এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • ব্যালকনির বাসিন্দা

    বিশ্বজিৎ রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৯ জুন ২০২০ | ২২৯৪ বার পঠিত
  • শান্তিনীড়ের সাততলায় চিলতে ব্যালকনি থেকে নীচের শুনশান রাস্তার দিকে তাকিয়ে সোমনাথ। ভিতরের ডাইনিং স্পেসে বসে দুপুরের রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত কাকলি ওকে দেখছে। মনে হল অর্কিডের টবগুলোর পাশে হাঁটুর ব্যথায় কাতর স্বামীর বেঁকেচুরে দাঁড়ানো শরীরটাও সাজানো। কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে উড়ে সেই বিভ্রম ভেঙে দিল। ভারী ভালো লাগছে কাকলির। অন্য সময় হলে তো এতক্ষণে তাসের আড্ডায় বেরিয়ে পড়তেন বাবু। রেবার মাকে নিয়ে দুপুর পর্যন্ত একাই কাটত কাকলির। ভাতঘুমের পর বিকেলে ফের হাওয়া হয়ে যেত ওর কর্তা। রান্নাবান্না সেরে রেবার মা চলে গেলে সন্ধ্যার সিরিয়ালগুলোও একাই দেখতে হত। এখন ঘরবন্দি সংসারে অনেকটাই পূর্ণতার স্বাদ। শুধু পাপাইটা কাছে নেই বলে মন খুঁতখুঁত করে। দূর দেশে চাকরি। তবে কানসাস থেকে ভিডিও কল করে প্রায়ই। হোয়াটসঅ্যাপে কল তো বটেই, ছেলের কল্যাণে ইদানীং সোমনাথ-কাকলি শিখে নিয়েছে গুগল মিট, জুমের চক্করও। বেশ লাগে। সোমনাথ তো এখন ফেসবুকে অ্যাকাউন্টও খুলেছে। কাকলি সেখানে মাঝেমধ্যে পাপাইয়ের সঙ্গে চ্যাট করে। স্বামী-স্ত্রী তাই বলাবলি করে—দুনিয়াটাকে কেমন হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বলো!

    নীচে রাস্তায় স্তব্ধতা চিরে মাঝেমধ্যে শুধু তীব্র হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স কি পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার কুকুরগুলো দল বেঁধে এপার-ওপার করে বেড়াচ্ছে খাদ্যের সন্ধানে। সকালের লুচি-আলুর ছেঁচকির পর সুখটানটা সন্তর্পণে টানছে সেচ দফতরের রিটায়ার্ড ইঞ্জিনিয়ার সোমনাথ। পুড়বে কম, উড়বে বেশি, এই নিপুণতা চৌষট্টি পেরিয়েও আয়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন গরজ বড়ো বালাই। লকডাউন চলছে। বাজারহাট, দোকানপাট সব বন্ধ। সিগারেট-বিড়ি-দেশলাই সব ডবল দামে বিকোচ্ছে। এদিকে নেশার বস্তু না পেলে পেট ফুলে ঢাই। তাই কাঁচিতে কেটে রেশনিং করছে।

    নিজেকে বোঝাচ্ছে, একটা যুদ্ধের মধ্যে আছে দেশ-দুনিয়া। অল্প বয়স থেকেই ও যুদ্ধের ছবি দেখতে ভালোবাসে। মানুষের ইতিহাসে মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধটা সবচেয়ে মহৎ যুদ্ধ। এসময় যে যার ট্রেঞ্চে বসে কৃচ্ছ্রসাধন করতেই হবে। এই ব্যালকনিটাও তো একটা ট্রেঞ্চ। ক-দিন আগেই এখানে দাঁড়িয়ে তালি-থালি বাজিয়েছে সোমনাথ-কাকলি। বেসুরে হলেও গলা মিলিয়েছে হাউসিংয়ের দুই ব্লকের ব্যালকনি থেকে উড়ে আসা বৃন্দগানে—উই শ্যাল ওভারকাম। কলেজ সোশ্যালের পর এতদিনে এই প্রথম ফের গানটা গাইল সোমনাথ।

    ~~~

    ক-দিন আগেই টিভিতে ভারতভাগ্যবিধাতা দেশের মানুষকে ত্যাগ ও তপস্যা করতে বলেছেন। আগে লোকটাকে পছন্দ করত না সোমনাথ। এমন নয়, সে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে ঘর করেনি। কলেজজীবনে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু এতাল-বেতাল পথে হেঁটেছিল বটে। পরে সরকারি চাকরির দস্তুর মেনে সারা জীবন ‘ইয়েস স্যার, সিওর স্যার’ করেছে। লাল জমানায় ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বলে বিশ্বস্ততা প্রমাণে কোনো ফাঁকি দেয়নি। তবে সরাসরি ঝাণ্ডাবাজি করেনি। দায়ে পড়ে পুজো প্যান্ডেলে পার্টির স্টল থেকে দু-একটা মার্কস-লেনিনের বইও কিনেছে। আবার মিশনে দীক্ষা নিয়েছে যাতে পাপাইয়ের নরেন্দ্রপুরে চান্স পেতে সুবিধে হয়। এভাবে বিদেশি থেকে দেশি মন্ত্রে প্রয়োজন মতো গলা মিলিয়ে বরানগরে গঙ্গাপারে এঁদো গলির একতলা থেকে দক্ষিণ কলকাতার লেক-পাড়ার সাততলায় উঠেছে সোমনাথ।

    তবু বাঙালি তো, একটু নাকউঁচু ভাব ছিল। মনের মধ্যে এই গর্ববোধ থেকেই যেত: সেকালে বিবেকানন্দ-অরবিন্দ, বঙ্কিম- রবীন্দ্রনাথ বলো আর নেতাজি, একালে সত্যজিৎ-অমর্ত্য-অভিজিৎ সব তো আমাদের। সুভাষ বোস থেকে জ্যোতি বোস, বাঙালি দিল্লিতে তার প্রাপ্যটা পেল না বলে ক্ষোভটাও ছিল।

    এই কারণে প্রথমটায় এই লোকটার ছদ্ম বিনয়ের আড়ালে লাগাতার আমিত্বের ঢাক পেটানোর ফাঁকে স্বামীজি-নেতাজির কথা শুনতে মন চাইত না। তারিয়ে তারিয়ে ওর ক্ষমতা উপভোগের শ্লাঘা শুনতেও কেমন অস্বস্তি হত। বিশেষ করে দামি চশমার আড়ালে ওর ঝকঝকে চোখের ক্রুরতা শিউরে তুলত। মনে পড়ে যেত, হেসে হেসে ওর গাড়ির তলায় চাপা পড়া কুকুরছানাদের নিয়ে দুঃখের কথা শোনানো। মন্দির-মসজিদ, শ্মশান-গোরস্থান বিবাদের বিষকুম্ভটাকে বারবার নেড়েঘেঁটে কিছুতেই থিতোতে না দেওয়া। এমনিতে এসব নিয়ে মারদাঙ্গা পছন্দ করে না সোমনাথ। তার উপর পড়শি শত্তুরের ঘরে ঢুকে তাকে মারার দাবি নিয়ে নাটুকেপনা। পাড়ার মাস্তানদের মতো ছাপ্পান ইঞ্চির ছাতি নিয়ে বারফট্টাই। দুধ-মধুর বন্যা বইয়ে দেওয়ার ধাপ্পাবাজি। মনে হত, ধুর! লঙ্কায় যে যাবে সেই হবে রাবণ! এই পোড়া দেশের কিস্যু হবে না!

