এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • রামচরিত মানস: নতুন পর্ব

    বিশ্বজিৎ রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৭ মে ২০২০ | ২৬৪৬ বার পঠিত
  • “প্রভু চরিত্র, শুনিবে কো রসিয়া। রাম লখন সীতা মন বসিয়া।।”

    ওরা হাঁটছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। খিদেয় তলপেট মুচড়ে উঠছে থেকে থেকে। সুরজ মহারাজ এখন মাথার উপরে। চৈত পেরিয়ে বোশেখ আসতে যায়। ভোরের দিকে পুবাইয়া হাওয়ার মিঠে ভাবটা কেটে গিয়ে রোদের তাত ক্রমশ বাড়ছে। ওদের হাঁটার গতি কমে আসছে। কাঁধের গামছা টেনে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে পিঠের ভারী বোঁচকাটা নামিয়ে একটু দাঁড়ায় রাম। বাঁ হাতের করতল টুপির কানাতের মতো চোখের উপর রেখে সামনে অতিকায় অজগরের মতো এলিয়ে থাকা হাইওয়ের ওপারে দিগন্তকে ঠাহর করার চেষ্টা করে। সকালের দিকে আকাশে ছিল চালধোয়া জলের রং। বেলা বাড়ার সঙ্গে সেখানে নীলের আভাস। কয়েক টুকরো পরিযায়ী মেঘ ইতিউতি ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু চিরপ্রকাশকে ঢেকে দেওয়ার ক্ষমতা ওদের নেই। দূরে কয়েকটা চিল-শকুনের ওড়াউড়ি। রাম চোখ কুচকিয়ে দৃষ্টিসীমা বাড়াতে চাইলেও ক্ষণিক পরেই তা ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। পিছন থেকে হা-ক্লান্ত সীতার গলা ভেসে আসে।
    -এ লবুয়া কে বাবু, মুলুক কিতনা দূর বা? বাঁচোয়া অউর চলত নেহি সকত, সমঝে কি না!
    এতক্ষণ লব-কুশ বাপের ধমকের ভয়ে চুপ করে ছিল। এখন মায়ের কথা শুনে ফুঁপিয়ে ওঠে। রাম পিছন ফিরে প্রথমটায় চোখ পাকায়। কিন্তু যমজ বাচ্চাদুটোর হাল দেখে নরম হয়। সবে পাঁচ পেরিয়েছে দুজনে। এক জনের কান্না এতক্ষণে অন্যে সংক্রমিত। পিছিয়ে গিয়ে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অক্ষম বাপ আর কি বা করতে পারে।
    --অউর তানিক চলনা হ্যায় বাবুয়া। সামনে জরুর কোই গাঁও-বাজার মিলবে করেগা। জিলাবি খরিদকে খিলাবে। সচ্চি।
    সীতা বুঝতে পারে স্বামী মিথ্যে প্রবোধ দিচ্ছে। ঝাঁঝিয়ে উঠতে যায়। কিন্তু মরদের বিপন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ মেরে থাকে।
    কাল রাত থেকে চারজনের পেটে দানাপানি পড়েনি। তার উপর এই অন্তহীন হাঁটা। পিঠের বোঁচকায় আনা চালডাল শেষ। কাল দুপুরে এক জায়গায় আম পাবলিকের লঙ্গরখানায় ভোর থেকে লাইন দিয়ে এক ডাব্বা খিচুড়ি মিলেছিল বটে। কিন্তু সন্ধ্যায় তিন ডবল লোকের ভীড়। স্থানীয় বস্তির লোক আর বাহিরি মজদুরদের মধ্যে ভাগাভাগি থেকে মারামারি। খিচুড়ির বদলে মিলেছে পুলিশের মার। জীবনে কতবার কত জায়গায় যে ‘বাহিরি’ হতে হল, ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাম।
    চার দিন আগের রাতে ডেরা ছেড়ে বেরোনোর পর প্রথমে রেল স্টেশনে গিয়ে শুনতে পায় সব ট্রেন বন্ধ। চারদিকে গিজগিজ করছে ওদেরই মতো হাপিত্যেশ যাত্রীর দঙ্গল। কোন রকমে আনন্দপুরের বাস টারমিনাসে গিয়ে দেখে সেখানেও বিপুল ভিড়। বাসও চলছে না। কেউ কেউ বলছিল, সরকার ঘুমিয়ে পড়ার পর গভীর রাতে কিছু বাস ছাড়বে ইউ পি-র দিকে। যাদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা, তারা নাকি আগে ‘চানস’ পাবে। দালালরা চড়া দামে তার টিকিট দিচ্ছে। গাদাগাদি লাইন লাগিয়ে, ধাক্কাধাক্কি করে রাম দেড়া টাকায় সেই টিকিট কিনেছে। কিছু বাহুবলী লাইন ম্যানেজের নামে দাদাগিরি ফলাচ্ছিল, মারধর করছিল। গায়ে-গতরে জোয়ান হলেও এমনিতে শান্তশিষ্ট রাম তাদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। তখন ভাবছিল, এই বিপদের সময় ওর ন্যাওটা লক্ষণটা দেশে খেতিবারিতে পড়ে না থেকে যদি সঙ্গে থাকত। শেষ পর্যন্ত বাস ছাড়ল না। দালালগুলো রামেদের চুনা লাগিয়ে ভেগে পড়ল। সংসারের খরচ বাঁচিয়ে সীতার অনেক কষ্টে জমানো টাকাগুলো জলে গেল।
