সোমব্রত সরকার দীর্ঘদিন ধরে সহজিয়া, বাউল, ফকির, অঘোরী, তান্ত্রিক, বৈষ্ণবদের নিয়ে গবেষণামূলক নিবন্ধ, গ্রন্থ লিখে যাচ্ছেন এবং তাঁর রচনা ক্ষেত্রানুসন্ধানের ফসলও। লিখিত গ্রন্থের পাঠ এবং তার সঙ্গে সরাসরি দেখা বা শোনার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। এই জন্য তাঁর লেখা আমাদের আগ্রহী করে তোলে। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থ ‘বিষ্ণুপ্রিয়া, নেড়ানেড়ি, বৈষ্ণবতন্ত্র’, এর ভিত্তি ‘নদীয়ামণ্ডল’। সোমব্রতর এই গ্রন্থ মূলত নদীয়ার বৈষ্ণবাদ পরবর্তী বৈষ্ণব যাপন সহজিয়া সম্প্রদায়, বাউল ফকিরদের নিয়ে। বৈষ্ণব গ্রন্থগুলির একটি বড়ো অংশ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম, তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভাবে ষড় গোস্বামীর বৈষ্ণববাদ। সহজিয়া বৈষ্ণবদের সাহিত্য নিয়েও বিস্তর আলোচনা আছে। এবং কোথাও কোথাও গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের গ্রন্থগুলির সঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণবদের তত্ত্বগুলি সমান্তরাল ভাবে দেখানো হয়েছে আর বাউলফকিরদের তত্ত্ব দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে।
নবদ্বীপে চৈতন্যদেব ও বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর যুগল মূর্তি
চৈতন্যদেবের দ্বিতীয়া পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া, গৌড়ীয় বৈষ্ণবমণ্ডলে অনেকটাই অবহেলিত— এটাই সোমব্রত দেখিয়েছেন। তুলনায় নিত্যানন্দী পত্নী জাহ্নবা দেবী বৈষ্ণব মণ্ডলে আরও গুরুত্ব পেয়েছেন। সেই অর্থে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর শিষ্যমণ্ডলীর কথা খুব একটা জানা যায় না। চৈতন্যভক্ত বংশীবাদনকে দিয়ে তিনিই প্রথম চৈতন্যদেবের নিমকাঠের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করান, সে মূর্তি আজও নবদ্বীপে পূজিত হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী চৈতন্য-বিষ্ণুপ্রিয়া যুগল মূর্তির আরাধনা শুরু করেন রাধাকৃষ্ণ যুগল মূর্তির প্রতিরূপে। আসলে বাঙালি চৈতন্যদেবের প্রাক্সন্ন্যাস রূপ পছন্দ করে। আর-এক দল পছন্দ করেন যুগল মূর্তি। খেতুরি উৎসবে রাধাকৃষ্ণের যুগলমন্ত্রে মূর্তিপূজার নির্দেশ মেনে নেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, বাঙালি বৈষ্ণবদের চৈতন্যপূজনের সঙ্গে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দ্বারা পরিকল্পিত কৃষ্ণপূজনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছিল (রমাকান্ত চক্রবর্তী, ১৯৯৬)। এসব ঘটনা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর মৃত্যুর পরে। যদিও তাঁর মৃত্যুর সঠিক সময় জানা যায় না। পরবর্তী কালে ‘শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া-গৌরাঙ্গ’ পত্রিকায় (ভাদ্র, ১৩৩৩, পৃষ্ঠা ২৪৫) যুগলমূর্তি নির্মাণ, তার শিল্পী, যুগলমূর্তির চিত্র ব্যাপারে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