    এখন আর অত খারাপ লাগছে না। সকাল-বিকেল টিভি চ্যানেল বদলালেই মনে হয় ভারতমাতার মন্দিরের চাতালে বসে আছে। ধূপধুনো, কাঁসরঘণ্টা, ভেরি বাদ্যের মধ্যে মন্ত্রপাঠে চারিদিকে একটা পবিত্র ভাব। লক ডাউনের মধ্যে আবার মহাভারত দেখাচ্ছে। তাতশ্রী, মামাশ্রীদের কাল ফিরে এসেছে। এদিকে মিশন পর্যন্ত এনার ‘ভিশন’ ছড়িয়ে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে বলাবলি করে এবং প্রায়শই একমত হয়। কাকলি শোনে বেশি, বলে কম। তবে যখন বলে তখন সোমনাথ টের পায় বউয়ের জন্যই সংসারটা সাজানো বাগান হয়ে উঠেছে।

    —বুঝলে, চারদিকে এখন ঘোর বিপদের বেড়াজাল। পাকিস্তান-চিন-করোনা মিলে একেবারে ত্র্যহস্পর্শ যোগ চলেছে। আরে, গদির জন্য পাবলিকের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি তো সব পলিটিশিয়ানই করে। কিন্তু চেনা-অচেনা শত্রুদের হানাদারির মুখে দেশটা বেলাগাম ছিল। সবাইকে একটা শক্তপোক্ত বাঁধনে বাঁধার ক্ষমতা কি সবার থাকে? ঘরের ভিতরেও কি শত্রু কম! নিজে শক্তিশালী হলে তবে না এমন সাড়ে বত্রিশভাজা জনসংখ্যাকে বাগ মানানো যায়!

    আর পাবলিক যে পোষ মেনেছে, এটা তো এখন স্পষ্ট। এর আগে গোটা দেশকে এমনভাবে কোনো নেতার ভাষণ শুনতে টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখেছে কেউ? সাতচল্লিশের এক মাঝরাতে নেহরুর ভাষণ শুনতে শুনতে রেডিয়োর সামনে আমার ঢাকাইয়া দাদুর চিৎকারের কথা বাবা বলত। একাত্তরে ইন্দিরার যুদ্ধঘোষণা শুনেছি। বাবা-কাকার সে কী নাচ! কিন্তু টিভির যুগ তো কম দিন হল না! শচীন, অমিতাভরাও এতটা পারেনি।

    —হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। দেখেছ, ক্যামেরার সামনে কেমন স্মার্ট? গলায় কেমন ওঠানামা, বল? নিশ্চয় অমিতাভের কাছে ক্লাস নেয়। তার উপর কী সুন্দর সংস্কৃতে শাস্ত্রবচন শোনায়! দেশের লোকের নাড়িতে হাত দিয়ে রেখেছে। তাই তো প্রেস-ফেসের ধার ধারে না। পাবলিকের কাছে সরাসরি নিজের মনের কথা বলে। আগের জন তো ছিল বুড়ো প্রফেসর। মিনমিন করে কী যে বলত, ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চও শুনতে পেত না। পাগড়িতে ঢাকা অর্ধেক মুখ, চশমায় আড়ালে ভাবলেশহীন চোখ। ধুর! কোনো অ্যাপিল ছিল যে পাবলিক দাঁড়াবে, শুনবে? কিন্তু এঁর গলা, ফিগারে ব্যাপক কর্তৃত্বের ছাপ। বোঝাই যাচ্ছে, সবকিছু এখন ওঁর হাতের মুঠোয়।

    —তা যা বলেছ। একেবারে সার্কাসের রিংমাস্টারের মতো কনফিডেন্স! দুর্দান্ত জানোয়ারগুলোকে বশে রাখতে চাবুকটা বেশি আছড়ায় না। শুধু চোখে চোখ রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে আদেশ দেয়। কিন্তু মনে হয় যেন উপদেশ দিচ্ছে। নির্বোধ খিদে-রাগ-কামতাড়িত জন্তুগুলোকে গার্জিয়ানের মতো শাসন করছে। আনএডুকেটেড, আনকালচারড সব ভেড়ার পালের দেশে এমন নেতাই জুতসই। আরে বাবা, জন্ম থেকেই তো এরা অন্ধ ভাবে মাতব্বরদের অনুসরণ ও অনুকরণ করে বাঁচে। তার সঙ্গে ভেড়া-তাড়ানো কুকুরদের চিৎকার ও দাঁত- খিঁচুনি থাকলে তো কথাই নেই।

    তাও কি লাইন ভেঙে ছিটকে যাওয়া পাবলিক কম! ওই যে টিভিতে দেখাচ্ছে, সব পালে পালে বোঁচকা-বুঁচকি বেঁধে, কোলে- কাখালে এন্ডি-গেন্ডি সামলে মুলুকের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। এদের কি বাবা-বাছা করে আটকানো যায়? যত সব মূর্খ, অমানুষ খোট্টার দল! দেশ বলতে বোঝে শুধু নিজেদের গাঁ-গঞ্জ। নিজেদের পেটভরানো আর ইঁদুরের মতো বংশবৃদ্ধি ছাড়া কিছু বোঝে না। আরে বাবা, মুলুক গেলেই যদি খেতে পাবি তবে ঘর ছেড়েছিলি কেন?

    —শুধু হিন্দুস্তানিদের কেন দোষ দিচ্ছ? বাঙালি কম? মনে আছে কোদাইকানাল থেকে কচ্ছ, বেড়াতে গিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে আমাদের বারবার ট্রেন মিস হওয়ার উপক্রম? আনরিজার্ভ কামরার সামনে পিলপিলে ভিড়। লাইনে এখন কত বাঙালি বল তো? বেশিরভাগ চাষাভুষোর ঘরের ছেলেপুলে। সব এখন বাড়ি ফেরার বায়না ধরেছে। নিজেরাও মরবে। আমাদেরও মারবে।

    —একদম কারেক্ট! এই অবস্থায় যারা শিক্ষিত, দেশ-দুনিয়ার হাল-বেহাল নিয়ে সচেতন, শুধু তাঁরাই বোঝে মুনিঋষিদের বাণী শুনিয়ে এই জান্তব জনতাকে অনুশাসনে রাখা সম্ভব নয়। জান, আমার দাদু বলত, ব্রিটিশরাই ভালো ছিল। বাবা বলত, মিলিটারি শাসন ছাড়া এদেশের উন্নতি সম্ভব নয়। এখন তো আমারও তাই মনে হয়। তবে মিলিটারি না নামিয়েই যেভাবে কড়া হাতে সব সামলাচ্ছে, তাতে দুনিয়ায় ধন্যি ধন্যি পড়ে গেছে। টিভিতেই তো সেদিন দেখাল আমেরিকায় দেশিরাও উচ্ছসিত। দেশে যারা ঘরমুখোদের দুর্দশা নিয়ে ড্রামাবাজি করছিল, তারাও এখন শঙ্খচূড়ের সামনে ঢ্যামনা কি শাঁখামুটের মতো নুইয়ে গেছে। হবে নাই বা কেন? দুনিয়া হল শক্তের ভক্ত। আর এদেশে সেটা সবচেয়ে জরুরি।

    আরে বাবা, টিভিতেই তো দুনিয়া দেখাচ্ছে! সব জায়গায় এখন এক-দেশ এক নেতা-এক বিধানের হাওয়া বইছে। সবাই সবাইকে বলছে—এখন রাজনীতির সময় নয়, দেশ জুড়ে ঐক্যের সময়। এঁর সঙ্গে কেউ যুদ্ধের সময়কার চার্চিল, কেউ স্তালিন, কেউ আবার রুজভেল্টের তুলনা টানছে। কেউ আবার একই অঙ্গে অনেক রূপ দেখছে। কেউ কেউ যে হিটলার, মুসোলিনির সঙ্গে তুলনা করছে না, তা নয়। তবে এরা সব ব্যাপারে দোষ-ধরা পার্টি। নিজেদের ছায়া ছাড়া কেউ ওদের কথা শোনে?

