যদি দশটা বছর আগে এই কোভিড অতিমারি এসে হাজির হত? ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ? জানি না, এখনও স্কুলের ছেলেমেয়েদের ‘বিজ্ঞান: আশীর্বাদ না অভিশাপ’ শীর্ষক নিবন্ধ লিখতে হয় কি না। যদি হয়, তা হলে এই প্রশ্নটা তাদের যুক্তি নম্বর এক হতে পারে। ২০১০ সালে কোভিড এলে গোটা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা সম্ভবত আরও মুথ থুবড়ে পড়ত একটামাত্র কারণে— মাত্র দশ বছর আগেও দুনিয়ার পক্ষে এ ভাবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করা সম্ভব হত না। ঘরে ঘরে হাই-স্পিড ইন্টারনেট, ইচ্ছেমতো ভিডিয়ো কল করার স্বাধীনতা, একই সঙ্গে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কম্পিউটারকে জুড়ে রাখা এক নেটওয়ার্কের সুতোয়— কোনওটাই হত না দশ বছর আগে। ফলে, হয় মানুষকে রাস্তায় নামতেই হত— তাতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ত বহু গুণ— আর নয়তো আরও অনেক বেশি অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হত। দুটোতেই ধাক্কা লাগত অর্থব্যবস্থার গায়ে।
২০২০ সালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম গোটা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থাকে এই ধাক্কা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অন্য বিপদের সামনে। দুনিয়া জুড়েই বহু সংস্থা জানাচ্ছে, অতিমারির পালা চুকলেও ওয়ার্ক ফ্রম হোম বন্ধ হবে না— অন্তত পুরোপুরি না। কর্মীদের একটা বড় অংশ কাজ করবেন দূর থেকেই— যাকে বলে টু ওয়ার্ক রিমোটলি— অফিসের সঙ্গে তাঁদের জুড়ে রাখবে তথ্যপ্রযুক্তির সুতো। এটাকে বিপদ বলছি কেন? তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ আলোচনা হয়ে গিয়েছে। বিশেষত, সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা না হওয়ার, অফিসে না যেতে পারার মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে। এক অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা। অফিসের পরিসরটাই যদি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বিলকুল, তা হলে আর কোথায় গিয়ে দেখা হবে সহকর্মীদের সঙ্গে? আমার কথাই বলি— গত দেড় দশকেরও বেশি চাকরি করছি একই অফিসের একই ঘরে, একই লোকদের সঙ্গে। সপ্তাহে ছ’দিন, দিনের অন্তত আটটা ঘণ্টা, তাঁদের সঙ্গে কাটে। কাজের ফাঁকে আড্ডা, এ-ওর বাড়ির খবর নেওয়া, খাওয়া, মনখারাপের কথা বলা, আনন্দে লাফালাফি করা— ওই ঘরে বসা লোকগুলোর সঙ্গে তো শুধু কাজের সম্পর্ক নয়। ভেবে দেখলে, পরিবারের সঙ্গে যত সময় কাটিয়েছি গত পনেরো বছরে, অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে কাটিয়েছি তার চেয়ে বেশি। জীবনের সেই দিকটা যদি ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, ধাক্কা তো লাগবেই।