সোমব্রতর বক্তব্য বিষ্ণুপ্রিয়ার জীবিতকালে তিনি অতটা গুরুত্ব পাননি, নিভৃতেই কেটেছে তাঁর বাকি জীবন। ‘কী সুধা শাটির দ্বারে, বিষ্ণুপ্রিয়া কি নাইরে’ নিত্যানন্দকে দিয়ে শুরু করে রসসাধনার দিকে আলোচনাকে নিয়ে যাচ্ছেন সোমব্রত। সহজিয়া বৈষ্ণব ধারা কথা চলে আসছে এবং সেইসঙ্গে পরবর্তী কালে বৈষ্ণবদের কিছু পুথি থেকে এবিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সহজিয়ারা বৈষ্ণব মহাজনদের নাম নিয়ে নিজেদের তত্ত্ব লিখতেন, এইসব বৈষ্ণব সাধুদের বিষয়ে সহজ সাধনা সাধনসঙ্গিনী দেহগত সাধনার বিষয়ে ব্যাখ্যা করতেন। এঁদের তত্ত্ব অনুসারে, সার্বভৌম কন্যা শাটি ছিলেন চৈতন্যদেবের সাধনসঙ্গিনী। চৈতন্যদেবের সময় বাংলায় বৌদ্ধ, শাক্ত, তন্ত্রাচারের ধর্ম বহাল তবিয়তে প্রচলিত। সোমব্রত এইসব সাধন প্রথার বিবরণ দিয়ে লিখেছেন এসব সাধনার উত্তরাধিকারী হলেন বৈষ্ণব সহজিয়ারা (পৃ- ২২)। এরপর বলা হয়েছে নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্র-মাধবী বিবির কথা, সহজিয়াদের গুপ্ত সাধনার কথা, পরকীয়া দেহসাধনার কথা।
একটি তথ্যবিভ্রাটে কিছুটা আটকে যেতে হয়। ৬৯ পৃষ্ঠায় সোমব্রত লিখেছেন, “চৈতন্যদেবের দেহান্তর হওয়ার কিছু আগেই দেহ রেখেছেন চৈতন্যপন্থী প্রাচীন ভক্ত বৃদ্ধ অদ্বৈত আচার্য।” কিন্তু চৈতন্যদেবের মৃত্যুকালে অদ্বৈত জীবিত ছিলেন। সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, তাঁর সময়কাল মোটামুটি ভাবে ১৪৫৪-১৫৫০ (পৃ-৪৪)। চৈতন্যদেবের মৃত্যুর খবরে ‘চৈতন্য স্মরণ করি আচার্য গোসাঞি (অদ্বৈত) নিরবিধ কান্দে আর কিছু স্মৃতি নাই’ (বৃন্দাবন দাস)—সুখময় মুখোপাধ্যায়ের ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম’, ১৯৭৪।
সহজিয়া পুথি/পুস্তক থেকে এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সোমব্রত যুগলভজন-এর সহজিয়া পদ্ধতি নিয়ে অনেকটাই আলোচনা করেছেন। দেহগত সাধনা এবং যৌনপদ্ধতি নিয়ে আলোচনাও অনেকটা বিস্তারিত। সহজ সাধনা বিষয়ে অনেকগুলি পুথি এখন সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এবিষয়ে আগেকার গবেষকদের থেকে এখনকার গবেষকরা আরও বেশি তথ্য উপাদান সংগ্রহ করেছেন। সোমব্রত গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনা, আচারের পাশাপাশি সহজিয়া এবং পরবর্তী অংশে বাউলফকিরদের অংশ তুলে ধরেছেন, পার্থক্যও দেখিয়েছেন। তবু কোথাও কোথাও মনে হয় এই দুই সাধনপ্রক্রিয়া যেন কাছাকাছি চলে আসছে। যোগ ও তন্ত্রের কিছু প্রক্রিয়া বাউল ফকির সহজিয়া বৈষ্ণবরা অনুসরণ করেন, এ গ্রন্থে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। বাউলফকিরদের দেহতাত্ত্বিক সাধনপদ্ধতিও আলোচিত।
সোমব্রত বইয়ের ১৬ পৃষ্ঠায় ‘বিলাস’ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করেছেন। এই অংশে লেখা হয়েছে, ‘মূল বইটি ১৬০০-১৬০১-এর ভিতরেই ছাপা।’ এটি ছাপার ভুল বা ভুল তথ্য, ওইসময় বাংলা বই ছাপার কোনো ব্যবস্থাই হয়নি।
১৮৭৬ সালে ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও থেকে প্রকাশিত ‘নবদ্বীপে মহাপ্রভুর সংকীর্ত্তন’ (ছবিসৌজন্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি)
চৈতন্য যুগের গুরুত্বপূর্ণ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধক ভক্তের কথা আলোচিত হয়েছে। বৈষ্ণব আন্দোলনকে বাংলায় অবস্থানকালে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভাঙতে চেয়েছেন জাতপাতের বেড়া, কিছু ব্রাহ্মণ্য সংস্কার যা মানুষকে ছোটো করে রেখেছিল। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বৈষ্ণব সাধকদের তিনি ঐক্যবদ্ধ করে রাখতে পেরেছিলেন। এই চৈতন্যপন্থা দলে দলে মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। নিম্নবর্গীয়কে দিয়েছিল সাহস। নবদ্বীপ নগর পরিক্রমা করে সংগীত বাদ্য সহকারে কাজির বাড়ির সামনে প্রতিবাদ সম্ভবত বাংলার প্রথম অসহযোগ, অহিংস আন্দোলন। নিম্নতম বর্ণ এবং মুসলমানদেরও কাছে টেনে নিয়ে তিনি সেযুগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মানুষের মধ্যে নতুন মানবিক চেতনার সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে বলেন, এটাই বাংলার আসল রেনেসাঁস। ভারতের প্রায় সর্বত্র তখন ভক্তি ও সন্ত আন্দোলন চলেছে। চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন একান্ত ভাবে বাঙালির, যদিও চৈতন্যদেব সর্বভারতীয় সাধকদের অনেকের সঙ্গে বা সাধনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু চৈতন্যদেব বাংলায় বেশিদিন থাকলেন না। প্রবীণ বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈত আচার্য ‘বার বার আচণ্ডালে প্রেম বেলানোর কথা বলেছেন’ (পৃ- ৬৯)। এর সঙ্গে যোগ দিলেন নিত্যানন্দ এবং আর অনেকে। নিত্যানন্দ বাংলার অব্রাহ্মণ এবং নিম্নবর্গকে বৈষ্ণবদের দলে টেনে নিলেন। এই তিনজন ছিলেন তিন প্রধান, যদিও এঁদের সঙ্গীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। চৈতন্যদেবের কালে এবং তাঁর মৃত্যুর পর বৈষ্ণব সংগঠন বৃদ্ধির কথা সোমব্রত তুলে ধরেছেন তাঁর নিজের ব্যাখ্যায়। প্রধান বৈষ্ণবদের শাখাপ্রশাখা বিষয়েও তাঁর আলোচনা মনোজ্ঞ।
দ্বিতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে ‘নিতাই কারে ফেলে যাবে না’ অধ্যায়টি দিয়ে। সোমব্রতর বিচারে বাস্তবিক একটি ফেনোমেনা হয়ে ওঠার নামই ‘নদীয়ামণ্ডল’। আর তা যদি আমরা মেনে নিই তবে এটাও মানতে বাধ্য “নদীয়ামণ্ডলের মণ্ডলেশ্বর হলেন নিত্যানন্দ প্রভু, চৈতন্য প্রভু কখনও কোনোভাবেই এই নদীয়ামণ্ডলের মহামণ্ডলেশ্বর হতে পারেন না” (পৃ-১১৫)। মন্তব্যটি বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে, পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিজাল বোনা যেতে পারে।
সোমব্রতের মন্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজবিজ্ঞানী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কথা—“তিনি (নিত্যানন্দ) হিন্দু বাংলার প্রথম সমাজ-বৈপ্লবিক ছিলেন”, বৈষ্ণব সাহিত্য সমাজতত্ত্ব, পৃ-২৭ (১৯৪৫)। নিত্যানন্দের এই সমাজবিপ্লবে বাংলার সামাজিক পরিবর্তন হয় এবং এই রক্ষণশীলতার বেড়া ভাঙা অনেকদিন বজায় ছিল। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রও নেড়ানেড়িদের (কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ তখনও বাংলায় ছিলেন, এঁরা অধিকাংশই সহজিয়া ছিলেন) এবং আরও নিম্নবর্গকে বৈষ্ণব ধর্মের দিকে টেনে আনেন। এভাবে রক্ষণশীল এবং উচ্চবর্গ শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে বঙ্গীয় জনসাধারণ সচেতন হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু বেশিদিন আর এই সমাজবিপ্লব চালু থাকল না। নিত্যানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী জাহ্নবা দেবী ও পুত্র বীরভদ্রের মতভেদ হয়। বীরভদ্র চলছিলেন সমাজ পরিবর্তনের পথে। আর জাহ্নবা দেবী বৃন্দাবন ঘুরে রক্ষণশীল গৌড়ীয় বৈষ্ণবপন্থাকে অবলম্বন করেন। ফলে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য ও জাতিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রক্ষণশীল বৈষ্ণবদের সঙ্গে জাত বৈষ্ণব, সহজিয়া বৈষ্ণবদের ব্যবধান বেড়ে ওঠে, কোথাও কোথাও মারপিটের খবরও পাওয়া যায়। তারাপদ সাঁতরা একটি পুথির পাটার কথা লিখেছেন, যেখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণবদের (ঘুষি বাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া) লড়াই-এর ছবি আঁকা হয়েছে। যেসব নিম্নবর্গের মানুষ বৈষ্ণব ধর্ম নিয়েছিল তারা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল। এইসময় শাক্ত ও বৈষ্ণবদের ঝগড়া মারপিটের কথাও জানা যায়। রামপ্রসাদের গানে শাক্ত ভক্তিবাদ প্রসারিত হল, এইসব ঝগড়াঝাঁটির বিরুদ্ধে রামপ্রসাদের ঐক্যবার্তা বাংলায় জনপ্রিয় হল।