    মানছি, কিছু লোক কয়েকশো মাইল হাঁটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে না খেতে পেয়ে মরছে। কিন্তু কী করা যাবে! গীতাতেই তো স্বয়ং ভগবান বলেছেন, ধর্মযুদ্ধে যুযুধান কুরু-পাণ্ডব রাজকুলে আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনের প্রাণনাশ অনিবার্য। আর এরা তো চিরকালের এলেবেলে। এর আগে ইরাকে-আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় টিভিতে শোননি? কী যেন বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে—কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ!

    তবু ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে কত সুরেই না মড়াকান্না শুনতে হচ্ছে—কেন পুলিশ প্যাঁদাচ্ছে? কেন সরকার প্লেন চালিয়ে বিদেশ থেকে ঘরে ফেরাচ্ছে? অথচ ট্রেন চালাচ্ছে না? আরে বাবা, প্যাঁদাবে না তো কি জামাই আদর করবে? প্লেনে আনার লোক ক-টা? আর ট্রেনে তো উঠতে চাইছে রাবণের গুষ্টি। তোদের কথা শুনলে সব তো পিঁপড়ের মতো মরবে। হাওড়া- সাঁতরাগাছিতে শেষ পর্যন্ত যে-কটা নামবে, সেগুলোকে গঙ্গাসাগরে না পাঠালে তো কলকাতা থেকে কালিম্পং শ্মশান হয়ে যাবে। এসব ভেবেই না দিদি পর্যন্ত ট্রেন আটকাতে চাইছে। তোদের তো কোনো দায়দায়িত্ব নেই। শুধু বুকনি মেরেই খালাস।

    একটু চা দেবে নাকি? বকে বকে গলাটা শুকিয়ে গেল। না না, তুমি কেন বকাবে? আমারই অভ্যেস!

    —হ্যাঁ যা বলছিলাম। দেশের দায় যার ঘাড়ে, তোদের সে থোড়াই কেয়ার করে। ইদানীং তো ওঁকে আরও চার্মিং লাগছে। ভোটের সময় প্রচারের ধকলে ওঁর মুখেচোখে ক্লান্তির কালি লেগে থাকত। এখন দিনকে দিন উজ্জ্বল, ফরসা মুখে হালকা হাসি লেগে। মেক-আপ করলেও বা কী? এত চকচকে ভাবটা আসে চামড়ার ভিতর থেকে। তার উপর রোজ নতুন রঙের কোট-কুর্তা। মুখে বা গলায় গামছার রং-বুনোটও বদলে যায়। দাঁড়িগোঁফ এমন ভাবে ছাঁটে যেন যাত্রার নকল দাঁড়ি, বাড়ে না কিছুতেই। মঞ্চের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেওয়ার কী দারুণ দক্ষতা। বাকি অভিনেতাদের নেহাৎ প্রাণহীন ‘প্রপ’ মনে হয়। মাত্র তিনঘণ্টা ঘুমোয়। সারাক্ষণ দেশের কথা ভাবে। তারপরও কী তরতাজা দেখেছ!

    —দেখেছি। এসব হল রোজ যোগা করার ফল। বাবা রামদেবের থেকে কম এক্সপার্ট নয়! টিভিতে দ্যাখ না? এত কাজের মধ্যেই কতক্ষণ ধ্যান করে জান? এই তো সেদিন বেলুড়ে এসে স্বামীজির ঘরে বসে কতক্ষণ ধ্যান করল। কেদারনাথ দর্শনে গিয়ে দেখলে না ওর ধ্যানের গুহায় এখন পাবলিক লাইন দিয়ে রাত কাটাচ্ছে? ভেবে দ্যাখো, তোমার থেকে বয়সে বড়ো, কিন্তু কী এনার্জি! তুমি তো কিছুই শিখলে না। খালি সুন্দরবনে বাঁধভাঙ্গা জল মাপলে, পাথর-বালির ঠিকেদারের ফাইল ম্যানেজ করে ইধার কা মাল উধার করলে আর তাস পেটালে! একে চিরকেলে অম্বুলে রুগী! এখন প্রেসারে-সুগারে নাজেহাল। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় হাঁটুর ব্যথায় কোঁকাচ্ছ। হোপলেস!

    বউয়ের কথা হঠাৎ বুমরার বলের মতো অন্য দিকে বেঁকে যাওয়ায় ফাঁপরে পড়ে সোমনাথ। নিজের ভুঁড়েল, টেকো হুলিয়ার দিকে তাকিয়ে মরমে মরে। এমন নয়, ছাপ্পান্নয় কাকলির ফিগার করিনার মতো। কিন্তু থাইরয়েডের রুগি হলেও অন্তত নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা করে। রামদেবের টেলি-ক্লাস তো নিয়মিত করেছে।

    ভাগ্যিস, দেশনায়কের ব্রহ্মচর্য পালনের কথাটা বউ তোলেনি। সোমনাথ তো প্রফুল্ল মাস্টারমশাইয়ের কাল থেকেই জানে, বীর্যধারণ বিনা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা বিফল। বিয়ে করে ব্রহ্মচর্য পালনের পরীক্ষা আরও কঠিন। ইস্কুলের শেষ দিকে মাস্টারমশাইয়ের পাল্লায় পড়ে ও স্বামীজির পথে যেতে চেয়েছিল বটে। কিন্তু অচিরেই রণে ভঙ্গ দেয়। এখন ওর কাছে দুপুর ঠাকুরপোর টেলি-মার্কেটিং থেকে ফোন আসে। অথচ দ্যাখো, ইনি এই পথে রামকৃষ্ণ বা গান্ধিজির থেকেও এগিয়ে। তপস্যা একেই বলে! আসল জিনিস হচ্ছে মনকে বশে রাখার ক্ষমতা। জলের মধ্যে হাঁসের মতো থাকতে হবে। ডাঙ্গায় উঠে গা ঝাড়া দিলেই শুকনো খটখটে। তবে বউ পাশে না শুলে ঘুম আসে না, এটাই সমস্যা। আর পাশে শুলেই বদচিন্তা চৌষট্টিতেও। কী যে আতান্তর!

