এই সেই হুকার গ্লেসিয়ার লেক, একদিন এখানে খরস্রোতা এক নদী ছিল। আজ থেকে ১০ বছর পর এও আর থাকবে না। দিগন্তে মাউন্ট কুক।
কি জানি, আমরাই নির্ঘাত সৃষ্টিছাড়া। আমাদের দুজনের চারপাশে আমরা এমন কাউকে দেখি না যারা আমাদের মতন একটা নাম না জানা পাহাড়ের মাথায়, একটা অজানা নদীর ধারে, একটা শান্ত সরোবরের ধারে কষ্ট করে , হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে চুপ করে ঘন্টাখানেক অন্তত বসে থেকে ফিরে এসে সেই সব বসে থাকা ভাল লাগার গল্প করে। আমরা যাদের সে সব গল্প শোনাতে চাই , তারা অবশ্য ভারি বৈষয়িক, নানারকম ব্যবসার অনেক কিছুর কথা বলে, নানা বিষয়ে মতামত দেয়, শাড়ি গয়না গ্যাজেট বলিউডি সিনেমার গল্প টল্প করে, আমরা সে সব শুনি, তার কিছু কিছু প্রায় কিছুই বুঝিনা, তাদের আমাদের নদীর তীরে বসে থাকার বা শান্ত সরোবরের ধারে ঢিল দিয়ে ব্যাঙ লাফানোর গল্প শুনতে ভারি বয়েই গেছে। তাঁরা যদিও নানান দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ান , তাঁদেরও কিন্তু কখনো প্রকৃতি পরিবেশ অচেনা প্রান্তরে বেড়াতে যাবার কথা বলতে বিশেষ শুনি না।
এই সেদিন তাঁদের একজন বললেন দারুণ সব জায়গা দেখে এসেছেন, শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কোথা থেকে ঘুরে এলেন তিনি বললেন যে এই তো ডিজনিল্যাণ্ড গেলাম, কত খরচা হল, কি কি রাইড নিলেন, তারপর হলিউডে কি একটা বুলেভার্ড দেখে এসেছেন, সেখানে নাকি ফুটপাথে চিত্র তারকাদের নাম খচিত আছে, সে সবের গল্প সবিস্তারে বললেন, এমনকি প্লেনে কি বিশ্রি খাবার খেয়েছেন তাও বললেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম প্রশান্ত মহাসাগর কেমন দেখে এলেন, সে বিষয়ে তাঁরা কিছু্ই আর বলতে পারলেন না। এইরকম।
অথচ আমাদের কেন যেন দূরের পাহাড় থেকে ভেঙে পড়া হিমবাহের একটা বিশাল চাঙড়, জলে ভাসছে, সেই সরোবরের তীরে দেখতে দেখতে অনায়াসে ঘন্টা তিনেক কেটে যায়, তারপর আরেক দিন একটা নাম না জানা ছোট লেকের ধারে তন্ময় হয়ে বসে থাকতেই ভাল লাগে। বরং বড় শহরে গেলেই আমার কেমন হাঁপ ধরতে থাকে, কতক্ষণে শহর ছেড়ে পালাব তার প্ল্যান করতে থাকি। কলকাতায় গেলে চোখ নাক জ্বালা করে, সে নাহয় পলিউশানের পাল্লায় পড়ে, কিন্তু কিছুতেই আর বড় শহর নকল আলোর ঝলকানি, মল, সিনেমা, হাট-বাজার, ঝাঁ চকচকে বাড়ি, হোটেল এসবে একদম মন বসে না। তো কি আর করা যাবে? সবাই তো একরকমের হয় না।
দুরকমের জীবন, দু রকমের ঘুরে বেড়ানো, ভালো লাগা।
কেউ শোনে, শুনতে চায় । কারো, বেশীর ভাগ আমার চেনা জানা মানুষের তাতে কোন আগ্রহ নেই |
যাকগে , কেউ না শুনুক, তবু্ও গল্পগুলো লিখে রাখি।
