সামাজিক দূরত্ব এই শব্দের ব্যাপ্তি বিরাট, শুধু পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব এই কথার অর্থ নয় । ডাবলু.এইচ.ও-র নির্দেশিকা অনুযায়ী ভারতীয় প্রশাসন সোশাল ডিসটেনসিংকে করোনা মোকাবিলার মুখ্য হাতিয়ার করেছে। নির্দিষ্ট ওষুধ, সঠিক চিকিৎসা কার্যপ্রণালী বা করোনা প্রতিরোধকারী ভ্যাকসিন না থাকার ফলে সংক্রমণকে শিথিল করা আর আক্রান্ত মানুষকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা এখন করোনা মোকাবিলার একমাত্র উপায় হয়ে দাড়িয়েছে। সামাজিক আদান-প্রদান বা সামাজিকরণের প্রক্রিয়া (socialization) বন্ধ করা কিন্তু এই মারণের প্রতিকার নয়, তাই ডিসটেনসিং বা দূরত্ব শুধু শারীরিক হওয়াই শ্রেয়। জনসাস্থ্যের দীর্ঘ ইতিহাসে অতিমারি বা মহামারি রোধে লকডাউন এক কার্যকরী পক্রিয়া – যা একশো বছর আগেও স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়েও দেখা গেছে। এর আক্ষরিক অর্থ হল সামাজিক মেলামেশার আদান প্রদান বন্ধ করে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখার কৌশল।
অতিমারি বা মহামারির সময়ে জনস্বাস্থের প্রাথমিক শর্ত হল ‘কমিউনিটি বন্ডিং’ বা গোষ্ঠী সংহতি। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে সমগ্র দেশেই ডাক্তার থেকে আমলা সব বিশেষজ্ঞই এক সতর্কতাবানী আওড়াচ্ছে- ‘আপনারা থাকবেন ঘরে – বাকিটা বুঝে নেবো আমরা (মানে পুলিশ – প্রশাসন এবং স্বাস্থ্যদপ্তর)। বলা আবশ্যক যে এই সাবধানবানী জনসাস্থ্যের পরিপন্থি। ভেবে দেখুন, ঠিক যতবার, যতটা অধ্যবসায়ী ভাবে আমরা সামাজিক দূরত্বের কথা শুনতে পাচ্ছি তার সাথে সামাজিক বন্ধন, সম্প্রদায়িক অংশগ্রহণের তাৎপর্য সেই অর্থে উচ্চারিত হচ্ছে কি? জনস্বাস্থ্যের বিধান স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণের দ্বিমূল প্রয়াসের ভাবনা পোষন করে না, বিশ্বাস করে এই দুইয়ের সামাজিক ও মানসিক ঐক্যে। মানুষের ঘরে থাকা বা বাজার-হাটে ভিড় এড়ানো একান্তই প্রয়োজন কিন্তু তা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সতর্কবানীতে দীর্ঘ মেয়াদী করা যাবে না – মানুষের মধ্যে থেকেই জনগনের প্রতিনিধিত্ব তুলে নিয়ে আসতে হবে যা শহর থেকে গ্রামে করোনা মকাবিলার যে কোন প্রচেষ্টাকে এক সামাজিক দায়িত্বে পরিনত করবে।
সোশাল ডিসটেনসিং-এর প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং তার গূঢ় অর্থ সরলীকরণ না করে নির্বিচারে এই শব্দ-বন্ধ ব্যবহার করলে অচিরেই করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক সামাজিক দূরত্ব তৈরি হবে। খেয়াল করুন মধ্যপ্রদেশে করোনা মোকাবিলায় কমিউনিটি ভিজিটে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের শারীরিক নিগ্রহের শিকার হওয়া, বিভিন্ন রাজ্যে করোনা সন্দেহে আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণ, করোনা সন্দেহদের কোয়ারান্টাইন ভেঙে আইন হাতে নেওয়া এইসব ঘটনা পরোক্ষ ভাবে সামাজিক দূরত্বের বার্তা বহন করে না কি? উত্তর দিচ্ছে সম্প্রতি এই রাজ্যের ঝাড়্গ্রাম জেলার সাকরাইল অঞ্চলের এক ঘটনা। সত্তরোর্ধ এক বৃদ্ধকে মূর্ছিত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেলো, করোনা আতঙ্কের জেরে কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে এলো না, হাসপাতালেও নিয়ে গেল না এমনকি তাকে সনাক্ত করতেও কেউ কাছাকাছি যায়নি। অবশেষে ২০ ঘন্টা ওই ভাবে পড়ে থেকে তার রাস্তাতেই মৃত্যু হয়। বাঁশে খাটিয়া বেঁধে ঝুলিয়ে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হলো তার দেহ।
এমন ঘটনা এখন প্রত্যহ ঘটছে, ঘটনাগুলি একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে এই ধরনের মানসিকতা কোন একটা বিত্তে আটকে নেই। শহুরে শিক্ষিত মাধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত আবার দরিদ্র গ্রামবাসী, করোনা সংক্রান্ত আতঙ্ক ছড়িয়েছে সর্বত্র। শ্যামপুকুর, মাস্ক না পড়তে চাওয়ায় ছেলে কে খুন করলেন বাবা। অন্তঃসত্ত্বার দেখাশোনা করবার জন্য তার মা কেও ঢুকতে দেওয়া হল না সোনারপুরের আবাসনে। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ঘষে, বারংবার হাত ধুতে ধুতে হাত কেটে-ছড়ে গেল পাটুলির এক মহিলার। প্রায় রোজ চোখে পড়ছে এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা। তাই প্রশাসনিক ভাবে অন্তত ডিসটেনসিং-এর প্রকৃত অর্থ যদি মানুষের কাছে না পোছৌয় তাহলে সময়ের সাথে এমন অমানবিক ঘটনার সংখ্যা আরও বাড়বে। তার সাথে দিতে হবে গোষ্ঠী ঐক্যের, মানুষকে নিযুক্ত করতে হবে মানুষের কাজে।
বিশ্বের এমন অচলাবস্থায় এই লকডাউনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই সাময়িক ভাবে লাভজনক, তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ দূরীকরণে সামাজিক দূরত্ব ফলপ্রসু হবে না। এই দূরত্বের জেরে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বিপন্নতায় ভুগছে বহু মানুষ, প্রধাণত শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষজন। একজন সাফাই কর্মীর কাছে ডিসটেনসিং -এর অর্থ কি? বস্তির ঘরে একসাথে থাকা সাত জনকে কোয়ারান্টাইন কিভাবে বোঝাব? এই প্রশ্নগুলি থাকতে হবে অতিমারী নীতি গঠনের মূলে। প্রান্তিক, অসহায়, ক্ষমতাহীনদের স্বার্থ থাকবে পরিকল্পনার শীর্ষে। জনস্বাস্থ্যর এই আপতকালিন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড – ১৯ অতিমারিকে রুখতে কৌশলগত ভাবে ঝুঁকি বিষয়ক বার্তা প্রচার ও গোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে (রিস্ক কম্মুনিকাশন ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট) অন্যতম হাতিয়ার করার কথা বলছে। এই কৌশলেরই অঙ্গ হল সাধারন মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ সমবন্ধে ব্যাবহার - দৃষ্টিভঙ্গি ও তার উদ্বেগের মূল্যায়ণ, এবং জনসাধারণের মধ্যে থেকে সেচ্ছাসেবক তৈরি করা যা করোনা সচেতনতায়, সংক্রমন রোধ এমনকি অ্যাকটিভ কেস ফাইনডিং-এর কাজে লাগানো যেতে পারে।
সামাজিক দূরত্ব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ভুল প্রয়োগে যদি সামাজিক বা মানসিক দূরত্ব ঘটায় তাহলে এই দেশজোড়া অচলাবস্থায় সমস্যা আরো বাড়বে। কিন্ত আক্ষরিক অর্থে সংক্রমণ রোধে পৃথকীকরণ পন্থা আসলে শারীরিক দূরত্ব কে বলবত করার কথাই বলছে। তাই তালাবদ্ধ এই দেশে অতিমারি রোধের বিরুদ্ধে প্রচার-পরিকল্পনায় কৌশলগত ভাবে এক সহানুভূতিশীল-মানবিক গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের রূপরেখা তৈরি করা দরকার। কারন শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণের সামাজিক স্তরে যৌথ প্রয়াসই আমাদেরকে করোনা প্রতিরোধের পথ দেখাবে।
একদম একমত ।
বিদেশে (অর্থাৎ ইউরোপ, আমেরিকায়) যেই ওরা বললো social distancing অমনি আমরা সেটার বাংলা তর্জমা করে নিয়ে তোতাপাখির মতো আওড়াতে লাগলাম
সামাজিক নয়, শারীরিক দূরত্ব মাত্র। অমানবিকতা সর্বত্রই আছে, করোনা রাক্ষুসি তার মুখোশ খুলেছে মাত্র।
#
এই লেখার বানান ভুলের ছড়াছড়ি। বুবুভা'তে আগে এমন দেখিনি, খুব চোখে লাগে।