কিন্তু, তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ আছে। দুনিয়ায় এখন আর্থিক অসাম্য যতখানি, টমাস পিকেটি সাক্ষী, শিল্প বিপ্লবের পর আর কখনও অসাম্য এতখানি বাড়েনি। অসাম্য জিনিসটা তার নিজের কারণেই খারাপ— জিনিসটা অন্যায়, অনৈতিক। কিন্তু, পুঁজিবাদের একটা কু-অভ্যাস, তা নৈতিকতার যুক্তিকে স্বীকার করতে চায় না। কাজেই, চাহিদা-জোগানের দিক থেকেও যে অসাম্য জিনিসটা খারাপ, সেটা মনে করিয়ে দেওয়া ভাল।ধরুন, মোট ১০০ টাকা আছে, সেটাকে দু’রকম ভাবে ভাগ করা যায়— দশ জনের মধ্যে দশ টাকা করে; আর, এক জন ৯১ টাকা, বাকি ন’জন এক টাকা করে। দ্বিতীয় বিকল্পে শেষ ন’জনের ক্রয়ক্ষমতা বলে কার্যত কিছু নেই, ফলে তাঁদের চাহিদাও নেই। প্রথম জনের হাতে অনেক টাকা, কিন্তু ভোগব্যয়ে খরচ করার প্রথমত একটা সীমা আছে; আর দ্বিতীয়ত, প্রাথমিকপ্রয়োজন মেটানোর পর যে ভোগব্যয়, তাতে খরচ হওয়া টাকার বণ্টনও এই দ্বিতীয় বিকল্পের মতোই অসম। মোটমাট, সবাই হাতে দশ টাকা করে পেলে বাজারে মোট চাহিদা যতখানি বাড়ত, এক জনের হাতে ৯১ টাকা গেলে শেষ অবধি চাহিদা বাড়বে তার চেয়ে ঢের কম। এবং, আজকে দায়ে পড়ে নরেন্দ্র মোদী বা ডোনাল্ড ট্রাম্পরা যে কথাটা শিখছেন, জন মেনার্ড কেইনস নামক ব্রিটিশ ভদ্রলোক ৯০ বছর আগে সেই কথাটা বলে গিয়েছিলেন— বাজারে চাহিদা না থাকলে অর্থনীতির সর্বনাশ। আর্থিক অসাম্য যে সেই সর্বনাশটার দিকেই ঠেলছে দুনিয়াকে, গত কয়েক মাসে একেবারে হাতেকলমে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু, ধান ভানতে এই শিবের গীত কেন? হচ্ছিল ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কথা, সেখানে আর্থিক অসাম্য এল কোথা থেকে? এল ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ নামক অধুনা-পরিচিত শব্দবন্ধের হাত ধরে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম বস্তুটার পূর্বশর্ত হল, সেটা কাজ করে শুধু নলেজ ইকনমিতে। অর্থাৎ, যেখানে হাতেকলমে উৎপাদনের প্রশ্ন নেই। আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এ কাজ করতে পারে; গরিব ছেলেমেয়েদের ছেঁটে দিলে শিক্ষাব্যবস্থাও চলতে পারে বাড়িতে বসেই; খবরের কাগজ চলতে পারে, সফটওয়্যারের দুনিয়া চলতে পারে। কিন্তু, যাঁরা ব্লু-কলার জব করেন, বাড়িতে বসে কাজ করার উপায় তাঁদের নেই। খেয়াল করে দেখলে, যাঁরা হাতেকলমে কাজ করেন, পুঁজিবাদের চৌহদ্দিতে তাঁরা অনেক আগে থেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তাঁদের গায়ে ঘামের গন্ধ বেশি, তাঁদের মাইনে কম, ছুটিছাঁটা কম, সুযোগসুবিধা কম, নিরাপত্তা কম। ভারতের মতো দেশে তো আরও চমৎকার— এই মানুষদের একটা বড় অংশ সংগঠিত ক্ষেত্রের অসংগঠিত শ্রমিক। চির-প্রান্তিক। এই অসাম্যকেই আরও বাড়িয়ে দেবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর নতুন বাস্তব।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ নিকোলাস ব্লুমকে নিয়ে ইদানীং আন্তর্জাতিক মিডিয়া বেশ টানাটানি করছে— কারণ, ব্লুম ২০১৪ সালে একটা বড় মাপের গবেষণা করেছিলেন ওয়ার্ক ফ্রম হোমের অর্থনৈতিক দিক নিয়ে। তিনি বলছেন, অসাম্যের ঢেউ আছড়ে পড়তে চলেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ৩৫ শতাংশ মানুষের কাছে ভাল স্পিডের ইন্টারনেট কানেকশন নেই, বসে কাজ করার মতো জায়গা নেই। যাঁদের সেই সুবিধা আছে, তাঁদের থেকে স্বভাবতই পিছিয়ে পড়তে থাকবেন এই ৩৫ শতাংশ। যাঁদের বাড়িতে জায়গা আছে, ভাল ইন্টারনেট নেওয়ার নেওয়ার সামর্থ্য আছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম তাঁদের উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে— দুনিয়া জুড়েই সেই সাক্ষ্য মিলছে। আর, যাঁদের এই সুবিধাগুলো নেই, কমছে তাঁদের উৎপাদনশীলতা। কাল বাদে পরশু উৎপাদনশীলতার মাপকাঠিতে ছাঁটাই হলে কারা বাদ পড়বেন, অনুমান করার জন্য কোনও নম্বর নেই।
