পরিযায়ী শ্রমিকেরা কোথায় থাকেন, কোথা থেকে আসেন আমরা কেউ জানিনা। তবুও তাঁরা আছেন, সর্বত্র।
হাইরাইজ থেকে হাইওয়ে, কারা বানায় এই সব? এই পরিযায়ী কর্মীবাহিনী –যাঁরা কাজ করে চলেন নীরবে । দিনে এবং রাত্রে, কোনরকম কর্ম-নিরাপত্তা ছাড়া, সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের বাইরে, অসহনীয় দারিদ্র্য এবং অব্যবস্থার মধ্যে। তবুও বিজ্ঞাপনের বোর্ডে যে নামগুলো জ্বলজ্বল করে সেখানে কিন্তু তাঁরা কোথাও নেই, দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির এইসব উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের ভিত্তিপ্রস্তরে তাঁদের নাম অনুপস্থিত। গৃহ-পরিচারক থেকে ড্রাইভার, রাস্তার সবজি বিক্রেতা বা রাস্তার ধারের খাবারের দোকান দিয়ে বসা মানুষটি, আপনার পাড়ার কিরানা স্টোরটির মালিক – কোন পে রোল, পেনশন প্ল্যান, বা ট্যাক্স রেজিস্টারে এঁদের নাম নেই – তবুও, এঁদের সরিয়ে দিলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শহুরে এবং আধা শহুরে অভ্যস্ত জীবনযাত্রা হয়ে পড়বে পঙ্গু ও বিপর্যস্ত। যেমন এই মুহূর্তে চলছে।
সাধারণতঃ সুখের দিনে এই শ্রমিকেরা থাকেন অদৃশ্য, তাঁরা যে আছেন, সেটাই আমাদের মনে থাকে না। আর সময় খারাপ হলে এঁরা পান চরম অবহেলা আর নিষ্ঠুরতা। যেমন আমরা দেখেছি এই নিদারুণ দাবদাহে ধুলিমলিন এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা মাইলের পর মাইল হেঁটে ফিরছেন তাঁদের গৃহের উদ্দেশে। উডি গাথরীরর সেই গানের লাইনগুলি মনে পড়ে যায় – “I ain’t got no home in this world anymore”। তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই কথাগুলি যেন আক্ষরিকভাবে ফলে গেছে – কেউ হয়তো মরেই গেছেন, অন্যরা গ্রামে ফিরে পেয়েছেন বিরূপ অভ্যর্থনা। এঁরা ঘর ছেড়েছিলেন দারিদ্রের ধাক্কায়, আরেকটু ভালো থাকার আর ফেলে আসা পরিবারকে আরেকটু ভালভাবে প্রতিপালন করতে পারবেন, এই আশায়। কিন্তু যখন দূঃসময় এলো, তাঁদের আপন করে নেওয়া সেই “নতুন ঘর” কিন্তু তাঁদের আপন করে নেয়নি।
এই মানবিক ট্র্যাজেডি হয়তো সবাইকে সমানভাবে স্পর্শ করবেনা। আরো আবেগহীন, বাস্তববাদী দৃষ্টিতে দেখলে কেউ বলবেন, যে প্রথমে জনস্বাস্থ্যের সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে, তারপর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চাকা আবার চালু করতে হবে। কথাটা ঠিক। কিন্তু এই বৃদ্ধির চাকা বিষয়টা আসলে কী? আপনি মনে করতেই পারেন এ হল পুঁজি জোগাড় করা (যেমন, নতুন যন্ত্র এবং কারখানা পত্তন) এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি (যেমন, উন্নততর প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন সাংগঠনিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে)। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে কোন পুঁজিই শেষ অবধি নিজে নিজে উৎপাদন করতে পারে না – সেজন্য তার চাই শ্রমিক। ভারতের মত দেশে এই শ্রমিকদের একটা বড় অংশ আসেন পরিযায়ী হয়েই, গ্রাম গ্রামান্ত থেকে। কম উৎপাদনশীল কৃষিক্ষেত্র থেকে অধিক উৎপাদনশীল শিল্প ও পরিষেবার ক্ষেত্রর পরিধির প্রসার হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথের প্রগতির লক্ষণ । প্রধানত এই পরিযায়ী শ্রমিক নামক সম্পদের চলাচলেই গড়ায় “বৃদ্ধির চাকা”। এই চলাচল বন্ধ হলে, বৃদ্ধির চাকাও থেমে যাবে, কারণ সীমিত পরিমাণ স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে হলে শ্রমিকের শ্রমমূল্য বেড়ে যাবে বহুগুণ, তাতে বিনিয়োগকারীদের পোষাবেনা ।