    এদিকে হাজার হাজার লোকের খিদে- তেষ্টা তুঙ্গে। ফলে টারমিনাস চত্বরে রুটি-বিস্কুট-চা-বিড়ির দোকানে চিলুবিলু কাড়াকাড়ি। দেড়া দামে রাম একটা পাউরুটি জোগাড় করে ছেলেদুটোর হাতে দিতে পারলেও ধাক্কাধাক্কিতে ওদের হাত থেকে আধখাওয়া রুটি পড়ে যায়। রাম তা কুড়োনোর আগেই ভিড়ের পায়ের তলায় পিষে যায় সেই দুর্লভ খাদ্য। রাগে-দুঃখে বাচ্চাদুটোকে দুঘা কষিয়ে দেয় রাম। এমনিতে পারতপক্ষে বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলে না। কিন্তু চার দিন ধরে ওদের দুনিয়াটা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। দুর্বিপাক- দুর্ভাবনায় শরীর-মন কোনটাই বশে নেই। রক্ত-মাংসের মানুষ তো, সামলাতে পারেনি।



    দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমান্তে লোনিতে হাইওয়ের অদূরে গাড়ি সারানোর গ্যারেজে মিস্ত্রির কাজ করে রামভরোসে রাম। গাঁয়ে থাকতে ওর কালো সুঠাম চেহারাটা দিগরের উঠতি বয়সের মেয়েদের চোখ টানত। গঞ্জের চাক্কিতে কাজ করার সময় গেহু ভাঙ্গাতে এসে শ্যামলা সীতা ওর প্রেমে পড়ে। ওর আটামাখা মূর্তি দেখে পুরু ঠোঁট মটকে হাসত। সেই হাসি চোখের খেলায় বদলে গেলে একদিন সুযোগ বুঝে রাম প্রেম নিবেদন করে। কদিন পরেই অবশ্য পাসির মেয়ে সীতা নাক বেঁকায়— তাল-খেজুরের রস নামিয়ে গুড় বানানোর দিন গিয়েছে বটে। এখন তাড়ি বেচে ঘর চালালেও দুসাদ জামাই ওর বাপজি মানবে না। জাতপাতের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কে ঘাসি-পাসিরা অছুত শুয়র দুসাদ একটু এগিয়ে যে। ওকে পেতে হলে পালাতে হবে। রামজি তো দিনভর চাক্কি পিসিং। উসকি কামাই সে ঘর থোড়ি চলেগা। দিল্লি-বম্বে-সুরাত কামধান্ধায় যেতে হবে। আশেপাশের কত ছেলে যাচ্ছে। পরে অবশ্য শ্বশুর মেনে নিয়েছে। কিন্তু দিল্লি কা লাড্ডু খাওয়ার পর রাম আর পেছনে ফেরেনি। নানা ধান্দা ঘুরে এখন দিনভর এক্সেল-পিস্টন-প্যাঁইয়া নিয়ে কাম। ক্ষয়াটে চেহারা দেখে বোঝা যায় বয়স আর খিদে থাবা বসিয়েছে। তুলনায় সীতাকে দেখে ওর বারোমাস্যার ঝক্কিটা বোঝা যায় না। রাস্তার চাপাকল থেকে বালতি বালতি জল টেনেও এখন জানকী একটু পৃথুলার দিকে।
    রোজ সন্ধ্যায় বাতিল ডিজেল ঘষে হাতপায়ের কালিঝুলি মুছে মউঝপুরার গলির চিলতে খোলিতে ফিরে রাম সামনের বারোয়ারি দাওয়ায় খাটিয়া পেতে একটু জিরোয়। এই সময় হনুমান চালিশা পড়া ওর অভ্যেস। গাঁয়ে থাকতে পিতাজি ওকে শিখিয়েছে। “যো য়হি পঢৈই হনুমান চালিশা। হোয় সিদ্ধি সাখী গৌরীসা।।” সঙ্কটমোচনজির নাম নিয়ে সিয়াবর রামচন্দ্রজির গুণগান না করে রাতের রুটিতে হাত দিবি না বেটা-- অছুত ঘরে জন্ম হলে কি হবে, কামিয়া বাপের শিক্ষা ছিল এটাই। দশরথ দুসাদের বেটা দুই কোশ দূরের ইস্কুলে বাভন- ভূমিহার- বাবু ভাইয়াদের ছেলেপুলেদের থেকে দূরে পিছনের সারিতে বসে অক্ষর চিনেছে। পরে লোহিয়াজির ভক্ত মাস্টারজির কল্যাণে হনুমান চালিশা আর রামচরিত মানস পড়তেও শিখেছে।
    ওর গলায় সুরের আভাস থাকায় ইস্কুল ছুটির পর বাভন মাস্টারজি ওকে তুলসীদাসজির দোহা আর চৌপাই মুখস্ত করিয়েই ক্ষান্ত হননি। বাপ মরার পর ক্রিয়াকর্মের দিন একটা পুরোন মানস ওর হাতে তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করেন— বরনাশ্রম নিজ নিজ ধরম নিরত বেদ পথ লোগ। চলহি সদা পাবহি সুখহি নঁহি ভয় সোক ন রোগ।। যাহা ভি যাও, আপন আপন জাতি-ধরম কা পালন করোগে তো সদা সুখ মিলেগা। ভয়-শোক, রোগ-দুখ দূর রহেগা। বুঝলো কি না বেটা?
