বাংলা সিনেমার তথা ভারতীয় সিনেমায় Trio-র প্রথম নামটি অনিবার্যভাবে সত্যজিৎ রায় এবং বাকি দু'জন মৃনাল সেন ও ঋত্বিক কুমার ঘটক।এই তিনজনকে নিয়ে আলোচনা করতে বাঙালি যতটা স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ বোধ করে, তেমনটাই করে খুব জনপ্রিয় বাণিজ্যসফল অতি বাজে, বাজে এবং মাঝারি মানের ছবিগুলোকে নিয়েও । বিষয়টা একটু খোলসা করেই বরং বলা যাক । ওই প্রথম ত্রয়ীর সিনেমা নিয়ে আলোচনা করার সুবিধে বিস্তর কারণ তাত্ত্বিকতার যাবতীয় ঢাল তরোয়াল হাতে নিয়ে, টেকনিক্যাল টার্মিনোলজির সুনিপুণ ব্যবহারে রায়, সেন এবং ঘটক এই তিন মায়েস্ত্রোকে চুলচেরা বিশ্লেষণে মেধাবী আলোচনায় অভ্যস্ত আমরা । ব্যক্তিগতভাবে সিনেমা সংক্রান্ত প্রচুর পত্রিকা পড়েছি এবং সেমিনারে থেকেছি এবং সবার মতো আমিও সেসবে মুগ্ধ হয়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি, কিন্তু পাশাপাশি এও ভেবেছি যে -আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনার পরিধি কি তবে ওই তিনজনেই আটকে থাকবে?এটা কি এক ধরনের সীমাবদ্ধতা নয়! আর যেসব জনপ্রিয় সিনেমাগুলোকে নিয়েও আলোচনা হয়েছে, ন্যায্য কারণেই সেসবে ভ্রু-কুঞ্চন এবং নাকসিঁটকানো মিশিয়ে আলোচনা হয়েছে ! দ্বিতীয় জায়গাটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কারণ খুব সহজ। সেসব বস্তাপচা ফর্মুলা ছবিগুলোর প্রসঙ্গ এসেছে নেহাতই তুলনামূলক আলোচনায় । তাহলে ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়াল! ওদিকে ঐ মেধাবী ত্রয়ী আর এদিকে ফর্মুলা ছবি, মাঝের জায়গাটা, মানে যে জন আছে মাঝখানে, সেটা মিসিং লিঙ্ক এর মতো আমাদের আড্ডা থেকে, চায়ের কাপ থেকে, পত্র-পত্রিকার, পাতা থেকে, সেমিনারের বিষয় থেকে সিম্পলি 'ভ্যানিস' । আমিও তো গা ভাসিয়েছি সেই প্রবাহেই,ফলে গল্প লেখার পাশাপাশি সামান্য সিনেমাপ্রেমী হিসেবে যখন সিনেমা সংক্রান্ত কোনো আলোচনা কিংবা লেখার জন্য আমন্ত্রণ পাই , আনন্দ হয় তো বটেই এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিষয় নির্বাচনের সিদ্ধান্তে বিলম্ব হয় না, আমার বা উদ্যোক্তা কোনো পক্ষেরই ।এবং হ্যাঁ, সেইসব বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন ওই ত্রয়ীর কোনো একজন কিংবা তিনজনই, সে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক না কেন । এই লেখার বিষয় ভাবনাতেও সেরকমটাই চলে আসছিল কিন্তু যিনি লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন সেই বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনিক কথোপকথন -কালে তিনি খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বললেন অন্যরকম সিনেমা নিয়ে ভাবুন-এই বিষয়ে তো আরও লেখা থাকছেই!আমার দীর্ঘদিনের অভ্যস্থ ভাবনা কিঞ্চিৎ ধাক্কা খেল বটে কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হলো ঠিকই বলছেন সেই বন্ধু!বরং যেজন বা যাঁরা আছেন মাঝখানে, মানে অন্যরকম এক নির্মাণে তাঁদের বা তাঁদের সিনেমা নিয়ে কথা হোক বরং ।
