একজন মাস্টারমশাই কখন ঠিকঠাক একজন মাস্টারমশাই হয়ে ওঠেন? না, যখন তিনি কথা বললেই সামনে বসা ছাত্রছাত্রীদের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, নিঃশ্বাস থেমে যায়, প্রতি পদেই আশ্চর্য ও অপ্রত্যাশিত কিছুর জন্যে তারা মুখিয়ে থাকে। তার মানে, তখন যেন তিনি একজন জাদুকর হয়ে যান, যে জাদুকর অজানাকে জানার সূত্র ধরিয়ে দেয়, কৌতূহলের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয় আর নানারকম আশ্চর্য ঘটনা ঘটানো যার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
এইবার ধরা যাক, একজন সত্যিকারের জাদুকর যদি মাস্টারমশাই হয়ে যান! আজ তেমনই এক মাস্টারমশায়ের কথা বলি, যাঁর নাম দীপক রায়চৌধুরী। তিনি আরও কিছু ভাল ভাবনা ফেরি-করা মানুষের মতই পরের প্রজন্মকে নিয়ে চিন্তা করেন। সেই ভাবনার একটি সূত্র যেমন যুদ্ধ। মাল্টিপ্লেক্স আর ভিডিওগেমের যুগে নানান বয়সের মানুষের মধ্যেই এখন, তাড়া করা, ধরে ফেলা, মেরে শেষ করার প্রবণতা। রাতদিন এসবের পিছনেই এরা ছুটছে। হারছে, জিতছে এমনকি মরছেও। এই সময়ের অনেক আগে থেকেই দীপকদা যুদ্ধবিরোধী ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে বার্তা দিতে জাদুকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছি। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে মানুষের মন ভাল করে দিতে পারবই।’
কিন্তু কেমন করে? বন্দুক থেকে বেরিয়ে আসা গুলি, যুদ্ধবিরোধী মানুষের হাতে-ধরা ফুলের তোড়ায় আটকে যাবে। ঝরে যাওয়া ফুল, ফের গজিয়ে-উঠে ভরিয়ে তুলবে তোড়া। এক সময় ক্লান্ত যোদ্ধার বন্দুকের নল থেকেও বেরিয়ে আসবে ফুল। ততদিনে সে-ও ভুলে যেতে বসেছে যুদ্ধের মন্ত্র। ম্যাজিকে এমন এক লজিকের কথা দীপকদাই প্রথম ভাবেন।
কার্ল মার্ক্সের মৃত্যু শতবর্ষে (১৯৮৩) বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ‘গণজাদু’, এই কলকাতারই বুকে। যার শিরোনাম ছিল ‘ফুল ফুটুক’। কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক শোষণ বাযুদ্ধের মত জ্বলন্ত সমস্যাগুলি অবলীলায় জ্যান্ত ঢুকে পড়েছিল এই জাদুর পরিসরে। অকুণ্ঠ প্রশংসিত হয়েছিলেন গণজাদুকর দীপক রায়চৌধুরী। সংস্কৃতির জগতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে গণজাদু তার স্থান করে নিল ক্রমশঃ।
জাদু কি শুধু চমক বা বিস্ময়েই শুরু ও শেষ হবে! জাদু কি শুধুই বিনোদন? কেন আমরা জাদু দেখব? কেন মনে হবে, এগুলি একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি! জাদু বুঝি শুধু ছোটদেরই জন্যে? জাদু কি আমাদের কোনও উপলব্ধিতে পৌঁছে দিতে পারে! জাদু মূক না মুখর হবে?-- এই সমস্ত প্রশ্নই তাঁর মনে প্রবল হয়ে উঠেছিল। তাই তিনি নাটকের মঞ্চ ছেড়ে জাদুর মঞ্চে চলে এসেছিলেন। পাশাপাশি চাকরি, ট্রেড ইউনিয়নের মিছিলে হাঁটা, বন্যাত্রাণের সাহায্যে পদযাত্রা-- এমন আরও কত সামাজিক কাজের সঙ্গে মিলেমিশে পথ চলেছেন এই জাদুকর-মাস্টারমশাই। জাদু শেখানোর বই অনেক আছে, কিন্ত জাদুকর কী করে হয়ে উঠতে হয় -- সে ভাবনাই তাঁর কাছে মুখ্য। একজন সমাজসচেতন মানুষের মতই জাদুকরের দায়িত্ব, জাদুর সামন্ত্রতান্ত্রিক চরিত্রকে বদলে, নির্বাক-জাদুর মুখে ভাষা ফোটানো। তারপর বর্তমান যুগের উপযোগী ভাবনা দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করে তোলা।