    ~~~

    ব্যালকনির রেলিং ধরে হাঁটু দুটোকে বশে আনার চেষ্টা করে সোমনাথ। হঠাৎ ওর কানে এল অস্পষ্ট চেঁচামেচির শব্দ। ঠাহর করে দেখে নীচে শান্তিনীড়ের গেটে জটলা। অশান্তির শব্দ আসছে ওখান থেকেই। বউকে ডাকে—“এই শোনো, এদিকে এসো। আমার চশমাটা আনো তো।”

    সোমনাথের গলা শুনে একটু আদুরে মেজাজেই কাকলি ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। চশমাটা আনেনি, সোমনাথ সেটা লক্ষ করল। বেলা পড়ে এলে কি মেঘবালিকা হওয়ার সাধ বাড়ে? অন্য সময় হলে সোমনাথ সেটা জিজ্ঞাসাও করত। কিন্তু এখন একটু ত্রস্ত গলায় বলল: “দ্যাখো তো, নীচে কীসের ঝামেলা হচ্ছে?” এত উপর থেকে নীচে হাউজিংয়ের গেটে জটলার মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। কথাবার্তার শব্দগুলোও ভেঙেচুরে অস্পষ্ট। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে লাগল কাকলির।

    —ও বউদি-ই-ই-ই, দ্যাকও না ঢুকতে দিচ্ছে না। ও দাদা-আ, নেমে এসো।

    আরে এ তো রেবার মায়ের গলা। লকডাউনের আগে হিঙ্গলগঞ্জে নিজের গাঁয়ে গিয়েছিল। ছেলের ঘরে নাতি হয়েছে। তাকে দেখার জন্য মন কেমন করছে। ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফিরতে পারেনি। ফোনে কান্নাকাটি করছিল। কাকলি অবশ্য অভয় দিয়েছিল, মাইনে কাটবে না। ছাড়িয়েও দেবে না। আয়লার বছর থেকে কাজ করছে। বাঁধ ভেঙে ঘর তলিয়ে গিয়েছে বলে কাঁদছিল। সোমনাথ সঙ্গে নিয়ে আসে। তা গুছিয়ে কাজ করে। একটু মুখরা বটে। কিন্তু হাতটানের স্বভাব নেই। আজকাল তো বিশ্বাসী লোক পাওয়াই মুশকিল। একা বুড়ো-বুড়ি দেখলেই তক্কে তক্কে থেকে ছেলেপুলে জুটিয়ে গলা কেটে দিচ্ছে। কাছেই পঞ্চাননতলার বস্তিতে রেবার মার এক বোনের ঘর। তার কাছেই থাকে। বোনকে বদলিতে কাজ করানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। ভরসা পায়নি কাকলি।

    কিন্তু একা হাতে বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা, তার উপর রান্নার জোগাড়। হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। রেবার মার গলা শুনে খুশিই হল কত্তা-গিন্নি। কিন্তু দেশ থেকে এলই বা কী করে? ছেলে কি তাড়িয়ে দিল? সে যাক, এখন ওকে গেট পার করানোর বা কী উপায়? ইতিমধ্যে যে শান্তিনীড় কমিটির সেক্রেটারি বি ব্লকের চক্রবর্তীদার নোটিশ পড়েছে: বাইরের কেউ এখন ঢুকতে পারবে না। কাকলি পরামর্শ দিল: “একবার সেক্রেটারিকে ফোন করো।” কিন্তু সোমনাথ আপত্তি জানায়। সেটা ঠিক হবে না। এক মাস পরেই হাউজিংয়ের কমিটি নির্বাচন। সোমনাথ চক্রবর্তীদের পালটা প্যানেলে দাঁড়াবে বলে ঠিকঠাক। এখন নিয়ম ভাঙলে অপোনেন্টদের হাতে ইস্যু হয়ে যাবে। তাই কাকলির আপত্তি সত্ত্বেও ও ইন্টারকমে সিকিউরিটি অফিস ধরে—“শোনো দাস, আমি এ-বারোর চৌধুরী সাহেব বলছি। আমাদের কাজের লোক এসেছে। ওকে বলে দাও, আমি হাঁটুর ব্যথায় নীচে নামতে পারছি না। সে আপাতত বোনের বাড়ি থাক। আমি বাজারফেরত একদিন কিছু টাকা দিয়ে আসব।”

    একটু পরে স্বামী-স্ত্রী দেখল, রেবার মা চলে যাচ্ছে। এত ওপর থেকে ওর মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে সোমনাথ কাকলি উলটোদিকের ফ্ল্যাটের বোসেদের মতো নয়। একটু সর্দি লেগে গা গরম হয়েছে বলে বোসগিন্নি ওদের অনেক দিনের কাজের লোক মান্তিপিসিকে বের করে দিল। সে বুড়ি সিঁড়িতে বসে কাঁদতে থাকায় বলে তাকে নিজের ফ্ল্যাটে ঠাই দেয় দোতলার রুমি। পাপাইয়ের থেকে সামান্য বড়ো রুমিকে ছোটো থেকে দেখছে কাকলি। ওর মায়ের মৃত্যুর পর একটা ছেলের সঙ্গে ‘লিভ ইন’ করে আশেপাশে বহু ভ্রূকুটি আর ফিসফিসানির মধ্যেই। দুজনে আইটি সেক্টরে কাজ করে। রাতবিরেতে বাড়ি ফেরে। গেট পর্যন্ত সঙ্গে থাকে একপাল কুকুর যাদের ওরা প্যাকেট প্যাকেট বিস্কুট বিলোয়। এই ‘নুইসেন্স’ নিয়েও আগে জলঘোলা হয়েছে। ওরা বিশেষ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ঘোরালো। কমিটির কাছে নালিশ জানিয়েছে বোস।

    চক্রবর্তীদা রুমিকে ডেকে জানিয়ে দিয়েছে—অন্য ফ্ল্যাটের কাজের লোককে আসকারা কি ভাঙানোর চেষ্টা অনৈতিক কাজ। এতে হাউজিং মেম্বারদের ইউনিটি নষ্ট হচ্ছে। রুমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিল—“আমি পিসিকে আমার ঘরে শেল্টার দিয়েছি যদ্দিন না ওর ছেলে এসে নিয়ে যায়। এর মধ্যে আইডি কি বাঙ্গুর হাসপাতালে আমি আর সুবীর ওকে টেস্ট করাতে নিয়ে যাব। আমাদের বন্ধুদের একটা গ্রুপ এমন অনেককে নিয়ে যাচ্ছে। হিউম্যানিটারিয়ান গ্রাউন্ড বলে তো একটা ব্যাপার আছে কাকু!” কিন্তু এককালের মাঝারি কর্পোরেট ম্যানেজার ওকে থামিয়ে দিয়েছে—“হিউম্যানিটি শিখিও না আমাকে। ওই বুড়ির থেকে ইনফেকশন গোটা হাউজিংয়ে ছড়িয়ে পড়লে তুমি তার দায়িত্ব নেবে? অ্যাজ এ রেস্পন্সিবল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, আমাকে লার্জার কমিউনিটি ইন্টারেস্টটা দেখতে হবে।” এরপর তার নির্দেশে মান্তিপিসিকে বেড়াল পার করা হয়েছে। শান্তিনীড়ের জনমত বোসেদের পক্ষে।

    এভাবে হাউজিংয়ের দুর্গ রক্ষায় বেশ একটা নতুন আমরা-ওরার খেলা চলছে। যারা সর্বক্ষণের কাজের লোক, তাদের লকডাউনের শুরুতেই নিজেদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে। যারা ছেলেপুলের জন্য কান্নাকাটি করছে, দেশে যাওয়ার রাস্তা খুঁজেছে তাদের মাইনেকড়ির কিছুটা চুকিয়ে বিদেয় করা হয়েছে। পুরোটা দিলে আর নাও ফিরতে পারে এই আশঙ্কা তো থেকেই যায়। খুব পুরোনো আর বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে কয়েকটা ফ্ল্যাটে মাইনে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ওদের হাতে রাখা দরকার। তবে লেকের এদিক ওদিকের বস্তি থেকে যেসব ঠিকে ঝি আসে, তাদের ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ। সোমনাথ শুনেছে, এই বাজারে ওদের নাকি একটা ইউনিয়ন হয়েছে। এইসব ইউনিয়নবাজি করেই দেশটা গেল।