বহুদিন আগে প্রিয় এক সাংবাদিকের লেখায় পড়েছিলাম একটি মেয়ের কথা । কোনো এক সিনেমা সংক্রান্ত সেমিনারের পর জে এন ইউ-এর এক তরুণী কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভীষণ কনফিডেন্টলি বলেছিলেন-ভারতীয় সিনেমার দুটো টার্নিং পয়েন্ট, এক ধরনের সিনেমায় 'পথের পাঁচালী', অন্য ধরণের সিনেমায় নিঃসন্দেহে 'শোলে' । এটাই হচ্ছে মেরুকরণ! তো সেই উচ্ছল যুবতীর মন্তব্যটি মানি বা না মানি, বিষয়টা আসলে এখানেই । হয় ঝিলকে ইসপার নয়তো উসপার । কিন্তু ইসপার আর উসপারের মাঝেও কিছু ছোট ছোট স্থলভূমি গড়ে ওঠে দ্বীপের মত খন্ড খন্ড কিছু জমি । অনেক সময় এপার-ওপারের মাঝে সেইসব স্থলভূমিগুলোই হয়ে ওঠে আমাদের ভালবাসার জায়গা, নিশ্চিন্ত এক আশ্রয় ।
সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের উত্তরসূরী হিসেবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, অপর্ণা সেন বা আরও পরে ঋতুপর্ণরা যখন আলোচনায় চলে আসেন, তখনও কিন্তু কিছুটা ব্রাত্যই রয়ে যান তপন সিংহের মতো কিছু পরিচালক! হ্যাঁ, তপন সিংহ হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি এপার আর ওপারের মাঝের সেই সবুজ, স্নিগ্ধ এক ভূখন্ড যেখানে রয়ে যায় অদ্ভুত এক ভালোলাগা এবং সে ভালো লাগা কেবলই এন্টারটেনমেন্টজনিত ভালো লাগা নয়, সে ভালো লাগায় রয়ে যায় চিন্তার কিছু স্পেস, শিল্পের কিছু অনিবার্য শর্তপূরণ! সম্ভবত 'দ্য হিন্দু' পত্রিকা তাঁর 'দাদাসাহেব ফালকে' পাবার পর তপন সিংহের সিনেমা নিয়ে লিখেছিল – 'Complex ideas through a simple narrative.....!' হ্যাঁ, সত্যি তিনি পারতেন। তাঁর ছবির সুদীর্ঘ তালিকা থেকে মাত্র একটি ছবিকে আলোচনায় আনতে চাই, উদাহরণ হিসেবেই, 'গল্প হলেও সত্যি'! কোনো এক আলাপচারিতায় তপন সিংহ একবার বলেছিলেন – 'আমার হতাশ লাগে এই ভেবে যে দর্শক ছবিটাকে শুধুই হাসির ছবি হিসেবে নিল'! একজন পরিচালক হিসেবে তো হতাশ হবারই কথা এবং ন্যায্য কারণেই। যারা সিনেমাটি দেখেছেন, আরেকবার ভাবুন তো, 'গল্প হলেও সত্যি' কি নেহাতই হাসির ছবি? নির্ভেজাল হাসি আর এন্টারটেইনমেন্ট? রবি ঘোষের অসামান্য অভিনয়ে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে বাঙালি দর্শকের কি একবারও মনে হয়নি, আপাত হাসির আড়ালে সিনেমাটির এক অন্তহীন স্পেস তৈরির কথা? প্রথম যখন 'গল্প হলেও সত্যি' দেখি, বয়েস নেহাতই কম। সেসময় নির্ভেজাল হাসি নিয়েই মুগ্ধ হয়েছিলাম কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন সিনেমাটা বেশ কয়েকবার দেখি, অনুভব করেছি একজন কুশলী পরিচালক কীভাবে তৈরি করেন ভাবনার স্পেস!ইংল্যান্ডের পাইনউড স্টুডিও থেকে সরাসরি কলকাতা, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থেকে পরিচালনায়, বাংলা সিনেমার দর্শক পেল এক পরিচালককে যিনি হেঁটে গেলেন মাঝের এক পথ বেয়ে। পাশাপাশি দু'টো পথেরই হাতছানি ছিল। বিস্তর আন্তর্জাতিক ছবি দেখার সুবাদে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ঘরানাগুলোর সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় পরিচয়, অন্যদিকে তথাকথিত আপাত জনপ্রিয়তার হাতছানিও ছিল। দুটো রাস্তাকেই সহজে এড়িয়ে মাঝামাঝির যে পথ তিনি বেছে নিলেন তাতে ঝুঁকি নেহাতই কিছু কম ছিলনা। 