এই পরিযানের পিছনে প্রধান কারণ শহরাঞ্চলে জীবনধারণের বাড়তি সুযোগ সুবিধা যা গ্রামাঞ্চলে অপ্রতুল। ম্জার কথা হল, পরিযান নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চল থেকে যত মানুষের কাজের জন্য শহরের দিকে যাবার কথা, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে অনেক কম মানুষ আসলে গ্রাম থেকে শহরে যান। এর প্রধান কারণ হিসাবে উঠে এসেছে ঝুঁকি নিতে না চাওয়ার মানসিকতা । শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষের গড় আয় কম হলেও গ্রামীণ জীবনযাত্রা অপেক্ষাকৃত সহজ যাপন-ভিত্তিক এবং সামাজিক সম্পর্কের জেরে গড়ে ওঠা এক স্বাভাবিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে তাঁরা বাস করেন। খুব গরীব ঘরের মানুষেরা অনেক সময়েই দেশ-ঘর ছেড়ে যাবার, শহরে গিয়ে থাকার যে আনুষঙ্গিক খরচ এবং মানসিক চাপ তা বহন করতে চান না – বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে শেষে স্বপ্ন পুরণ না হলে কী হবে এই ভয়ের বশবর্তী হয়ে। বর্তমান সঙ্কটের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এই প্রবণতাকেই আরো বাড়িয়ে তুলবে এবং ভবিষ্যতে সম্ভবত এই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আরো কমবে।
লকডাউনপর্ব শেষ হলে এর প্রভাব কী হতে পারে? আমরা একটা বোতাম টিপব আর বৃদ্ধির চাকা আবার গড়াতে শুরু করবে, যেমনটা বেন বার্নাঙ্কে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, বলেছেন মার্কিন অর্থনীতির ক্ষেত্রে? বার্নাঙ্কে বলেছেন এই বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মত, কারণ ১৯৩০-এর মহামন্দা বা ২০০৮-এর আর্থিক সংকটের মূলে ছিল মানুষের তৈরী প্রতিষ্ঠানগুলির বিভিন্ন সমস্যা, এক্ষেত্রে সেটা সত্যি না। তাই তাঁর অনুমান, জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট প্রশমিত হলে, যত দ্রুত অর্থনৈতিক মন্দা এসেছে, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াও সেরকমই দ্রুত হবে।
বার্নাঙ্কের অনুমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কতখানি সঠিক তা সময়ই বলবে কিন্তু একথা মোটামুটি বলাই যায় যে ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্র অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি গভীর এবং ব্যাপকতর প্রভাব বিস্তার করে থাকে সেখানে এই যুক্তি একেবারেই খাটে না। যে কোন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই বিশ্বাস এবং ভাবমুর্তির একটা বড় ভূমিকা থাকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে এগুলির ভূমিকা আরও বেশি যেহেতু এখানে কোন চুক্তি বা আইন নেই। নিয়োগ থেকে শুরু করে মাইনে, কাজের দায়িত্ব ও মূল্যায়ন সবই মুখের কথার ভিত্তিতে হয়ে থাকে - উদাহরণস্বরূপ গৃহপরিচারকদের কথা ভাবা যেতে পারে।
সুতরাং এই ধরণের অর্থনীতিতে সামাজিক সম্পর্কের কাঠামো (social networks) এবং বিশ্বাস খুব বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সৎ কিনা, বা কাজে ফাঁকি দেয় কিনা, এগুলো লোকের কথা ও সুপারিশের ওপর ভিত্তি করেই হয়। কিন্তু এক ধাক্কায় অনেকে দেশে চলে গেলে, এই চ্যানেলগুলো সব ওলোটপালোট হয়ে যায়, আবার নতুন লোকের সাথে সম্পর্ক ও বিশ্বাস গড়ে উঠতে সময় লাগে। সুতরাং এদেশে অন্তত এই যে একবার সঙ্কট কেটে গেলেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে এবং আবার গ্রাম থেকে শহরে যাবার পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল নেমে আসবে, এমন ভাবনা অবাস্তব। শহরে মজুরি উল্লেখযোগ্যরকম বাড়লে এবং যে সব যোগসূত্রের মাধ্যমে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক জোগাড় করা হয়ে থাকে সেগুলিকে আবার পুনর্গঠিত করে তুলতে পারলে তবেই আবার শ্রমিকের জোগান স্বাভাবিকের দিকে এগোবে। মালিকপক্ষ অবশ্যই এই দেওয়াল লিখন পড়তে পারছেন। তারই ফল হিসাবে কিছু রাজ্যে শ্রমের আইন আলগা করার যে চেষ্টা চলল, তার পেছনে এই দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
গরীব মানুষকে ত্রাণ দেবার সময়ে বারবার বাজারপন্থী অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীরা যে কথাটা বলে আসেন তা হল “বিনামূল্যে” কিছু পাওয়া যায় না। সেই একই বাজারের যুক্তি কিন্তু একথাও বলে যে সস্তায় যেমন ভালো মানের জিনিস পাওয়া যায়না, তেমন ভালো মানের শ্রমও পাওয়া যায়না। শ্রমিককে কাজে ফিরিয়ে আনবার একমাত্র উপায় হল কাজের পরিবেশ ও জীবনযাত্রার মানের উন্নতি এবং অধিকতর মজুরির সংস্থান – জোর জবরদস্তি নয়। ভারতের মত দেশে যেখানে প্রায় ৯০% শ্রমিকই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং যাদের কোনরকম কাজের নিরাপত্তা বা অবসরকালীন সুবিধা ইত্যাদি কিছুই নেই, তাদের জন্য সরকারের দ্বারা প্রবর্তিত সুরক্ষাবলয় যথেষ্ট শক্তিশালী হতেই হবে এই বিপর্যয় কেটে গেলে তাদের কাজে আবার ফিরিয়ে আনায় উৎসাহিত করতে।