    শিক্ষাটা সমস্তিপুরের অজ গাঁ থেকে রাজধানীর বস্তিতে এসেও ভোলেনি রাম। ইদানীং তো ছুটি পেলে বিকেলে দাওয়ায় বসে কাচা ধুতি আর গলায় লাল গামছা ঝুলিয়ে, কপালে বাসন্তী রঙের তিলক কেটে তুলসীদাসজির ভাবসাগরে ডুব দেয় রাম। বিশেষ করে লঙ্কাকান্ডের পর উত্তরকান্ড পড়তে খুব ভালবাসে রাম। “ অল্পমৃত্যু নহি কবনিউ পীরা। সব সুন্দর সব বিরুজ শরীরা।। নহি দ্ররিদ্র কোউ দুখী না দীনা। নহি কোউ অবুধ ন লচ্ছন হীনা।। দণ্ড জতিনহ কর ভেদ যহু নর্তক নৃত্য সমাজ। জিতহু মনহি সুনিও অস রামচন্দ্র কে রাজ।।”
    অর্থাৎ, বাচ্চে অউর জওয়ান কে মৃত্যু বন্ধ হো গইলে। বিমারি-উমারি সব খতম। সভি লোগ সুন্দর অউর সোয়াস্থ বনি। না রহি দুখ-দরদ, না গরীবি কি ভুখমরি। কিসিনে মুরখ নাহি রহলে । সব কে চেহেরে মে শুভলচ্ছন দিখাই পড়ি। সুর তাল কে ভেদ বিনা অউর কোই ভেদ না রহি। সমাজকে কোই কিসিকে দুষমনি না মোলে তো রাজা কা দন্ড কা ভি কেয়া কাম। দন্ড রহি তো শ্রিফ সন্ন্যাসী কা হাত মা। অব ইনসান কো জিত না হ্যায় তো স্রিফ আপনি মন কো। সব চেয়ে বড় কথা, রাম রাজ্যে ‘বাজার রুচির ন বনই বরনত বস্তু বিনু গথ পাইএ’-- বাজারে বিনে পয়সায় জিনিস মেলে। স্বয়ং তুলসী গোস্বামী যখন লিখে গেছেন তখন তো তা মিছে কথা নয়।
    এক রাম আর এক রামের বহুশ্রূত কিন্ত চিরনতুন স্বপ্নরাজ্যের বর্ণনা পড়তে পড়তে ভাবের ঘোরে কেঁদে ফেলে। ওর সুর করে পড়া আওয়ধি-র মিঠে বোলিতে শাহী দিল্লি থেকে দূরে ঘিঞ্জি গলিতে ক্ষণিকের জন্য হলেও অযোধ্যার রামরাজ্য নেমে আসে। সামনেই রাখা রঘুপতির অভিষেক দৃশ্যের ফোটো। শ্রোতা বস্তির দেশোয়ালি বুড়ো-বুড়িদের ভিড়ও বাড়ছে। এতে খোলির লোকজন আজকাল ওকে বেশ মান্যিগণ্যি করে। গাঁয়ে থাকতে ‘দুসাদ পণ্ডিত’ বলে উঁচু জাতের অনেকে ব্যঙ্গ করলেও খোলিতে এসব তেমন শুনতে হয় না। অন্তত প্রকাশ্যে।
    রাম টের পায়, দিন কে দিন ওর ভিতরে সাত্ত্বিক ভাবটা বাড়ছে। তাই নবরাত্রি- রামনবমী পর্বে তো বটেই, তিথি- পার্বণ মেনে উপোষ করছে। পুজো-আচ্চার দিন ছাড়াও শাকাহারী ভোজন এখন ওর পছন্দ। এসব দেখে গ্যারেজের সহকর্মীরা, বিশেষতঃ গাড়ি সারাতে আসা ড্রাইভার- কুলিরা আওয়াজ দেয় বটে। ওদের লাইনে নেশাভাং স্বাভাবিক হলেও ওকে আজ পর্যন্ত কেউ দারু ধরাতে পারেনি। নেশার মধ্যে শুধু খইনি। তাও ছেড়ে দেবে ভাবছে।
    সীতা অত ধর্মকর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। স্বামীকে শুনিয়ে দেয়--পরটিন চাহিয়ে বাচ্চোকো, নাহি দিমাক কা বাত্তি ক্যায়সে জ্বলেগা জি? টিভিতেই তো বলে, শাকসব্জি-দুধ ছাড়াও ছেলেদের একটু আধটু ডিম-মাংস না খাওয়ালে ওরা বাড়বে না। বউয়ের চেঁচানোকে একটু ভয়ই পায় রাম। গাঁইগুই করে তাই মাঝেমধ্যে আমিষ আনে। বস্তুতঃ সীতার যাবতীয় ভালমন্দের ধারণা টিভি থেকেই। টিভিই ওর বেদ-পুরাণ, রামায়ণ- মহাভারত। সন্ধ্যের সিরিয়ালগুলো না গিললে জানকীর রাতের ঘুম বরবাদ। সন্ধ্যেয় ছেলেদের চৌকিতে বসিয়ে নিজে মেঝেয় দু পা ছড়িয়ে আটা মাখতে মাখতে সবেধন ছোট আলমারিটার মাথায় থিতু টিভিতে চোখ সেঁটে বসে। ছেলেদুটো তো এখনও ইস্কুলের দরজা মাড়ায়নি। বাপের কাছে অক্ষর শিক্ষা চলছে। বাপের দুলে দুলে চালিশা আর মানস পাঠ ওদেরও খুব পছন্দ। সুযোগ পেলেই আধো আধো গলায় নকল করে দু ভাই। রামজি আর সীতা মাইয়ার ফটোর সামনে গড় করার সময় অবশ্য ওদের নজরে থাকে পেরসাদি লাড্ডুর দিকেই।



    টি ভির শাস- বহুর কোঁদলের পর্দা ক্রমশ চড়ায় রাম চালিশা বন্ধ করে খাটিয়ায় এলিয়ে পড়েছিল। জানে, এই সময় দ্বিতীয় বার চা চাইলেই বৌ খিঁচিয়ে উঠবে। অগত্যা গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকাই ভালো। সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখ লেগে যায়। হঠাৎ সীতা এসে ওকে ঝাঁকাতে থাকে।
    -আরে উঠো তো জি। সত্যনাশ হো গয়া।
    চটকা ভেঙ্গে ধড়মড়িয়ে ওঠে রাম।একটু আগে পড়া চালিশার লাইন আউড়োয়— ভূত- পিশাচ নিকট নেহি আবৈ। মহাবীর নাম যব শুনাবৈ।। রাম দুআরে তুম রখবারে। হোত না আজ্ঞা বিনু পৈসারে।
    শুনে চটে যায় সীতা। ভুরু কুঁচকে বলে—আরে রাখো জি তুমহারি বকোয়াস। অব জলদি বাজার যাও। আনাজ যো ভি মিলে লে আনা। অউর হাঁ, চাবল- আটা ভি। হপ্তা মিলা কি না?