'গল্প হলেও সত্যি' দেখতে দেখতে তপন সিংহ সম্পর্কে সেই মন্তব্য বোধহয় ভীষণভাবে অনুভব করি – " A magical union of liberate art and critical populism made Tapan Sinha middle-of-the road – Bengali Cinema. যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে স্টোরিলাইন সেই ধনঞ্জয়ের আবির্ভাব থেকে সিনেমার শেষদৃশ্যে অদ্ভুত এক ধোঁয়াশার মধ্যে তার মিলিয়ে যাওয়া, পুরোটাই এক রহস্যময়তায় ঘেরা! কোথা থেকে এল ধনঞ্জয়, নানান প্রশ্নে তার হেঁয়ালি মাখানো উত্তর, একসময় চলেই বা গেল কোথায়, কোনো উত্তরই যনো প্রাত্যহিক বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনা, কিন্তু ভীষণভাবেই প্রাত্যহিকতায় গড়ে ওঠে এ কাহিনীর নির্মাণ, চরিত্র, আঙ্গিক!
কিছুদিন আগে বুনুয়েলের একটি লেখা পড়ছিলাম, এ প্রসঙ্গে বলা জরুরি, যে চারজন চলচ্চিত্র পরিচালককে বার্গম্যান তাঁর চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম নামটিই বুনুয়েল। তো সেই লুই বুনুয়েল তাঁর লেখার একজায়গায় বলছেন – ''ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছবি, আত্মকেন্দ্রিক মনস্তত্ত্ব এসব সেকেলে হয়ে গেছে। প্রদর্শিত সমস্যার সঙ্গে একাত্মবোধ না করলে দর্শক সেই ছবি নেবে না। শিল্পের প্রথম কথা হল রহস্য। তা কবিতার চেয়েও জোরালোভাবে সিনেমায় আনা যায়! তপন সিংহের 'গল্প হলেও সত্যি' থেকে সরাসরি শটজাম্প করে বুনুয়েলে যাওয়াটা আপাতভাবে অপ্রাসঙ্গিক বা 'ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল' মার্কা মনে হলেও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনাও রয়ে যায় অবশ্যই। 'ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছবি', 'আত্মকেন্দ্রিক মনস্তত্ত্ব' এসব প্রসঙ্গগুলো না এনেও বরং সেই রহস্যময়তার প্রসঙ্গে আসা যাক। 'শিল্পের প্রথম কথা হল রহস্য' – এই আপ্তবাক্যটিকে মেনে নিয়ে একটি কথা বলা জরুরি, 'রহস্য' মানে আক্ষরিক অর্থের বাইরে ভিন্নতর এক স্পেস তৈরি, যেখানে ছুঁয়ে থাকে যাদুবাস্তবতা। 'গল্প হলেও সত্যি' সম্পর্কে বলা যায় 'unique in its structure, feel of magic realism'! তথাকথিত 'আর্ট ফিল্ম' বা 'প্যারালাল সিনেমা' জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার না করেও বলা যায় তপন সিংহের এ ছবি কমার্সিয়াল সিনেমার অনেকটা দূরের সমান্তরাল এক পথ দিয়ে হেঁটেও ভীষণভাবে 'সার্বজনীন এবং সর্বত্রগামী'! অপরিণত মস্তিষ্কে প্রথমবার এ সিনেমা দেখার বহু বহু বছর পর যখন আবার আবার দেখলাম, নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম কীভাবে চিত্রনাট্য, ডায়ালগ, অভিনয়ের নিখুঁত মেলবন্ধন একটা সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়! ১৯৬৬ তে নির্মিত ছবিটির প্রেক্ষাপট এক একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত পরিবার। প্রাত্যহিক টানাপোড়েন, একান্নবর্তী পরিবারের অনিবার্য মনকষাকষির এক সংসারে ধনঞ্জয়ের আচমকা আবির্ভাব এবং সেই প্রাত্যহিকতার, টানাপোড়েনের ক্যাকোফনি থেকে কল্পরাজ্যের সিম্ফনিতে যে উত্তরণ, তা তো আসলে সেই সুররিয়ালিস্টিক স্ট্রাকচার! এ সিনেমায় গানের ব্যবহার শুধু কমই নয়, অতি কম কিন্তু 'এ জীবন গেলে ফিরে আসেনা আবার' তো সিনেমার মূল সুরটিই দিয়েছে বেঁধে। 