না, কোভিড-১৯’এর মোকাবিলায় ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজে মৌমাছি প্রতিপালন আর গবাদি পশুর টিকাকরণের ব্যবস্থা নিয়ে একটি শব্দও খরচ করব না। এবং, শুরুতেই বলে রাখব, কৃষিক্ষেত্রে ফার্মগেট পরিকাঠামো নির্মাণবাবদ এক লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো জরুরি। কী ভাবে সেই কাজ হবে, কোন পরিকাঠামো তৈরি হবে, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ হওয়ার ফলে তার চরিত্র ঠিক কী রকম দাঁড়াবে, অর্থমন্ত্রীর আজকের ঘোষণা থেকে তার আঁচ পাওয়া মুশকিল। তবুও, কৃষিক্ষেত্রে ফসল তোলার পরবর্তী স্তরের জন্য যদি পরিকাঠামো তৈরি হয়, সেই পরিকাঠামো যদি সত্যিই সাধারণ কৃষকের নাগালে আসে, মস্ত লাভ।
আজকের লেখায় প্রশ্ন করব দুটো সংস্কারের সিদ্ধান্তকে— এক, ১৯৫৫ সালের এসেন্শিয়াল কমোডিটিজ় অ্যাক্ট বিলোপ করার সিদ্ধান্ত; দুই, এপিএমসি লাইসেন্সি ছাড়াও অন্যদের কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কৃষিপণ্য কিনতে দেওয়ার ছাড়পত্র। প্রবল বিপদই যে সংস্কারের জননী, ভারতে অন্তত সে কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই— ১৯৯১ সালের জুলাই মাসের স্মৃতি মোছার নয়। কিন্তু, বিপদ আর সংস্কারের সিদ্ধান্তের মধ্যে একটা চরিত্রগত মিল থাকতে হবে তো। কোভিড-১৯ কৃষিক্ষেত্রে যে বিপদ তৈরি করেছে, তার সঙ্গে এই দুটো সিদ্ধান্তের যোগসূত্র আছে কি? আজকের প্রশ্ন শুধু এটুকুই।
সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে খোঁজ করা দরকার, কোভিড-১৯ কৃষিক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলল? উৎপাদনের পরিমাণ কমেনি, বরং গত অর্থবর্ষে তুলনায় এই বছর দেশে রবি ফসলের উৎপাদন বেড়েছে আড়াই শতাংশের মতো। খবরে প্রকাশ, এফসিআই-এর গুদামেও প্রয়োজনের তিন গুণ খাদ্যশস্য মজুত আছে। ফলে, কোভিড-১৯’এর ধাক্কায় খাবারের জোগান কমে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা অন্য অনেকগুলো। এক, অভিবাসী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে যাওয়ায় রবি শস্য তুলতে বিপুল সমস্যা হয়েছে; দুই, নতুন ফসল বোনার সময় যে জিনিসগুলো লাগে, অর্থাৎ বীজ, ট্রাক্টর, চারার ওষুধ— বাজারে কোনওটারই যথেষ্ট জোগান নেই; তিন, লকডাউনের ফলে ফসলকে বাজারজাত করার সমস্যা— চাহিদার সমস্যা; চার, রফতানির বাজার বন্ধ। এমনই অবস্থা যে কিছু দিন আগে পি সাইনাথ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, যে কৃষকরা ক্যাশক্রপ বা পণ্যশস্য উৎপাদন করেন, তাঁরা ঘোর বিপাকের মুখে পড়বেন।
