্তঃপুরে চিতা প্রস্তুত করে ঈনিসের অস্ত্র, পোশাক, প্রতিকৃতি, বাসরশয্যা চিতায় নিক্ষেপ করলেন। গলায় ফুলের মালা, শিথিল বস্ত্রে সজ্জিতা কার্থেজেশ্বরী দিদো অতঃপর চিতায় উঠে তরবারি হাতে বলে উঠলেন,
'লো সহচরি, এত দিনে আজি
ফুরাইল জীবলীলা জীবলীলাস্থলে
আমার।... '
তারপর...
'ইরম্মদরূপে অগ্নি ধাইলা ভূতলে!
সহসা জ্বলিল চিতা।...'
সত্যিই প্রেমের চেয়ে মহতী মোহময়ী সর্বগ্রাসী চিতা আর কিই বা আছে সংসারে..যেখানেই প্রেম সেখানেই অগ্নিপরীক্ষার নির্মম ফাঁদ পাতা আছে, যাঁরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তাঁরা অবিস্মরনীয়া..
'আর কি কহিব সখি? ভুলো না লো তারে-
প্রমীলার এই ভিক্ষা তোমা সবা কাছে।'
'তারে' কি ভোলা যায়??
তামিমৌ ত্রমি