    দেশ-দশের বৃহত্তর স্বার্থে লকডাউনের পর্ব যত বেড়েছে, কাগজে-টিভিতে, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে অহর্নিশ অদৃশ্য মৃত্যুদূতেদের দিগ্বিজয়-বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে, ততই হাউজিংয়ের ভিতরে-বাইরে লক্ষণরেখা তত গভীর হয়েছে। কাগজের হকার, মাছ-আনাজের ফেরিওয়ালা, অনলাইনে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ই-কুলি মায় সুখাদ্যের ডেলিভারি বয়দের ঢোকাও এখন নিষিদ্ধ। পারতপক্ষে বাইরের জিনিস আনা বন্ধ। দুর্গরক্ষক সিকিউরিটির লোকেদেরও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফ্ল্যাটে যাওয়ার অনুমতি নেই। ওরাও যেসব জায়গায় থাকে তাতে রিস্ক নেওয়া যায় না।

    কমিটির নোটিশ পড়েছে: একান্ত দরকারি যে যা আনাবে, সব গেটে প্লাস্টিকের প্যাকেটবন্দি করে সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে রেখে যাবে। স্যানিটাইজার স্প্রে করে তা যতটা সম্ভব জীবাণুমুক্ত হলে বাসিন্দারা তা নিয়ে যাবে। এর জন্য কমিটি স্পেশাল স্যানিটাইজার ফান্ড খুলেছে। চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক। জারবন্দি ওই সবুজ-রং তরল জীবাণুনাশকের সাপ্লায়ার ছেলেটি কাউন্সিলরের শালা। চক্রবর্তীদা ওর সঙ্গে হেসে কথা বলে।

    সোমনাথ মিত্র কাফের ফিস ফ্রাই খুব পছন্দ করে। কিন্তু সাততলা নেমে স্যানিটাইজারের গন্ধমাখা ফিস ফ্রাই খেতে ওর হাঁটু আর জিভ কোনোটাই সায় দেয়নি। যত দিন যাচ্ছে, তত ফ্রাইয়ের জন্য প্রাণটা হু হু করছে। কিন্তু ও নিজেকে বোঝায়—এই ছোটো ছোটো স্যাক্রিফাইস মিলিয়ে এত বড়ো দেশটার ত্যাগ, তিতিক্ষা আর অনুশাসনের পরীক্ষা। শুধু বাজার থেকে খবরের কাগজটা থলের ভিতরে লুকিয়ে আনছে। পটিতে বসে কাগজ না পড়লে ওর যে নামে না!

    পঞ্চাননতলার কয়েক ঘর এই সুযোগে হোম ডেলিভারির ব্যাবসা খুলেছে। মাছ-ভাত থেকে পরোটা-আলুর দম-ডিম কষা, এগ চাউমিন সবই দিচ্ছে। রান্না থেকে রেহাই পেতে কাকলি কয়েকদিন আনিয়েছে। কিন্তু কমিটি নোটিশ দিয়েছে—নোলা সামলান। বস্তির পাঁচ ফুটের ঘরে আট জনের ভিড়ে ঘাপটি মেরে আছে যম। করোনা কামড় বসালে কমিটি দেখবে না। মোদ্দা কথা হল, যত ভাবে সম্ভব ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্স’ বজায় রাখতে হবে। কিন্তু সবাই সেটা বুঝলে তো!

    ~~~

    —একটু ভালো দেখে পটল এনো। দোরমা করব। আর দেখো তো বড়ো চিংড়ি পাও কি না। এখন নাকি সস্তা যাচ্ছে।

    সকালে কাকলির এহেন ফরমায়েস শুনে সোমনাথের জিভে জল এসেছিল। এই জন্যই বউকে এত ভালোবাসে। না বলতেই বুঝে নেয় ওর ইচ্ছেগুলো। আগে সন্ধ্যার বাজারে যেত। কিন্তু এখন সাত-সকালে দুতিন ঘণ্টার জন্য বাজার বসছে। দিদির সিভিক ভাইয়েরা লাঠি হাতে ভিড় সামলাচ্ছে। এক জায়গায় বেশি ভিড় জমে গেলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে যাচ্ছে। কখনও দু-ঘা কষিয়ে দিচ্ছে। হাতের লাঠি মানুষকে কতটা বদলে দেয়, তা ওদের দেখে বোঝা যায়। ভদ্রলোকদের অবশ্য জেঠু-কাকু, কাকিমা-মাসিমা বলে অনুরোধ করছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে পুরপিতার ভাই। মাইক ফুঁকে সবাইকে সরে যেতে বলছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে: দিদি নিজে বাজার ঘুরে মার্কা দিয়ে গেছে, কে কোথায় দাঁড়াবে।

    কিন্তু চিলুবিলু ভিড়ে মুখে মাস্ক এঁটে দু-গজ দূর থেকে মাছওয়ালার সঙ্গে দরাদরি কী সম্ভব! তার উপর দেড়া দাম চাইছে। ওদিকে নাকি বিদেশে গলদা-বাগদা যাচ্ছে না বলে ঘেরির লোকেরা কপাল চাপড়াচ্ছে। কিন্তু এদিকে দাম পড়ছে কই! কাঁইকাঁই করেও শেষে বাগদা চারশোর কমে দিল না। এদিকে চাল-ডালের দামও বেড়েছে সাপ্লাই নেই বলে। ভাগ্যিস সোমনাথ লকডাউনের শুরুতেই কুড়ি কেজি চাল-ডাল কিনে রেখেছে। কয়েক কেজি সস্তার কাটা মুরগিও।

    কিন্তু ফ্রিজে তো সবজির আড়ত বানানো সম্ভব নয়। তবে রক্ষে, আনাজ এখনও কম আক্রা। ভোজেরহাট, ঘটকপুকুর, বাসন্তী-ভাঙড়ের চাষিরা নাকি ট্রেন-ট্রাক বন্ধ বলে সস্তায় মাল ছেড়ে দিচ্ছে। আলুর মতো এসবের তো হিমঘর নেই। তা কুড়ি টাকা কিলো নধর পটল-ঝিঙ্গে-ঢ্যাড়শ বেশ কিছুটা তুলবে বলে বড়ো ব্যাগ নিয়েই বেরিয়েছিল সোমনাথ। বেশি নিলে আর একটু সস্তা হবে বলে দরাদরি করছিল। কিন্তু পেছন থেকে এক মহিলা এমন হামলে পড়লেন যে দোকানদার সোমনাথকে হাঁকিয়ে দিল। পৃথুলা মহিলার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে সোমনাথকে সরে আসতে হয়। তবে ও বলতে ছাড়েনি—“দেখেশুনে তো এডুকেটেড মনে হচ্ছে। কিন্তু কোনো সিভিক সেন্স নেই!”