কারণ চোখের সামনে অনেক কিছু দেখেছি ও দেখছি যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে, এতটাই বদলে গেছে যে আর সে আগের মতন হবে না। য়েমন উষ্ণায়ণের প্রভাব দেখেছি | কত বছর ধরে দেখে এসেছি মাউন্ট কুকের পাহাড় আর গ্লেসিয়ার গলে খরস্রোতা নদী, গ্লেসিয়ার থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পাথরের ওপরে খেলা করতে করতে চলেছে সমতলভূমির দিকে; ওমা, শেষ যেবার সে নদী মু্গ্ধ হয়ে দেখলাম, তার বছর পাঁচেক পরে সেখানে একেবারে ঐ জায়গাতেই দেখি গ্লেসিয়ার গলা জলের মস্ত এক লেক। যে সব পর্বতারোহী সারারাত পাহাড়ের ওপরে কাটিয়ে ভোররাতে গ্লেসিয়ার বেয়ে নীচে নেমে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে আসতেন, তাঁদের আর দেখা পাওয়া যাবে না কারণ সে নদী আর নেই। একদিন এই হ্রদ ও আর থাকবে না, সেখানে শুধুই শুকনো পাথর আর কাঁটাঝোপ রয়ে যাবে। আর ওই গ্লেসিয়ার, যা কি না বরফের নদী , পিছিয়ে যাবে আরো দূরে, আরেকটা হ্রদ অবিশ্যি হবে, তবে অন্য কোথাও । এতসবেও কারো কিছুই আসবে যাবে না জানি, তবুও মনে হয় দিন রাত্রির এই চলা ফেরার গল্পগুলো যেমন দেখেছি কোথাও লিখে রাখি।
আর কেউ কি নেই যে আমাদের মত করে ভাবে? অনেকটা বোতলে গল্প লিখে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবার মতন। কে জানে কার না কার কাছে পৌঁছয়? কারো কাছে যদি নাই বা গেল ,তাতে বা কি? গল্প তো | সে কোথাও একটা থাকে নিশ্চয়ই |
সেই সব চলার গল্প , কষ্ট করে পায়ে হেঁটে পাহাড়ে জঙ্গলে নদীতে ঘুরে বেড়ানোর গল্প, নদীর তীরে, লেকের ধারে, পাহাড়ের ছায়ায় বসে থাকার, জলের কলকল আওয়াজ শোনার গল্প।
ভারি ভাল লাগল। আমিও তো এমন করেই ভাবি।
আরও অনেকেই আছে এমন, শুধু একের সাথে অন্যের যোগাযোগ হয় না
ডিট্টো।
হাইরাইজ, ফ্লাইওভার, শপিং মল। নগর ভারতের এই বিরামহীন ক্লোন ক্লান্ত করে। এই লেখা ও চোখ জুরানো ছবির মিছিল চলুক।
আচ্ছা, মহাপ্রাণবর্ণগুলো কী করে লেখে? যেমন খুশি কীবোর্ড।
এর একটা যুক্তিও একবার আমায় দেওয়া হয়েছিল - যে জিনিস লোককে বলতে পারবো না, তার পেছনে সময় নষ্ট করে কোন লাভ আছে?
এমন নয় যে এরা সবাই শাড়ি বাড়ি গাড়ি নিয়েই ব্যস্ত। ইন ফ্যাক্ট যে ঐ কথা বলেছিল সে নিজে প্লেন লিভিং ও হাই থিংকিং এ বিশ্বাসী। কেবল শহর থেকে দূরে শান্ত একটা ক্রীকের পাশে ফুটে ওঠা বুনো ফুলের জন্য সময় দিতে নারাজ!
হয়ত এতে বিরোধিতা নেই!
"আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী,
তোমরা খাবে নিমের পাঁচন, আমরা খাব মিশ্রী ।
আমরা পাব খেলনা পুতুল, আমরা পাব চম্চম্,
তোমরা ত তা পাচ্ছ না কেউ, পেলেও পাবে কম কম ।
আমরা শোব খাট্ পালঙে মায়ের কাছে ঘেঁষটে,
তোমরা শোবে অন্ধকারে একলা ভয়ে ভেস্তে ।
আমরা যাব জামতাড়াতে চড়ব কেমন ট্রেইনে,
চেঁচাও যদি "সঙ্গে নে যাও" বল্ব "কলা এই নে" !"