    আবার কি হল? ফের কি দাঙ্গা-ফাসাদ শুরু হয়ে গেল? কদিন আগেই দিল্লির এসব মহল্লায় দাঙ্গা বেঁধেছিল। বেশ কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট হয় আগুনে খাক নয় লুটপাটে চৌপাট। লোকও অনেক মরেছে। পাড়ায় পাড়ায় ফের হিন্দুস্তান-পাকিস্তান। এদিকের লোক ওদিকে গেলেই নাকি লাশ পড়ে যাচ্ছে। পুলিসকেও ছাড়ছে না। দিন পনের কাজকাম, বাজারহাট বন্ধ। রাম নিজে মারকুটুরে নয়। ছোটবেলা থেকেই ও স্থির-ধীর। বরং লক্ষণটা রগচটা বলে ওকে সামলে-সুমলে রাখত।দেশে থাকতে রাম নিজে এতকাল শ্মশান-গোরস্থান রাজনীতির কারবারীদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু দিল্লিতে আসার পর থেকে মহল্লায় গেরুয়া মাতব্বরদের কথা শুনে শুনে ওর মনেও মুসলমানদের উপর রাগ বাড়ছে।
    গাঁয়ে থাকতে রাম-লক্ষণ পড়শি টোলার আকবর- সেলিমের সঙ্গে বিলে ঝাঁপিয়ে ছটের কলার কাঁদি, নারকেল তুলে খেয়েছে, ঝালনুনে মাখিয়ে একই কামরাঙ্গা কামড়েছে, জন্মাষ্টমীতে মাষ্টারজির পেরসাদি ঘিয়ে ভাজা লাড্ডু চুরি করেছে, ঈদের দিনে লাচ্চা-সেমাই চেটেপুটে খেয়েছে বটে। কিন্তু তাতে কি? ওরা দুই ভাই এখন মুম্বইতে রাজমিস্ত্রির কাম করে। রামেরা দিল্লিতে। দেশে ফেরার সময়ও আলাদা। ভোটের সময় ছাড়া দেখা হয় না। পারস্পরিক টানটা আর নেই। তবু ছোটবেলার বন্ধুদের কথা ভাবলে মনটা নরম হয়ে আসে। কিন্তু দূরের শহরে অচেনা মিয়াঁদের কথা আলাদা।
    সত্যি ওদের বড্ড বাড় বেড়েছে। আরে, হিন্দুদের দেশে থাকবি আর পুরুষোত্তম রামচন্দ্রজির জনমস্থানটা ছাড়বি না কিছুতেই? এদেশের নুন খেয়ে পাকিস্তানের গুণ গাইবি? যত্তোসব ঘুসপেটিয়া ঢুকে পুণ্যভূমি ভারতকে ফের ভাঙতে চাইছিস। সরকার কাকে দেশের নাগরিক বানাবে তা তোরা ঠিক করার কে? পাকিস্তান চাওয়ার সময় মনে ছিল না? এখন এদেশে থাকতে হলে হিন্দুরাজ মানতে হবে, ব্যস। নইলে এমন শিক্ষা দেওয়া হবে যে তোদের সামনের চোদ্দ পুরুষ মনে রাখবে। তাই এবারের দাঙ্গার দিনগুলোয় রাত জেগে বস্তি-পাহারায় যোগ দিয়েছে রাম। ‘জয় শ্রী রাম’ তো বটেই, প্রথমটায় অনভ্যাসে অস্বস্তি হলেও পরে ‘দেশ কে গদ্দারো কো গোলি মারো শালো কো’ নারাতেও গলা মিলিয়েছে। এভাবেই নয়া রামরাজ্য স্থাপনার ব্রতে ধীরে ধীরে নিজেকে ও জড়িয়ে নিচ্ছে। ফাসাদের সময় থেকে ওর তাগিদ ও সাহস দুই-ই বেড়েছে। ইচ্ছে আছে, এসব ঝামেলা মিটলে ও সঙ্ঘের শাখায় নাম লেখাবে। ভোরবেলায় উঠে পাশের চিলতে পার্কে ভগোয়া ঝাণ্ডাকে প্রণাম করে কুচকাওয়াজ, লাঠিখেলা করবে। গলা মিলিয়ে গাইবে – সদা বৎসলে মাতৃভূমে। প্রাচীন ও আধুনিক হিন্দু বীরদের সম্মানে জয়ধ্বনি দেবে। নারা দেবে—বাচ্চা বাচ্চা রাম কা জনমভূমি কা কাম কা। দুধ মাঙ্গো তো খির দেঙ্গে, কাশ্মীর মাঙ্গো তো চিড় দেঙ্গে।
    রাস্তার ওপারে মিয়াঁপাড়ার দিকের নয়া ইংরেজি ইস্কুলটায় আগুন লাগানো হুজুমে ও জুটে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায়, সীতা ওখানে বাচ্চা দুটোকে ভর্তি করার জন্য লাইন লাগিয়েছে। লিস্টে নাকি নাম উঠেছে। শিগগিরি ইন্টারভিউতে ডাক পড়বে। এখন ওদিকের কেউ চিনে ফেললে মুস্কিল। তাই সরে এসেছিল। কিন্তু এখন ফের হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। এবার রাম আড়-পার কি লড়াইয়ে নেমে পড়বে।



    সীতা হাঁসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। ওর মরদটা নিজের ধুন্দে থাকে। দুনিয়াদারি বুঝতে চায় না।
    --আরে নেহি জি। অব তো বড়কা ফাসাদ শুরু হো গইলে। পরধানমন্তরী নে আভি আভি দেশ ভর মা তালাবন্দি কে ঘোষনা কর দৈলে। রাত বারা বাজে সে সব কুছ ঠপ হো যাবে। ট্রিরেন- বাস বন্ধ। কাম ধান্দা বন্ধ। রোটি রোজি বন্ধ। দুকান-বাজার বন্ধ। আপ নে খোলি সে নিকাল না বন্ধ। সমঝৈলে কি না?