    মাঝে পুরপিতা চ্যালাচামুন্ডাদের নিয়ে মাইক ফুঁকে দিদির ‘অনুপেরনা’য় বস্তিতে কিছু চাল-ডাল-আলু বিলি করেছে। এর মধ্যে কে টাকা ঝেড়েছে, কার নিজের লোক পায়নি—তাই নিয়ে ওদের দু-দলের মারামারিও হয়েছে। তবে হাউজিংয়ের দিকে ওরা আসেনি। বাজারফেরত সোমনাথ একদিন ওদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুনতে পেল—ওসব ভদ্দরলোকের হেভি পেস্টিজ জ্ঞান, বুইলে গ্যাঁড়াদা। গাঁড় ফাটবে কিন্তু মুখ ফুটবে না! চাল-ডাল নিতে হারগিস গেটে এসে দাঁড়াবে ভেবেছ? কাউন্সিলর নয়নশোভনের ডাকনাম যে গ্যাঁড়া, সেটা সোমনাথ জানত না। তার উত্তর কানে এল—সেটা ঠিক বলেছিস ভল্টু। ওদের বুথে আমাদের ক-টাই বা ভোট। সব মাকু ছিল, এখন বেশিরভাগ ভাকুদের ভক্ত। ফালতু ভাত ছড়াব কেন? চল বে, গাড়ি ঘোরা।

    সোমনাথ কিন্তু বাজারে ওদের বিলি করা মুড়ির প্যাকেট নিয়েছে। শান্তিনীড়ের গেট থেকে দূরে পেলে চাল-ডালও নিত। কবেই তো কবি বলে গেছেন—অপমানে হতে হবে সবার সমান।

    আনোয়ার শাহ রোডের মুসলমান পাড়া থেকে কয়েকজন ফিরিওয়ালা সবজি আর ফল বেচতে এদিকে এসেছিল। ভ্যানরিক্সা কি মাথায় ঝাঁকা করে আনা ব্রকোলি-বেবি কর্ন-ক্যাপসিকাম-বিনস, আপেল-আঙুর-আম-তরমুজ সাজিয়ে শান্তিনীড়ের গেটে ওদের পসরা নতুন নয়। সোমনাথ-কাকলি আগে ওদের থেকে কিনেছে। কিন্তু এখন কমিটি সিকিউরিটি দিয়ে ওদের ভাগিয়ে দিয়েছে জেনে স্বস্তিই পেল। সিভিক পুলিশও এসেছিল ডান্ডা নিয়ে। ওদের এলাকা নাকি রেড জোন। ঘিঞ্জি এলাকায় গায়ে নিশ্বাস ফেলা বসতি। তার উপর লকডাউনের নিয়মকানুন নাকি মানছে না ওরা! সোমনাথ-কাকলি সেসব নিয়ে বলাবলি করে।

    —টিভিতেই তো দেখাচ্ছে, ওদের জাতভাই ওই তবলিগওয়ালাদের জন্য দিল্লি থেকে তেলেঙ্গানা মহামারি ছড়িয়ে গেছে। কলকাতা থেকেও লোক গিয়েছিল। এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের নিয়ে এই হয়েছে মুশকিল। একে আকাট মূর্খ, তায় মোল্লাদের তালুবন্দি। দেশের ভালো দূরের কথা, নিজেদের ভালোও বোঝে না। শুনছ না, এর পিছনে পাকিস্তানের চাল! ফল-মূলে থুতু মাখাচ্ছে, মসজিদে বসে হাঁচি-কাশির কমপিটিশন করছে, লালামাখা টাকা রাস্তায় ফেলে রাখছে। এভাবে মহামারি ছড়িয়ে ভারতকে ধনেপ্রাণে মারার চেষ্টা। দিল্লি-ইউপিতে তো এখন ওদের হাউসিং এলাকায় ঢুকতে দেখলেই প্যাঁদাচ্ছে। ওদের থেকে সবজি-ফল কেনা বন্ধ। তবে কলকাতার কালচার আলাদা। আমরা শিক্ষিত বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে আলাদা করি না। তাই শুধু খেদিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

    —ঠিক বলেছ। আরে হিন্দু-মুসলমান বলে ব্যাপার নয়। হিন্দু পাড়াতেও কি কম নজরদারি? গলিতে গলিতে এখন ঢোকা-বেরুনোর মুখে বাঁশের বেড়া। ইটের পাঁজা, বালি কি খোয়ার বস্তা দিয়ে ব্যারিকেড। এপাড়ার লোক ওপাড়ার লোককে মাপছে। বাইরের লোক মনে হলেই জেরা চলছে। গেরিলা কায়দায় সেসব ডিঙিয়ে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গলে দোকান-বাজার যাচ্ছি। সবই যে পাড়ার লোকের স্বার্থে। এই ব্যাপারে দেখছি ঘটি-বাটি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, রুলিং পার্টি-অপোজিশন সব এক।

    তা চৌষট্টির রায়টের সময়, পঁয়ষট্টি বা একাত্তরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময়, কি নকশাল আমলে এসব দেখেছি, বুঝলে। এদিকে রোজ সন্দেহভাজন, উপদ্রুত এলাকার সরকারি নকশা বদলাচ্ছে। এই পাড়া আজ অরেঞ্জ তো কাল রেড। ভুলভুলাইয়ার মতো খোপের মধ্যে খোপ, দেয়ালের মধ্যে দেয়াল। রেড জোন, কন্টেনমেন্ট জোন—কোন্‌টার মধ্যে কোন্‌টা, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ গো, দারুণ গন্ধ বেরিয়েছে তো! রান্না শেষ? স্নানে যাব?

    ~~~

    এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও বাকি দেশের মতো কলকাতাতেও মড়ক-মৃত্যু বেড়ে গেছে। এর জেরে ক-দিন ধরেই শান্তিনীড়ে প্রবল ফিসফিসানি। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে কমিটির নির্দেশ: পাশের ফ্ল্যাট থেকে হাঁচি-কাশির কি ঘন ঘন নাক টানার শব্দ পেলেই রিপোর্ট করুন। সেক্রেটারি অবশ্য এসব গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বদমায়েশ ছেলেপিলেরা এ নিয়ে নানাজনকে উত্যক্তও করছে বলে নালিশ এসেছে। এই সবের কারণে সশব্দে হাঁচি-কাশি প্রায় শোনা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বুড়োদের মধ্যে জ্বর-জ্বালা, হাঁপানি-শ্লেষ্মা, ঘড়ঘড়ানি-বুক ধড়ফড়ানির গপ্পো থেমে গেছে। আগে ফি সন্ধ্যায় শান্তিনীড়ের ছোট্ট কমিউনিটি হলে বুড়োদের আড্ডা বসত। মাঝেমধ্যে নামগান, গীতা পাঠও হয়। ইদানীং সোমনাথও যেত। বেলা যে পড়ে এল। এখন আড্ডা বন্ধ।

    সেদিন ঘরে বসে থাকতে না পেরে নিয়মকানুন ভুলে সোমনাথ তাসের আড্ডার বন্ধু দত্তদার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মেরেছিল। বেশ কিছুক্ষণ বেল বাজানোর পর দত্তবউদি দরজা খুললেন বটে। পিছন থেকে দত্তদার ফ্যাঁসফেঁসে গলা পাওয়া গেল—“শরীরটা ভালো নেই হে। ভালোয় ভালোয় বিপদটা কেটে যাক। ক-দিন পরে বসব।” দত্তদার চোখে মৃত্যুভয়ের ছায়া স্পষ্ট দেখেছে সোমনাথ।