দীপকদা এটাই চেয়েছিলেন । তাঁর মনে হয়েছিল, এই পর্যায়ে না-পৌঁছলে জাদু বা ম্যাজিক চিরকাল হয়ে থাকবে সে-ই সনাতন ‘মাদারি কা খেল’ এর জাতভাই। এইজন্যেই তিনি মাস্টারমশাই। এই মানুষটির মধ্যে কোনও জাঁকজমকের বাহুল্য নেই। তিনি জনগণের একজন হয়েই জাদু দেখান সাদা শার্টের ওপর কালো কোট পরে। না-কোনো জবরদস্ত আলখাল্লা, লাল কোট, জরির টুপি, স্যুট-বুট। আর তাই নিয়ে যখন তিনি স্টেজে উঠে কথা বলতে শুরু করেন, তাতেই ছোটবড়র দল মন্ত্রমুগ্ধ। তারা আবিষ্ট হয়ে দেখে, হেসে গড়িয়ে পড়ে হাততালি দেয়। তাই জাদু দেখানোর সময় জাদুকরের বলা কথা বা ‘প্যাটার’ তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ‘ফুল ফুটুক’ গণজাদুতে প্যাটার এসেছিল শেষে, আবহসঙ্গীতের মাধ্যমে। এও এক নতুন এক্সপেরিমেন্ট। আর নতুন কিছু করা মানেই তো স্রোতের বিপরীতে চলা, নানান বাধা বিপত্তিকে এড়িয়ে।
জাদুকে ঠিকঠাক সংজ্ঞা দিতে দীপকদার কলম সদাব্যস্ত। যেমন তিনি ভাবাতে চেয়েছেন – জাদু যখন নাটকের মতই দৃশ্য ও শ্রাব্য, তাহলে জাদুর কপালে ‘প্রদর্শনী’র মত টীকা লাগিয়ে দেওয়া কেন! জাদু কি ফুল, নাকি ছবি, নাকি নির্বাক দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনের মতো কিছু!
গতানুগতিক জাদুধারার বাইরে দীপকদা জাদুকে একটা পারফর্মিং আর্ট করে তোলার লক্ষ্যে এগিয়েছেন বরাবর এবং সেই উদ্দেশ্যেই বই লিখেছেন । জাদু শেখার বই নয়, এক জাদুকরের আত্মসমীক্ষার বই। জাদু এক বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প। নাটক দেখা, সিনেমা দেখার মত জাদুও সপরিবার দেখতে যাবেন মানুষ। এই বইয়ে দীপকদা একনিষ্ঠ মাস্টারমশাইয়ের মতই কিছু সূক্ষ্ম তফাতের দিকে তর্জনী তুলে ধরেছেন। জাদুকরের দায়িত্ব অনেক বেশি। জাদুকরেরা সেটা ভুলে, হয়তো কিছু বিশেষ ‘ট্রিক’ প্রদর্শন করে তাৎক্ষণিক হাততালি পেতেই পারেন, কিন্তু তাতে জাদুটা নিছক প্রদর্শনী হয়েই রয়ে যায়। তাই দরকার হল উৎকৃষ্ট ‘পরিবেশন’-এর। পরিবেশনের গুণে চেনা ডাল-ভাত যেমন অসামান্য হয়ে উঠতে পারে, ম্যাজিকও তেমনি, সামান্য যত্ন ও পরিশ্রমেই হয়ে উঠতে পারে দৃশ্য, শ্রাব্য ও যুক্তিগ্রাহ্য। আর তখনই ‘ম্যাজিক’কে সম্ভ্রান্ত এক শিল্প বলে মেনে নিতে কারোর আর কোনও দ্বিধা থাকবে না।