    এবার রাম চটে যায়। সত্যি, টিভি দেখে দেখে বউটার মাথা গেছে।
    -- কাহেলা অনপ সনপ বকে যা রহে হো। দেশ ভর মা তালাবন্দি! দেশ কোই তেজুরি হ্যায় কেয়া? তেজুরি হো গা ভি তো হ্যায় জিস কে পাস, হাম লোগো সে মতলব কেয়া?
    স্বামীর বচন শুনে কপাল চাপড়ায় সীতা। এতক্ষণে বাজারে ধুন্দুমার বেঁধে গেছে নিশ্চয়। আশেপাশের সবাই দৌড়চ্ছে।
    --আরে তুমরে ভেজা মে তালা পড় গয়া কেয়া? যুধ শুরু হো গয়া জি, যুধ!
    এবার টনক নড়ে রামের। লাফিয়ে ওঠে।
    -পাকিস্তান সে? কি চিন সে?
    -নাহি জি। করোনা সে।
    ফের তালগোল পাকিয়ে যায় দশরথপুত্রের দিমাকে। স্কুলে ভূগোলে-ইতিহাসে বেশিদূর এগোতে পারেনি। নিয়মিত কাগজ পড়ার অভ্যেসও নেই। করোনা নামে কোনও দুশমন দেশের কথা তাই জানে না।
    ঝাঁজিয়ে ওঠে বৌ। পিছিয়ে পড়া স্বামীকে এগিয়ে আনতে ফালতু সময় বরবাদ হচ্ছে।
    --মুরখ কে তরহা বাত মত করো জি। ইস লিয়ে কহতে হ্যায় কি রোজ টিভি দেখা করো। আরে, ইয়ে করোনা মহামারী! সর্দি- জুকাম জৈসে হ্যায় ভি, অর নেহি ভি। আদমি ছিকনে-থুকনে, হাত মিলানে সে দুসরে কে নাক-মুহ মে ঘুস যাতা হ্যায়। ফির শাস ফুল কে লোগ মরতা হ্যায়। দুনিয়া ভর মা ফয়েল গৈলে অব। মহামারী সে বাঁচনে কে লিয়ে তালাবন্দি চলেগা। আপনে আপনে ঘরকে চারো তরফ লছমনরেখা খিঁচ না হোগা। না কোই ঘুসেগা, না কোই নিকলেগা। সমঝে কি না?
    গ্যারেজে কথা চালাচালির সময় এরকম দুই একটা শব্দ রামের কানে এসেছে বটে। কিন্তু আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নিয়ে মাথা ঘামায়নি। খইনি মুখে রেখে থুকনা, বিড়ি-সিগারেট ভাগ করে টানা তো কত কালের দেশি দস্তুর। আর লছমনরেখা! এই ঘিঞ্জি গলির আট ফুট বাই আট ফুটের খোলিতে? বারোয়ারি কলতলা আর পায়খানায় যেখানে নিত্য সকালে মারামারি বাঁধে? সীতার কি মাথা খারাপ হল? সব চেয়ে বড় কথা, কামধান্দায় না গেলে খাবে কী?
    সীতা মাথা নাড়ে। ঘোর দুশ্চিন্তার ব্যাপার তো বটেই। কিন্তু রামই তো দুদিন আগে মহল্লার মাতব্বরদের কথা শুনে এসে ওকে উৎসাহ দেয় বস্তির বাকি বউ-ঝিদের সঙ্গে মিলে প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো তালি-থালি বাজাতে।
    --তুম হি বোলে জি কি হামলোগোন ব্যালকনি নেহি হ্যায় তো কেয়া! হাম ভি তো ইস দেশ কা বাসী হ্যায়!অব জলদি যাও তো বাজার!
    অগত্যা বাজারের ব্যাগ হাতে নেয় রাম। কিন্তু পকেট হাতড়ে ফের বসে পড়ে। সামান্য কটা টাকা পড়ে আছে। এতে কিলোটাক করে চাল আর আলু হবে হয়ত। ফাসাদের দিনগুলোয় গ্যারেজ বন্ধ ছিল বলে মালিক টাকাপয়সা দেয়নি। তার উপর আজ সবে মঙ্গলবার। হপ্তা হতে দেরি আছে। সংসারের খরচ বাঁচিয়ে সীতার জমানো কিছু থাকলে ভরসা। বউকে বলতে সে চিড়বিড়িয়ে ওঠে।
    --যব ভি দেখো, ভিখমাঙ্গা কে তরহা হাত পসার দিয়ে। ইস রাম কে ভরোসে পিতাজি হামনি কো গওনা করালে!
    এবার মাথা গরম হয়ে যায় রামের।
    --কাঁহা সে লাউ? তেঁরে বাপ নে তেজুরি ভর কে দিয়ে থে কেয়া?
    অন্যদিন হলে বাপ তুলে কথা বলায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিত সীতা। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি আলাদা। গলা নামিয়ে জানায়, সামান্য যা জমিয়েছিল তা তো দুই ছেলের স্কুল ভরতির লাইনে নাম ঢোকাতেই গেছে। লব-কুশের বাবা কি সেটা জানে না? মিস্তিরি বাবার ছেলেরা ইংরেজি শিখে চাকরি-বাকরি করবে, এই স্বপ্ন তো দুজনেই দেখেছে, সেটা রাম মানে। কিন্তু এখন উপায়? গ্যারেজে নাগা করলেই মজুরি বন্ধ। গাড়িঘোড়া না চললে লোনি পৌঁছবেই কি করে? ট্রাক-মোটর না ঢুকলে খাবে কী?