    ওর দোষ কী! টিভি-ফোনে সারাক্ষণ বিভীষিকার সাতকাহন। যদিও সারাক্ষণ তোতাবুলিতে কান ঝালাপালা—আতঙ্ক আর গুজব ছড়াবেন না। ফলে সাবান জল কি স্যানিটাইজারে হাত ধুতে ধুতে হাতে হাজা ধরে গেল। নিজের নাকমুখকে এত দূরের, অস্পৃশ্য ভাবা যে কী কঠিন কাজ, সোমনাথ তা মর্মে মর্মে বুঝছে। প্রথমটায় মুখে মাস্ক এঁটে ফ্ল্যাটবাড়ির লোক বারোয়ারি চৌহদ্দি মাড়ালেও এখন একে অপরকে ভয় পাচ্ছে। কার নিশ্বাসে বিষ, কে জানে? অবশ্য কিছু সুবিধেও হয়েছে। আগে সিঁড়ি বা করিডরে দেখা হলে, ইচ্ছে না থাকলেও দেঁতো হাসি হাসতে হত। এখন মুখোশে ঢাকা দাঁত দেখানোর দায় নেই। দূর থেকে ছুড়ে দেওয়া কুশল-জিজ্ঞাসাও অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য। দেখতে বা চিনতে না পারার ভান করে অপছন্দের লোকগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ বেড়েছে। যদিও বাইরের সন্দেহভাজন লোকগুলোকে যেভাবে আটকানো সম্ভব, ভেতরে এহেন বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে তা বেশ মুশকিল। ফলে গোয়েন্দাগিরি বাড়ছে। বিশেষ করে যারা বিদেশ থেকে ফিরেছে অথবা হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স ইত্যাদি বিপদজনক পেশায়।

    এই নিয়ে সেদিন এ ব্লকের রবীনদাদের ফ্ল্যাটে তুলকালাম বেঁধে গেল। উনি আর মোহিনীবউদি যে লকডাউনের আগে দুবাইতে মেয়ে-জামাইয়ের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলেন, সেটা কথায় কথায় বেরিয়ে গেছে। এমনিতেই কত্তা-গিন্নি মেয়ে-জামাইয়ের চাকরির ঠাঁটবাট, গাড়ি-বাড়ি নিয়ে সাতকাহন বলার সুযোগ ছাড়েন না। তার উপর এবার পাশের ফ্ল্যাটে মরুভূমির দেশের খেজুর বিলিয়েছেন। ওই খেজুরে গপ্পোই পল্লবিত হয়ে খবর হয়েছে: ওদের ফ্ল্যাট থেকে মেয়েলি গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ তো থাকে না। তবে কি রবীনদার কিছু হল? মোহিনীবউদি দরজা খুলতে রাজি না হওয়ায় সন্দেহটা বাড়ে। আজকাল তো পচে গন্ধ না বেরোনো পর্যন্ত বডি আঁকড়ে পড়ে থাকার খবর খুব বেরোয়। এখন হলে গোটা শান্তিনীড়ের বড়ো বিপদ।

    সিকিউরিটি দরজা ধাক্কিয়ে হালে পানি না পাওয়ায় কমিটির কেষ্টবিষ্টুরা সদলবলে হাজির হন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ডাকার ভয় দেখিয়ে দরজা খোলানো হয়। দেখা যায়, স্বামী- স্ত্রী দুজনেই বিধ্বস্ত অবস্থায়। তবে ওদের কিছু হয়নি। ওদের জামাই অফিসের কাজে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিল। সেখানে করোনায় মারা গেছে। শুনে খুব কষ্ট পেল সোমনাথ। কাকলিকে এসে বলায় ও বুড়ো-বুড়ির জন্য খাবার পাঠিয়ে দিল।

    পরদিন অবশ্য চক্রবর্তীদার ফরমান—বুড়ো-বুড়িকে টেস্টিং করাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। কিন্তু রবীনদা কিছুতেই যাবেন না। হাসপাতালে গেলেই নাকি উনি মরে যাবেন। জোরাজুরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় একদা পুলিশের ছোটোকর্তার সে কী কান্না! দেখে সোমনাথের চোখে জল এল। কিন্তু সকলের স্বার্থে কড়া হতেই হবে যে।

    ওদের যদি বা প্রায় বিনা বাধায় বের করা গেল, পরশু বি ব্লকে ডাক্তার পালের সে কী ত্যাণ্ডাই- ম্যান্ডাই! আরে বাবা, আইডি-তে সরকারি ডাক্তার হয়েছ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ? তোমার বউ বাঙ্গুরের নার্স। দুজনেই সারাক্ষণ ওই বিষ-নিশ্বাসের রুগি ঘাঁটছ। এদিকে তোমাদের ছেলেমেয়ে দুটোও এখানে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশছে। ভাড়াটে হলে তো কবেই বের করে দেওয়া হত। নিজেদের ফ্ল্যাট বলেই রেয়াত করে বলা হচ্ছে: ক-টা মাস অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। কোথায় যাবে তা আমরা কী জানি! আত্মীয়স্বজন নেই নাকি? হোটেলে থাকো, নইলে হাসপাতালে থাকো। তোমাদের জন্য আমরা সবাই মরব নাকি? একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমাদের? নো সিভিক সেন্স? তার উপর মন্ত্রী-পুলিশের ভয় দেখাচ্ছ?

    হ্যাঁ জানি, টিভিতে-ফোনে সর্বক্ষণ বাতেলা চলছে: চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী-পুলিশ-সাফাইকর্মীরা করোনা যোদ্ধা। ওদের সম্মান করুন, সহযোগিতা করুন। আরে বাবা, দূর থেকে জ্ঞান দিতে সবাই পারে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। মন্ত্রীদের ধক থাকলে নিজেদের বাড়িতে তোমাদের রাখুক না! পুলিশ এসে পালেদের ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল বটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তিনীড়ের বাকি বাসিন্দাদের ঐক্যের জয় হয়েছে।

    সমবেত বয়কট তো আছেই, তা ছাড়া ঢোকা-বেরোনোর মুখে ছেলেপিলের প্যাঁক। সবচেয়ে মোক্ষম প্যাঁচ ছিল: মেইনটেনান্স স্টাফ ওদের ঘরের সামনে থেকে ময়লার প্যাকেট তোলেনি। ব্যাস, ফণা নেমে গেল। ওরা তালা বন্ধ চলে যাওয়ার সময় বাচ্চা দুটো কাঁদছিল। সোমনাথের খারাপ লাগছিল। কিন্তু কী করা যাবে। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত অধিকাংশের স্বার্থরক্ষায় কঠোর হতেই হচ্ছে। কমিটি ইলেকশনের সময় এসব ইস্যু হলে তখন কী বলবে সেটা পরে ভাববে। এখন মাথার উপরের খাঁড়াটা তো সরুক।

    ~~~

    সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসেছিল সোমনাথ। কাকলি রুটি করছে। হঠাৎ ঝড় উঠল। কিন্তু কালবৈশাখীর মতো কিছুক্ষণ উড়িয়ে-ঝরিয়ে শান্ত হল না। বরং উথালপাথাল হাওয়ার দাপট বেড়েই চলেছে। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। বাজ পড়ছে না বটে। কিন্তু বিদ্যুৎরেখায় আকাশ চিরে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী উদ্‌বেগে বাইরে তাকায়। সোমনাথ ছুটে গিয়ে ব্যালকনির দিকের কাচের স্লাইডিং ডোর, বন্ধ করল। বৃষ্টির ঝাপটায় বেশ ভিজেও গেল। টিভিতে সাবধান করেছে বটে। কিন্তু ক্রমশ প্রবল এমন ঝড় এর আগে ওরা দেখেনি। মহামারির অদৃশ্য ভাইরাসটা যেন হঠাৎ প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের রূপ পেয়েছে। সিনেমার গডজিলা বাস্তবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যত দূর চোখ যায়। ওর লেজের ঝাপটে উপড়ে পড়ছে গাছপালা, লাইটপোস্ট, উড়ে যাচ্ছে বিরাট বিরাট ফ্লেক্সবোর্ড, টিন-কাঠ। অতিকায় জন্তুটার পায়ের তলায় চাপা পড়ছে গাড়িঘোড়া, বাড়িঘর। সাততলাতেও উঠে আসছে প্রলয়ের শব্দ। থরথর করে কাঁপছে ফ্ল্যাটবাড়ি। টিভির কেবল লাইনটা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের আলোও নিভে গেল। ভেঙে পড়ল শোবার ঘরের জানালার কাচ। ভীত কাকলি পাপাইয়ের ঘরের দেয়াল হাতড়ে ঠাকুর-দেবতার কুলুঙ্গি থেকে শাঁখটা বাজাতে শুরু করল। একটু পরে শান্তিনীড়ের নানা ফ্ল্যাট থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। মনে একটু জোর পেল সোমনাথ।