'গল্প হলেও সত্যি' দেখতে দেখতে বার বার একটা কথা মনে হয়, শেষ দৃশ্যটা কি খুব দ্রুত, অনাড়ম্বর হলো? একটা গল্পের নির্মাণ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক সেসময় এতো কম কথায় এভাবে শেষ হয়ে যাওয়াটা কি সরলীকরণ নয়! কতটাই বা শিল্পসম্মত! চিন্তার নানান স্রোত, প্রতিস্রোতে শেষপর্যন্ত কিন্তু মনে হয় এটাই সেরা, এর থেকে নিখুঁত, শিল্পসম্মত, অব্যক্ত কিছু হতে পারত না! পরিমিতিবোধ এবং রহস্যময়তা, একজন কুশলী পরিচালক হিসেবে তপন সিংহ এই দুইয়ের সচেতন ব্যবহারই করেছেন!
আসলে বাংলা সিনেমায় তপন সিংহের আবির্ভাব সম্পর্কে বলা যেতে পারে – "Bengali Cinema had got its first artiste, and art cinema its first unrepentant entertainer. তাঁর আত্মজীবনী 'মনে পড়ে' পড়েছিলাম বহুদিন আগে! জেনেছিলাম দেশি বিদেশি বিভিন্ন বিখ্যাত সিনেব্যক্তিত্ব, পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর নানান অভিজ্ঞতার কথা! সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন দুজনেই কিন্তু ভাবনার পার্থক্য সত্ত্বেও তপন সিংহকে একজন শ্রেষ্ঠ 'middle-of-the-road' পরিচালক হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন! সত্যজিৎ রায় তপন সিংহের সিনেমাভাবনাকে যে যথেষ্ঠই গুরুত্ব দিতেন তার একটা ছোট্ট গল্প বলেই বরং এ লেখার ইতি টানা যাক। 'চারুলতা' রিলিজ করার পর তপন সিংহ সত্যজিৎ রায়কে ফোন করে বললেন – চারুলতা একেবারে ওভার বাউন্ডারি কিন্তু 'মহানগর-এ যে ছ'বলে ছ'টা বাউন্ডারি হয়েছে সেটা কিন্তু কেউ মনে রাখবে না। শুনে হো হো করে হেসেছিলেন সত্যজিৎ। বেশ কিছু বছর পর দু'জনেই রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান থেকে একই বিমানে পাশাপাশি বসে ফিরছিলেন। সত্যজিৎ রায় হঠাৎ তাঁকে বললেন "জানেন, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, সবাই 'চারুলতা'র কথা বলে, 'মহানগর' বোধহয় হারিয়েই গেল।"
এ প্রসঙ্গের অবতারণা আসলে তাঁর গভীর চলচ্চিত্রবোধ এবং ভাবনা সম্পর্কে বলার জন্যই। দর্শকের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন তিনি কিন্তু সেটা কখনোই শুধুমাত্র একজন এন্টারটেইনার হিসেবে নয়, এক্ষেত্রে চার্লি চ্যাপলিনের নামটা স্বত:স্ফূর্তভাবেই মনে এলো! শিল্পের যে কোনো মাধ্যমেই অনেকগুলো স্রোত বহমান। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। সেইসব মূল, সমান্তরাল ইত্যাদি নানারকম স্রোতের মাঝে তপন সিংহ বা চ্যাপলিনরা গুরুত্বপূর্ণ একটা স্রোত। বাঙালি তিন মায়েস্ত্রোর উত্তরসূরি হিসেবে যাঁদের নামগুলো উচ্চারিত হয়, সিনেমামেধা এবং দক্ষতায় তপন সিংহ তাঁদের থেকে কম তো ননই, বরং এগিয়েই। তো বক্স অফিস সফলতার জনমনোরঞ্জকারী সিনেমার হাতছানি এবং সেইসব সমান্তরাল ছবির প্রবল হাতছানি এড়িয়ে এন্টারটেইনমেন্ট এবং আর্ট-ফর্মকে মিশিয়ে অদ্ভুত এক ভারসাম্য রক্ষা করে সিনেমা বানানো নেহাতই ঝুঁকি নেওয়াই নয়, স্যাক্রিফাইসও বটে! দুদিকের প্রায় নিশ্চিত সাফল্যকে এড়িয়ে একের পর এক নির্মাণে মেতে ছিলেন তিনি। বেছে নিয়েছিলেন এক নিজস্ব ঘরানা। ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয় পরিচালকের নাম আঁন্দ্রেই তারকোভস্কি।একদম ভিন্ন ঘরানার এক পরিচালক, যাঁর সঙ্গে তপন সিংহের ঘরানার মেরুদূরত্ব কিন্তু এ লেখার ক্ষেত্রে তারকোভস্কির একটা কথা খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, অন্তত 'গল্প হলেও সত্যি' প্রসঙ্গে – "The artist exists because the world is not perfect. Art would be useless if the world were perfect, as man wouldn't look for harmony but would simply live in it. Art is born out of an ill-designed world". ঘরানার মেরুদূরত্ব হলেও কথাগুলো তপন সিংহ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। সেই ক্যাকোফনি থেকে সিম্ফনির যাত্রায় তিনি শেষপর্যন্ত এক অসামান্য শিল্পী।
শ্রী সরকার একটি জরুরী বিষয়টির উপরে আমাদের আলোকিত
করলেন। দেরীতে হলেও এটি একটি শুভ সংবাদ। একটি গদ্য তে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একদা আক্ষেপ করেন এমন মধ্যপন্থী বহু ভালো চলচিত্র পরিচালক বাংলায় থাকা সত্ত্বেও তাঁদের নাম পর্যন্ত আলোচনায় আসে না কেন !
লেখকের কাছ থেকে আসা করেছিলাম বিশ্লেষণ। তার বদলে পেলাম কিছু উচ্ছাসপূর্ন স্বগতক্তি। আর তপন সিংহ এর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করতে ভরসা সেই এপিল টু অথরিটি ফ্যালাসি, সত্যজিৎ রায় এর নাম স্মরণ। তাঁর একটা যুৎসই কোটও লেখক খুঁজে পেলেন না তপন সিংহ সম্পর্কে। দিনের শেষে হাতে রইল পেন্সিল।
বেশ আশা নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম, শেষ করলাম একরাশ হতাশা নিয়ে। বহু দিন আগে দেশ পত্রিকায় তপন সিংহ একটি অনবদ্য সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তাঁর প্রায় প্রত্যেকটা ছবি ধরে ধরে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, 'আমি কোনও ছবিতে নিজেকে রিপিট করিনি'। এই বাক্যটা তপন সিংহের সিনেমা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সিগনেচার টিউন হিসেবে ব্যবহার করা যায়
আপনজন বাদ গেল, হারমোনিয়াম বাদ গেল, এমনকি এক ডাক্তার কি মওত অবধি বাদ গেল। পড়ে রইল শুধু গল্প হলেও সত্যি। আর সত্যজিৎ সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার আগে, ছবি বিশ্বাস যখন কাবুলিওয়ালার জন্য পুরস্কার নেওয়ার জন্য বিদেশে - সেই সময়ে সত্যজিতের উল্লেখটা পড়ে নিতে অনুরোধ করব। বিষয় চলচ্চিত্র গ্রন্থে সেটা আছে।
লেখাটা ডিসাপয়েন্ট করলো। গল্প হলেও সত্যি অনেকবার দেখা, ডিটেল শট বাই শট আলোচনা এক্সপেক্ট করেছিলাম।
কাবুলিওয়ালা নিয়ে সত্যজিতের কোন কমেন্ট বিষয় চলচ্চিত্রে আছে? মনে পড়ছেনা।