এবং এই সুরক্ষাব্যবস্থায় ন্যুনতম করণীয়ের মধ্যে পড়বে রেশন কার্ডের গতিশীলতা – অর্থাৎ দেশের যেখানেই থাক পরিযায়ী শ্রমিকেরা যেন সেই কার্ডের বিনিময়ে খাদ্য পেতে পারেন এবং তার মাধ্যমে গণবন্টন ব্যবস্থার অংশীদার হতে পারেন। একই সঙ্গে তাদের বর্তমান বরাদ্দের তুলনায় উল্লেখযোগ্যরকমের বেশি অনুদানের ব্যবস্থাও করতে হবে (এই রিলিফ প্যাকেজে যা বলা হয়েছে তার চেয়ে) – সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া এবং গণবন্টন ব্যবস্থা উভয়ের মাধ্যমে। কারণ, “বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না” – পরিযায়ী শ্রমিকেরা কাজে না ফিরলে দেশের অর্থনীতির চাকা গড়াবে না।
অষ্টম পরিচ্ছদে লেখা হয়েছে যেঃ-" শহরে মজুরি উল্লেখযোগ্যরকম বাড়লে এবং যে সব যোগসূত্রের মাধ্যমে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক জোগাড় করা হয়ে থাকে সেগুলিকে আবার পুনর্গঠিত করে তুলতে পারলে তবেই আবার শ্রমিকের জোগান স্বাভাবিকের দিকে এগোবে। মালিকপক্ষ অবশ্যই এই দেওয়াল লিখন পড়তে পারছেন। তারই ফল হিসাবে কিছু রাজ্যে শ্রমের আইন আলগা করার যে চেষ্টা চলল, তার পেছনে এই দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।"
শ্রম আইন সংস্কারের ফলে তো শহরে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি হ্রাসেের সম্ভাবনা আরো প্রকট হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ বেকা রত্ব বাড়ার ও সার্বিকভাবে শ্রমিকদের মজুরি কমার সম্ভাবনা প্রবল হবে বলে মনে হয়।
প্রয়োজনীয় লেখাটা অনুবাদ করবার জন্য গুরুচন্ডালীকে ধন্যবাদ। অত্যন্ত ঝরঝরে অনুবাদ।
@শেখরদা - সেটাই আশঙ্কা। শ্রম আইন নিয়ে এত তদ্বিরের পিছনে বোধ করি সেটাই আসল কারণ। এতে শ্রমিকের মজুরি কমার আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু তার সরাসরি ফল যেটা হবে, সেটা হল পরিযান কমবে। এমনিতেই এই অরডিলের পর অনেকেই মনে করছেন গ্রামে একটু কষ্ট করে থাকাই বরং ভাল - সেই প্রবণতা আরো বাড়বে। শ্রমিকের জোগান কমলে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে বাধ্য হবেন অথবা অন্য পন্থা নেবেন - এই অন্য পন্থাটাকেই ভয়। এক অদ্ভুত প্যারাডক্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, আমাদের অর্থনীতি।
@স্বাতীদি এটার আরো লিঙ্ক খুঁজছি - পেলে তোমায় জানাব
আরে রৌহিন! এমন সাবলীল অনুবাদের জন্য তোমায় ধন্যবাদ জানাতেই ভুলে গিয়েছিলাম।
অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সন্ধানে এবং বেশি মজুরির প্রত্যাশায় এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যারা যান, তাঁদের ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকার ফলে এটা বলা মুশকিল যে এই মহামারীর কালে কত সংখ্যক শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে এসেছেন আর কত সংখ্যক ভিন রাজ্যে রয়ে গেছেন। আর নিজের রাজ্যে ফিরে আসা শ্রমিকদের মধ্যেও কত সংখ্যক আবার কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন সে সম্পর্কেও কোনও তথ্য জানা আছে কি? তাছাড়া রাজ্যের ভিতরেও তো গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশন অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। পরিযানের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্যের অভাবে ও অসংগঠিত শ্রমিকদের ট্রেডইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।
@রৌহিন, পুনেতে অটো ইন্ডাস্ট্রির তরফ থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের আবার কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনার দাবী উঠেছে। আজকের গণশক্তির খবর। লিংকটা দিলাম।
@শেখরদা - লিঙ্কটার জন্য ধন্যবাদ।
@স্বাতীদির প্রশ্নের উত্তরে (এই প্রশ্ন নিশ্চই আমি সহ আরো অনেকেরই) মৈত্রীশদা আজ দুটি লিঙ্ক দিয়েছেন - সেই দুটি এখানে দিলাম
১। https://www.theigc.org/wp-content/uploads/2014/09/Mobarak-Et-Al-2011-Policy-Brief.pdf
২। https://microeconomicinsights.org/why-is-labor-mobility-in-india-so-low/
ভালো অনুবাদ।