    কিছুদিন ধরেই ওর সব ওলটপালট চলছে। আগে শক্করপুরার যে সস্তার ফ্যান তৈরির কারখানাটায় কাজ করত, সেটার মালিক ভাল লোক ছিল। কিন্তু নোটবন্দির সময় থেকেই কামকাজে মন্দা। ধারদেনায় ডুবে, তার উপর জি এস টি চক্করে পড়ে গণেশ উল্টেছে। এক বন্ধুর দৌলতে কোনরকমে নতুন এই গ্যারেজের কাজটা জুটিয়েছে। কিন্তু মালিকটা মাক্ষিচুষ। ছুতোনাতায় মজুরি মারে। তবু কিছু অগ্রিম পাওয়ার আশায় মোবাইলে মালিকের নম্বর টেপে। টাকা পেলে যেভাবে হোক মালিকের বাড়ি পৌঁছে যাবে। কিন্তু বার কয়েকের চেষ্টায় যদি বা পেল, মালিক সাফ জানিয়ে দিল- তাঁর নিজেরই হাল খারাপ। অনেক রেগুলার পার্টি পেমেন্ট করেনি। রাম যেন নিজের পথ দেখে নেয়। এর উপর সীতা শোনাল আরেক অশনিসঙ্কেত। মাস ফুরলেই বাড়িওয়ালা হাজির হবে। ফাসাদে ফেঁসে গতমাসের ভাড়া বাকি পড়েছে বলে শাসানি শুনিয়ে গেছে। ভাড়ার টাকাটাই জমিয়ে রেখেছে সীতা। কিন্তু তারপর খাওয়া জুটবে কোত্থেকে? মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে রামভরোসে। শেষ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী শলা করেঃ যা থাকে কপালে, বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। দেশে ফিরতে পারলে অন্ততঃ কদিন ভাত তো জুটবে। আলাদা হাঁড়ি হলে কি হবে, লক্ষণ ভাইয়া-ভাবী-ভাতিজাদের বিপদে পাশে দাঁড়াবেই। বেরোনোর সময় রামজি-সীতামাইয়ার যুগল ফটোটা আর চালিশা- মানসের বইদুটো বোঁচকায় ভরতে ভোলেনি রাম।



    হাইওয়ের বাঁকে গঞ্জের মোড়ে আড়াআড়ি বাঁশের বেড়ায় রাস্তা আটকে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। রামের সেটা ঠাহর পেতে দেরি হয়েছে। সঙ্গের পথচলতি দঙ্গলটাতে চ্যাংড়া ছেলে বেশি। তাই ওরা জোরকদমে আগে পৌঁছে গিয়েছে। বৌ-ছেলেদের নিয়ে ভয়ে ভয়ে রাম যখন ব্যারিকেডে পৌঁছল তখন তর্কাতর্কি, ধাক্কাধাক্কি চলছে। পুলিশের এক কর্তা কাঁধের হ্যান্ড-মাইক ফুঁকে বলছেঃ মুসাফিরদের ফিরে যেতে হবে। নইলে আশেপাশে গাঁ- গঞ্জে সংক্রমণ ছড়াবে। নিজেদের মুলুকেও। টি ভি-তে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ওরা শোনে কী? তালাবন্দিতে দেশবাসীর কষ্ট হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ত্যাগ ও তপস্যার ভূমি ভারতে এখন রাষ্ট্রের অনুশাসন মেনে শৃঙ্খলাবদ্ধ সিপাহীর মতো চলতে হবে। সারা দুনিয়া ভারতের তালাবন্দি নিয়ে ধন্যি ধন্যি করছে। তবু কিছু দেশদ্রোহী বেমক্কা বেরিয়ে-পড়া আনপড় মজুরদের ছবি দেখিয়ে দেশের বদনাম করছে। নানা গুজব ছড়াচ্ছে। এসব আর সহ্য করা হবে না। সরকারি আদেশ না মানলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার গরিব কল্যাণ যোজনায় ওদের ব্যাঙ্কের খাতায় টাকা পাঠাবে। ফিরে গেলে রেশন দেবে, চাই কি লঙ্গরখানাতেও লাইন দিতে পাবে। সবুরে মেওয়া ফলবে। শুধু নিজেদের পেট ভরানোর কথা ভাবলে চলবে? দেশের কথা ভাবতে হবে না?