    কিন্তু দানবীয় প্রাণীটার রোষ কমছে কই! ও আরও বেশি বেশি ফুঁসে উঠছে। ব্যালকনির দিকের পুরু কাচটায় আছড়ে পড়ছে ওর ক্রুদ্ধ বিষ-নিশ্বাস। এখনি সেটা ভেঙে ঢুকে পড়বে সোমনাথদের সাধের ফ্ল্যাটে। স্বামী- স্ত্রীর তিলে তিলে সাজানো ঘরকন্না চুরমার করে দেবে। পিষে মারবে দুজনকেই। প্রবল তরাসে স্বামীকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠল কাকলি—“ঠাকুর, রক্ষা করো!” আতঙ্কে কুঁকড়ে ওঠে সোমনাথও। আঁকড়ে ধরে বউকে। কতক্ষণ দুজনে এভাবে মুহ্যমান বসে থেকেছে আন্দাজ নেই। কখন ঝড় থেমেছে তাও খেয়াল করেনি।

    সংবিৎ ফিরতে কাকলিকে প্রায় কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। সে এখনও তরাসের ঘোরে কাঁদছে। পাপাইকে ডাকছে। ওকে শান্ত করতে মাথায় হাত বুলোতে লাগল সোমনাথ। এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল।

    ভোরের দিকে শীতবোধে সোমনাথের ঘুমটা ভেঙে গেল। পায়ের কাছের চাদর টেনেও শীতটা কমছে না। নিজের গলায়-কপালে হাত দিয়ে দেখল, গা বেশ গরম। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হয়তো গত সন্ধ্যার ঠান্ডা জলের ঝাপ্টাটা বসে গেছে। কিন্তু বুকটায় চাপ ধরে আছে। দম আটকে আসছে। উঠে বসে জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে কাশি উঠল। অন্য সময় হলে গা করত না সোমনাথ। ঝড়-বাদলের দিনে, তাপমাত্রা ওঠানামার মধ্যে এমন তো হয়েই থাকে। তার উপর সিগারেট-বিড়ি খায়। ফুসফুস এমনিতেই কমজোরি। গ্যাস-অম্বল নিত্যসঙ্গী। তার উপর চিংড়ি খেয়েছে। কিন্ত এখন খুব ভয় পেয়ে গেল সোমনাথ। এসব কীসের লক্ষণ? তবে কি দত্তদার ঘরে খাবার পৌঁছোনোর ভালোমানুষিটাই কাল হল? ওদের মুখে তো মাস্ক ছিল না। ঘরে এসে হাত ধুতে ভুলে গিয়েছিল কি? মনে পড়ছে না। ভয়টা বাড়ছে। একবার ভাবল, কাকলিকে ডাকে। এক কাপ আদা-চা পেলে ভালো হত। কিন্তু অঘোরে ঘুমুচ্ছে সে।

    প্রবল অস্বস্তি নিয়ে টিভির সামনে এসে বসে সোমনাথ। মনটাকে শান্ত করতে মানুষের গলা শুনতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লাইন নেই এখনও। স্তব্ধ চৌকো বাক্সটা যেন গিলে খেতে আসছে। হঠাৎ নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। পাশের ফ্ল্যাটের লোককেও ডাকার উপায় নেই। হাউজিংয়ে জানাজানি হলেই দত্তদাদের মতো হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। সেখানে স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দেবে। আত্মীয়-বন্ধুর ফোনে আর কাগজ পড়ে সোমনাথ ইতিমধ্যেই জেনেছে সেখানে করোনা-পরীক্ষার নামে কী প্রবল হয়রানি চলছে। কোয়ারান্টিনে থাকলেও অচ্ছুতদের মতো ব্যবহার মিলছে। আর যদি সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়? তবে কি ছোটো শালাকে জানিয়ে রাখবে? কিন্তু মোবাইল টেপাটেপি করে যে লাইন মিলছে না। গড়িয়াহাটও পরিসেবা সীমার বাইরে। একবার পাপাইকে ট্রাই করবে? কিন্তু লকডাউনের মধ্যে ও কী ভাবে সাত সমুদ্দুর পার হয়ে পৌঁছবে? মরার আগে কি একমাত্র সন্তানকেও দেখতে পাবে না?

    এদিকে কাগজেই তো বেরোচ্ছে হাসপাতালে মরে গেলে বাড়ির লোককে খবর না দিয়েই পুড়িয়ে ফেলছে, নয় দেরিতে জানাচ্ছে। অনেক সময় বাড়ির লোকেও লাশ নিতে চাইছে না। মর্গে বডি পড়ে পচছে। নিলেও আষ্টেপৃষ্ঠে পুরু প্লাস্টিকে মোড়া বডি কেউ দেখতে পাচ্ছে না। পরিবার-আত্মীয়-বন্ধু-পাড়াপড়শি সবার কাছেই ভাইরাসে খুবলে-খাওয়া সেই শব ভয়ংকর দানোয় পাওয়া বিভীষিকা। শ্মশানে-মশানে চরা কালের করালমূর্তি। বাঁধন খুললেই মৃত্যুবীজগুলো হাওয়ায় উড়তে শুরু করবে শিকারের সন্ধানে। জীবনভর মৃত্যু ঘিরেই যাঁদের রুটিরুজি, তারাও ভয়ে সৎকারে রাজি হচ্ছে না। কোনোরকমে চুল্লিতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে লাশ।

    এভাবে পুলিশ পাহারায় সমাজবিরোধী দাগি আসামি, দেশদ্রোহীর মতো পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে দিশাহারা সোমনাথ গুমরে কেঁদে উঠল। কিন্তু নিজের কানে সেই শব্দ যেতেই তড়িঘড়ি মুখে চাপা দেয়। আশেপাশে কেউ যেন শুনতে না পায়। তাহলেই তো গণশক্র বলে দাগিয়ে দেবে।

    হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল। ভেজা দৃষ্টির আলো-ছায়ায় সোমনাথ দেখতে পেল, টিভিটা হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ কী? পর্দা জুড়ে সেই দানবটা লেজ আছড়াচ্ছে! ওর মাথায় সোনার মুকুট। চোখে চশমা। মুখে মাস্ক। এবড়োখেবড়ো ইস্পাতের ফলার মতো দাঁতগুলো তাতে পুরোটা ঢাকা পড়েনি। দুই লাল চোখে অদ্ভুত ক্রুর হাসি। পায়ে পায়ে ও সোমনাথের দিকে এগিয়ে আসছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৯ জুন ২০২০ | ২২৯৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমেন | 2405:8100:8000:5ca1::404:***:*** | ০১ আগস্ট ২০২০ ০০:০২95771
  • ভালছে দাদা
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন