
দ্বিতীয় পর্ব >>
অ্যালিসের মতো বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কিউরিয়াসার অ্যান্ড কিউরিয়াসার!’ গরিবগুর্বো হাড়হাভাতেদের রক্ষা করতে অর্থমন্ত্রী যদি বিমান চলাচলের রাস্তা সিধে করে পাইলটদের জন্য মহার্ঘ আধ ঘণ্টা সময় বাঁচানোর ব্যবস্থা করলেন, তখনও বুঝিনি, আকাশও তাঁর দৌড়ের সীমানা নয়। এই বিকেলেই তাঁর কল্পনা পৌঁছে যাবে তারাদের আশেপাশে— মহাজাগতিক সমাধানসূত্র খুঁজে আনবেন তিনি, আর্থিক প্যাকেজের অছিলায়।
ভেবে দেখেছেন, তাঁর প্রতিটি সাংবাদিক বৈঠকে এমন কিছু কথা কেন থাকেই, যেটা নিয়ে হাসলেও নিজেকে বোকা মনে হয়? কাল মৌমাছি প্রতিপালন তো আজ বেসরকারি সংস্থার জন্য মহাকাশ খুলে দেওয়া— কোভিড-১৯’এর মোকাবিলায় আর্থিক প্যাকেজের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক কোথায়? আছে, আছে, টেলিপ্যাথির জোর আছে— এই আপাত-হাস্যকর ঘোষণাগুলো আসলে শাকের আঁটি, যার নীচে চাপা দেওয়া আছে অজস্র হাঙর। গত তিনটি পর্বে তিনটে হাঙরের কথা বলেছি— এমএসএমই-র সংজ্ঞা পরিবর্তন; অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য স্বল্প ভাড়ার আবাসন তৈরির মোড়কে প্রোমোটারদের রোজগারের ব্যবস্থা করে দেওয়া; এসেনশিয়াল কমোডিটিজ় অ্যাক্ট তুলে দিয়ে, এপিএমসি অ্যাক্টে পরিবর্তন করে এক দিকে মধ্যস্বত্বোভোগী, আর অন্য দিকে রিলায়েন্স-ফেসবুকের জন্য সুবিধার ব্যবস্থা করা। আজকের সাংবাদিক বৈঠকের পর মনে হচ্ছে, ওগুলো নেহাত দু’চার আনার গল্প। আসল খেলা হল আজ।
নির্মলা সীতারামন জানালেন,
এক) কয়লাখনির মালিকানায় আর সরকারের একচেটিয়া অধিকার থাকছে না— বেসরকারি পুঁজির জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে খনি কেনার রাস্তা;
দুই) খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রেও নিলামের নিয়ম পাল্টাচ্ছে;
তিন) সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে তালিকা তৈরি হচ্ছে, যার অন্তর্ভুক্ত জিনিসপত্র আর বিদেশ থেকে কেনা যাবে না, কিনতে হবে দেশি নির্মাতাদের থেকে;
চার) বিমানবন্দর ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যবস্থা হচ্ছে আরও বিলগ্নিকরণের, বেসরকারি পুঁজির অন্তর্ভুক্তির।
নির্মলা ইংরেজিতে, আর অনুরাগ ঠাকুর হিন্দিতে জানালেন, ইহার নামই সংস্কার। কোভিড-১৯’এর ধাক্কা সামলানোর আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার মধ্যে সংস্কারের এমন প্লাবন কেন, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক। এর একটা উত্তর হতে পারত, বিক্রিবাটা আর বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে যত টাকা পাওয়া যাবে, সব খরচ করা হবে কোভিড-১৯’এর ধাক্কায় শুয়ে পড়া সাধারণ মানুষের স্বার্থে। সেই টাকায় তাঁদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, তাঁদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোর উন্নতিসাধন হবে, তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্য মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়বে, আরও স্কুল তৈরি হবে, এবং এই অসংখ্য ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে— পনেরো লক্ষ না হোক— কিছু টাকা পৌঁছে যাবে। যদি এই কথাগুলো বলতেন—সবক’টা না হলেও কয়েকটাও যদি বলতেন, অন্তত ইঙ্গিত করতেন এ দিকে— সত্যি বলছি, এই সিদ্ধান্তের পিছনে থাকা কারণগুলো খুঁজতে বসতাম না। বুঝতে চেষ্টা করতাম না, এই সংস্কারের আড়ালে কাদের স্বার্থরক্ষা করছেন তিনি। নির্মলা আর অনুরাগের মুখে এই কথাগুলোর একটাও শুনতে পেলাম না।
অতএব, প্রশ্ন করা যাক, এই সংস্কারে কাদের লাভ, কতখানি লাভ। ভারতে এখনও সত্তর শতাংশ বিদ্যুৎই তাপবিদ্যুৎ। সবচেয়ে বেশি কয়লা খরচ হয় তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজেই— ২০১৭-১৮ সালের হিসেব বলছে, ভারতে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল মোট ৮৯৬.৩৪ মিলিয়ন টন কয়লা, তার মধ্যে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবহৃত হয়েছিল ৫৭৬.১৯ মিলিয়ন টন, অর্থাৎ ৬৪.৩% (সূত্র >> )। কাজেই, কয়লাখনি বিক্রি হলে কাদের লাভ, সেই খোঁজ করতে গেলে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থার খোঁজ না নিয়ে উপায় নেই। ভারতে সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার নাম আদানি পাওয়ার লিমিটেড— মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১২,৪১০ মেগাওয়াট। আছে অনিল অম্বানির রিলায়েন্স পাওয়ার— উৎপাদন ক্ষমতা ছ’হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। সস্তায় কয়লার ব্যবস্থা হলে মন্দ কী? এ ছাড়াও লাভবান হবে টাটা পাওয়ার, জেএসডব্লিউ। প্রসঙ্গত, বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলির জন্যও বিবিধ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এটা অনুমান করার জন্য কোনও নম্বর নেই যে দেশের পয়লা নম্বর বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থার মালিকের নামও গৌতম আদানি।
সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়াকে সংস্কার বললে কেলেঙ্কারি। সেটা সম্ভবত অহেতুক নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত নীতি হল প্রতিরক্ষা খাতে প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঠা— তার জন্য টাকা খরচ করতে সরকারের দ্বিধা নেই। এবং, ভারতে সামরিক সরঞ্জাম নির্মাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রথম সারির নাম আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস লিমিটেড। তবে, এই গল্পের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশটা এখনও বলিনি। সেই গল্পের নায়কের নাম অনিল অম্বানি। ২০১৭ সালে তিনি ঘোষণা করলেন, তাঁর সংস্থার সবচেয়ে বড় ব্যবসা হবে প্রতিরক্ষা খাতেই। ব্যবসার পরিমাণ? বছরে অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা। জানালেন, সংস্থার লক্ষ্য হল আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নির্মাতা হয়ে ওঠা (সূত্র >> )। তার দু’বছরের মাথায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হল সংস্থার। ব্যাঙ্ক আর ঋণ দিতে নারাজ (সূত্র >> )। অথচ, এই ঋণ-জর্জরিত সংস্থাকেই এ বছরের গোড়ায় কার্যত ডেকে আনা হল, ২৬,০০০ কোটি টাকার নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি করার প্রকল্পে দরপত্র জমা দিতে (সূত্র >> )। কেন, সেই কারণ বিশ্লেষণে যাব না। তবে, সামরিক অস্ত্রশস্ত্র আর সরঞ্জামে আত্মনির্ভরতা— ইংরেজিতে যাকে বলে সেল্ফ রিলায়েন্স— তৈরি করার জন্য যদি এই সংস্থার বরাত জোটে বহু লক্ষ কোটি টাকার, অবাকও হব না।
আর হ্যাঁ, প্রতিরক্ষাখাতে নির্মাণে বিদেশি বিনিয়োগের অটোমেটিক রুটে ছাড়ের পরিমাণ ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হল ৭৪ শতাংশ। আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেসই হোক বা রিলায়েন্স নেভাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, সবারই বিদেশি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা আছে (সূত্র >> ) ।
আর বেশি কথা বাড়াব না, তবে জানিয়ে রাখা যাক, এর আগে ভারতে যে ছ’টি বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণের জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছিল, তার প্রতিটিতেই সর্বোচ্চ দর দিয়েছিল আদানি এন্টারপ্রাইজ়েস লিমিটেড (সূত্র >> )।
হুম্ম | 2402:3a80:a41:dc33:0:5b:ad07:***:*** | ১৯ মে ২০২০ ০৯:২১93460
SC | 2409:4065:493:680f:4cae:372c:fb1a:***:*** | ১৯ মে ২০২০ ১০:১৫93464খুব ভাল বিশ্লেষ্ণ হয়েছে। আমি একটা লেখা লিখব। এই বিশ্লেষণ কাজে দেবে।