আরও একটা বিপদ আছে। এই ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর সংস্কৃতির একেবারে গোড়ার কথাটাই হল, কর্মীদের উপস্থিতি ছাড়াই কাজ চলবে। প্রযুক্তি যে পথে এগোচ্ছে, তাতে অনুমান করা যায়, বাহ্যিক উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর প্রচলন বাড়বে। অর্থাৎ, বাড়িতে বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্দেশ দেবেন এক জন, আর সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে রোবট। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। ইতিমধ্যেই দুনিয়া সে পথে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। তাতে অনেক সুবিধা। রোবটের ছুটি লাগে না, রোবটের পেটখারাপও হয় না। রোবট অবাধ্য হয় না, আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করে না। পুঁজিবাদের কাছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আকর্ষণ অমোঘ। এই অতিমারি সে গন্তব্যে যাত্রার বেগ বাড়িয়ে দিল, এই যা। এই ব্যবস্থায় আর্থিক অসাম্য বাড়বে স্বাভাবিক ভাবেই, কারণ রোবটকে তো আর মাইনে দিতে হয় না। যাদের দিতে হত, তাদের পাকাপাকি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে, একটা কথা মনে রাখা ভাল— রোবট কিন্তু খরচও করতে পারে না। কারখানার শ্রমিকরা মাইনে পেলেই দৌড়োন দোকানে— রাজগারের একটা বড় অংশ দিয়ে কেনেন সেই সব জিনিস, পুঁজিবাদ যা উৎপাদন করে চলেছে। মানুষগুলো চাকরি হারালে এই চাহিদার একটা বড় অংশ উবে যাবে। তখন?
সুধীন দত্ত হয়তো বলতেন, পুঁজিবাদই হল সেই উটপাখি, যে অখিল ক্ষুধায় শেষে নিজেকে খাবে।
অর্থনৈতিক প্রগতির লক্ষণকে এখন বলা হচ্ছে K-shaped অর্থাৎ একটা দাঁড়ি উঠতে থাকবে আর অন্যটি পড়তে থাকবে। জনসংখ্যার কোন অংশ কোনদিকে তা সহজেই অনুমেয়।
আমার ব্যক্তিগত মত (মানে যতটুকু তাড়াহুড়োয় বুঝেছি আর কি) এই k শেপ বা অন্য গ্রুপটি v, w L, -- দুটোর প্রেক্ষিত আলাদা। গোটা ইকনমির রিকভারি হবে ওই v, বা w বা L গতিপথে। কিন্তু দেশের সম্পত্তি বা জিডিপিতে কবজা হবে k শেপ এ।
অর্থাৎ গোটা ইকনমি চুলোয় গেলেওঃ ধরুন w বা L আদানি/আম্বানিদের বৃদ্ধি হতেই থাকবে। ভারতের এভিয়েশনের হাঁড়ির হাল আর একটি পরিবারের একের পর এক এয়ারপোর্ট ম্যানেজমেন্ট অধিগ্রহণএর খেলটা দেখুন।
তবে আসল কথাটা অমিতাভ বলেছেন শেষ প্যারায়।
সমস্ত কুলীনদের লেখাপত্তরে টিভি টক এ এখন 'এ আই ' এর কথা। ওতেই নাকি দেশের ভবিষ্যৎ!
তখন ? নিজের হাত পা কামড়ে খাবে আর কী !
যেন একটা অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং অন্তহীন যাত্রা। খাবলা অন্ধকার তুলে নিলে অন্ধকারই থাকবে।
দুর্দান্ত লেখা ! নিজেকে খাওয়া ছাড়া পুঁজিবাদের আর রাস্তা কোথায়? তাই তো খেয়ে চলেছে সে তার বিকাশ বন্ধ হওয়া ইস্তক। তা না হলে কেনই বা বৈষম্যের এই চেহারা, আর কেনই বা এমন বাজার সংকট !
এরকম অযৌক্তিক বোকা বোকা লেখা খুব কম পড়েছি জীবনে।
সুন্দর আলোচনা
Amra bodh hy Big Data Economy concept ta ekhno bujh tey চাইছি না কি পারছি না , উৎপাদন , শ্রম ( ডাটা miners ) এবং তার পনোঁয়ণ প্রক্রিয়া তে বড় পরিবর্তন চলছে , পুঁজিবাদ নতুন রূপ e r oo তীব্র হবে
তুলি