সোমব্রত বাংলাদেশের মরমি লেখক ফরহাদ মজহারের রচনা থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেছেন। ফরহাদ মজহার ‘ভাবমণ্ডল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং এই ভাবমণ্ডল নিত্যানন্দ থেকে বাউল ফকির মরমিয়া সাধনার সম্পর্ক নিয়ে সোমব্রতর বিস্তারিত আলোচনা আছে। নিত্যানন্দের পরই সোমব্রতর গ্রন্থে লালন ফকিরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘নদীয়ামণ্ডলে’। সেইসঙ্গে আরও যে সম্প্রদায়গুলি বাংলায় গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে গৌরনিতাইয়ের বৈষ্ণববাহ্যর সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা আছে। বাউল ও ফকিরদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা তাঁর তথ্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
লালন ফকির। স্কেচ: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শ্রীরাধাতত্ত্ব নিয়ে ষড় গোস্বামীর মত বঙ্গীয় বৈষ্ণব মত এবং সহজিয়া মত এই তিনটি দিক নিয়েই আলোচনা রয়েছে। প্রসঙ্গত চলে এসেছে রাধাতন্ত্র নিয়ে আলোচনা। এবং সেই বিষয়েই অধ্যায় ‘রাধারানির ঋণের দায় গৌর এসেছে নদীয়ায়’। এখানে সোমব্রতর বক্তব্য ‘নদীয়ায় রাধারানি হয়ে উঠেছিলেন আর এই হয়ে ওঠার পেছনে মুখ্য ভূমিকাটি ছিল মহাপ্রভুর (পৃ-১৩৯)।’ রাধারানি বৃন্দাবনে পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকলে যেটা হতে পারেননি, কীভাবে নদীয়ায় সেটা সম্ভব হল। এই অধ্যায়টিতে ও পরের দুটি অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে। রাধা প্রসঙ্গের অধ্যায়গুলির শেষ হয়েছে সোমব্রতর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণের উপসংহারে, “পুরুষতন্ত্রের কামবাসনা, ঈর্ষাভারে ঘুরে মরছেন তাঁরা। তবে রাধার মতো স্বাধিকারের লড়াই ভাবসাধনার মাতৃমণ্ডলেও বর্তমান তা এঁদের ভেতর (সাধক-সাধিকা-আলোচক) প্রায় একযুগ কাটিয়ে ফেলে আজ বুঝতে পারি।” (পৃ-১৫৯)।
পরের অধ্যায় ‘গৌর কি আইন আনিলে নদীয়ায়’ লালন ফকিরের পদটির অংশ নিয়ে। চৈতন্যের বৈষ্ণববাদ এর সঙ্গে লালন ফকির ও পরবর্তী কয়েকজন ফকির ভক্তের ভাবগত সংযোগের কথা আলোচিত হয়েছে। ‘সদর দরজা’ অংশের আলোচনায় লালন শাহ নিজের ঘর ছাড়া আরও চারটি ঘর—সতী মা, পাঞ্জু শাহ, উজল চৌধুরী, দোলদার শাহের ঘরকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সেপ্রসঙ্গে আলোচনা, এখানে লালন কীভাবে গৌরকে তাঁর আনা আইনকে দেখেছেন, সেসব বিষয়ে বিশ্লেষণ।
সহজিয়া বাউলফকিরদের যৌনচিন্তা, যৌনবিকৃতি নিয়ে যে ধারণাগুলি আমাদের সমাজে প্রচলিত সোমব্রত তাঁর গভীরে গিয়ে তাঁর অবস্থানটি দেখিয়েছেন, ‘সমস্যা আমাদের মতো গবেষকদের। যারা ভাব বুঝিনি, বুঝিনি অভেদ। না বুঝে কারণহীন হয়ে এসবের চর্চা করছি (পৃ-১৮৩)।’ এখানেই আমরা সোমব্রতর কৃতিত্বের কথা না বলে পারি না; পাঠ, ক্ষেত্রসমীক্ষা, ব্যক্তিগত আলোচনা, পর্যাপ্ত পরিক্রমা করে অনেক জটিল বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, ভেঙেছেন ভ্রান্ত ধারণা। এই বইতে আমরা পাব আরও নতুন তথ্য, জটিল সব তত্ত্বের আলোচনা, সহজ ভাষায়। কিছু কিছু জায়গায় আমরা একমত না হলেও বইটির, বহুপঠিত হোক বাংলার সংস্কৃতি চর্চায় এই নতুন সংযোজন।