ম্যাজিককে গণজাদুকর দীপক রায়চৌধুরী করে তুলেছেন কুসংস্কার দূরীকরণের এক হাতিয়ার। তাই তাঁর মতে ম্যাজিকে চাই লজিক। আপনারা অনেকেই হয়তো দেখছেন, স্টেজে একজন জাদুকর খেলা দেখাতে শুরু করলেন। তিনি শূন্যে তাঁর ফাঁকা হাতটি নাড়তেই, হাতে একটা রুমাল চলে এল। রুমালের গায়ে হাত বোলাতেই তার গা থেকে বেরিয়ে এল একটি রঙিন বল। জাদুকর বলটি মুখে পুরলেন, তারপর একটির পর একটি করে অনেকগুলি বল একে-একে বের করলেন মুখ থেকে। শেষে বলের বদলে বেরতে লাগল কাগজের শিকলি। আর পায়ের কাছে তা জমতে জমতে স্তূপ হয়ে গেল। সব শেষে সেই স্তূপ থেকে বেরিয়ে এল একটি পায়রা। ম্যাজিকটা খুবই চেনা, কিন্ত এতে কোনও লজিক নেই।
দীপকদা হলে কেমন ভাবে এই খেলাটা দেখাতেন ? তিনি প্রথমে মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়াতেন। নিজের নাম বলতেন। তারপর বলতেন-- ম্যাজিক ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, হস্তকৌশল বা চাতুরী। তারপর নিজের খালি-হাত দেখিয়ে বলতেন, এই যে আমার খালি-হাত, যেখান থেকে জাদুকরেরা বের করে আনেন টাকা, রুমাল বা সিগারেট। যেমন, এই মুহূর্তে আমার হাতে এসে গেছে ফুল। তেমনি আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা মুঠো থেকে বের করেন তাবিজ, কবচ, মাদুলি। আর সেসব সাধারণ মানুষের হাতে দিয়ে বলেন, আপনার ছেলে পাশ করে যাবে, আপনার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরাও কিন্তু আমার মতই জাদুর কারবারি। কিন্তু এঁরা কিছুতেই তা স্বীকার করেন না। বদলে নিজেদের বাবা, যোগী বা গুরু বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
জাদুকর মাত্রেই জানেন, ব্লেন্ডো খেলাটি হল চারটে ছোটো রঙিন রুমালকে মিলিয়ে, একটি চাররঙা বড়ো রুমালে পরিণত করার ম্যাজিক। কিন্তু দীপকদা চারটি চাররঙা রুমালকে, একটি কাগজের রোলের মধ্যে ভরে দিয়ে ,যখন ম্যাজিক করে তাদের জুড়ে দিয়ে একটা মস্ত বড় রুমাল বের করেন, যাতে ওই সব রঙই রয়েছে, তখন ভারতবর্ষের একজাতি-একপ্রাণ- একতার গান বেজে ওঠে। তাই এইসব ম্যাজিক মানুষ বহুকাল ভালবেসে মনে রাখেন।
দীপক রায়চৌধুরীর মতো একজন মাস্টারমশাই-ই কেবল ম্যাজিক নিয়ে এইভাবে ভাবতে ও ভাবাতে পারেন। বন্ধু জাদুকরের মৃত্যুতে স্মরণসভার জন্য লিখতে পারেন ‘একটি কাল্পনিক স্বাগত অনুষ্ঠান’। যেখানে জাদুকর প্রিন্স শীল চলেছেন সুন্দর এক রথে চড়ে স্বর্গের নন্দনকাননে , যেখানে তাঁর অভ্যর্থনায় সাজানো হয়েছে মায়ামহল, আয়োজন করা হয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ ম্যাজিক ‘বুলেট ক্যাচিং’ দেখানোর । সেই অপূর্বলোকে প্রিন্স শীলকে স্বাগত জানাতে হাজির রয়েছেন প্রবাদপ্রতিম গণপতি চক্রবর্তী, কিংবদন্তি পি সি সরকার সিনিয়র, প্রফেসর রাজা বোস, রয় দ্য মিস্টিক, দেবকুমার, ডি সি দত্ত, কে লাল, গোগিয়া পাশা, গীতা কুমারের মতো প্রখ্যাত জাদুকরেরা। আর বুলেট চালনার জন্যে হাজির সদ্য নরক থেকে প্রোমোশন পাওয়া ফাটা কেষ্ট। অবশ্য আরেকজনও হাজির, তিনি রাজাবাজারের প্রাক্তন পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষাল।
সংস্কার বা কুসংস্কার নিয়ে প্রশ্ন করলে দীপকদা বলেন, ‘আমার মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর চোখ ও দেহ দান করা হয়েছে। অশৌচ পালন করা হয়নি। শ্রাদ্ধ হয়নি। তবে বাড়ির বাকি সদস্যদের মন রাখার জন্য পুরুত ডেকে অভিনব শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। সব ছেলেরা এবং নাতি-নাতনিরা মায়ের ছবির সামনে লাইন দিয়ে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করে অঞ্জলি দিয়েছে। পুরোহিত তাঁর জীবনে কখনও এমন শ্রাদ্ধবাসর করেননি। তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । আর সন্ধ্যায় স্মরণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। 'এই ঘটনার পর প্রতিবেশীরা কিছুদিনের জন্য আমাদের পরিবারকে একটু দূরে ঠেলে রেখেছিল। সেটা অনেকটাই এক-ঘরে গোছের। তবে সেটা ছিল সাময়িক।’
এইভাবে জীবনের সবকিছুকে হাসির ছলে ভাসিয়ে নিতে পারেন একজনই। তিনি আমাদের দীপকদা।
মেলার স্টলে ম্যাজিকের বাক্স কিনতে তো পাওয়াই যায়। তাতে অনেকরকম ম্যাজিক আর তার ট্রিক্স লেখা থাকে। কিন্ত সেটা কিনে, পড়ে, বুঝে ফেললেই কি প্রকৃত জাদুকর হয়ে ওঠা যাবে! জাদুকরকে হতে হবে জীবনরসিক। জানতে হবে মনুষ্যচরিত। বুঝতে হবে-- কার জন্যে খেলা দেখাচ্ছি। দর্শক কারা!
এমন একটা স্কুল আছে যেখানে তাঁকে বাচ্চারা সামনে স্যর বলে ডাকে, আর নিজেদের মধ্যে বলে ‘ম্যাজিক স্যর। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে দীপক রায়চৌধুরী এক বিস্ময়কর মাস্টারমশাই। স্কুল ক্যাম্পাসে যাতায়াতের পথে দূর থেকে তারা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, যদি একটু কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় ম্যাজিক স্যারের সঙ্গে। তিনি যেন এক রূপকথার চরিত্র। সত্যিই আছে তেমন স্কুল যেখানে অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি ম্যাজিক শেখানোরও ক্লাস হয়।
গড়িয়ার ব্রহ্মপুরে ‘নিভা আনন্দ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার সময় জাদুকর দীপক রায়চৌধুরীকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন স্কুলের সকলের ‘দাদান’ শুভঙ্কর চক্রবর্তী (প্রাক্তন উপাচার্য)। তাঁরই উৎসাহে দু’বছর পর শুরু হয় ম্যাজিকের ক্লাস। রুটিন বেঁধে। শুভঙ্করবাবুর প্রশ্নের উত্তরে দীপকদা বেছে নেন সেভেন আর এইটকে। কেন বেছে নিলেন তিনি সারা স্কুলের মধ্যে এই দুটো ক্লাসকে ? এই বয়সেই লাগে বন্ধুর মত সাহচর্য, কারণ এই বয়সটা ভারি অদ্ভুত। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা না বড়র দলে, না ছোটর দলে। তাদের মানসিক ও শারীরিক বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তারা খানিক অস্থির। দিশাহারা। মনে নানান দ্বন্দ্ব। সত্যি-মিথ্যের, সংস্কার-কুসংস্কারের, ভাল-মন্দের। তাদের সামনে আসে নানান হাতছানি। বাবা-মায়ের পাশাপাশি এই বয়েসটাই আঁকড়ে ধরে তাদের প্রিয় কোনও শিক্ষককে, যাঁকে তারা ভরসা করতে পারে। দীপক রায়চৌধুরী এখানে তাই তাদের বন্ধু-মাস্টারমশাই।
নির্দিষ্ট ক্লাসগুলিতে গিয়ে তিনি একেকদিন বলেন, চলো, আজ ম্যাজিকের আগে গল্প করি খানিকক্ষণ। এইভাবে কোনওদিন আলোচনায় আসে শুধু জল। ছেলেরা আড্ডা-সেশনে সবচেয়ে উত্তেজিত থাকে কুইজের সময়। জল কী? জল ভাঙলে কী হয়? এইচ-টু-ও! একে একে আসে ভারী জলের ‘এইচ-ফোর-ও –টু’ র কথা, যা নাকি বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের বড় হয়ে যাওয়ার কারণ। এইভাবে কোনওদিন আসে চোখের কথা, কানের কথা, পেশির কথা। জীবনশৈলীর শিক্ষা এমন করে অজান্তে চারিয়ে যায় ছাত্রছাত্রীদের মননে। তাই স্কুল ছেড়ে যাওয়ার পরও তারা যোগাযোগ রাখে তাদের ম্যাজিক স্যরের সঙ্গে। তাদের জন্যে ম্যাজিক স্যরের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা। এই লকডাউনেও তারা মজে থেকেছে অনলাইন ম্যাজিকে। নিজেদের ম্যাজিকের ভিডিও তুলে তাঁকে পাঠিয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত একজন মানুষ এভাবেই বদলে যান তাদের প্রিয় বন্ধুতে। প্রিয় ম্যাজিক স্যরে।
এই ম্যাজিক স্যর সবচেয়ে ভালবাসেন ছোটদের সঙ্গে মিশতে। যেমন ভালবাসেন চারা থেকে ফুল ফোটাতে। শিশুদের স্নেহ আর পরিচর্যা দিয়ে ঠিকমত মানুষ করে তুলতে পারলেই তো ফুল ফোটে। তাঁর বাড়িতে ছাদ-ভর্তি গাছ। ফুল, ফল, পাতাবাহার থেকে অচেনা গাছ, যাদের কিনা আগাছা বলে অনেকেই ভুল করে, সে সবই তাঁর কাছে আশ্রয় পায়। ‘নিভা আনন্দ নিকেতন’-এও তেমনি দুপুরবেলায় সব কুচোকাচারা যখন খাবারঘরে জড়ো হয়, ম্যাজিক মাস্টারমশাই তখন সেখানে ছোটেন । আলাপ শুরু হয় লুকোচুরি দিয়ে। নরম হাতের ঝাঁপিয়ে পড়া আদর যে স্বর্গীয় তা বলাই বাহুল্য। তারপর খেতে-খেতে ওরা গল্প শোনে। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। ম্যাজিক মাস্টারমশাই তখন জি.কে. স্যর। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন-- এভাবেই ছাত্রপ্রিয় তিনি। আবদার মেটাতে ক্লাস ওয়ানের পুঁচকির গাড়িতে সওয়ার হয়ে কখনও ফেরার পথে। ছুটির পর যতক্ষণ না তিনি স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে আসেন ততক্ষণ দুটি শিশুচোখ দরজার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকে। এ আহ্বান এড়ানোর নয়।
একদিন স্কুলে শুভঙ্করবাবু দীপকদাকে পাকড়াও করে জিগ্যেস করেছিলেন , ম্যাজিক নিয়ে তিনি কোনও বই লিখেছেন কিনা। দীপকদা বলেছিলেন, হ্যাঁ লিখেছেন। কিন্ত সেটা ম্যাজিক শেখার বই নয়, ম্যাজিক করা শেখার বই। ঝরঝরে বাংলায় লেখা সেই বই পড়ে শুভঙ্করবাবু মুগ্ধ হন এবং স্টাফরুমের সবাইকে গিয়ে সেই কথা বলেন। তিনি স্কুলের লাইব্রেরিতে সেই বইটির পাঁচখানি কপি রাখার ব্যবস্থাও করেন। এখানেই দীপকদার জাদু।