অর্থমন্ত্রী যে দুটো সংস্কারের কথা বললেন, সেগুলো দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি সমাধান করতেও চাননি। তা হলে আচমকা এমন দুটো সিদ্ধান্ত কেন, এ বার সে কথায় আসব। একটা একটা করে। প্রথমে এসেন্শিয়াল কমোডিটিজ় অ্যাক্টের কথা বলি। অর্থমন্ত্রী জানালেন, এই আইনের ফলে কৃষকের তাঁর ফসলের জন্য ভাল দাম পেতে সমস্যা হয়। যেন বাজারে ফসলের দরের ওপর নির্ভর করে কৃষকের হাতে পাওয়া টাকার পরিমাণ! দেশের কৃষিপণ্যের বাজার দাঁড়িয়ে আছে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর। তাঁরা কৃষকদের থেকে যৎকিঞ্চিৎ মূল্যে শস্য কেনেন, আর তার পর বাজারের ওঠাপড়ার ওপর নির্ভর করে সেই পণ্য বাজারে ছাড়েন, বা মজুত রাখেন বাজার চড়ার অপেক্ষায়। এসেন্শিয়াল হোক আর না-ই হোক, যে কোনও কৃষিপণ্যের বাজারই চলে এই নিয়ম মেনে। যে টমেটো আপনি বাজারে আশি টাকা কেজি দরে কেনেন, কৃষক তার জন্যও কেজিপ্রতি দু’তিন টাকার বেশি পান না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।
এসেন্শিয়াল কমোডিটিজ় অ্যাক্ট, ১৯৫৫ অনুসারে, অত্যাবশ্যক পণ্য উৎপাদন করেন যিনি, অথবা যিনি এই পণ্য মজুত করেন, অথবা যিনি এই পণ্য কেনা-বেচা করেন, এই আইনবলে তাঁদের বাধ্য করা যাবে সরকার-নির্ধারিত দরে তাঁর হাতে মজুত থাকা পণ্য আংশিক বা পুরোপুরি দিতে। কৃষকের ঘরে ফসল মজুত থাকে না— ঋণের জাল তাঁকে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে যে ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকি ওঠার আগেই, তা বেচে দিতে বাধ্য থাকেন তাঁরা। ফসল থাকে মধ্যস্বত্বভোগীর ঘরে। এসেন্শিয়াল কমোডিটিজ় অ্যাক্টে যদি ক্ষতি কারও হয়, তবে এই মধ্যস্বত্বভোগী বণিক শ্রেণির। যাঁরা বিজেপির পরিচিত ভোটব্যাঙ্ক।
এ বার এপিএমসি লাইসেন্সির কথায় আসি। এখনও অবধি দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই বড় রিটেলারদের কৃষিপণ্য কিনতে হয় এপিএমসি মান্ডির মাধ্যমে। সে বালাই ঘুচে গেলে সরাসরি কৃষকের থেকেই ফসল কিনতে পারবে তারা। কৃষকের লাভ? প্রথম কিছু দিনের জন্য তো বটেই— মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি কম্পানির ঘরে ফসল বেচতে পারবেন তাঁরা। শুধু সেই স্বার্থের কথা ভেবেই এই সংস্কার? না কি, গত মাসে যে খবরটায় হইচই পড়ে গিয়েছিল গোটা দুনিয়ায়— রিলায়েন্স জিও প্ল্যাটফর্মে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করল ফেসবুক— তার সঙ্গে যোগ রয়েছে আজকের এই সিদ্ধান্তের?
যোগসূত্রটা খুব স্পষ্ট। রিলায়েন্স-ফেসবুক জানিয়েছিল, তারা এমন রিটেল ব্যবসায় আসতে চায়, যেখানে দেশের প্রতিটি কোনায় পৌঁছে যাবে তাদের পণ্য, আর দেশের প্রতিটি কোনা থেকে ফসল আসবে তাদের ঘরে। এই দুই সংস্থার সম্মিলিত পুঁজির জোরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এমন সাধ্য ভারতের বাজারে কারও নেই। আর, এদের রাজনৈতিক সংযোগের সঙ্গে পাল্লা? সে অন্য সাধনার ফল। কাজেই, রিলায়েন্স-ফেসবুক যদি সরাসরি কৃষকের থেকে ফসল কিনতে আরম্ভ করে, অল্প দিনের মধ্যেই সেই বাজারে তারা হয়ে দাঁড়াবে একচেটিয়া ক্রেতা। নিদেনপক্ষে, সিংহভাগের ক্রেতা। ফলে, বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকবে তাদের হাতে।
তার পর কৃষকের কী হবে, নির্মলা সীতারামনের গল্প সে কথা বলেনি।