আহা, যোগাযোগ হবে না কেন, অরণ্যদা কি সর্ষে সিরিজ পড়েনি নাকি! হিমালয় আলাস্কা কিউবা - কত চমৎকার সব গভীর ভ্রমণের গল্পের সঙ্গে গল্প জুড়ে গেছে গুরুর পাতায় - এই চরৈবেতি সেসবের নবতম সংযোজন, হোক।
দেশ দেখার যে কত গল্প। আমি একটা বেসরকারী প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম, দরিদ্র স্কুল, শিক্ষক শিক্ষিকাদের ভয়ানক কম মাইনেকড়ি। আমাদের অঙ্ক পড়াতেন প্রফুল্ল স্যার, ভয়ানক বদমেজাজি মারকুটে খিটখিটে কড়া ধরনের লোক। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রফুল্ল স্যার একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা যান, হাঁপানী ছিল ভয়ানক। মৃত্যুর পর দাহ করার জন্যে স্কুলে চাঁদা তোলা হয়েছিল, ঐ বয়সে এত তো বুঝিনি, এখন ভাবলে অত্মরাত্মা কেঁপে ওঠে।
সে যাক, সেসব অন্য গল্প।
একদিন, ঐ ক্লাস ফাইভেই, প্রফুল্ল স্যারের কি মর্জি হয়েছিল, বেমালুম লেখাপড়া গুটিয়ে গল্প করতে শুরু করলেন। যদ্দূর মনে পড়ে কাউকে একটা বেধড়ক পিটিয়েছিলেন, এমন পিটিয়েছিলেন যে গোটা ক্লাস ভয় পেয়ে গেছিল, তো ঐ।
সেই গল্প হলো ওনার বেড়ানোর। স্কুল ফাইনাল পাশ করে বইপত্তর পড়ে খুব দেশ দেখার শখ হয়েছিল, হতদরিদ্র পরিবার, দু'চার টাকা কোন রকমে জুটিয়ে নিয়ে পূর্ববঙ্গের কোন স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বসেছিলেন। তারপর পথে টিকিট চেকার, হাজত, ভিক্ষে, নানান উঞ্ছবৃত্তি - এইসব করে হিমালয়ের কোথাও গিয়ে পৌঁছেছিলেন। কাশ্মীর, ওদিকে অমরনাথ, হরিদ্বার ইত্যাদি - বছর দুয়েক নাকি হিমালয়ে কাটিয়েছিলেন।
এইসব লোকগুলোর কথা ভাবি। বলারও কেউ ছিল না - ছাত্র ঠেঙিয়ে জীবন কেটে গেল, প্রাইমারী স্কুলে অঙ্ক পড়ানোর ইচ্ছেও হয়তো ছিল না, কেউ জানলোও না - আমাদের বলতে শুরু করেছিলেন, ঐ একদিনের পর আর গল্প এগোয়নি - আর কার মনে আছে কে জানে, এইটা লিখতে লিখতে মনে হলো ঐ ক্লাসের দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাবে। ওঁর কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ থাকতো তাতে তাড়া তাড়া কাগজ থাকতো, কী লিখতেন। কে জানে সেসব কী।
বরফ ঢাকা হিমালয়ের বর্ণনা, প্রথম দেখার রোমাঞ্চ - এইসব বলেছিলেন, সে কত কাল হয়ে গেল, বিস্তারিত কিচ্ছুই মনে নেই, লোকটার জন্যে ভয়ানক মায়া হয়েছিল এইটুকু মনে আছে।
যাগ্গে, সেসব কোন কথা না। কথা হলো চরৈবেতি চলুক।
একটি নদীর সাথে কতশত জীবনের উপাখ্যান জড়িত থাকে, আর অবশ্যই কেউ না কেউ হারানো নদীর গল্প শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন, হোক তা বোতল বন্দী ... আরও লিখুন