বহুকাল ধরে মিছিলে-হাঁটা এই মানুষটি চিরকাল মিছিলের সামনের সারিতে হাঁটলেও, জীবনের বাকি ক্ষেত্রে নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার তাঁর কোনও ইচ্ছেই ছিল না। তিনি একজন স্নেহপ্রবণ, হাসিখুশি এবং আড্ডাপ্রিয় মানুষ। আড্ডা দেবে তো এসো, ইন্টারভিউ কোরো না!-- হাসতে হাসতে বলেন দীপকদা। তবে জানাতে না চাইলেও তো ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েই। তাই যাঁরা তাঁকে চেনেন, জানেন-- তাঁরা দীপকদার সম্মাননার কথা, পুরস্কার পাওয়ার কথা ঠিকই ছড়িয়ে দেন চতুর্দিকে। রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডীর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার ছবি তাই ছাপাও হয় আর সবাই জানতেও পারে।
ম্যাজিক স্যারের গাছপ্রীতির কথা আগেই বলেছি এবার একটা গল্প বলি।
দীপকদা মনে করেন শিশুদের মনে গাছপালার প্রতি আগ্রহ জন্মানোর জন্য যে গাছটি উপযুক্ত, তা হল লজ্জাবতী। তিনি একবার কিছু বীজ জোগাড় করে বাড়িতেই গাছটির চারা বানিয়েছিলেন । নিভা আনন্দ বিদ্যালয়ে গাছপালার কদর আছে। সেখানে অনেকটা শান্তিনিকেতনের আদলে প্রকৃতির ছোঁয়া পেয়ে বাচ্চারা বড় হয়। ম্যাজিক স্যর একদিন খেয়াল করলেন সব গাছই আছে কিন্ত শিশুদের ভাললাগার গাছ লজ্জাবতী নেই। একটি টবসুদ্ধু ফুলন্ত গাছ তিনি স্কুলকে উপহার দিলেন। রেক্টর স্যর স্কুলের মালিদাদাকে ডেকে গাছের যত্ন নিতেও বলেন। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল গাছটির কোনো হদিশ নেই। মালিদাদা কোনো সদুত্তর দিতে তো পারলোই না বরং বলে বসল, কী জানি কে নিয়েছে ! স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কোনোরকম কুইঙ্গিতপূর্ণ কথা হজম করেন না শুভঙ্করবাবু। তিনি নতুন মালিদাদা আনলেন। ম্যাজিক স্যর নতুন টবে আর একটি লজ্জাবতী এনে আবার কুচোকাচাদের মুখে হাসি ফোটালেন । অনাদরে পথের ধারে হয়ে থাকা গাছের কদর ম্যাজিক স্যরই বোঝেন। আর বোঝে শিশুরা।
দীপকদা যখন কথা বলেন তাঁর মুখের রেখা এতটুকুও বাঁকে না কিন্ত দর্শক-শ্রোতারা হাসতে হাসতে খুন হয়ে যান । মাইকের ঘোষক কিম্বা মঞ্চের বক্তা যখন খুব যত্ন সহকারে 'কোর্তব্য' ,'বোক্তব্য' ইত্যাদি শব্দ বলতে থাকেন ,তখন দীপকদার ভুরু কিঞ্চিৎ ধনুক হয়ে ওঠে। তিনি কলম ধরেন। জিভের জড়তা থাকলে শ্রীকৃষ্ণ হয়ে যায় শীকৃষ্ণ বা শ্রীকিষ্ণ। প্রোগ্রাম হয়ে যায় পোগ্রাম। জাদু যেহেতু সামাজিক বার্তাবাহক এবং জাদুকর একজন শিল্পী, তাই তাঁরা সবসময় কমিউনিকেট করার চেষ্টা করেন আর দর্শকরাও চেষ্টা করেন তাঁর সঙ্গে কমিউনিকেট করতে, সেই বোধকে ছুঁতে। সেক্ষেত্রে শুদ্ধ উচ্চারণ খুবই জরুরি। সুবিধেটা হল জাদু পৌঁছোয় সর্বস্তরের মানুষের কাছে। তাই "অজ্ঞাতসারে দর্শকদের ভুল উচ্চারণ শেখানোর অধিকার কোনো শিল্পীরই নেই। এটা সামাজিক অপরাধ । "-- এই তাঁর বক্তব্য। হঠাৎ কে হটাৎ ,আবৃত্তিতে অনাবশ্যক 'ব' যোগ করে আববৃত্তি, অমৃত কে অমমৃত, এভাবে স্বীককৃতি, নেততৃত্ব, হতে হতে বিকৃতও হয়ে যায় বিক্রিত। এইসব আলোচনা ও রয়েছে তাঁর 'জাদুর জাদু' বইতে। সবচেয়ে মজার উদাহরণ :
" ভাবুন তো একবার, রানী ইয়োকান্তে রাজা অয়দিপাউসকে ডাকছেন, ' আমার আজা' বলে। কথাটা ্রর' আমার রাজা'। পরপর দুটি 'র' থাকার জন্যে রানীর মুখে রাজারই যদি এই অবস্থা হয়,তাহলে দর্শকদের অবস্থা কী হবে?"
রসিক জাদুকর এভাবে পারফর্মিং আর্ট-এর সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সচেতন করে চলেন প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, নাটীকার মাধ্যমে। নিজে নাটক অভিনয় ও পরিচালনা করেছেন । আবার অন্যদিকে সিনেমা দেখা ও তার খুঁটিনাটি নজর করা তাঁর প্রিয় বিষয়। সিনেমার ছকভাঙা চরিত্ররা তাঁকে আকৃষ্ট করে আর আকর্ষণ করে কন্ট্রাস্ট। সত্যজিতের 'দেবী' সিনেমার প্রথম দৃশ্যের সাদা-কালো যে বৈপরীত্য, গায়কের কালো শাল, তার পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সার সার সাদা শাড়ি, এই যে চলমানতা ও স্থিতি, মৌন সাদা থান বিধবার মিছিল ও মুখর গায়ক-- এই সবকিছুই একটি সৃষ্টিকে অনন্য করে তুলেছে প্রথম দৃশ্য থেকেই । জাদুকরের মনে এই কন্ট্রাস্টের ধারণা থাকা জরুরি। জাদুকর কাউকে নকল করবেন না। তিনি যে খেলা দেখাবেন, সেই অনুযায়ী নিজেকে সাজাবেন বা ভূমিকা স্থির করবেন। সিনেমার ছবি বিশ্বাস যেমন কাবুলিওয়ালাতে একরকম, জলসাঘরে আরেকরকম-- একজন জাদুকরের ভূমিকাও তেমনই হবে। কখনও দুর্জ্ঞেয়,কখনও রসালাপী, হাদ্যময় চটুল, স্থিতধী গম্ভীর কিম্বা বেদনায় নীল।
বেদনায় নীল হয়ে ওঠার ঘটনাও এসেছে দীপকদার জীবনে। ঝড় সামলে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন।কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে অন্ধকারমুক্ত করার নেশায় তাঁর হাতের ম্যাজিক লণ্ঠনকে কিছুতেই নিভতে দেননি।অনেক কথা বলেও অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল তাঁর সম্বন্ধে। পরে আবার সেসব বলা যাবে।
এইতো সেদিন ,করোনার থাবা হাল্কা ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁকেও , নার্সিং হোমের চোদ্দদিনের অন্তরীণ দশাও তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাড়ি ফেরার পর যোগাযোগ করতেই হাসিমুখে বলেছিলেন , 'হোয়াটসঅ্যাপ চেক করো!' আর অমনি নার্সিংহোমে র ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে জোগাড় করা কাগজ-কলমে লেখা, তাঁর তিনটি ছোটগল্প টুং টুং করে ঢুকে পড়ল আমার সেল ফোনে। এই হলেন জাদুকর দীপক রায়চৌধুরী, যাঁর ছোঁয়াতেই সবকিছুই আলো।
মুগ্ধ হলাম।
খুব ভাল লাগলো।
জাদু-মানুষের সঙ্গে পরিচয় করানর জন্য পিয়ালী কে ধন্যবাদ।
মুশকিল হ'ল, এই কালাজাদুর রাজত্বে আলো-জাদুকর রা লুকিয়েই থাকেন। গুরুচন্ডালী কেও ধন্যবাদ সেই কারণেই...
আহা। কত মণি মুক্তের মত মানুষ যে আমাদের আসে পাশে রয়েছেন
বড় মাপের মানুষ। জানতামই না ওঁর কথা। আরও আগে জানলাম না যে কেন! লেখাটা ভাল লাগল।
এই ধরনের লেখা আরও চাই। খুব ভাল লাগল ।
শ্রদ্ধেয় মানুষটি সম্পর্কে জানা ছিল না। অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
খুব ভালো লাগলো। একেবারেই জানতামনা এমন মানুষটির কথা! পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অনেক ধন্যবাদ জানবেন।
খুব ভালো লাগল। এমনি কত মানুষ আছেন সমাজে। তাঁদের কথা লেখা হোক।
একনিশ্বাসে পড়ে ফেলেছি। আবার পড়লাম। এঁদের মত মানুষকে নিয়ে এমন মনকাড়া লেখা পড়লে প্রাণে একটা উদ্দীপন হয়। ভরসা পাই। আরো লিখুন এঁকে নিয়ে। বড্ড ভালো লেখা।