আমরা গড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন তেঁতুলবেড়িয়া অঞ্চলের একটা ছোট স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী। নাম প্রয়াস। লকডাউনের সময় স্থানীয় মানুষকে সাহায্য করব বলে শুরু করি, তারপর কাজের পরিধি বেড়ে যায়।
আমরা গত শনিবার গোসাবার কাছে সাতজেলিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম ৩০০ লোকের জন্যে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। যোগাযোগ হয়েছিল আর এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সূত্রে।
যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য ছিল আম্ফানের দরুণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে পরবর্তী কাজের দিশা নির্ণয় করা। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ছিল, এখনও আছে। লকডাউনের সময়ে একটা বিশেষ প্রয়োজন ছিল হঠাৎ আয়হীন হয়ে পড়া মানুষদের কিছু ত্রাণ দিয়ে সময়টুকু পার হতে সাহায্য করা। আম্ফানের পর ফান্ড তোলার কাজে ভাল সাড়া পাওয়া গেছে। কিন্তু ঠিক কি ধরণের কাজ করলে দুর্গত মানুষের সবচেয়ে বেশী উপকার হয়, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
হয়ত প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা নিজের লুকানো বায়াস দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু ত্রাণ নিতে আসা মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হল যে আম্ফানের চেয়ে লকডাউন নিয়েই তাঁদের দুঃস্বপ্নের রাত কাটছে।
গোসাবা ব্লকের সাতজেলিয়া গ্রাম মোটামুটি আসল সুন্দরবনের শুরু। গ্রামে বা আশেপাশের লোকালয়গুলিতে প্রায় কিছুই নেই। একটা পঞ্চায়েত অফিস, বাজার চত্বর আর কিছু আধভাঙ্গা বাড়ি। বড় গাছ এমনিতেই কম, যা ছিল ভেঙ্গে পড়েছে। পঞ্চায়েত অফিসের ছাদে সোলার প্যানেল বেঁকে গেছে। কিন্তু কংক্রিটের রাস্তা আছে। স্থানীয় লোকজন সেসব গাছ কেটে রাস্তা পরিস্কার করে রেখেছেন। বাজারের আশেপাশে অনেক বাড়িতেই দেখলাম নতুন বাঁশ পড়েছে। রাস্তার দুধারে ফাঁকা জমি। জমি পেরিয়ে দূরের লোকালয়গুলি হতদরিদ্র। সেখান থেকেই মানুষ এসেছেন রিলিফ নিতে। অধিকাংশই মহিলা।
ওনারা কিন্তু প্রায় একযোগে বললেন, ঝড়ের চেয়ে অনেক বেশী ভাবিত অন্নসংস্থান নিয়ে। ওনাদের ভাষায়, ঝড়ের থেকে জলকে ভয় বেশী। আয়লার সময় সব ভেসে গিয়েছিল। এবার নদীর মাটির বাঁধ কোথাও কোথাও ভেঙ্গেছে, কিন্তু জল ঢোকেনি গ্রামে। অঞ্চলে বারো আনা বাড়ি মাটির। ঝড়ে চাল উড়ে গেছে - কিন্তু সারাতে বেশী অসুবিধা হয় নি। খড় বাড়িতে থাকে। খরচা বলতে দুদিনের মজুরি ৬০০। ঝড়ের দুদিনের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। টিউব ওয়েল আছে, যদিও দূরে দূরে। তবু পানীয় জলের অসুবিধা নেই।
সবাই বললেন, মূল সমস্যা লকডাউন। অধিকাংশের ছেলেরা কলকাতা বা শহরতলীতে কাজ করেন। তাঁদের দুমাস কোন আয় নেই, শহরে আটকে আছেন। করোনা এখনো আসেনি, কিন্তু সরকারের আদেশে অরথনৈতিক জীবনে এসেছে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। দোকানপাট বন্ধ, এখন সকালে অল্প সময়ের জন্য খোলে। দোকান যাঁরা চালান, তাঁদেরও হাতে কিছু নেই। স্কুল অনেকদিন বন্ধ। বাড়িতে পড়ানোর কেউ নেই। গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, অসুখ হলে গোসাবা যেতে হয়। লকডাউনে গোসাবা যেতে আসতে দুশো টাকা। মে মাসে অবশেষে রেশনের চাল পেয়েছেন ৫ কিলো করে - কিন্তু শুধুই চাল। ভাতের সঙ্গে অন্য কিছু কিনে খাবার পয়সা নেই। তাই আধঘন্টা হেঁটে রিলিফ নিতে এসেছেন। এই রিলিফে তিনচারদিন চলবে, কিন্তু তারপর কি হবে কেউ জানেন না।
যা দেখেছি, তার থেকে সিদ্ধান্ত অনেকরকম হতে পারে। হয়ত সুন্দরবনের এই অঞ্চলে ঝড়ের তান্ডব তেমন প্রবল হয়নি, সাগরদ্বীপ বা নামখানার দিকে যতটা হয়েছে। অথবা হয়ত, ঝড়ের যে ধ্বংসলীলার কথা আমরা বলছি বা ভাবছি, সেটা মূলতঃ অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষতি – যাদের হারানোর কিছুই নেই, ঝড় তাদের থেকে আর কি কেড়ে নেবে? হয়তবা, এবারের ঝড়ের প্রভাব অপেক্ষাকৃত ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে অনেক বেশী।
এইগুলি সবই অনুমান। যাঁরা সুন্দরবনে বা দঃ চব্বিশ পরগণার অন্যান্য অঞ্চলে আগে থেকে কাজ করছেন, তাঁরা এই বিষয়ে আরও বিশদ বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের সাতজেলিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে অন্নসংস্থানের চিন্তা আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাই তাঁদের মূল সমস্যা। সেক্ষেত্রে আপাততঃ রণকৌশল হিসেবে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার মূল্য কিন্তু অপরিসীম। আর মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে আমাদের ভাবা উচিৎ সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার কথা, যাতে কলকাতার উপর নির্ভরতা কমে। লকডাউন উঠলেও কলকাতার অর্থনীতি ঝিম মেরে থাকবে, আর চলাচলের নানান আসুবিধা থাকবে। দুর্গত মানুষ নিজেরা সবচেয়ে ভাল বোঝেন সমস্যাগুলি ঠিক কোথায়, এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণ হলে তাঁদের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই অন্ততঃ খানিকটা হলেও মিটিয়ে নিতে পারবেন।
সেই, "যাদের কিছুই নেই, ঝড় তাদের থেকে আর কি কেড়ে নেবে?"
বারবার সুন্দরবন পূবের মানুষগলোকে বাঁচানোর জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষগুলো, তাদের নেতৃত্ব সেটি বুঝল না।