    কিন্তু ছেলেরা মানতে রাজি নয়। ওরা দাবি করছে—সরকার ট্রেন-বাসের ব্যবস্থা করে দিক যাতে পথক্লান্ত গরিব মানুষ অন্তত যে যার জেলা সদর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। খাবারের দাবি, জলের দাবিও উঠছে। কেউ আবার টিপ্পনী কাটছে, আগের বার বিদেশ থেকে আমীরদের কালা ধন কেড়ে এনে ১৫ লাখ করে হর গরিবের খাতায় পাঠানোর বাদা করেছিল সরকার। তার কি হল? ফের জুমলাবাজি? কেউ মনে করাচ্ছে শহরের নেতাদের বুলি-- ভোট দিবি যেখানে ভাত পাবি সেখানে। মুলুকে ফোন লাগা। কেউ স্মার্টফোনে ভেসে আসা খবর শোনায়ঃ খিদে- তেষ্টায় রাস্তাতেই মরছে ঘরমুখোদের কেউ কেউ। তাঁদের মধ্যে জোয়ান- বুড়ো-বাচ্চা সবাই আছে। সরকার এইসব ভুখমরির খবর চেপে যাচ্ছে।
    এই উতোরচাপানের মধ্যে কুচোকাঁচা নিয়ে বউঝিরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে জড়োসড়ো। কেউ কেউ ফোঁপাচ্ছে। বাচ্চাগুলো ভয়ে সিটিয়ে। এদেশে হুঁশ হওয়ার আগেই গরিবের ছেলেপুলে পুলিশকে ভয় পেতে শেখে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। রাম নিজেও পুলিশ থেকে দূরে থাকে। গ্যারেজে সেপাই এলেই ‘সারজি’ বলে খাতির করে হাত কচলায়। তবু হট্টগোল শুনতে শুনতে ভিড়ের সামনের সারিতে মাথা গলায়। খোলিতে তুলসীদাসজি পড়ে মান্যদের মধ্যে নিজেকে গণ্য করবার ইচ্ছেটা ইদানীং বেড়েছে। সেটা ফের চাগাড় দিচ্ছে। তেরিয়া ছেলেদের থামিয়ে ঠান্ডা দিমাকে পুলিশের সঙ্গে সদবুদ্ধির কথা বললে বখেড়া মিটে যাবে বলে ওর দৃঢ বিশ্বাস। তাই হাত জোড় করে গলা তোলে।
    --সার জি, সরকার সে হামরে কোই ঝগড়া নাহি বা। হাম ভি তো ইস দেশ কা বাসী হ্যায়। দেশ কা ভালাই হাম ভি চাহতে হ্যায় জি। পরধানমন্তরি জি তো হামারে মুখিয়া হ্যায়। বালবাচ্চা লেকে হাম বেবশ গরিব লোগ মজবুরন চল পড়ে। ভুখে-পিয়াসে মরনে কাগাড় মে হ্যায় জি। মর না হ্যায় তো আপনে গাঁও মে, আপনো কো বিচ মে যাকে হি দম তোরেঙ্গে।
    বলতে বলতে কেঁদে ফেলে রাম। প্রজা কাঁদলে কি রাজার কোতোয়ালদের দয়া হবে না?
    --হামনিকে আরজ পরধানমনতিরী জি তক পৌছা দিজিয়ে, সারজি। ওহ তো হামারে রাজা হ্যায়। ওহ জরুর গরিবো কি শুনেঙ্গে। হামারে খানে-পিনে কা ইন্তেজাম কর দেঙ্গে, মুলুক তক পহুচা দেঙ্গে।
    আবেগে ভেসে যায় দশরথপুত্র। রাজস্তুতিতে চালিশা উগড়ে দেয়।
    --সব পর রাম তপস্বী রাজা। তিন কে কাম সকল তুম সাজা।। চারো যুগ পরতাপ তুমহারা। হৈ পরসিদ্ধ জগত উজিয়ারা।।
    সামনের সিপাইদের মধ্যে একটু ভাবান্তর দেখা দেয়। একজন পিছিয়ে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ানো কর্তাটির কানে কানে কি যেন বলতে থাকে। তা দেখে রামের উদ্দীপনা বেড়ে যায়। পেরেছে, ও বোঝাতে পেরেছে। ছেলেপুলেরাও ওর কথায় মাথা নাড়ছে।
    --হাঁ হাঁ, সচ্চি বাত কহলে কাকা। মর না হ্যায় তো ঘর মে যাকে মরেঙ্গে।
    এতে রামের ভাবের আবেশ ঘন হয়ে ওঠে। তুলসী মহারাজের রামায়ণ থেকে দোঁহা শুধু নয়, চৌপাইও শোনাতে থাকে।
    -- মুখিয়া মুখু সো চাহিঐ খান পান কহু এক। পালই পোষই সকল অংগ তুলসী সহিত বিবেক।। অর্থাৎ, বনবাস মে যানে কে পহলে সিয়াবর রঘুপতি ভাই ভরত কো কহলেঃ জ্যায়সে মুখ একেলে খাতে-পিতে তো হ্যায়, পরন্তু উস কে জারিয়ে সারে অংগ কা পুষ্টি মিলত করে, তো রাজা কি আচরণ ভি অ্যায়সা হোয়ে। মতলব, প্রজা কি হিত মে হি রাজা কে হিত।
    - রাজধরম সরবসু এতনোঈ। জিমি মন মাহ মনোরথ গোঈ।। বন্ধু প্রবোধ কিনহু বহু ভাঁতী। বিনু অধীর মন তোষু না সাঁতী। অর্থাৎ, রামজি ভরত কো সমঝাইলে, রাজধরমের সারবস্তু এহি হ্যায়। এহি হামেশা তুমহারা মনোরথ বনি রহনা চাহিয়ে।
    রামের কথা এলে তো রাবণের কথা আসবেই। সিপাইরাও বেশ মন দিয়ে শুনছে বলে রামের উৎসাহ বেড়ে যায়।
    --শুনিয়ে ভাই, লঙ্কাকান্ড শুনিয়ে। রামজি কে সাথ যুধ মে উতর নে কা পহলে রাভনকে মন্ত্রীয়ো নে রাক্ষস-রাজ কো বহুত উপসায়া। উসি সময় দশাননকে বেটা প্রহস্ত বাপ কো সাবধান কিয়ে থে। হাত জোড় করে বাপ কো সমঝায়া – সব কে বচন শ্রবণ শুনি কহ প্রহস্ত কর জোরি। নীতি বিরোধ ন করিও প্রভু মন্ত্রীনহ মতি অতি থোরি।। কহহি সচিব শঠ ঠাকুরসোহাতী । নাথ ন পুর আব এহি ভাঁতী।।
    অর্থাৎ, হে প্রভু, মন্ত্রী- সচিবো কি বাতো মে আ কে নীতি-বিরুদ্ধ কাম না কিজিয়ে। ইয়ে চাপলুশ আপ কি সর্বনাশ কর দেঙ্গে। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো কখনও রাবণের মতো অহংকারী, স্বাভিমানী, জিদ্দি, ধর্মনাশী পাখন্ডী নন। তিনি নিশ্চয় গরীবের ব্যথা বুঝবেন, কথা শুনবেন।
    ব্যারিকেডে রামকথা শোনানোর ঘোরে রামভরোসে লক্ষ্য করেনি ইতিমধ্যে পিছনের পুলিশ কর্তাটি এগিয়ে এসেছে। মাঝবয়সী, ভুড়িওয়ালা টাকলা লোকটির মাথায় এখন পুলিশি শিরস্ত্রাণ। মুখে মাস্ক আঁটা। হাতে লাঠি, কোমরে পিস্তল। ভাবভঙ্গি অন্যরকম। কাছে সে হেলমেট খুলে লাঠি উঁচিয়ে চেঁচিয়ে সে রামকে থামতে বলে। নামধাম, জাতি জানতে চায়। রাম বিনীত ভঙ্গিতে তা জানালে বিদ্রুপের হাসি খেলে যায় কর্তার মুখে।
    -তো, দুসাদ গোস্বামী জি অব প্রধানমন্ত্রী জি কো রাজধরম সমঝা রহে হ্যায়! সরকার কো উন সে আপনি কর্তব শিখ না পড়েগা? মন্ত্রী- আলা অফসারো বদলে আনপড় গাওয়ারো কি শলা লেনা হোগা?
    একটু দমে যায় রাম। ও শুনেছে বেদ পড়ে হেঁটমুণ্ড তপস্যা করে ব্রাহ্মণ মুনিঋষিদের মতো সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার চেষ্টা করায় রাজা রামচন্দ্র নিচ জাতির সাধকের মাথা কেটে সনাতন ধর্মের মর্যাদা বজায় রেখেছিলেন। তুলসীদাসজি সে কথা লেখেননি বটে। তবে সব রামভক্তকে বর্ণাশ্রম মেনে জাতিধর্ম পালন করার আজ্ঞা দিয়ে গেছেন। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন-- কলিযুগের মূল লক্ষণ হল বেদনিন্দা, বর্ণাশ্রম ও ব্রাহ্মণ বিরোধিতা এবং শুদ্রের ব্রাহ্মণতুল্য মর্যাদার দাবি। এই কাজ করলে নিচ জাতিদের নরকবাসও করতে হবে। কিন্তু রামভরোসে তো তেমন কিছু দাবি করেনি, নরকেও যেতে চায় না। ও বরং মনে রাখে যে রামজি বানর জাতিকে, এমনকি নিষাদ রাজা গুহককে গলে লাগিয়েছেন। সে কথা মনে পড়তেই দুসাদপুত্র গলা তুলে বলে ফেলে- হাম তো নয়া আজ কি রাজা রাম কি গুহক মিতা হ্যায় জি! ভগোয়া ঝাণ্ডা হামারা ভি ঝাণ্ডা হ্যায়।
    টাকলা অফিসার লাঠিটা নাচাতে নাচাতে রামকথা শুনছে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে। তার মানে বুঝছে। রামের কথকতার তোড় বেড়ে যায়। ও এবার মহল্লার নেতাদের সমান হয়ে উঠছে।
    ও বোঝাতে থাকেঃ এখন তো লোকতন্ত্রের জমানা। ভোটের সময় নিয়ম করে দলবেঁধে দেশে ফেরে ওরা। সরকার মাই-বাপ, সে তো ওরা জানে পরদাদার কাল থেকে। সত্ত্বাধারীদের সঙ্গে মানিয়ে চলাই ওদের অস্তিত্বের শর্ত। বিনিময়ে সরকার ওদের বিপদে-আপদে শরণ দেবে, এটাই প্রত্যাশা। তাছাড়া ও তো এটাও শুনেছে প্রধানমন্ত্রীও উঁচু জাতির নয়। গরীব চায়েওয়ালা ছিলেন। তপস্যার জোরে উপরে উঠে এসেছেন। তবে ওদের ভোট না পেলে তাঁর তপস্যা সফল হত কি?
    এবার রাগে চিৎকার করে উঠে পুলিশ কর্তা। লাঠি তুলে তেড়ে আসে।
    -বহোত শুন লিয়া তেরি বকোয়াস। ভাগ শালে, চুতিয়া কাঁহা কা। তেরা অউকাত কেয়া হ্যায় রে? পায়ের কে জুতি অব মাথে পর চড়না চাহতে হো! আভি হাড্ডি-পসলি এক কর দেঙ্গে।
    হেলমেট এঁটে নিয়ে লাঠি চালায় অফিসার। ছিটকে পড়ে রাম। নিমেষে বাকি পুলিশরাও লাঠি বাগিয়ে ছুটে আসে। বেমক্কা বেদম মার খেয়ে ছত্রখান হয়ে যায় ভিড়। কিছু চ্যাংড়া পিছিয়ে এসে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পাল্টা পুলিশ এবার আঁসু গ্যাস ছাড়ে। কিন্তু রাম হটে আসে। বাঁহাতটা প্রবল টাটাচ্ছে। পুলিশের লাঠি থেকে মাথা বাঁচাতে ওই হাতটাকেই ঢাল করেছিল। তার উপর নাকমুখ জ্বলছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা বাঁচিয়ে বউ-বাচ্ছাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু ভয়- তরাসে কোথায় পালাল ওরা? এদিকে পুলিশ বন্দুক তাক করে এগিয়ে আসছে। জান বাঁচাতে রাস্তা থেকে নেমে পাশের খেতের দিকে ছুটতে ছুটতে আহত রাম ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করতে থাকে – বাচোয়া কে লেকে ভাগ রে সীতা! ওর পিঠ থেকে ছিটকে পড়া বোঁচকায় রয়ে যায় হলুদ, ছেঁড়া পাতার চালিশা আর তুলসী মহারাজের রামায়ণ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৭ মে ২০২০ | ২৬৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন