কৃষিক্ষেত্রকে বাদ রাখলে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের নাম যে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র আর মাঝারি শিল্প (মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ়েস বা এমএসএমই), তা নিয়ে সংশয়ের কোনও জায়গাই নেই। দেশের এগারো কোটির বেশি মানুষ কাজ করেন এমএসএমই ক্ষেত্রে— অর্থাৎ, কম-বেশি পঞ্চাশ কোটি মুখে অন্ন জোগায় ক্ষেত্রটি। কাজেই, কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক প্যাকেজের প্রথম দিনই এই ক্ষেত্রটির কথা এলে আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। অথবা, বলা ভাল, আপত্তি করার প্রশ্ন উঠত না, যদি না অর্থমন্ত্রীর ঘোষণাটি হরেক অস্বচ্ছতা আর তঞ্চকতায় ভরে থাকত।
সেই তঞ্চকতার কথায় যাওয়ার আগে স্পষ্ট করে নেওয়া যাক, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র আর মাঝারি শিল্প বলতে কী বোঝায়। আরও স্পষ্ট করে বললে, আজ বিকেল পাঁচটার আগে অবধি কী বোঝাত। এত দিন পণ্য আর পরিষেবা ক্ষেত্রে এমএসএমই-র সংজ্ঞা আলাদা ছিল। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে হিসেবটা ছিল এই রকম— শিল্পে (কারখানা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে) বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ লক্ষ টাকার কম হলে তা অতিক্ষুদ্র, ২৫ লক্ষ থেকে পাঁচ কোটি অবধি ক্ষুদ্র আর পাঁচ কোটি থেকে দশ কোটি টাকা অবধি মাঝারি। পরিষেবা ক্ষেত্রে হিসেব ছিল— (যেহেতু পরিষেবা ক্ষেত্রে কারখানার প্রয়োজন নেই, তাই) শিল্পে যন্ত্রপাতির পিছনে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকার কম হলে তা অতিক্ষুদ্র, ১০ লক্ষ থেকে ২ কোটি টাকা অবধি ক্ষুদ্র, আর ২ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা অবধি মাঝারি। নির্মলা সীতারামন আজ জানালেন, এই সংজ্ঞায় দু’ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। এক, বিনিয়োগের পরিমাণের মাপ বাড়িয়ে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র আর মাঝারি উদ্যোগের ঊর্ধ্বসীমা হচ্ছ যথাক্রমে এক কোটি, দশ কোটি ও কুড়ি কোটি টাকা; দুই, পণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রের ফারাক থাকছে না আর— দুই গোত্রের উদ্যোগেই এক ঊর্ধ্বসীমা প্রযুক্ত হবে। সরকারি হিসেবের তঞ্চকতায় এই দুটো পরিবর্তনেরই তাৎপর্য অসীম।
দেশে এমএসএমই ক্ষেত্রের অধীন মোট ৬.৩৪ কোটি শিল্পের মধ্যে ৯৯.৫ শতাংশই অতিক্ষুদ্র শিল্প। পুরনো সংজ্ঞায় অতিক্ষুদ্র, অর্থাৎ ছ’কোটি ত্রিশ লক্ষ শিল্পোদ্যোগের পুঁজির পরিমাণ ২৫ লক্ষ টাকার কম। এই ধরনের শিল্পপ্রতি গড়ে এক জনের কর্মসংস্থান হয়। সোজা কথায়, একা খাটার যে ব্যবসা গ্রামবাংলায় অতি পরিচিত, এমএসএমই ক্ষেত্রের ৯৯.৫ শতাংশের চেহারা সে রকমই। গ্রামবাংলার উল্লেখ নেহাত কথার কথা নয়— ভারতে অতিক্ষুদ্র শিল্পের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম অগ্রগণ্য রাজ্য। আর, গোটা দেশেরই গ্রামাঞ্চলে এমএসএমই মানে অতিক্ষুদ্র শিল্প। ক্ষুদ্র আর বৃহৎ শিল্পের ঠিকানা শহর, কারণ বড় পুঁজিও সেখানে।
নির্মলা সীতারামন বড় মুখ করে এমএসএমই ক্ষেত্রের জন্য যে ব্যবস্থাগুলোর কথা বললেন, সেগুলো এই রকম:
১) তিন লক্ষ কোটি টাকার ঋণ— যাদের ব্যাঙ্কে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকা, তাঁরাও ঋণ পাবেন;
২) ২০,০০০ কোটি টাকার সাবর্ডিনেট ঋণ— দুই লক্ষ এমএসএমই (অর্থাৎ, দেশের মোট এমএসএমই-র ০.৩ শতাংশ, প্রতি এক হাজার সংস্থার মধ্যে তিনটি) এই ঋণের সুবিধা পাবে। ব্যাঙ্কে যাদের ঋণ অনাদায়ী বা এনপিএ হয়ে আছে, তারাও এই ঋণ পাবে;
৩) এমএসএমই-তে ইক্যুইটি লগ্নির জন্য় ৫০,০০০ কোটি টাকার তহবিল।
এ বার ভাবুন— দেশের ৯৯.৫ শতাংশ এমএসএমই-র ক্ষেত্রেই পুঁজির পরিমাণ যেখানে ২৫ লক্ষ টাকার কম, সেখানে কোন এমএসএমই-র ব্যাঙ্কে ২৫ কোটি টাকা বকেয়া ঋণ থাকতে পারে? কোন এমএসএমই-তে ইক্যুইটি লগ্নির সম্ভাবনা থাকে? উত্তরটা সহজ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি হিসেবে যে চার লক্ষের কাছাকাছি শিল্প দেশে রয়েছে, তারও একটা সামান্য অংশেরই এই পরিমাণ ঋণ করার সামর্থ্য আছে। পুরো এমএসএমই-র নাম করে অর্থমন্ত্রী সেই কতিপয় শিল্পপতির আখের গুছিয়ে দিলেন।
এবং, আরও বেশ কিছু শিল্পপতির জন্য আখের গোছানোর ব্যবস্থা করে দিলেন এমএসএমই-র সংজ্ঞা পরিবর্তন করে। কুড়ি কোটি টাকা অবধি লগ্নি এখন এমএসএমই-র অধীন, ফলে এই সহজ শর্তে ঋণে তাদেরও অধিকার জন্মাল। দশ লক্ষ থেকে কুড়ি কোটির ব্যবধান ২০০ গুণ। আসলে, আকাশ-পাতাল। যাঁদের লগ্নির পরিমাণ দশ লক্ষ টাকার কম, তাঁদের নাম করে যদি কুড়ি কোটি টাকার লগ্নিকারীদের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঋণের ভান্ডার খুলে দেওয়া হয়, তার মধ্যে নৈতিকতার খোঁজ পাওয়া অসম্ভব। কাদের হাতে এই কুড়ি কোটি টাকার মাপের পুঁজি? একটু গুগল করুন, স্পষ্ট হয়ে যাবে।
পণ্য আর পরিষেবার মধ্যে ফারাক মুছে দেওয়া কেন তাৎপর্যপূর্ণ, এ বার বলি। পরিষেবায় যেহেতু কারখানা লাগে না, তার পুঁজির দাবিও কম। অন্য ভাবে বললে, দশ কোটি টাকা লগ্নি করে যত বড় পণ্য উৎপাদনের ব্যবসা ফাঁদা যায়, সেই একই লগ্নিতে পরিষেবার ব্যবসার মাপ অনেক বড় হবে। অর্থাৎ, পণ্য আর পরিষেবার মধ্যে ফারাক মুছে দেওয়ার ফলে পরিষেবা ক্ষেত্রে আরও অনেক বড় ব্যবসা চলে আসবে এমএসএমই-র সংজ্ঞার ভিতরে। গ্রামের অতিক্ষুদ্র শিল্প আর শহরের মাঝারি পরিষেবা উদ্যোগের মধ্যে ঠিক ততটাই ফারাক, ভারত আর ইন্ডিয়ায় যতখানি। নির্মলা সীতারামন আজ জানিয়ে দিলেন, তিনি কোন দলের হয়ে খেলছেন।
আসলে শুধু তিনি নন, গোটা সরকারই খেলছে একটা দলের হয়ে। অন্নচিন্তায় দীর্ণ, বেকারত্বের গ্নানিতে ম্লান ভারতের কেউ সেই দলে নেই।
~~~~~~
দ্বিতীয় দিনের সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানালেন, কথা বলবেন দরিদ্র মানুষদের নিয়ে। বিশেষত, অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে।
কী কী বললেন, সংক্ষেপে জানাই।
১) কোভিড-১৯’এর মোকাবিলায় তাঁরা রাজ্যগুলিকে স্টেট ডিজ়াস্টার রেসপন্স ফান্ডের টাকা খরচের অনুমতি দিয়েছেন।
প্রথমত, ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইন অনুসারে, এই টাকা খরচ করা রাজ্যের অধিকার এবং দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, সেই একই আইন অনুসারে, কোনও বিপর্যয়ের আকার যদি রাজ্যের ক্ষমতার তুলনায় বড় হয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে অর্থসাহায্য করতে সাংবিধানিক ভাবে দায়বদ্ধ। এবং তৃতীয়ত, এই খরচের কথাটা কেন অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রের সাহায্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত হল, অর্থমন্ত্রী জানাননি।১
২) স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার তৈরি করছেন। তাতেও নাকি অভিবাসী শ্রমিকরা উপকৃত।
৩) গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা প্রকল্পে নতুন কাজ তৈরি করে অভিবাসী শ্রমিকদের কাজ দেওয়া হচ্ছে।
যাঁরা শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরতে না পেরে, ফেরার চেষ্টায় প্রাণ খুইয়ে সংবাদ শিরোনামে, তাঁরা গ্রামে কাজ পেলেন কী করে? পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে নারেগা-য় কাজ পেয়েছিল এক কোটি সত্তর লক্ষ পরিবার। এ বছর এপ্রিলে কাজ পেয়েছে মাত্র ৩৪ লক্ষ— গত বছরের তুলনায় ৮৬ শতাংশ কম।২
৪) কেন্দ্রীয় সরকার যে শ্রমবিধি তৈরি করছে, অভিবাসী শ্রমিকরা তাতে লাভবান হবেন।
শ্রমবিধির সঙ্গে আর্থিক প্যাকেজের কী সম্পর্ক, অর্থমন্ত্রী বলেননি। চারটি শ্রমবিধির মধ্যে একটি গত নভেম্বরে সংসদে পেশ করা হয়েছিল। বাকি তিনটে এখনও বকেয়া। ভবিষ্যতের গর্ভে থাকা সেই শ্রমবিধি কী ভাবে আজ অভিবাসী শ্রমিকদের রক্ষাকবচ হবে, বলেননি তা-ও। কতখানি নির্লজ্জ হলে প্যাকেজের ঘোষণায় এই শ্রমবিধির কথা উল্লেখ করা যায়, সেটাও অর্থমন্ত্রী বলেননি। স্বাভাবিক।
এই নতুন শ্রমবিধি আদৌ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে তা নিয়েও। কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের ভূতপূর্ব উপদেষ্টা পার্থপ্রতিম মিত্র-র এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।
৫) দু’মাসের রেশন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার।
তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩,৫০০ কোটি টাকা। সেটা কতখানি, জানার জন্য সঙ্গের গ্রাফিকটি দেখুন।
৬) মার্চ, ২০২১ থেকে ওয়ান নেশন, ওয়ান রেশন কার্ড
অর্থমন্ত্রী যা বলেননি, তা এই— তত দিন অবধি এই শ্রমিকরা বেঁচে থাকবেন কী ভাবে, সেটা তাঁদেরই বুঝে নিতে হবে। যাকে বলে আত্মনির্ভরশীলতা।
৭) অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য স্বল্প ভাড়ার আবাসন।
বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। অর্থাৎ, সুদের হারে সুবিধা দেওয়ার পরও মধ্যবিত্ত যদি ফ্ল্যাট না কেনে, সরকারি টাকায় রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা হল। তাতে অভিবাসী শ্রমিকদের লাভ? অর্থমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেননি।
প্রথম দিনের সাংবাদিক সম্মেলনের পর লিখেছিলাম আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে গিয়ে ছলচাতুরি করছেন অর্থমন্ত্রী। আজ আর সে কথা বলার উপায় নেই। কোনও রাখঢাক ছাড়াই আজ তিনি জানিয়ে দিলেন, অভিবাসী শ্রমিকরা হাঁটতে হাঁটতে জাহান্নামে গেলেও তাঁদের আপত্তি নেই। শ্রমিকদের কথা তাঁরা ভাববেন না।